Ajker Patrika

দেশে এখন আলোচনায় ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’

জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা
আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৪, ২০: ৩০
দেশে এখন আলোচনায় ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’

বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি শব্দবন্ধ খুব বেশি করে উচ্চারিত হচ্ছে, সেটি হলো-ডকট্রিন অব নেসেসিটি। বাংলায় উপযুক্ত অনুবাদ কী হতে পারে-প্রয়োজনীয়তার মতবাদ, জরুরতের নিদান, বিশেষ পরিস্থিতির নীতি ইত্যাদি। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতের পর রাজনীতি ও প্রশাসনের নানা ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতকের আবর্জনা যে রাতারাতি সাফ-ছুতরো করা সম্ভব নয়, সেটি সবাই মানছেন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চায় যে হতাশা থেকে প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা তৈরি হয়েছে এরই ফলস্বরূপ একটি গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক। 

সেখানে থেকেই এই সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার পক্ষে জনমত আসছে। কিন্তু সংবিধান এখানে বড় বাধা হয়ে রয়েছে। সংবিধান মানতে গেলে এই সরকারকে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, আবার এই নব্বই দিনের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার যে সম্ভব নয় সেই বাস্তবতাও সামনে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। 

এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত হচ্ছে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। আগামী দিনে এই নীতির পক্ষেই সম্মতি উৎপাদনের তৎপরতা আরও জোরালো হবে বলে ধারণা করা যায়। এই কারণেই এই ধারণা সম্পর্কে একটু জানাশোনা থাকা ভালো! 

প্রয়োজনীয়তা কোনো আইনের ধার ধারে না-এই হলো ঈশপের একটি গল্পের মোরাল।’ Nemo in propria causa judex, esse debet’ এই লাতিন ম্যাক্সিমে (নীতিবাক্য) যে কথাটি বলা হয়েছে সেটিকে বাংলায় এভাবে বলা যায়-বিচারপতির অপরাধের বিচারের ভার তাঁর ওপরেই দেওয়াটা বেকার! এটি প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের অন্যতম নীতি। 

ম্যাক্সিমটি আরও একটি বিষয় তুলে ধরেছে, কাউকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা দেওয়া হলে তাঁকে অবশ্যই কোনো ধরনের পক্ষপাত ও সংস্কার ছাড়া ন্যায্য এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। 

এটির একটি মোক্ষম উদাহরণ হতে পারে সাম্প্রতিক রক্তপাতের ঘটনা। হত্যার হুকুমদাতা এবং হত্যাকারীরাই যখন সেই হত্যার বিচার করার প্রতিশ্রুতি দেয়, সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, তার ওপর কোনোভাবে আস্থা রাখা যায় না। কারণ তিনি পুরো বিচারপ্রক্রিয়াতেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের কৌশল অবলম্বন করবেন। 

এটি ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যকে ভেস্তে দেয়। তাই এই ধরনের জঘন্য পক্ষপাত রোধে প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতিগুলো গ্রহণ করা হয়। পক্ষপাতের বিরুদ্ধে এই পদ্ধতি এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে যে-মনোবিজ্ঞান বলে, নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষের স্বভাব-বিরুদ্ধ। 

পক্ষপাতিত্ব বা একদেশদর্শিতা বা কারও প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন বলতে মূলত এমন কোনো উপাদানকে বোঝায় যা একজন ব্যক্তিকে ঘটনার পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব শঙ্কা বা ধারণার পক্ষে বা বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে। সুতরাং, এক্ষেত্রে তিনি আর শুধু সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো নিরপেক্ষ থাকেন না। 

প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতিগুলো এইভাবে পক্ষপাতের বিপরীতে বিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এসব বিধান সেই উপাদানগুলোকে দূর করে যেগুলো একটি বিশেষ মামলায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় বিচারককে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করে। 

যাইহোক, ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার মতবাদ পক্ষপাত প্রতিরোধের বিধিবিধানের ব্যতিক্রম বলে মনে করা হয়। এ নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত বলা যাক: 

ডকট্রিন অব নেসেসিটি কী
প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতিগুলো হলো মৌল আইনি প্যারামিটার। প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের একটি নীতির কথা এলে, অর্থাৎ পক্ষপাত প্রতিরোধে গৃহীত বিধিবিধানের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। এটিই হলো-ডকট্রিন অব নেসেসিটি বা প্রয়োজনীয়তার মতবাদ। 

রাজনৈতিক বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা বদল, কিংবা সামরিক অভ্যুত্থানের মতো রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক ঘটনা আইনবহির্ভূত হলেও সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারে আদালত প্রয়োজনের তাগিদে ঘটেছে বলে ‘বৈধতা’ দেওয়ার নজির রয়েছে। বাস্তব প্রয়োজনের এই তাগিদকেই বলে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। স্পষ্টত এটি বিদ্যমান আইন ও আইনের বাইরের তাগিদ। 

ডকট্রিন অব নেসেসিটি যে পদ্ধতিতে কর্তৃপক্ষকে কাজ করার অনুমতি দেয়: 
অবশ্যই একটি বিশেষ মুহূর্তে এমন নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যেখানে এই ধরনের পদক্ষেপ একটি সাধারণ আইনি পরিস্থিতিতে আইনের পরিধির মধ্যে বিবেচিত হবে না। 

ডকট্রিন অব নেসেসিটি প্রয়োগ করা শুধু এমন পরিস্থিতিতেই ন্যায্য যেখানে, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি নির্ধারক কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি রয়েছে। 

এমন একটি পরিস্থিতিতে যেখানে একজন ব্যক্তিকে একটি বিষয়ে পক্ষপাতদুষ্টভাবে কাজ করতে দেওয়া অথবা বিষয়টিকে বাতিল করার জন্য একটি বিকল্প তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে পক্ষপাতমূলক পদ্ধতিতে পদক্ষেপ নেওয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকতে পারে, এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্বের দ্বারা সিদ্ধান্তটি প্রভাবিত হতে পারে এমন আশঙ্কা সত্ত্বেও এ সুযোগ রাখা হয়। এটিই ডকট্রিন অব নেসেসিটি। 

পূর্বোক্ত পরিস্থিতির অনুরূপ ক্ষেত্রে, পক্ষপাত প্রতিরোধের বিধিগুলো ডকট্রিন অব নেসেসিটির দ্বারা উপেক্ষিত হয়। এখানে একমাত্র শর্ত হলো, এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষকে বাধ্যতামূলকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। 

ডকট্রিন অব নেসেসিটির ইতিহাস
মধ্যযুগীয় ইংরেজ আইনবিদ ও জুরি (ত্রয়োদশ শতাব্দী) হেনরি ডি ব্র্যাকটনের লেখায় প্রথম ডকট্রিন অব নেসেসিটির ধারণা দেওয়া হয়। এটি হলো প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ ‘যা আইনে বৈধ নয়, তা প্রয়োজনের তাগিদে বৈধ করা’। 

উপমহাদেশে এর একটি উদাহরণ হলো, ফেডারেশন অব পাকিস্তান বনাম মৌলভি তমিজউদ্দিন খান (১৯৫৫)-এর বিতর্কিত মামলা। 

এই ক্ষেত্রে, পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ মুনির গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদকে সংবিধান বহির্ভূত জরুরি ক্ষমতার ব্যবহারকে আইনগত বৈধতা দেন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সেই সময় হেনরি ডি ব্র্যাকটনের নীতিবাক্যটিও উল্লেখ করেছিলেন। 

ফেডারেশন অব পাকিস্তান বনাম মৌলভি তমিজউদ্দিন খান মামলাটি কমনওয়েলথ দেশগুলোতেও ডকট্রিন অব নেসেসিটি ব্যবহারের পথ প্রশস্ত করে। 

ভারতের ক্ষেত্রে, গুল্লাপল্লী নাগেশ্বরা রাও বনাম এপিএসআরটিসি (১৯৫৮)-এর বহুল আলোচিত মামলাটি ডকট্রিন অব নেসেসিটি প্রয়োগের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। পরে ভারতের নির্বাচন কমিশন বনাম ডক্টর সুব্রাহ্মনিয়াম স্বামী (১৯৯৬) মামলার মাধ্যমে ডকট্রিন অব নেসেসিটি প্রয়োগের নীতি পরিবর্তিত হয়। আদালত বলেন, শুধু নিরুপায়ের ক্ষেত্রে ডকট্রিন অব নেসেসিটি প্রয়োগ করা যাবে। 

ডকট্রিন অব নেসেসিটির ব্যতিক্রম
ডকট্রিন অব নেসেসিটি কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পক্ষপাতের অজুহাত ব্যবহার করার লাইসেন্স দেয় না। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় পক্ষপাতের আশ্রয় নেওয়া বিচারকদের অযোগ্য বিবেচনা করা হয়। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে যেখানে পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্তকেও বৈধ বলে গণ্য করা হয়। যেমন: 

সালিসের জন্য অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তি না পেলে। কোরাম পূর্ণ হয় না এমন বিচারক বা জুরির অনুপস্থিতিতে। 
অন্য কোনো উপযুক্ত ট্রাইব্যুনাল গঠনের সম্ভাবনা না থাকলে। 

ভারতীয় ফৌজদারি আইনে ডকট্রিন অব নেসেসিটি রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির চতুর্থ অধ্যায়, ১৮৬০-এ ৭৬ ধারা থেকে ১০৬ ধারার অধীনে ‘সাধারণ ব্যতিক্রম’-এর বিধান রয়েছেন 

কিছু দৃষ্টান্ত: 

রেজিনা বনাম ডুডলি ও স্টিফেনস (১৮৮৪) 
টমাস ডুডলি এবং এডউইন স্টিফেনস মামলার আসামি ছিলেন। এই দুই আসামি এবং কেবিন বয় রিচার্ড পার্কার জাহাজডুবির দুর্ঘটনায় একটি নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কোনো খাবার এবং পানীয় জল ছিল না। তাঁরা তিনজন সাত দিন ধরে না খেয়ে ছিলেন এবং পাঁচ দিন ধরে পানীয় জল ছাড়া থাকার পর দুর্ঘটনার আঠারোতম দিনে টমাস ডুডলি এডউইন স্টিফেনকে প্রস্তাব দেন, বাকিদের জীবন বাঁচাতে একজনকে হত্যা করা হোক। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন পার্কারকে হত্যা করার। বিশতম দিনে, ডুডলি এবং স্টিফেনস পার্কারকে হত্যা করেন এবং চারদিন তাঁর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকেন। পরে একটি জাহাজ তাঁদের উদ্ধার করে। পরবর্তীতে তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। 

আদালতের রায়ে বলা হয়, নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করাকে সমর্থন করা যায় না, যদিও তা ক্ষুধার প্রয়োজনে সংঘটিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তবে, পরে তা কমিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড করা হয়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম হোমস (১৮৪২) 
উইলিয়াম ব্রাউন নামে একটি আমেরিকান জাহাজে ৬৫ জন যাত্রী এবং ১৭ জন ক্রু ছিলেন। একটি হিমশৈলতে আঘাত করলে সেটি দ্রুত ডুবে যায়। উত্তাল সমুদ্রে একটি লংবোট দূরে ভেসে যায়। নৌযানটি যাতে ডুবে না যায় সেজন্য কয়েকজন যাত্রীকে জাহাজ থেকে ছুড়ে ফেলেন নাবিকেরা। পরে ক্রু সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। একজন ক্রুর বিরুদ্ধে শুনানির সময় আদালত বলেন, এই ধরনের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি ফৌজদারি হত্যার অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যাইহোক, আদালত বলেন, যখন এভাবে বলিদান করা হবে তখন তাদের অবশ্যই উপস্থিত লোকদের ওপর নির্ভর করে ন্যায্যতার সঙ্গে নির্বাচন করতে হবে। 

রেক্স বনাম বোর্ন (১৯৩৮) 
পাঁচ সেনা সদস্যের ধর্ষণের শিকার ১৪ বছরের কিশোরী গর্ভবতী হয়ে পড়ার ঘটনায় মামলা হয়। আসামিদের একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি মেয়েটির বাবা-মার সম্মতিতে গর্ভপাত করিয়েছিলেন। কারণ, তাঁর ধারণা ছিল, এত কমবয়সী মেয়েটি সন্তান জন্ম দিলে তার জীবনই শঙ্কার মধ্যে পড়বে। 

শুনানি ও সত্যতা যাচাইয়ের পর আদালত বলেন, আসামিকে বেআইনিভাবে গর্ভপাত ঘটানোর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। কারণ তিনি একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে সরল বিশ্বাসে কাজ করেছেন। 

টাটা সেলুলার বনাম দ্য ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (১৯৯৪) 
ভারত সরকার সব মোবাইল অপারেটরকে চারটি মহানগর-চেন্নাই, বোম্বে, কলকাতা এবং দিল্লিতে তাদের নেটওয়ার্ক স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। মূল্যায়ন কমিটিকে টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া-এর অধীনে দরপত্র পর্যালোচনা এবং মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়, যার মধ্যে টেলিকমিউনিকেশনের একজন মহাপরিচালক ছিলেন। 

মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষে মহাপরিচালকের ছেলের দরপত্র চূড়ান্ত হয়। এই ক্ষেত্রে, সুপ্রিম কোর্ট পক্ষপাতের অভিযোগ আমলে নেননি কারণ, টেলিকমিউনিকেশনের মহাপরিচালককে ছাড়া কোনো দরপত্র নির্বাচন করা যায় না এবং সুষ্ঠু মূল্যায়নও করা যায় না। এক্ষেত্রে তাঁকে প্রতিস্থাপনের কোনো বিকল্পও ছিল না। এই ক্ষেত্রে, সুপ্রিম কোর্ট ডকট্রিন অব নেসেসিটি উদারভাবে প্রয়োগ করেছেন। 

ভারতের নির্বাচন কমিশন বনাম ড. সুব্রহ্মনিয়াম স্বামী (১৯৯৬) 
প্রধান নির্বাচন কমিশন যদি পক্ষপাতের সম্ভাবনা বা ক্ষেত্র তৈরি করে এবং এই কাজে তাদের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক না হয় সে ক্ষেত্রে ডকট্রিন অব নেসেসিটি প্রযোজ্য হবে না। 

তবে একটা পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন আদালত যে, তারা একটি সভা আহ্বান করতে পারে এবং সিদ্ধান্ত সভা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে কমিশনের অন্য সদস্যদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ছেড়ে দিতে পারে। শুধু সে ক্ষেত্রে ডকট্রিন অব নেসেসিটি প্রযোজ্য হবে যখন তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেবে। 

বাংলাদেশে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে মোট ১৭ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। এই সরকারকে নিয়ে প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। ফলে বিদ্যমান সংবিধানের বাইরে গিয়ে অনেক কিছু ঘটার শর্ত তৈরি থাকছে। 

তবে এই ডকট্রিন অব নেসেসিটির নামে ভবিষ্যৎ বৃহৎ স্বার্থের খাতিরে ছোটখাটো অন্যায়, বিচ্যুতিগুলোকে উপেক্ষা বা অবহেলা করা যাবে। এসব বিষয়েও গণমাধ্যম এবং সচেতন নাগরিকদের কড়া নজর রাখতে হবে। 

লেখক: আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

ভেসে আসা কোরালে ‘কপাল খুলল’ আনোয়ারের

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

একটি প্রত্যাবর্তন, বহু প্রত্যাশা

সম্পাদকীয়
একটি প্রত্যাবর্তন, বহু প্রত্যাশা

দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরে এলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশের মাটিতে নেমেই কিংবদন্তিপ্রতিম মার্কিন নাগরিক অধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিংয়ের (জুনিয়র) অনুকরণে বললেন, ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর দ্য পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি’। একই সঙ্গে দেশবাসীর উদ্দেশে নিজের পরিকল্পনার কথাও সংক্ষেপে তুলে ধরলেন। তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন এবং জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দীর্ঘ সময় বাধ্য হয়ে প্রবাসে থাকার পর তাঁর এই ফিরে আসা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক অধ্যায়ের এক নতুন পর্বের সূচনা বলেই অনেকে দেখছেন। স্বাভাবিকভাবেই, এই ঘটনা নিয়ে জনমনে অনেক প্রত্যাশা জেগে উঠেছে। উঠেছে কিছু প্রশ্নও।

তারেক রহমানের বক্তব্যে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, তা হলো গণতন্ত্র, ঐক্য, উন্নয়ন, আইনের শাসন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা। তিনি বলেছেন, ‘আজ আমাদের সময় এসেছে সকলে মিলে দেশ গড়ার। আমরা চাই, সকলে মিলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলব আমরা, যে বাংলাদেশের স্বপ্ন একজন মা দেখেন।’

দীর্ঘদিন ধরে বিভক্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তাঁর কণ্ঠে এই সমঝোতা ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির আহ্বান খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। তবে বক্তব্যের ভাষা খুবই আশাব্যঞ্জক হলেও, বাস্তবে তার প্রতিফলন কতটা ঘটানো সম্ভব হবে, সেটাই হলো এখনকার আসল চ্যালেঞ্জ।

দীর্ঘ ১৭ বছর দেশের বাইরে ছিলেন তারেক রহমান। তাঁর এই দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক বাস্তবতা অনেক কিছুই বদলে গেছে। নতুন প্রজন্মের ভোটারদের অভিজ্ঞতা অন্য রকম। তাঁদের মধ্যে প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। ফলে তারেক রহমানের সামনে বড় দায়িত্ব হলো—এই পরিবর্তিত বাস্তবতাকে বোঝা এবং সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচি গ্রহণ করে তা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা। বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি, তাতে কেবল অতীতের রাজনৈতিক স্মৃতি বা আবেগ দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। এখন একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বর্তমান প্রজন্মকে ভালোভাবে বোঝা।

তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তনকে একটি সুযোগ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। সেটা হলো সংলাপ-সমঝোতা, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ। রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন হয় ধারাবাহিক আচরণ, স্বচ্ছতা এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করার মধ্য দিয়ে। সভার মঞ্চে বক্তব্যে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও অবস্থান যদি বাস্তব কর্মসূচিতে রূপ নেয়, তবেই তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে। এখন সেটাই করে দেখাতে হবে তারেক রহমান ও তাঁর দল বিএনপিকে।

তবে এ-ও মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষ ও জনগণের দায়িত্বও কম নয়। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের ন্যায্য প্রয়োগ নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন টেকসই হয় না। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন সেই বৃহত্তর আলোচনাকেই আবার সামনে এনে দিয়েছে।

তারেক রহমানের দেশে ফেরার ঘটনা দেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এটি অপার সম্ভাবনা যেমন তৈরি করেছে, তেমনি দায়িত্বশীল রাজনীতির দাবিও জোরালো করেছে। সকলের প্রত্যাশা, এই প্রত্যাবর্তন যেন কেবল একটি প্রতীকী ঘটনা হয়ে না থাকে; বরং এটি যেন সত্যিই গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়নে একটি মাইলফলক হিসেবে দেশবাসীর সামনে প্রতিফলিত হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

ভেসে আসা কোরালে ‘কপাল খুলল’ আনোয়ারের

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ: তারেক রহমানের দেশে ফেরা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ 
দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও তারেক রহমান দেশের প্রতিটি আন্দোলন ও কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছবি: ফেসবুক
দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও তারেক রহমান দেশের প্রতিটি আন্দোলন ও কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছবি: ফেসবুক

দীর্ঘ ১৭ বছর ৩ মাস ১৫ দিনের নির্বাসিত জীবন শেষে গতকাল ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এটি শুধুই একজন রাজনৈতিক নেতার স্বদেশে ফেরা নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে এক প্রতীকী মুহূর্ত। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নির্যাতন ও নির্বাসনের পর তাঁর দেশে ফেরা নতুন প্রত্যাশার সূচনা করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক রহমানের নাম কেবল দলের নেতৃত্বের সঙ্গে যুক্ত নয়; এটি একটি আদর্শিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্রের দর্শন তিনি উত্তরাধিকারের মাধ্যমে নয়, বরং রাজনৈতিক চর্চা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ধারণ করেছেন। তাঁর কাছে রাজনীতি কখনোই ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ছিল না; বরং এটি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি নৈতিক লড়াই।

সংগঠক থেকে নেতৃত্বে উত্তরণ

তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ভোটাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি দলকে শক্তিশালী করার কাজে মনোনিবেশ করেন। মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ, সাংগঠনিক দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নেতৃত্ব পুনর্গঠনের মাধ্যমে তিনি বিএনপিকে একটি তৃণমূলভিত্তিক সংগঠনে পরিণত করেন। দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ জোরদার করা এবং কর্মীদের মূল্যায়নের ধারা দলের শক্তি দৃঢ় করে। এই কার্যকর সংগঠক সত্তা পরবর্তী সময়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় আরও পরিপক্বতা আনতে সহায়তা করেছে। তিনি সব সময় দলীয় নীতি ও আদর্শকে প্রাধান্য দিয়েছেন, ব্যক্তিগত স্বার্থ কখনো নয়।

এক-এগারো ও নির্বাসনের রাজনীতি

২০০৭ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের নেতৃত্ব আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। এক-এগারোর অগণতান্ত্রিক বাস্তবতায় দেশের রাজনীতি প্রায় স্থবির হয়ে পড়লেও গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও জোরপূর্বক রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টার মুখেও তিনি আপসহীন ছিলেন। চিকিৎসার অজুহাতে তাঁকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হলেও বাস্তবে এটি রাজনৈতিক নির্বাসনই ছিল। দীর্ঘ প্রবাসজীবনে তিনি বিএনপিকে শুধু টিকিয়ে রাখেননি; দলকে ভাঙনের হাত থেকেও রক্ষা করেছেন। একাধিকবার দলকে নেতৃত্বশূন্য করার বা বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র হয়েছে, কিন্তু তাঁর ধৈর্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে দল ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন—নেতৃত্ব মানে শুধু উপস্থিতি নয়; সংকটে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই প্রকৃত নেতৃত্ব।

ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রকেন্দ্রিক রাজনীতি

তারেক রহমান বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানকে স্পষ্টভাবে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রকেন্দ্রিক করেছেন। তাঁর মতে, দেশের চলমান সংকটের মূল কারণ জনগণের ভোটাধিকার হরণ। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া টেকসই স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।

তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণমুক্ত করার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। এটি রাজনৈতিক দলকে আদর্শিক পথে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের চেয়ে জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

শাসক বা সরকারের কাজ হলো জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা; যারা এর বিপরীতে কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে জনগণই শেষ সত্তা। তাই তারেক রহমানের রাজনীতিতে সর্বদা জনগণকে কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয়।

তরুণ প্রজন্ম ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ

তারেক রহমান সব সময়ই তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার পক্ষে ছিলেন। তাঁর বিশ্বাস, তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। শিক্ষিত, মেধাবী ও চিন্তাশীল তরুণদের রাজনীতিতে আনার আহ্বান দলের মধ্যে নতুন নেতৃত্ব বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও তিনি দেশের প্রতিটি আন্দোলন ও কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কৌশল নির্ধারণ, সময়োপযোগী কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংকট তুলে ধরা—এই নেপথ্যের নেতৃত্ব বিএনপিকে রাজনীতির মূলধারায় টিকিয়ে রেখেছে। তরুণদের অংশগ্রহণ দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে নতুন ধারণা, উদ্ভাবনী কৌশল এবং নৈতিক মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারে—এটাই তাঁর বার্তা।

২৫ ডিসেম্বর: একটি প্রতীকী প্রত্যাবর্তন

গতকাল ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের দেশে ফেরা উপলক্ষে বিএনপি যে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল, তা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি দীর্ঘ অপেক্ষা, আবেগ এবং রাজনৈতিক প্রত্যাশার প্রতিফলন। রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন ৩০০ ফুট এলাকায় প্রস্তুতি এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা-কর্মীদের আগমন প্রমাণ করে—তারেক রহমান আজও দলের রাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

দীর্ঘদিনের নেতৃত্বের অনুপস্থিতি কাটিয়ে ওঠা, মাঠের রাজনীতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা—সবই তাঁর সরাসরি উপস্থিতির মাধ্যমে সম্ভব। পাশাপাশি, এটি সরকারবিরোধী রাজনীতিতে ভারসাম্য স্থাপন করবে। তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন সাধারণ জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে, ভোটাধিকার ও ন্যায্য প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করবে। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তার পর তাঁর উপস্থিতি দলের ভেতরে নেতৃত্ব পুনর্গঠন এবং সংহতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

নিশ্চয়ই সামনে চ্যালেঞ্জ কম নয়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নিপীড়ন, দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং গণতন্ত্রহীন বাস্তবতা বড় বাধা। তবে দীর্ঘ সংগ্রাম, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও আপসহীন অবস্থান তাঁকে এগিয়ে যেতে শক্তি দেবে। যদি প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে ভোটাধিকার, গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহি পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন নয়; এটি গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ, নতুন নেতৃত্বের শক্তি এবং তরুণ প্রজন্মের আশা—সবকিছুর একক চিহ্ন। এইসব প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হলে ২০২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর সারা দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে এক নবজাগরণের দিন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

ভেসে আসা কোরালে ‘কপাল খুলল’ আনোয়ারের

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা

বিধান রিবেরু
পুড়িয়ে মেরে ভীতির রাজনীতি সচল রাখা হচ্ছে কয়েক দশক ধরে। ছবি: আজকের পত্রিকা
পুড়িয়ে মেরে ভীতির রাজনীতি সচল রাখা হচ্ছে কয়েক দশক ধরে। ছবি: আজকের পত্রিকা

ইউরোপে পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত ডাইনি শিকার বা উইচ হান্টের নামে ৫০-৬০ হাজার মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। যাদের মারা হয়, লক্ষ করার বিষয়, সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি। নারী, সংখ্যালঘু বা ভিন্নমতের মানুষদেরই পুড়ে মরতে হয়েছে বেশি। আপনারা নিশ্চয়ই ষোড়শ খ্রিষ্টাব্দে ইতালীয় দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওদার্নো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার কথা জানেন। তো মধ্যযুগীয় সেই বর্বর সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটার পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করেছে। সামাজিক উদ্বেগ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অর্থনৈতিক করুণাবস্থা, মহামারি সামাল দিতে না পারা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিরতা। সবকিছু মিলিয়ে তখন সমাজের মানুষের ভেতর প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশা কাজ করছিল, পাশাপাশি তাদের ছিল না জ্ঞানের আলো, কাজেই খুব সহজে দোষ চাপিয়ে নিজেদের ক্ষোভ প্রশমনের জন্য তারা বেছে নিয়েছিল নারী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের। তবে সপ্তদশ শতকের শেষ দিক থেকে যখন বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটছে, যখন আইন ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার হচ্ছে এবং যখন মানুষ ধর্মের অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করেছে, তখন ইউরোপীয় সমাজে পুড়িয়ে মারার প্রবণতাও কমে এসেছে। তারপরও বলা যাবে না, তারা পুরোপুরি আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই একবিংশ শতকের বাংলাদেশে ইউরোপের সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতা ফিরে এল কেন?

এই প্রশ্নটির উত্তর নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। ৫০০ বছর আগের বাস্তবতার ভেতরেই এর উত্তর নিহিত রয়েছে। সেই উত্তর মাথায় নিয়ে, বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া, গণমাধ্যমে আসা কিছু ভয়াবহ ঘটনা উল্লেখ করা যাক। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে ভাঙচুর ও আগুন লাগায় মিছিল নিয়ে আসা একদল লোক। তো এই মব বা দঙ্গল, যাই বলি না কেন, তাদের কয়েকজন নিচতলায় পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে হোটেলটির কয়েকটি তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন সেখান থেকে বিদেশিসহ ২১ জনের দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

২০২৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে ‘তৌহিদি জনতা’ পরিচয়ে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার কবর, বাড়ি ও দরবার শরিফে হামলার ঘটনা ঘটে। মর্মান্তিক ঘটনা হলো, এই মব নুরুল হকের মরদেহ কবর থেকে তুলে মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

২০২৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে পোশাক কারখানার শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং পরে তাঁকে গাছে ঝুলিয়ে পোড়ানো হয়। পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের কটূক্তির নজির তারা পায়নি।

এই ঘটনার পরদিনই, ১৯ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে দরজায় তালা লাগিয়ে ও পেট্রল ঢেলে বেলাল হোসেন নামের এক বিএনপি নেতার ঘরে আগুন দেওয়া হয়। এ সময় ঘরের ভেতর আগুনে পুড়ে মারা যায় ওই বিএনপি নেতার সাত বছরের মেয়ে। এ ছাড়া ওই বিএনপি নেতা এবং তাঁর আরও দুই মেয়ে আগুনে দগ্ধ হন।

এসব ঘটনার ভেতর আরও এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যেতে পারত, বলা যেতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসে হয়তো লেখা হয়ে যেত কালো অধ্যায়টির নাম, শিরোনাম হতো ‘পুড়িয়ে মারা হলো ৩০ জন সাংবাদিককে’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। ১৮ ডিসেম্বর এই আয়োজনটাই করা হয়েছিল। সেদিন রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার—এই দুই পত্রিকা অফিসের সামনে আগে মব জড়ো হয় এবং পরে অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়। শুধু তা-ই নয়, ভেতরে আটকে পড়াদের যখন ফায়ার সার্ভিস বাঁচাতে এগিয়ে আসে, তাদের ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয় এই দঙ্গলবাজরা। উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট, যেন ভেতরে থাকা প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক পুড়ে মারা যান। নিউ এজের সম্পাদক নূরুল কবীর নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে এই সাক্ষ্য দেন।

একই সময়ে (১৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থেকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছায়ানট ভবনেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই ভবনের ভেতর থাকা নালন্দা স্কুলের শিশুদের জন্য রাখা আসবাব ও বইপত্রও রেহাই পায়নি। ঠিক পরদিনই (১৯ ডিসেম্বর) আগুন লাগানো হয় আরেক ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অফিসে। সৌভাগ্যের বিষয় যে, ছায়ানট ও উদীচী কার্যালয়ের ভেতরে কেউ ছিল না।

বলা হচ্ছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে নাকি পত্রিকা অফিস ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়ে আগুন ও লুটপাট করা হয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছিলেন ওসমান হাদি। প্রচারের সময় থেকেই তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজের জীবনের শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি, বিশেষ করে প্রশাসন। ১২ ডিসেম্বর হাদিকে গুলি করা হয়। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্যে থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালান। তাঁর দাবি, এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচারণার টিমে যোগ দিয়েছিলেন।

এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত নিন্দনীয় ও বর্বরোচিত। তবে সবচেয়ে বেশি বর্বরতা বোধ হয় ছবি ও পরিচয় জানার পরও প্রধান আসামিদের ধরতে না পারা। যারা হাদিকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলো এবং হত্যাকারীদের ধরতে পারল না, রাগ-ক্ষোভ তাদের ওপর হলো না, রাগ হলো বইপত্র, হারমোনিয়াম ও তবলার ওপর!

একেই বলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। হাদিকে হত্যার পেছনে রয়েছে জঘন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এর পরিবর্তন হওয়া জরুরি। হাদির ওপর রাজনৈতিক হামলা ও হত্যার বিচার সবাই চান, কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে কেন গণমাধ্যম বা সাংস্কৃতিক সংগঠন আক্রান্ত হবে? কেনই-বা সেগুলোর ভেতর লুটপাট চালানো হবে, সেটা একটু ভাবলেই বোঝা যায়।

নগর পুড়লে যেমন দেবালয় এড়ায় না, তেমনি যারা আগুন নিয়ে খেলছে, তাদের হাতও যে অরক্ষিত থাকবে, সেটিও হলফ করে বলা যায় না। চট্টগ্রামেও আমরা দেখি, পুড়িয়ে মারার উদ্দেশ্যে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ দিনের ব্যবধানে চারটি হিন্দু পরিবারের ঘরের দরজা আটকে বাইরে থেকে আগুন দেওয়া হয়। সবশেষ ২৩ ডিসেম্বর ভোরে রাউজান উপজেলার পৌর শহরে পশ্চিম সুলতানপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। আগুনের পর আক্রান্তরা টিন ও বাঁশের বেড়া কেটে ঘর থেকে বের হয়ে যান।

যে বিপজ্জনক পরিস্থিতির ভেতর বাংলাদেশ ঢুকে পড়েছে, তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার, পূর্বের ভয়ের সংস্কৃতিকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে সচেতনভাবে। কখনো রগ কেটে, কখনো গুম-খুন করে, কখনোবা পুড়িয়ে মেরে এই ভীতির রাজনীতি সচল রাখা হচ্ছে কয়েক দশক ধরে। স্বাধীন মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, এখন কেউ স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা পর্যন্ত পাচ্ছে না। পত্রিকা অফিসের সামনে এসে প্রকাশ্যে ক্যামেরার সামনে লোকজন বলছে ঘরে ঘরে গিয়ে সাংবাদিকদের হত্যা করার কথা। প্রশাসন নির্বিকার! মোটা দাগে দেখলে, এমন হুমকি, নৃশংসতা ও বর্বরতার পেছনে বর্তমান সময়ের ঝঞ্ঝামুখর রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী। তা ছাড়া আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। শিক্ষার অবস্থাও করুণ। আসল কথা হলো, জ্ঞানের আলো থেকে এখনকার সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরেই বঞ্চিত। এই বঞ্চনা একদিকে মানুষের ভেতর হিংস্রতার জন্ম দিচ্ছে, আরেক দিকে তাদের ভেতর যুক্তিসিদ্ধ চিন্তা করার ক্ষমতাও লোপ করে দিচ্ছে। তারা পরিণত হচ্ছে হিংস্র জড় পদার্থে। তাই মানুষকে কুকুর-বিড়ালের মতো পিটিয়ে মেরে, পুড়িয়ে ফেলতে তাদের একবিন্দুও আটকাচ্ছে না। আদতে তারা আর মানুষ নেই। মানুষ গড়ার কারিগর যারা, সেই শিক্ষকেরাও আজ চরমভাবে অপমানিত ও অপদস্থ হচ্ছেন। যে সমাজে শিক্ষকদের সঙ্গে নির্বিচারে অসম্মান করা হয়, রাষ্ট্র ও শিক্ষার্থী উভয় পক্ষ থেকে, সে দেশে মানুষ গড়বে কে? আর মানুষই-বা হবে কারা? গভীর সংকটে বাংলাদেশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

ভেসে আসা কোরালে ‘কপাল খুলল’ আনোয়ারের

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অভিমত

তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান
আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১: ৩৩
তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে, আজ থেকে ছয় দশক আগে। বাবা দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। মা বিএনপির চেয়ারপারসন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাই জন্মসূত্রে তারেক বিরল ভাগ্যের অধিকারী। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছেন, সেদিন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। বহু প্রতিভার অধিকারী বাবা জিয়াউর রহমান কীভাবে চড়াই-উতরাই মোকাবিলা করে দেশকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়েছেন, তাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। মা খালেদা জিয়া হলেন তাঁর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই স্বৈরাচারী এরশাদ প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তখন বিএনপির খুব দুঃসময়। হাল ধরলেন খালেদা জিয়া। তারেক রহমান প্রত্যক্ষ করেছেন, নবাগত তাঁর মা কীভাবে ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সুসংগঠিত করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনবার দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে তারেক রহমানের রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে। তৃণমূল সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হন, যা ছিল তাঁর জন্য মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা তাঁর পরিবার থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার কাজে সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। অতঃপর এই অঙ্গনে তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল নিরন্তর প্রবহমান। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী প্রচার-কার্যক্রম পরিচালনার পাঠ গ্রহণ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আধুনিক ও কার্যকর প্রচারের কৌশল প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং বিএনপির অমিত সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে তাঁর অভ্যুদয় ঘটে। ২০০১ সালে নির্বাচিত হন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে। ২০০৯ সালে দলের কাউন্সিলের মাধ্যমে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক গণসংযোগ ও যুবসমাজকে রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়ে নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে দলের ভেতরে ও দেশবাসীর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার কারাবন্দী দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার স্থলে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। কখনো সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখে, আবার কখনো-বা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নেতাকে অপশক্তির রোষানলে পড়তে হয়। কৈশোরের অনুরূপ তারেক রহমানের রাজনৈতিক অঙ্গনে পথ চলাও নিয়ত সরলরৈখিক হয়নি। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে যে সেনা সরকার এসেছিল, তা জরুরি অবস্থা জারি করে বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

বিশেষ করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনী এবং টাস্কফোর্সের নামে হামলা-মামলা, জুলুম ও নির্যাতন চালায়। দেশনেত্রীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই নির্যাতন ও জুলুমের শিকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের ওপর নেমে আসা নির্যাতনের মাত্রা ও ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ৭ মার্চ ২০০৭ তারিখে গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর নেমে আসে পৈশাচিক নির্যাতন। এই আক্রমণ তাঁর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্যই করা হয়েছিল। তিনি ভাগ্যক্রমে এবং দেশবাসীর দোয়ায় বেঁচে যান। ৭ মার্চ ২০০৭ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। এটি তাঁর জন্য একদিক থেকে যেমন নির্বাসনের যন্ত্রণা ভোগের শামিল, অন্যদিক থেকে দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে তাঁর নিজের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরও দৃঢ় করার একটি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। রাজনৈতিক জীবনের এই আঁকাবাঁকা পথ চলায় তিনি যে জীবনমুখী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা তাঁর বর্তমান পথ চলার ক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব পালন করার সময় তাঁর এই অভিজ্ঞতার সুবাদে সূচিত হতে পারে বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির গতিধারা। পৃথিবীর স্বনামধন্য রাজনীতিকগণের জীবন ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, তাঁদের অনেকেরই রাষ্ট্র পরিচালনায় সফল হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা ও চড়াই-উতরাই পার হওয়ার করুণ কাহিনি। সুখ-দুঃখের এই মিশ্র অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরও জোরালো করেছে। তারেক রহমানের রয়েছে নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করার অভিজ্ঞতা। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সফলতম রাষ্ট্রনায়ক পিতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের করুণ কাহিনি প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা। আরও রয়েছে মা খালেদা জিয়ার ৪০ বছর যাবৎ বসবাস করা নিজ বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হওয়ার করুণ অভিজ্ঞতা। প্রতিনিয়ত নেতা-কর্মীদের ওপর ঘটে যাওয়া অসংখ্য নিপীড়ন-নির্যাতনের কাহিনি তো রয়েছেই। এই অভিজ্ঞতাগুলো তারেক রহমানকে করে তুলেছে এক সর্বংসহা রাজনীতিক হিসেবে। তাঁর মধ্যে এমন এক বোধ তৈরি হয়েছে, যা তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে।

সুতরাং বলা যায়, যে অভিজ্ঞতাগুলো একজন মানুষকে ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ উপলব্ধিতে সাহায্য করে, তারেক রহমান সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রায় অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতির পঙ্কিল পথে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার-আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে এর চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে কি? বোধ করি নেই।

এখন প্রয়োজন হলো, এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে সচেষ্ট হওয়া, যার স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল এবং যার সূচনা করেছিলেন তাঁরই পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরবর্তী সময়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মাধ্যমে।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিন ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, সেদিন থেকেই এই স্বপ্ন পূরণের বাস্তব এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। প্রতিশোধের অগণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে তারেক রহমান জাতির উদ্দেশ্যে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত থাকবে, সেটাই জাতির প্রত্যাশা। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন শুধু একজন ব্যক্তির ফিরে আসা নয় বরং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের এক সুবর্ণ সুযোগ।

অন্তর্বর্তী সরকার তারেক রহমানসহ সকল রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে এই সুযোগের বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা উচিত। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বজায় থাকলে প্রতিহিংসার বিপরীতে গণতান্ত্রিক ইতিবাচক প্রতিযোগিতার বিজয় অনিবার্য।

লেখক: অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২৪৩ আসনে প্রার্থী দিল জি এম কাদেরের জাপা

‘অনলাইনে জুয়ার টাকা ভাগাভাগি’ নিয়ে খুন হন বগুড়ার সেই ব্যবসায়ী

সূর্যাস্তের আগে স্মৃতিসৌধে পৌঁছাতে পারলেন না তারেক রহমান, তাঁর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন কেন্দ্রীয় নেতাদের

ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি সাদ্দাম, সাধারণ সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ

ভেসে আসা কোরালে ‘কপাল খুলল’ আনোয়ারের

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত