Ajker Patrika

ভারতের সঙ্গে বিগত সরকারের সমঝোতা চুক্তিগুলো বাতিল হতে পারে 

আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৯: ১২
ভারতের সঙ্গে বিগত সরকারের সমঝোতা চুক্তিগুলো বাতিল হতে পারে 

ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলো পুনর্বিবেচনা, এমনকি বাতিল করতে পারে বাংলাদেশ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক নয় এমন সমঝোতা স্মারকগুলো পুনর্বিবেচনা বা বাতিল করতে পারে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ড. তৌহিদ হোসেনের একটি মন্তব্য থেকে এমনটাই বিবেচনা করছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া। 

যদিও সমঝোতা স্মারকগুলো পর্যালোচনার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি, তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারত সরকার মনে করে, সমঝোতা স্মারকগুলো পর্যালোচনা বাংলাদেশের নতুন প্রশাসনের প্রাথমিক কাজগুলোর একটি। পরিণতিতে সমঝোতা স্মারকগুলো নিয়ে বর্তমান অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন অবস্থান তৈরি হতে পারে বাংলাদেশ সরকারে। 

গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, ‘এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) চূড়ান্ত চুক্তি নয়। কাজেই এখানে আমাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়েছে কি না, সেটি আমরা দেখতেই পারি। দেশের স্বার্থ রক্ষা করে যা করা দরকার, আমরা তা-ই করব।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সরকার যদি নির্ধারণ করে, এই সমঝোতা স্মারকগুলো দেশের স্বার্থ রক্ষা করে না, তবে অবশ্যই সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

ভারতের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধারণা থাকতে পারে যে শেখ হাসিনা প্রশাসনের ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তাই সেসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সময় মাত্রাতিরিক্তভাবে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য প্রত্যর্পণের বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, দেশের লিগ্যাল সিস্টেম থেকে নির্দেশনা পেলে শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, ‘যদি দেশের আইন-আদালত আমাকে তাঁকে (শেখ হাসিনাকে) ফেরত আনার ব্যবস্থা নিতে বলে, তাহলে সে ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।’ যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর নির্ভর করে, যা অনুসরণ করার নিজস্ব আইনি প্রটোকল আছে। দুই দেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রক্রিয়াটি জটিল হতে পারে। 

চলতি বছরের জুনে শেখ হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে মোট ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। এগুলোর মধ্যে ৭টি নতুন এবং ৩টি বিদ্যমান সমঝোতা স্মারকের নবায়ন। শেখ হাসিনার দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরের সময় ভারতের হায়দরাবাদ হাউসে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার সময় এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

এদিকে বাংলাদেশে ভারতীয় ঋণের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) বা ঋণের অর্থায়িত চলমান ও প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করছে। এই পর্যালোচনায় তিনটি ভারতীয় এলওসির অধীনে বর্তমান ও প্রস্তাবিত প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত।

প্রকল্পের অংশীদারেরা বিশ্বাস করেন, এই ঋণ সহায়তার অধীনে অর্থায়ন করা অনেক প্রকল্পই প্রাথমিকভাবে ভারতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। উদাহরণস্বরূপ, আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত চার লেনের রাস্তাটি ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে করা হচ্ছে বলে মনে করেন তাঁরা। 

ভারত ২০১০, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশকে মোট ৭ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার লাইন অব ক্রেডিট বা ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারত খুব সামান্য পরিমাণ অর্থই ছাড় করেছে। এখন পর্যন্ত ভারত মোট ১৮০ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার অর্থ ছাড় করেছে। এই তিন দফার লাইন অব ক্রেডিটের বিপরীতে সড়ক ও রেল সংযোগ, জ্বালানি এবং অবকাঠামো খাতে মোট ৩৬টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৫টি সম্পন্ন হয়েছে, ৮টি চলমান রয়েছে এবং বাকি প্রকল্পগুলো পরামর্শক বা ঠিকাদার নিয়োগ বা প্রস্তাব তৈরির পর্যায়ে আছে। 

ভারত ও শেখ হাসিনা সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারক অনুসারে, ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) দিয়েছে। আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেনের সড়ক প্রকল্পটি ছিল দ্বিতীয় এলওসির মাধ্যমে অর্থায়ন করা এমনই একটি প্রকল্প। ভারতীয় ব্যাংকের অর্থায়ন করা এসব ঋণের শর্ত ছিল, এগুলোতে ভারতীয় ঠিকাদার নিয়োগ করতে হবে এবং প্রকল্পের পণ্য ও পরিষেবার ৬৫ শতাংশ ভারত থেকে সংগ্রহ করতে হবে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়নের জন্য একটি ভারতীয় ঋণ অর্থায়নে চলমান প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। কারণ, ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা প্রকল্পটি পরিত্যাগ করে ভারতে ফিরে গেছেন। এই সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প ২০১৭ সালে শুরু হয়েছিল। 

এই প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। যার মধ্যে ভারতের দেওয়ার কথা ছিল ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারের দেওয়ার কথা। ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের জুন নাগাদ কাজ শেষ হয়েছে ৫০ শতাংশ। 

এদিকে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যুতে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি জানিয়েছেন, তবে এই ইস্যুতে চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব না হলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। 

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমি তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি নিয়ে (বাংলাদেশে) সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা আলোচনা করেছি যে তিস্তা চুক্তি নিয়ে প্রক্রিয়া ও সংলাপ পুনরায় শুরু করতে হবে। আমাদের গঙ্গা চুক্তিতেও কাজ করতে হবে, যা আগামী দুই বছরের মধ্যে শেষ হতে হবে।’ 

পানিবণ্টনের আন্তর্জাতিক নীতিমালার দিকে ইঙ্গিত করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। যেহেতু এটি একটি আন্তর্জাতিক পানি সমস্যা, এটি অন্যান্য দেশের আইনগত অধিকারের বিবেচনাকেও আমলে নেয়। সুতরাং, কতটা পানি পাওয়া যায় এবং তা পর্যাপ্ত কি না, তা আমাদের কাছে অস্পষ্ট। খুব ন্যূনতম পানি পাওয়া গেলেও আন্তর্জাতিক পানিবণ্টনের নিয়মের কারণে বাংলাদেশে প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশ পানিবণ্টন-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও নথির অনুমোদনের বিষয়টিও আমলে নিতে পারে।’ 

রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, ‘সে সময় উভয় পক্ষই সম্মত হয় এবং তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির একটি খসড়াও প্রস্তুত করা হয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। বাস্তবতা হলো, আমরা চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে পারিনি। সুতরাং, আমরা সেই জায়গা থেকে চুক্তির খসড়া দিয়েই শুরু করব এবং ভারতকে এগিয়ে আসার ও সংলাপ প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানাব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিদের আনাগোনা: সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষে প্রবেশ সীমিত

বাসস, ঢাকা  
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসকক্ষগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির আদেশে আজ সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের কোর্ট রুমে (এজলাসকক্ষে) আইনজীবী ছাড়া বিচারপ্রার্থী বা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যক্তির প্রবেশাধিকার সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত থাকবে। এই আদেশ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সিদ্দিকীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নতুন নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট দেশের বিচার অঙ্গনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। প্রধান বিচারপতি, বিচারপতিবৃন্দ, মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে, আদালতে আগত কিছু বিচারপ্রার্থী, মামলাসংশ্লিষ্ট এবং অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি এজলাসে প্রবেশ করছেন, যা আদালতের নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ এবং বিচারকাজ পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে বিচারপতি, আইনজীবী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি এড়াতেই নিরাপত্তার স্বার্থে এই কড়াকড়ি আরোপ করা হলো।

এজলাসকক্ষের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের জন্যও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যেকোনো ধরনের সমাবেশ, মিছিল, বৈধ বা অবৈধ সব ধরনের অস্ত্র, মারণাস্ত্র, বিস্ফোরক এবং মাদকদ্রব্য বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

নতুন এই নিরাপত্তা আদেশ ১৫ ডিসেম্বর (সোমবার) থেকে কার্যকর হয়েছে এবং ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। আদালত স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এই আদেশ অমান্য করেন, তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আদালত এ বিষয়ে আইনজীবী, তাঁদের সহকারী, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিচারপ্রার্থীদের সচেতন ও সতর্ক থাকার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: ভোটের আগে আতঙ্ক জনমনে

  • ওসমান হাদির ঘটনার পর সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ও নেতাদের মধ্যে শঙ্কা।
  • চোরাগোপ্তা হামলা, নাশকতার আশঙ্কার মধ্যে বাসে অগ্নিসংযোগ।
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ইসির বৈঠকেও ওঠে চোরাগোপ্তা হামলার প্রসঙ্গ।
  • পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে।
শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা 
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ১৫
গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় ওসমান হাদি হামলার শিকার হন। ছবি: আজকের পত্রিকা
গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় ওসমান হাদি হামলার শিকার হন। ছবি: আজকের পত্রিকা

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির আশা করা হলেও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে গুলির ঘটনা দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। ওই ঘটনায় সম্ভাব্য প্রার্থীসহ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহের বদলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাজনৈতিক নেতারাসহ জুলাই যোদ্ধারা। সরকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচার নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, সময়মতো কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন হাল। নির্বাচনের ট্রেন চলা শুরু হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাবাচ্ছে সবাইকে। পরিস্থিতি ঠিক করতে এখনই দৃশ্যমান ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

ওসমান হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে প্রকাশ্যে মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তরা ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদির মাথায় গুলি করে। এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাদির সার্বিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে মেডিকেল বোর্ড।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার এবং নাশকতার আশঙ্কার মধ্যে এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে থমথমে ভাব নেমে এসেছে। তফসিলের পর যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল, তাও কমে গেছে।

সূত্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

একই সঙ্গে মাঠপর্যায় থেকেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়গুলো জানানো হয়েছে। গত শনিবার পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে দেশের সব রেঞ্জের ডিআইজি ও মহানগর পুলিশের কমিশনারদের বৈঠকেও এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ এসেছে।

জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে এবং কোনো প্রার্থী অনিরাপদ বোধ করলে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হবে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে গতকাল রোববার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই বৈঠকেও চোরাগোপ্তা হামলা ও জামিনে মুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রসঙ্গে ওঠে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি, যাতে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা পরিকল্পনা আরও কার্যকর করা যায়। তবে নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার শঙ্কা নেই বলে জানানো হয়েছে।’

এদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে বিভক্তি থাকলেও ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় প্রধান সব রাজনৈতিক দল আবার এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণাও এসেছে। ওই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদউল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে একজন নিহত ও প্রার্থীসহ দুজন আহত হন। অবশ্য সেখানে হত্যার লক্ষ্য ছিলেন সন্ত্রাসী সরোয়ার। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ আসনে জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী আবু তালেব মণ্ডলের গণসংযোগকে কেন্দ্র করে হামলা ও সংঘর্ষ হয়। এর পেছনে স্থানীয় রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ভিন্ন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়েছে। এই ঘটনার পর কোনো কোনো দল থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও উঠেছে।

রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, কয়েক দিন ধরে বাসে অগ্নিসংযোগ ও ককটেল হামলার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরির একটি চেষ্টা চলছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।

ওসমান হাদির ওপর হামলাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা হিসেবে দেখছেন রাজনীতিকদের অনেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই একটি পক্ষ নির্বাচন ঠেকানোর হুমকি দিয়ে আসছিল।

অন্তর্বর্তী সরকারও ঘটনাটিকে নির্বাচনবিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা ও প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, কোথায় কোথায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শত্রুতা বেশি, কোথায় শক্ত প্রার্থী রয়েছেন—এসব জায়গায় আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এমন ঘটনা যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট সব তথ্য সংগ্রহ ও গোয়েন্দা চ্যানেলকে সক্রিয় করতে হবে এবং অন্য কাজের চেয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এদিকে প্রার্থীদের নিরাপত্তা দিতে শনিবার আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে কমিটি করা হয়েছে। অপারেশন ডেভিল হান্ট-২ শুরুর ঘোষণাও দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এদিকে গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের জন্য পুলিশ নিরাপত্তা প্রটোকল দেবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলেছে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র ছিল, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর সঙ্গে জড়িত চিহ্নিত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি পেশাদার সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনার আলোকে অবৈধ অস্ত্রের সরবরাহপথ চিহ্নিত করা এবং অস্ত্রের পেছনে থাকা অর্থের জোগানদাতাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ শুরু করেছে।

এদিকে গত বছরের ৫ আগস্ট পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে জোর দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, লুণ্ঠিত ১ হাজার ৩৩৭টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৪০০টি পিস্তল রয়েছে।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সীমান্ত দিয়ে দেশে অস্ত্র প্রবেশের আশঙ্কার পাশাপাশি লুট হওয়া অস্ত্রগুলো কোনো অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সেটিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। অভিযানে এসব বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।

নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদারের দাবি করেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুন করে সাজানো হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে প্রার্থীদের এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, নির্বাচনের সময় যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করতে এবং নির্বাচনকে শঙ্কামুক্ত রাখতে সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। প্রার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, প্রার্থীদের সঙ্গে সশস্ত্র প্রহরী থাকবে এবং গোয়েন্দা সংস্থা সম্ভাব্য ঝুঁকি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সতর্ক করবে। প্রার্থীদের ঠিক কোন জায়গায় যাওয়া নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ সে সম্পর্কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সুদানে শান্তিরক্ষা মিশনে হামলা: শোকে স্তব্ধ নিহত সেনাদের স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায়

  • শনিবার রাতে সুদানের আবেই এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলা।
  • নিহত হন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত সেনাবাহিনীর ৬ সদস্য।
  • আহত হয়েছেন আরও আট বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী।
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭: ৪৩
সুদানে শান্তিরক্ষা মিশনে হামলা: শোকে স্তব্ধ নিহত সেনাদের স্বজনেরা লাশের অপেক্ষায়

সুদান থেকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক আছে। কিন্তু রাতেই দেশটির আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর ড্রোন হামলায় নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক শান্ত মন্ডল। কুড়িগ্রামে শান্তদের বাড়িতে এখন চলছে শুধুই মাতম।

শুধু শান্ত নন, সুদানের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওই ঘাঁটিতে হামলায় সেনাবাহিনীর আরও তিন সৈনিক এবং দুই কর্মচারী নিহত হয়েছেন। সবার বাড়িতে এখন মাতম চলছে। তাঁদের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও প্রতিবেশীদের কেউ।

২০১৮ সালে সৈনিক পদে যোগ দেওয়া শান্ত গত ৭ নভেম্বর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুদানে যান। এক বছর আগে বিয়ে করেছিলেন তিনি। শান্তর স্ত্রী এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সাটমাধাই ডারারপাড়ে শান্ত মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা, সেখানে কান্নার কোনো শব্দ নেই। শান্তর মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। কথা নেই, কান্নাও নেই। ছেলের নাম উচ্চারণ করলেই চোখ ভিজে ওঠে সাহেরা বেগম এবং পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের। লাশ দেশে এলে বাবার কবরের পাশে দাফনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। এখন তাঁরা লাশ আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। শান্তর ভাই সোহাগ মন্ডল বলেন, ‘যাওয়ার সময় মায়ের পা ছুঁয়ে দোয়া নিয়েছিল। কেউ ভাবেনি, সেটিই হবে তার শেষ দেখা। এমন মৃত্যু আমাদের কল্পনার বাইরে।’

শনিবার সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের কাদুগলি লজিস্টিক ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। এতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মধ্যে করপোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর) এবং সৈনিকদের মধ্যে মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), শামীম রেজা (রাজবাড়ী), শান্ত মন্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা) নিহত হন।

এ ঘটনায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান (কুষ্টিয়া), সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন (দিনাজপুর), করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি (ঢাকা), ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম (বরগুনা); সৈনিক মো. মেজবাউল কবির (কুড়িগ্রাম), মোসা. উম্মে হানি আক্তার (রংপুর), চুমকি আক্তার (মানিকগঞ্জ) ও মো. মানাজির আহসান (নোয়াখালী) আহত হয়েছেন বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।

হামলায় নিহত কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম তিন ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে শোকের আবহ চলছে বাড়িতে। জাহাঙ্গীরের চাচাতো ভাই আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমে সহকর্মীদের কাছ থেকে খবর পাই। এরপর ভোরে সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোন করে নিশ্চিত করেন।’ জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবাইয়া আক্তার স্বামীর ছবি আর তিন বছরের ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। বৃদ্ধ বাবা হজরত আলী রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি শুনছি, বোমা ফালাইয়া আমার ছেলেরে মাইরা ফেলছে। এ দুঃখ কেমনে সহ্য করমু?’

হামলায় নিহত মমিনুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামে। তাঁর বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স ৪ বছর। মমিনুলের পরিবারের সদস্যরা জানান, শনিবার বিকেলে ভিডিও কলে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলেন মমিনুল। কয়েক ঘণ্টা পরই আসে মৃত্যুর খবর। প্রতিবেশীরা জানান, খবর শোনার পর স্ত্রী ও মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আব্দুল করিম বলেন, ‘আমার ছেলে ভালো মানুষ ছিল। আল্লাহ হয়তো তাকে ভালোবাসেন বলেই শহীদের মৃত্যু দিয়েছেন।’

ড্রোন হামলায় নিহত গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের আমলাগাছি গ্রামের সবুজ মিয়া ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। এক বছর আগে বিয়ে করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর খবরে মা, স্ত্রীসহ স্বজনেরা শোকে ভেঙে পড়েছেন। গ্রামজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

হামলায় নিহত রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের হোগলাডাঙ্গী গ্রামের আলমগীর ফকিরের ছেলে শামীম রেজা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

শামীম রেজার ছোট ভাই সোহান ফকির বলেন, ‘টেলিভিশনে সুদানের ঘটনার খবর দেখার পর থেকে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ভাইয়ের মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। রাত ১২টার পর আমরা নিশ্চিত হই ভাই আর নেই। গত শুক্রবার তিনি বাড়িতে ভিডিও কলে শেষবার কথা বলেছিলেন।’

শামীম রেজার বাবা আলমগীর ফকির কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে ৭ মাস আগে বিদেশে গেছে। শুক্রবারও কথা বলেছি। শামীম তখন বলল, আব্বু তুমি ভালো থেকো আমি ডিউটিতে যাব। আমার ছেলেকে এনে দাও তোমরা।’

নাটোরের লালপুর উপজেলার আরবাব ইউনিয়নের বোয়ালিয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ রানা নিহত হওয়ার খবরে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি সাহার উদ্দিনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মাসুদ ছিলেন সবার বড়। ২০০৬ সালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর দুই ভাইও সেনাবাহিনীর সদস্য।

মাসুদ রানার স্ত্রী আসমাউল হুসনা আঁখি বলেন, ‘তিনি আমার মেয়েকে এতিম করে চলে গেলেন। বাকি জীবন আমরা কীভাবে কাটাব? গতকালও আমাদের সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন। আজ তিনি নেই ভাবতেই পারছি না।’

ড্রোন হামলায় হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি নিহত শান্তিরক্ষীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে আহত শান্তিরক্ষীদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।

আহত শান্তিরক্ষীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে আইএসপিআর বলেছে, তাঁদের মধ্যে সৈনিক মেজবাউল কবিরের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। বর্তমানে তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। আহত অন্যদের উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে স্থানান্তর করা হয়েছে, তাঁরা সবাই শঙ্কামুক্ত।

আন্তোনিও গুতেরেসের শোক

বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গতকাল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। গুতেরেস প্রধান উপদেষ্টাকে বলেন, ‘আমি গভীর সমবেদনা জানাতে ফোন করেছি। আমি এই ঘটনায় খুবই মর্মাহত।’

হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ মহাসচিব গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ড. ইউনূসও শান্তিরক্ষীদের মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। পাশাপাশি তিনি আহত সেনাসদস্যদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার এবং নিহত ব্যক্তিদের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে জাতিসংঘকে অনুরোধ জানান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে জামায়াতের দুই ছাত্রনেতা আশরাফ ও মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৪৮
জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ছাত্রসংঘের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ছবি: সংগৃহীত
জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ছাত্রসংঘের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। ছবি: সংগৃহীত

আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের কয়েক দিন আগেই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানো যাচ্ছে না বুঝতে পেরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে শেষ মরণ আঘাত হানে পাকিস্তানি বাহিনী। পরিকল্পিতভাবে একযোগে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বিজয়ের পরই তাঁদের অনেকের ক্ষতবিক্ষত মরদেহের সন্ধান মেলে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী স্থানীয় আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরাই মূলত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। আর এই দুই বাহিনীর মূল শক্তি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীর তখনকার সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা। পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের আগে ঢাকা শহরে ঘন ঘন কারফিউয়ের মধ্যে মাইক্রোবাস নিয়ে বেরিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তাদের সহায়তা করেছিল ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীরা।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালে ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় জন শিক্ষক, ছয় জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার দায়ে ছাত্রসংঘের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও আলবদর কমান্ডার আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে আছেন যুক্তরাষ্ট্রে, আর মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে। কোনো দেশই তাদের ফেরত দিচ্ছে না।

ট্রাইব্যনালের ১৫৪ পৃষ্ঠার রায়ে উঠে এসেছে, কীভাবে আশরাফুজ্জামান ও মুঈনুদ্দীন ১৯৭১ সালের ১১ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আল বদর সদস্যদের নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ ও হত্যার পর বধ্যভূমিতে লাশ গুম করেছিলেন। আশরাফুজ্জামান ছিলেন হত্যাযজ্ঞের ‘চিফ এক্সিকিউটর’ ও মুঈনুদ্দীন ‘অপারেশন ইনচার্জ’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা ব্যক্তিগত দিনপঞ্জিতে হত্যার পরিকল্পনা ও একটি তালিকাও পাওয়া যায়।

জামায়াতের এই দুই ছাত্র নেতা ও তাদের সহযোগীদের হাতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং চিকিৎসক মো. মর্তুজা, মো. ফজলে রাব্বি ও আলিম চৌধুরীকেও হত্যার পর গুম করে তারা।

‘ফ্যাসিস্ট’ জামায়াত

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালের রায়ে উঠে এসেছিল। আদালত বলেছিল, সেই সময় জামায়াতে ইসলামী একটি ফ্যাসিস্ট সংগঠন হিসাবে কাজ করেছে। ‘কিলিং স্কোয়াড’ আল বদরের নিয়ন্ত্রণ জামায়াতের হাতেই ছিল।

রায়ে বলা হয়, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ফ্যাসিস্ট জামায়াতে ইসলামীর সংগঠিত মহাপরিকল্পনার আলোকেই সে সময় আল বদর বাহিনীকে নামানো হয়। বাঙালি জাতিকে প্যারালাইজড করতে তারা বুদ্ধিজীবী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিহীন করতে চেয়েছিল।

একাত্তরের ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে অপহরণের পর হত্যার বিষয়টি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ‘সন্তানের জন্য সেলিনা পারভীন প্রাণ ভিক্ষা চান, তাকে ছেড়ে দিতে বলেন। তার ছোট একটি ছেলে রয়েছে, যাকে দেখাশুনা করার আর কেউ নেই। কিন্তু নিষ্ঠুর হত্যাকারীরা তাকে ছাড়েনি। বেয়নেট দিয়ে তাকে তাতক্ষণিকভাবে হত্যা করা হয় বলে প্রসিকিউশনের ২২ নম্বর সাক্ষী জানিয়েছেন। সেলিনা পারভীন ছিলেন একজন মা। ভীতিকর আক্রমণ কেবল সেলিনা পারভীনের ওপরই করা হয় নাই। বরং মাতৃত্বের ওপরও হয়েছে। এটা বরং মাতৃহন্তাও। অবর্ণনীয় এই নিষ্ঠুরতা মানবতার বিবেককে আঘাত করেছে।’

এর আগে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ে দলটিকে ‘সন্ত্রাসী দল’ আখ্যা দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সরকারের আমলে পুলিশ প্রহরায় মুঈনুদ্দীনকে দেশে আসার সুযোগ করে দেয়ায় ওই দুই সামরিক শাসককেও ধিক্কার জানানো হয়েছে রায়ের পর্যবেক্ষণে।

রায়ে বলা হয়, ‘এটা জাতির বড় একটি বিরাট লজ্জা (গ্রেট শেম) যে, জিয়া ও এরশাদ তাকে গ্রামের বাড়িতে যেতে দিয়েছেন। আত্মগোপনে গিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া এই আসামিকে সে সময় পুলিশি নিরাপত্তাও দেয়া হয়। বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে তাকে রাষ্ট্রীয় মেশিনারি দিয়ে সম্মান দেয়া হলো।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত