সিরিয়ার ঐতিহাসিক ৫ মসজিদ

প্রাচীন সভ্যতার ভূমি সিরিয়া ইসলামি স্থাপত্যশিল্পের আঁতুড়ঘর। এখানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য নান্দনিক স্থাপত্যের ঐতিহাসিক মসজিদ। মসজিদগুলো কেবল ইবাদতের স্থান নয়, বরং ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও শিল্পের মেলবন্ধন। সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা এসব মসজিদ মুসলিমবিশ্বের গর্বের প্রতীক। এখানে ৫টি ঐতিহাসিক মসজিদের কথা লিখেছেন মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ

মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ 
Thumbnail image
উমাইয়া মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

আল-আদিলিয়াহ মসজিদ

আলেপ্পো শহরের অন্যতম বিখ্যাত মসজিদ হচ্ছে আল-আদিলিয়াহ মসজিদ। এটি ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে অটোমান শাসক সুলতান সোলেমানের নির্দেশে নির্মিত হয়। সুলতান সোলেমান (১৫২০-১৫৬৬), যিনি সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট নামে পরিচিত, ন্যায়বিচারের জন্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর শাসনামলে সমতার ভিত্তিতে বিচার নিশ্চিত করেছিলেন এবং মুসলিম ও অমুসলিমদের জন্য নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেছিলেন। সুলতানের সেই ন্যায়পরায়ণতার স্মারক হিসেবে মসজিদটির নাম আল-আদিলিয়্যাহ বা ন্যায়ের প্রতীক রাখা হয়।

মসজিদটির স্থাপত্যে অটোমান শিল্পের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এর বড় গম্বুজ ও দৃষ্টিনন্দন মিনার মনোমুগ্ধকর। অভ্যন্তরের মার্বেল পাথরের কারুকাজ ও ক্যালিগ্রাফি মসজিদটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আসাদবিরোধী যুদ্ধের সময় মসজিদটি ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়।

মসজিদের ছাদ ও মিনার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং এর অভ্যন্তরের কারুকার্য নষ্ট হয়ে যায়। পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলেও আগের সৌন্দর্য পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

নুরুদ্দিন জিনকি মসজিদ

মসজিদটি ১১৭২ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নুরুদ্দিন জিনকি কর্তৃক নির্মিত হয়। এটি দামেস্কের পুরোনো শহরের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। নুরুদ্দিন জিনকি (১১১৮-১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন একজন বিখ্যাত মুসলিম শাসক ও সেনাপতি, যিনি জিনকি রাজবংশের অন্যতম নেতা ছিলেন। সিরিয়া ও মিসরের কিছু অংশ শাসন করেছিলেন। তিনিই জেরুজালেম মুক্ত করার পথ সুগম করেছিলেন।

জেরুজালেম বিজেতা সালাহউদ্দিন আইয়ুবির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা তাঁকে ইসলামি ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। তাঁর নির্মিত মসজিদটির স্থাপত্যে মধ্যযুগীয় আইয়ুবি স্থাপত্যশৈলীর ছাপ স্পষ্ট। এর চওড়া উঠান, মার্বেল পাথরের মেঝে ও নকশা করা মিনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে সুন্দর অলংকরণ এবং সুরম্য ক্যালিগ্রাফি। সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় বিক্ষিপ্ত গোলাবর্ষণের কারণে মসজিদের কিছু অংশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

আস-সালিহিয়া মসজিদ

আস-সালিহিয়া মসজিদ দামেস্কের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ, যা ১২ শতকের শেষের দিকে নির্মিত হয়। এটি সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সময়ে নির্মিত এবং তাঁর সময়কার ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ছিলেন একজন মহান মুসলিম সেনাপতি ও শাসক, যিনি আইয়ুবি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মূলত ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জন্য বিখ্যাত। ১১৮৭ সালে হিট্টিনের যুদ্ধে তিনি ক্রুসেডারদের পরাজিত করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর ন্যায়পরায়ণতা, দয়া এবং শত্রুদের প্রতি মহানুভব আচরণের জন্য তিনি সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে নির্মিত এ মসজিদের নকশায় মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মার্বেল পাথরের ব্যবহার এবং নিখুঁত খোদাই কাজ মসজিদটিকে বিশেষ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে।

আল আদলিয়াহ মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত
আল আদলিয়াহ মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

উমাইয়া মসজিদ

উমাইয়া মসজিদ, যা দামেস্ক গ্র্যান্ড মসজিদ নামেও পরিচিত, ইসলামের অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ। এটি ৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের শাসনকালে নির্মিত হয়। মসজিদটি দামেস্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এবং এখানে হজরত ইয়াহিয়া (আ.)-এর মাথা সমাহিত আছে বলে ধারণা করা হয়।

মসজিদের স্থাপত্যে বাইজেন্টাইন ও রোমানশৈলীর প্রভাব স্পষ্ট। এর চারটি মিনার এবং সোনালি মোজাইক দ্বারা সজ্জিত প্রশস্ত উঠান চোখে পড়ার মতো। উমাইয়া মসজিদের অলংকৃত মিহরাব ও মিম্বর মুসলিম শিল্পকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এটি শুধু সিরিয়ার নয়, বরং পুরো মুসলিমবিশ্বের ঐতিহাসিক ধনভান্ডার।

২০১৩ সালে বাশার আল-আসাদের বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সৈন্যদের যুদ্ধে একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মসজিদটির একটি মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে তা পুনর্নির্মাণ করা হয়।

খলিদ ইবনে ওয়ালিদ মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত
খলিদ ইবনে ওয়ালিদ মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

খালিদ ইবনে ওয়ালিদ মসজিদ

মহাবীর সাহাবি খালিদ ইবনে ওয়ালিদের স্মরণে নির্মিত এই মসজিদটি সিরিয়ার হোমস শহরে অবস্থিত। ১৩ শতকে মামলুক শাসনামলে প্রথম নির্মিত হলেও পরবর্তীকালে অটোমান শাসকদের সময় পুনর্নির্মাণ করা হয়। মসজিদের পাশে খালিদ ইবনে ওয়ালিদের কবর অবস্থিত, যা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।

খালেদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি। তাঁকে ‘সাইফুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর তরবারি’ উপাধিতে ভূষিত করেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। সামরিক কৌশল, বুদ্ধিমত্তা ও অদম্য সাহসিকতার কারণে তিনি অপ্রতিরোধ্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর স্মৃতি অম্লান করে রাখতে তাঁর সমাধির পাশে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর দুটি সুউচ্চ মিনার ও বিশাল গম্বুজ ইসলামি স্থাপত্যের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলে। এর নকশায় মামলুক ও অটোমানশৈলীর সংমিশ্রণ দেখা যায়।

২০১১ সালে হোমস শহরটি মুক্তিকামী ও সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল ছিল। ২০১৩ সালে সরকারি বাহিনীর বোমাবর্ষণে মসজিদটির প্রধান গম্বুজ, মিনার ও খালিদ ইবনে ওয়ালিদের সমাধি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধ শেষে মসজিদটি পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হলেও এর ঐতিহাসিক কাঠামো অনেকটাই হারিয়ে যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কারা পরিদর্শক হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক

টিউলিপ সিদ্দিকের পতন ঘটাতে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ রাজনীতির আঁতাত

ট্রাম্পের অভিষেক: সি আমন্ত্রণ পেলেও পাননি মোদি, থাকছেন আরও যাঁরা

ট্রাম্পের শপথের আগেই বার্নিকাটসহ তিন কূটনীতিককে পদত্যাগের নির্দেশ

কিশোরগঞ্জে বিএনপি নেতা হত্যা: সাবেক চেয়ারম্যানসহ গ্রেপ্তার ৪

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত