Ajker Patrika

বাবার হাতে ইউটিউবার তিবা আলী খুন, ইরাকে নারীবিদ্বেষই এর কারণ?

আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫: ০৫
বাবার হাতে ইউটিউবার তিবা আলী খুন, ইরাকে নারীবিদ্বেষই এর কারণ?

তারুণ্য-সজীবতায় ভরা চঞ্চল স্বভাবের ইউটিউবার তিবা আল-আলি। নিজের জীবনের মজাদার ভিডিও তৈরি করে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাই তাঁর জীবন কেড়ে নিল। অনার কিলিং বা পরিবার ও সমাজের মুখ রক্ষায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তিনি। বাবা তাঁকে খুন করেছেন।

২০১৭ সালে ১৭ বছর বয়সে ইরাক থেকে তুরস্কে গিয়েই ইউটিউবে ভিডিও বানানো শুরু করেন তিনি। সেখানে নিজের স্বাধীনতা, বিয়ে, মেকআপসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নিজ দেশ ইরাকে যান তিবা। সেখানে বাবার সঙ্গে নানা বিষয়ে মতের মিল হয়নি তাঁর। তাতেই জীবনের যবনিকাপাত হলো। বাবার হাতেই মৃত্যু হয় তিবার।

এই ইউটিউবারের বাবা তায়িপ আলিকে মাত্র ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন দেশটির আদালত। বাবার হাতে তিবার মৃত্যু, অনার কিলিংয়ের বিষয় নিয়ে আদালতের রায়ের পর দেশটিতে শুরু হয় বিক্ষোভ। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরাকে নারীদের কোন চোখে দেখা হয়, তা তিবার মৃত্যুর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছে। সেখানে এখনো কোন মাত্রায় রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে, তাও তুলে ধরা হয়েছে।

ইরাক ছেড়ে তুরস্কে যাওয়া কিংবা সিরীয় বংশোদ্ভূতকে বিয়ে—এসবের কিছুই মানতে পারেননি তিবার বাবা। বাবার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিবা। ৩১ জানুয়ারি শ্বাসরোধে তিবাকে হত্যা করেন তায়িপ আলি। এরপর পুলিশের কাছে নিজেই ধরা দেন। এপ্রিলে মাত্র ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয় তায়িপ আলিকে।

তিবাকে হত্যার পর অনার কিলিং নিয়ে বিদ্যমান আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানিয়ে আসছে হাজার হাজার নারী। মৃত্যুর পর তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিনই ভিডিও পোস্ট করতেন তিনি। তুরস্কে যে স্বাধীনতা ভোগ করতেন তা যে ইরাকে সম্ভব নয়, সে কথাও বলেছেন তিনি।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতা ও অপরাধের ক্ষেত্রে অনার কিলিং বা সম্মান রক্ষার্থে খুনের শাস্তি প্রশমিত করাকে অনুমোদন করে ইরাক। কোনো উসকানি কিংবা ‘সম্মান রক্ষার’ উদ্দেশ্য থাকলে সেই খুনের শাস্তি কমানোর কথা বলা হয়েছে।

ইরাকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেনারেল সাদ মান বলেন, ‘তিবা আল-আলি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। আইনের দৃষ্টিতে এটি একটি অপরাধমূলক দুর্ঘটনা এবং অন্যভাবে দেখলে, এটা অনার কিলিং। ঘটনার আগের দিন তিবা ও তার বাবার মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছিল। স্থানীয় পুলিশকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।’

এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অবস্থান জানতে চাইলে জেনারেল সাদ মান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে বিষয়টি দেখছে, সঙ্গে সঙ্গে আইনের প্রয়োগও ঘটিয়েছে। তারা প্রাথমিক ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে, সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ করেছে এবং সাজা দেওয়ার জন্য ফাইলটি বিচার বিভাগের কাছে পাঠিয়েছে।

তিবার মৃত্যু এবং তাঁর বাবাকে দেওয়া লঘুদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ইরাকের হাজারো নারী। ইরাকের আইনে পারিবারিক সহিংসতা থেকে মেয়ে ও নারীদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা নেই জানিয়ে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন করেছেন নারী অধিকার কর্মীরা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরাকের দণ্ডবিধির ৪১ অনুচ্ছেদে ‘স্বামীর দ্বারা স্ত্রীর শাস্তি’ এবং ‘বাবা-মায়ের দ্বারা...নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের কর্তৃত্বাধীন শিশুদের শাসনকে’ আইনগত অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৪০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর স্ত্রীকে পরপুরুষের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায় এবং অবিলম্বে তাঁদের একজন বা দুজনকেই হত্যা করে, বা তাদের মারধর করে পঙ্গু বানিয়ে ফেলে; তবে তার শাস্তি তিন বছরের বেশি হবে না।

নারী অধিকারকর্মী ড. লেয়লা হুসেইন বিবিসিকে বলেন, এসব খুনের উৎস নারীবিদ্বেষ এবং নারীদের শরীর ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা। ‘অনার কিলিং’ শব্দটির ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই ভিকটিম এবং তাদের পরিবারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই শব্দ ব্যবহার করে ‘ভিকটিম তার মৃত্যুর জন্য নিজেই দায়ী, খুব বাজে কোনো কাজ করে তার মৃত্যু হয়েছে’—এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, প্রতিবছর অনার কিলিংয়ের শিকার হয়ে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা খুন হন বিশ্বের প্রায় ৫ হাজার নারী।

তিবার মৃত্যুর পাঁচ দিন পর বাগদাদের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কোর্টের সামনে বিক্ষোভরত ২০ জন নারী অধিকারকর্মীকে আটক করেছে ইরাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিক্ষোভকারীদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘নারী হত্যা বন্ধ করুন। নারীদের হত্যা করায় কোনো সম্মান নেই।’

ইরাকের মানবাধিকারকর্মী রুয়া খালাফের মতে, তিবার বাবাকে দেওয়া শাস্তি অন্যায়। এবং তিনি এজাতীয় মামলাকে নারী অধিকার লঙ্ঘনকারী বিধান এবং আইনের প্রমাণ হিসেবে দেখেছেন। খালাফ বলেন, ‘ইরাকি আইনের ব্যাপক উন্নতি, সংশোধন এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান অত্যন্ত জরুরি।’

নারী অধিকারকর্মী ইরাকি আইনজীবী হানান আবদেল খালেক বলেছেন, ‘একটি সমাধান খুঁজে বের করতেই হবে। নারী হত্যা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। নারীদের হত্যা করা এখন খুবই সহজ হয়ে গেছে। শ্বাসরোধ, ছুরিকাঘাত করা এখানে অনেক সহজ। আমরা আশা করি, ৪০৯ নম্বর ধারাটি বাতিল করা হবে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নারীরা বলেছেন, তিবা হত্যা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তা ছাড়া, অনেক অনার কিলিংয়ের ঘটনা প্রকাশ পায়নি। নারীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইনের ধারা আরও কঠোর করার দাবি কেবল ইরানেই নয়, উঠেছে বিশ্বের নানা দেশেও।

ইরাকি পার্লামেন্টে কুর্দিস্তান ব্লকের প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়নের প্রধান আলা তালাবানি বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে নারীরা আইনি বাধা এবং সরকারি পদক্ষেপের অনুপস্থিতির কারণে পশ্চাৎপদ প্রথার কাছে এখনো জিম্মি। বর্তমানে পারিবারিক সহিংসতা যে আকারে হচ্ছে, তা হ্রাস করার জন্য আইনি বাধা এবং সরকারি পদক্ষেপের অনুপস্থিতি কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’

পরিবারের সদস্যদের হত্যাসহ গুরুতর শারীরিক সহিংসতা থেকে রক্ষায় পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনের খসড়া পাস করার আহ্বান জানান তিনি।

তিবা হত্যাকে ‘ঘৃণ্য’ আখ্যা দিয়ে ইরাকে জাতিসংঘের মিশন বলেছে, ইরাকে এখনো নারীদের প্রতি সহিংসতা ও অবিচারের সংস্কৃতি যে কতটা শক্তিশালী, এ ঘটনা সেটাই প্রকাশ করে। সেই সঙ্গে, নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে আইন ও নীতিগুলোকে সমর্থন করা, এই ধরনের অপরাধের সব অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা এবং নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করার মাধ্যমে দায়মুক্তি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইরাকি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ।

পুরোনো আইনগুলো যে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে নারীদের আর লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে পারছে না, অনেকের কাছেই সেই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করেছে তিবার গল্প। কিন্তু অন্যদের কাছে তিবা কেবল আরও একটি উদাহরণ, যাদের গল্প ঢেকে রাখা হয়; যাদের কথা বলা হয়নি কোনো দিন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার উপকূলে আবার তেলের ট্যাংকার জব্দ করল যুক্তরাষ্ট্র

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
গত সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার উপকূলে একটি বিদেশি তেলের ট্যাংকার জব্দ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: সংগৃহীত
গত সপ্তাহে ভেনেজুয়েলার উপকূলে একটি বিদেশি তেলের ট্যাংকার জব্দ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে ঘোষিত ‘সর্বাত্মক অবরোধের’ অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক জলসীমায় আরও একটি তেলের ট্যাংকার জব্দ করেছে মার্কিন কোস্টগার্ড। আজ শনিবার (২০ ডিসেম্বর) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন মার্কিন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

গত মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন, ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ এবং সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে। তাঁর এমন ঘোষণার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় এই অভিযান চালানো হলো।

এর আগে গত সপ্তাহে একটি বিদেশি তেলের ট্যাংকার জব্দের পর এটি দ্বিতীয় ঘটনা। তবে এই ট্যাংকারের নাম বা নির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে পেন্টাগন বা হোয়াইট হাউস এখনো বিস্তারিত প্রকাশ করেনি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মার্কিন কোস্টগার্ড এই অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে আগের অভিযানকে ‘আন্তর্জাতিক জলদস্যুতা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল মাদুরো সরকার।

এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবরোধ ঘোষণার পর থেকে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানিতে ধস নেমেছে। আটকের ভয়ে ভেনেজুয়েলার জলসীমার ভেতরে কয়েক মিলিয়ন ব্যারেল তেল নিয়ে বহু ট্যাংকার নোঙর করে আছে।

গত সপ্তাহের অভিযানের পর থেকে দেশটির অপরিশোধিত তেল রপ্তানি আরও কমেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই অবরোধ দীর্ঘস্থায়ী হলে দৈনিক প্রায় ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল সরবরাহ বন্ধ হবে। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় এশীয় ও ইউরোপীয় বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামও কিছুটা বেড়েছে।

গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ভেনেজুয়েলা ও কলম্বিয়া উপকূলে ‘মাদকবিরোধী অভিযানের’ নামে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ২৬টি সামরিক হামলা চালিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, এসব হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ১০০ জন নিহত হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো অভিযোগ করেছেন, এই অবরোধ ও সামরিক তৎপরতা আসলে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে ভেনেজুয়েলার বিশাল তেল সম্পদ দখলে নেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা।

ভেনেজুয়েলার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীন। ডিসেম্বরে দেশটি প্রতিদিন গড়ে ৬ লাখ ব্যারেল তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল, যা এখন চরম ঝুঁকির মুখে। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ডেমোক্র্যাট কিছু কংগ্রেসম্যান ‘যুদ্ধের শামিল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সতর্ক করেছেন, শিগগির ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরে স্থল হামলাও শুরু হতে পারে।

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার ওপর জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে দেশটির তেল কিনতে আগ্রহী ব্যবসায়ী ও শোধনাগারগুলো তথাকথিত ‘শ্যাডো ফ্লিট’ ব্যবহার করে আসছে। এসব ট্যাংকার নিজেদের অবস্থান গোপন রাখে এবং অনেক ক্ষেত্রে ইরান বা রাশিয়ার তেল পরিবহনের জন্য নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজ ব্যবহার করা হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভারতে নিকাব বিতর্ক: কাজে যোগ দেননি সেই নারী চিকিৎসক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

সরকারি অনুষ্ঠানে সার্টিফিকেট নিতে আসা এক মুসলিম নারীর মুখ দেখতে নিকাব টান দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ঘটনাটি নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে আজ আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। জানা গেছে, নিকাব বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা সেই নারী চিকিৎসক নুসরাত পারভীন নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে যোগ দেননি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ শনিবার (২০ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তিনি কাজে যোগদান করেননি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাটনার সিভিল সার্জন অবিনাশ কুমার সিং। এমনকি তাঁর বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

পাটনার সিভিল সার্জন জানান, নুসরাত পারভীনের কাজে যোগদানের শেষ সময় ২০ ডিসেম্বরের পর আরও বাড়ানো হয়েছে। তবে নতুন সময়সীমা কত দিন, তা স্পষ্ট করেননি তিনি। সিভিল সার্জন বলেন, ‘তিনি সোমবার যোগ দেন কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।’

নুসরাত পারভীনের পাটনা সদরের সাবলপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। সেখানকার সার্জন বিজয় কুমার জানিয়েছেন, আজ ৫-৬ জন নতুন চিকিৎসক যোগ দিলেও নুসরাতের কোনো খোঁজ নেই। এমনকি সিভিল সার্জন অফিস থেকেও তাঁর নিয়োগপত্র এখনো সেখানে পৌঁছায়নি।

নুসরাত পারভীন পাটনার সরকারি তিব্বি কলেজ ও হাসপাতালের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজের প্রিন্সিপাল মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, নুসরাত সর্বশেষ ১৭ বা ১৮ ডিসেম্বর কলেজে এসেছিলেন।

নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁরা অতিরিক্ত মিডিয়া কাভারেজ এড়াতে চাইছেন। এই বিতর্কের কারণে নুসরাত আদৌ চাকরিতে যোগ দেবেন কি না, তা নিয়ে নতুন করে ভাবছেন।

এদিকে নুসরাতের পরিবার কলকাতায় চলে গেছে বলে যে গুঞ্জন উঠেছিল, তা নাকচ করে দিয়েছেন তাঁর স্বামী। তিনি জানিয়েছেন, তাঁরা সরকারের ওপর নয়, বরং সংবাদমাধ্যমের সৃষ্টি করা বিতর্কে বিরক্ত।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে পাটনায় আয়ুশ চিকিৎসকদের নিয়োগপত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ভিডিওতে দেখা যায়, নুসরাত পারভীন নিয়োগপত্র নিতে মঞ্চে এলে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার তাঁর মুখের নিকাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং একপর্যায়ে তা টেনে সরিয়ে দেন। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়।

বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন বিহারের রাজ্যপাল আরিফ মোহাম্মদ খান। তবে তিনি এই ঘটনাকে ‘বিতর্ক’ বলতে নারাজ। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘বাবা ও মেয়ের মধ্যে কি কোনো বিতর্ক হতে পারে? নীতীশ কুমার নারী শিক্ষার্থীদের নিজের মেয়ের মতো মনে করেন। আপনারা বিষয়টিকে কোথায় নিয়ে গেছেন?’

তবে এর আগেও বিতর্কে জড়িয়েছিলেন নীতীশ কুমার। গত নভেম্বরের বিহার বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এক জনসভায় এক নারীকে মালা পরানোর ভিডিও ভাইরাল হলে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। সে সময় এক জেডিইউ সংসদ সদস্য থামানোর চেষ্টা করলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে ধমক দেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বন্ধু ট্রাম্পকে খুশি করতে মোদির ‘শান্তি’ বিল পাস, বিরোধীদের সমালোচনা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

ভারতের মোদি সরকারের সদ্য পাস হওয়া ‘শান্তি’ বিল নিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। দলের প্রবীণ নেতা ও রাজ্যসভার সংসদ সদস্য জয়রাম রমেশ অভিযোগ করেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করতেই এই বিতর্কিত বিলটি সংসদে জোরপূর্বক পাস করা হয়েছে।

জয়রাম রমেশের দাবি, এই বিলের মাধ্যমে ভারতের পরমাণু খাতে বিদেশি সরবরাহকারীদের দায়বদ্ধতা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা দীর্ঘদিনের জাতীয় ঐকমত্যের পরিপন্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জয়রাম রমেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স অথরাইজেশন অ্যাক্ট (এনডিএএ) ২০২৬’-এর প্রসঙ্গ টেনে আনেন।

তিনি বলেন, ট্রাম্প স্বাক্ষরিত ৩ হাজার ১০০ পৃষ্ঠার ওই মার্কিন আইনের ১৯১২ নম্বর পৃষ্ঠায় ভারতের ‘পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন’ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় পর্যালোচনার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু আমাদের নতুন বিলে সেটা নেই।

জয়রাম রমেশ বলেন, ‘এখন আমরা নিশ্চিত যে প্রধানমন্ত্রী কেন চলতি সপ্তাহেই “শান্তি” বিলটি পাস করার জন্য এত তাড়াহুড়ো করলেন। এটি তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর (ট্রাম্প) সঙ্গে সুসম্পর্ক বা শান্তি ফিরিয়ে আনার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।’

কটাক্ষ করে তিনি বলেন, শান্তি বিলটিকে আসলে ‘ট্রাম্প অ্যাক্ট’ বলা উচিত। এর পূর্ণরূপ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন—‘দ্য রিঅ্যাক্টর ইউস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্রমিজ অ্যাক্ট’।

কী আছে এই ‘শান্তি’ বিলে

মোদি সরকারের দাবি, ‘সাস্টেইনেবল হার্নেসিং অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অব নিউক্লিয়ার এনার্জি ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া (শান্তি বা এসএইচএএনটিআই) বিল-২০২৫’ ভারতের পরমাণু খাতে আমূল পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করবে। এই বিলের মাধ্যমে ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎ খাতে এই প্রথম বেসরকারি কোম্পানিগুলোর প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

গত বুধবার ভারতের পরমাণু শক্তি দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। তাঁর মতে, এই বিলের লক্ষ্য হলো—১৯৬২ সালের পারমাণবিক শক্তি আইনের ভিত্তিতে আধুনিক প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও জ্বালানি বাস্তবতার সঙ্গে ভারতের পারমাণবিক কাঠামোকে আধুনিক করা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই বিল পাস হওয়াকে একটি ‘রূপান্তরমূলক মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেন।

বিলটির মূল লক্ষ্য হলো—ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বাড়ানো। বর্তমানে ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন উৎপাদন সক্ষমতা ৮ দশমিক ২ গিগাওয়াট। মোদি সরকার ২০৪৭ সালের মধ্যে তা ১০০ গিগাওয়াটে নিতে চায়। এ ছাড়া ভারতের ২০৭০ সালের মধ্য নেট জিরো লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং পাশাপাশি ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়ার সঙ্গেও এটি সম্পর্কযুক্ত।

তবে বিরোধীরা বলছেন, নতুন এই বিলের মাধ্যম ১৯৬২ সালের পরমাণু শক্তি আইন ও ২০১০ সালের পরমাণু ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ক বেসামরিক দায়বদ্ধতা আইন (সিভিল লাইয়াবিলিটি ফর নিউক্লিয়ার ড্যামেজ আইন) বাতিল হয়ে গেছে।

বিরোধীদের প্রধান অভিযোগ, নতুন আইনে পারমাণবিক দুর্ঘটনায় সরঞ্জাম সরবরাহকারীর দায়বদ্ধতা-সংক্রান্ত কঠোর ধারাগুলো শিথিল করা হয়েছে। এখন কোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায় মূলত অপারেটরের ওপরই বর্তাবে।

সংসদে বিলটি পাসের সময় কংগ্রেসসহ অন্য বিরোধী দলগুলো দাবি করেছিল, বিলটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হোক। কিন্তু সরকার সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং বিরোধীদের ওয়াকআউটের মধ্যেই বিলটি পাস হয়ে যায়।

বিরোধীদের মতে, ২০১০ সালে যখন ইউপিএ সরকার পরমাণু দায়বদ্ধতা আইন এনেছিল, তখন বিজেপিই সরবরাহকারীর দায়বদ্ধতার দাবিতে অনড় ছিল। এখন সেই বিজেপিই ক্ষমতায় এসে বিদেশি সংস্থাগুলোকে ছাড় দিতে আইন শিথিল করছে, যা জনস্বার্থের পরিপন্থী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গ্রিস উপকূলে মাছধরা নৌকা থেকে বাংলাদেশিসহ ৫৪০ অভিবাসী উদ্ধার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
উদ্ধারকৃতদের মধ্যে বাংলাদেশ, মিশর ও পাকিস্তানের নাগরিক রয়েছেন। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে
উদ্ধারকৃতদের মধ্যে বাংলাদেশ, মিশর ও পাকিস্তানের নাগরিক রয়েছেন। ছবি: রয়টার্সের সৌজন্যে

গ্রিসের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপ গাভদোসের কাছে একটি মাছধরা নৌকা থেকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫৪০ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে দেশটির কোস্ট গার্ড। গ্রিক কোস্ট গার্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গতকাল শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) গাভদোস দ্বীপ থেকে প্রায় ১৬ নটিক্যাল মাইল (২৯.৬ কিমি) দূরে লিবীয় সাগরে নৌকাটি শনাক্ত করা হয়।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্সের টহল জাহাজ প্রথমে নৌকাটি দেখতে পায়। এরপর কোস্ট গার্ডের তিনটি জাহাজ, ফ্রন্টেক্সের তিনটি জাহাজ ও তিনটি বাণিজ্যিক জাহাজের সমন্বয়ে উদ্ধার অভিযান পরিচালিত হয়।

জানা গেছে, উদ্ধার হওয়া ৫৪০ জন অভিবাসীর সবাই বর্তমানে সুস্থ আছেন। তাঁদের উদ্ধার করে নিকটবর্তী ক্রিট দ্বীপের আগিয়া গালিনি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

গ্রিক কোস্ট গার্ডের একজন মুখপাত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, উদ্ধারকৃতদের মধ্যে বাংলাদেশ, মিশর ও পাকিস্তানের নাগরিক রয়েছেন। এ ছাড়া ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ফিলিস্তিনি নাগরিকেরাও এই দলে ছিলেন।

তাঁদের আপাতত ক্রিট দ্বীপের রেথিমনো শহরের একটি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তাঁদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের (Asylum) আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর তোব্রুক থেকে পরিচালিত পাচারকারী চক্রগুলো এখন ইউরোপে প্রবেশের জন্য গাভদোস রুটটিকে বেশি ব্যবহার করছে। ২০২৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই ক্রিট ও গাভদোসে ৭ হাজার ৩০০-এর বেশি অভিবাসী পৌঁছেছেন, যা ২০২৪ সালের পুরো বছরের মোট সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোটাকিস জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের মাঝামাঝি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন অভিবাসন চুক্তি কার্যকর হবে। এর আওতায় যাঁদের আশ্রয়ের আবেদন বাতিল হবে, তাঁদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরত পাঠানোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

উদ্ধারকৃতদের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ, মিসর ও সুদানের নাগরিকেরা এই মরণযাত্রার জন্য পাচারকারী চক্রকে জনপ্রতি দুই থেকে পাঁচ হাজার ইউরো (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২.৫ থেকে ৬ লাখ টাকা) পরিশোধ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত