Ajker Patrika

সিমিকে কী জবাব দেবেন সুইডেন আসলাম

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ২১
সিমিকে কী জবাব দেবেন সুইডেন আসলাম

ব্যস্ত ফার্মগেটে হঠাৎ গুলির শব্দ। সুদর্শন এক তরুণ দুই হাত প্রসারিত করে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর দুই হাতে দুটি অস্ত্র ধরা। সেই অস্ত্র দুটি থেকে খইয়ের মতো গুলি ফুটছে। বেপরোয়া তরুণের কাছে ঘেঁষার সাধ্য কারও নেই। গুলি থেকে বাঁচতে নিরাপদ স্থানে যেতে মরিয়া মানুষ।

এই অবস্থায় পাল্টা গুলি চালালে প্রাণহানি অনিবার্য। দূরে দাঁড়ানো পুলিশের ছোট দলটির প্রধান পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে চুপ হয়ে গেলেন। আর সেই সুযোগে অস্ত্রধারী যুবকটি একটি মোটরবাইকেলের পেছনে উঠে চম্পট দেন।

এ ঘটনা আমাকে বলেছিলেন একসময়ের ডাকসাইটে পুলিশ কর্মকর্তা এসি আকরাম হোসেন। তবে সেই অভিযানে তিনি নিজে ছিলেন না, ছিলেন তাঁর টিমের এক পরিদর্শক। এরপর সেই তরুণ সন্ত্রাসীকে ধরতে প্রায় এক বছর ছক কষেছিলেন তিনি। ধরেছিলেন ১৯৯৭ সালে ২৬ মে বিকেলে পুরোনো ডিওএইচএসের বাসা থেকে। সেই বাসা চিনতেও ফ্রিজ বহন করা একটি ভ্যানের পিছু নিতে হয়েছিল পুলিশকে। নতুন কেনা ফ্রিজ সেই সন্ত্রাসীর বাসায় যাচ্ছে শুনেই ভ্যানের পিছু নিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ।

সেদিনের সেই ভয়ংকর তরুণ এখন কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি সুইডেন আসলাম নামে পরিচিত। আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেলে। তবে কারাগারে থাকলেও লক্ষ্মী ছেলের মতো ভেতরে বসে নেই। মোবাইল ফোনে নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকার অপরাধজগৎ। কারাগারে তাঁর সেল থেকে দুটি মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা হয়েছিল। এসব ফোন দিয়ে তিনি কারাগারের বাইরে থাকা পাণ্ডাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা মামলা করেছিলেন, তাঁদের এবং সেই সব মামলার সাক্ষীদের হুমকি দিতেন। সেই হুমকিতে বাদী ও সাক্ষী আর আদালতে যান না। সাক্ষীর অভাবে বেশির ভাগ মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। এখন বাকি আছে মাত্র একটি মামলা। সেই মামলা থেকে খালাস পেলেই কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন অনায়াসে।

ক্রাইম রিপোর্টিংয়ের সুবাদে প্রায় প্রতিদিন বিকেলের দিকে দল বেঁধে আমরা যেতাম মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে। সেখানে সহকারী পুলিশ সুপার পদের একজন কর্মকর্তা জনসংযোগের দায়িত্বে থাকতেন। তাঁর কক্ষে বসে দিনের বিভিন্ন ঘটনা শুনতাম। দরকার হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলতাম। জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা বসতেন ডিবি অফিসের ভেতরে একটি টিনশেডে। ডিবি অফিসের মূল ভবনের দোতলায় বসতেন দক্ষিণের ডিসি আর নিচতলায় ডিবির ডিসি। নিচের একটি বড় কক্ষের ভেতরে হার্ডবোর্ড দিয়ে ছোট ছোট কক্ষ বানানো। এ রকম একটি কক্ষে বসতেন এসি আকরাম হোসেন। ’৯৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রুবেল খুনের ঘটনায় তাঁর কারাদণ্ড হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর গত বছরের ১৬ জুলাই তিনি মারা যান।

১৯৯৭ সালে ২৬ মে বিকেলে আমরা বসে আছি জনসংযোগ শাখার সহকারী কমিশনার মিয়া আব্দুস ছালামের রুমে। হঠাৎ ওয়াকিটকিতে ব্যাপক শোরগোল। বড় এক আসামি ধরা পড়েছে। ঘণ্টাখানেক পর সেই আসামিকে আনা হয় কড়া পাহারায়। আমরা দৌড়ে গেলাম আকরাম হোসেনের রুমে। দেখি হ্যান্ডকাফ পরা তরুণকে আরও শক্ত করে বাঁধা হচ্ছে। সেই তরুণকে আমরা সহজেই চিনে ফেললাম, তিনিই হলেন সুইডেন আসলাম। এসি আকরাম তাঁর অভিযান নিয়ে সহজে কিছু বলতেন না, সেদিনও বললেন না। তবে তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা সুইডেন আসলামের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম; কিন্তু আসলাম কোনো কথা বললেন না। যা জিজ্ঞাসা করি, মাথা নিচু করে থাকেন। তাঁকে দফায় দফায় রিমান্ডে আনা হলেও মুখ খোলেন না। পরে আমরা খোঁজ করে বের করি ভয়ংকর সব তথ্য। সে কথায় পরে আসি।

আসলামের বাবার নাম শেখ মোহাম্মদ জিন্নাত আলী। পরিবারটির আদি বাস ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার আলগা ইউনিয়নের সাঁথিয়া গ্রামে। তবে পরিবারের কেউ এই গ্রামে থাকেন না। আসলামের বাবা-চাচারা স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকার ইন্দিরা রোডে বসবাস শুরু করেন। স্বাধীনতার পর জিন্নাত আলী ফার্মগেটে রড-সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে আসলাম দ্বিতীয়।

আসলাম এসএসসি পাস করেন তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুল (বর্তমানে তেজগাঁও সরকারি বিদ্যালয়) থেকে। স্কুলজীবনে তিনি ভালো ফুটবল খেলতেন। আন্তজেলা স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতায় খেলেছেন। তেজগাঁও কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েই বনে যান উঠতি রংবাজ। সে সময় ফার্মগেট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন আজাদ-বাপ্পি নামে দুই ভাই। একদিন ফার্মগেটের নিউ স্টার হোটেল থেকে বাপ্পিকে জোর করে তুলে নিয়ে যান আসলাম ও তাঁর লোকজন। এরপর মারধর করে রাস্তায় ফেলে দেন। এতে দুই ভাইয়ের পতন ঘটে, উত্থান হয় আসলামের। শাকিল নামের এক কিশোর হত্যার মধ্য দিয়ে আসলামের এই কাজে হাতেখড়ি বলে অভিযোগ আছে। ১৯৮৭ সালে পূর্ব রাজাবাজার নাজনীন স্কুলের ভেতরে মায়ের সামনে খুন হয় শাকিল। তখন সুইডেন আসলামের সঙ্গে ছিলেন পূর্ব রাজাবাজারের সুমন ওরফে চাংখা সুমন, ব্যাটারি বাবু ওরফে কিলার বাবু, মণিপুরিপাড়ার বিআরটিসি কোয়ার্টারের আমজাদ হোসেন, পূর্ব রাজাবাজারের বাবু এবং কলাবাগানের সাবু।

ফার্মগেট এলাকায় সে সময় চাইনিজ নামের আরেক সন্ত্রাসীর বেশ নামডাক ছিল। তাঁর সহযোগী ছিলেন শাকিল। চাইনিজের সঙ্গে সম্পর্ক করতে তাঁর সুইডেনপ্রবাসী বোন ইতিকে বিয়ে করেন সুইডেন আসলাম। চাইনিজ তাঁর বোনের সঙ্গে সুইডেনে চলে গেলে শাকিলকে নৃশংসভাবে খুন করেন আসলাম। এরপর তিনিও স্ত্রীর কাছে সুইডেনে চলে যান। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই সম্পর্কে চিড় ধরে। সুইডেনেই ইতির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় আসলামের। ইতি ঢাকায় এসে মামুন নামের এক সন্ত্রাসীকে বিয়ে করেন। আসলামের সহযোগীরা এর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। ’৯৫ সালের মে মাসে পুরান ঢাকার সন্ত্রাসী আগা শামীমের আস্তানায় সমঝোতার কথা বলে মামুনকে ডাকা হয়। মামুন সেখানে যান ভারতীয় সন্ত্রাসী গোপাল কর ও নুরুল ইসলামকে নিয়ে। আসলামের লোকেরা সেখানেই তাঁদের তিনজনকে গুলি করে খুন করেন। ২০০৪ সালের জুন মাসে এ মামলার রায় হয়। সন্ত্রাসী আগা শামীমের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও আসলাম এ মামলা থেকে খালাস পান। সে সময় মামুন ও ইতির বিয়েতে সহায়তা করেছিলেন আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুল। একদিন মধুবাগের মাঠে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিপুলের দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে আসলাম তাঁকে খুন করান বলে অভিযোগ। বিপুলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কলাবাগানের কিসলুকেও মেরে ফেলা হয়। আসলামের আরেক সহযোগী ছিলেন গাব্বু। তাঁর স্ত্রী আসমা একবার পুলিশকে আসলামের গতিবিধির কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন তেজগাঁও রেললাইনের বস্তিতে গাব্বুর সামনেই তাঁর স্ত্রী আসমাকে বুকে গুলি করে খুন করা হয়। তখনো মূল অভিযোগ ছিল আসলামের দিকে। মিরপুরে রানা, সাজ্জাদ, টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতা শামীম তালুকদারও তাঁর হাতে খুন হয়েছিলেন। নিজের সাম্রাজ্য ঠিক রাখতে কারওয়ান বাজারের পিচ্চি হান্নান, মগবাজারের সুব্রত বাইন ও টিক্কার সঙ্গে এক হয়েছিলেন আসলাম। তখন শোনা যেত, বিএনপির এক নেতার প্রশ্রয় পাচ্ছিলেন আসলাম। অবশ্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার তাঁকে শীর্ষসন্ত্রাসী ঘোষণা দিয়ে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে।

এটা মনে আছে, সুইডেন আসলাম গ্রেপ্তারের পর তাঁর সাবেক স্ত্রী ইতি তাঁর মাকে নিয়ে ভোরের কাগজের তৎকালীন ক্রাইম রিপোর্টার পারভেজ খানের কাছে এসেছিলেন তাঁর ওপর নির্যাতন ও সম্পদ লুটপাটের অভিযোগ জানাতে। পরে পারভেজ খান তাঁদের ইস্কাটনের জনকণ্ঠ ভবনে আমার কাছে নিয়ে আসেন। ইতির করা অভিযোগের ভিত্তিতে জনকণ্ঠে রিপোর্টও হয়। ইতি আমাকে বলেছিলেন, তিনি সুইডেন আসলামকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে ফেরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, আসলাম মনে করতেন, হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিলেই তাঁকে মরতে হবে। ইতির বিষয়ে দুই দিন আগে কথা বলেছিলাম সুইডেন আসলামের এক চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি আমাকে বললেন, ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ইতি সুইডেনে চলে যান। সেখানে বিষাদগ্রস্ত হয়ে একপর্যায়ে আত্মহত্যা করেন।

এই লেখার জন্য সুইডেন আসলামের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের হালনাগাদ তথ্য নিয়েছিলাম গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে। তাতে দেখা গেল, বিভিন্ন সময়ে সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে ২২টি মামলা হয়েছে, যার ৯টি হত্যা মামলা। বাকিগুলো অপহরণ ও চাঁদাবাজি। অস্ত্র আইনের দুটি মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন এবং ১৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। পরে এসব মামলায় তিনি উচ্চ আদালত থেকে অব্যাহতি পান। এখন তাঁর বিরুদ্ধে আছে শুধু একটি হত্যা মামলা। সেটা হলো গালিব হত্যা মামলা। এই খুনের পরই গ্রেপ্তার হন আসলাম। মাহমুদুল হক খান গালিব ছিলেন তেজগাঁওয়ের যুবলীগের নেতা। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ তেজকুনিপাড়ার বাসার সামনে খুন হন। এ মামলার আসামি শাহীন আদালতে জবানবন্দি দিয়ে বলেছিলেন, সুইডেন আসলামের উপস্থিতিতে দেলু ও মাসুদ গুলি করে খুন করেন গালিবকে। গালিবের স্ত্রী শাহেদা নাসরিন শম্পা তেজগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন। কিন্তু আসলামের ভয়ে এই মামলার সাক্ষীরা আর আদালতে যান না। ২৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৪ জন। এই একটি মামলাতেই আসলামের জামিন হয়নি।

ইতির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর আসলাম তাঁর চাচা শেখ মো. আবদুল লতিফের মেয়ে সিমিকে বিয়ে করেন। সিমি এখন তাঁর ছোট বোন শ্যামলী আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ইন্দিরা রোডের বাড়িতেই থাকেন। গত বৃহস্পতিবার তাঁর বাসায় গিয়েছিলেন তরুণ রিপোর্টার শাহরিয়ার হাসান। কিন্তু স্বামী সম্পর্কে কোনো কথা বলতে চাননি সিমি। এত দিন পর এই পরিচয়ে তিনি কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না, এই পরিচয়ও বহন করতে চান না। সারাক্ষণ থাকেন অজানা এক আশঙ্কায়।

সিমি এখন একাকী। তিনি বিশ্বাস করেন, বাকি জীবন আসলামকে জেলেই কাটাতে হবে। তাঁর সঙ্গে ছোট বোন শ্যামলীও বললেন, ‘মামলাগুলো যে অবস্থায় থাকুক না কেন, তিনি যে কখনো জেল থেকে বের হতে পারবেন, এটা আর আমাদের বিশ্বাস হয় না।’

সিমির কাছে প্রশ্ন ছিল, এমন একজন ভয়ংকর সন্ত্রাসীর সঙ্গে জীবন বেঁধে কী পেলেন, তাঁর হিসাব কষেছেন? সিমি কোনো জবাব দেন না, শূন্যের দিকে চেয়ে থাকেন, সেই প্রশ্নের জবাব হয়তো তাঁর নিজের কাছেও নেই। 

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ: জেএমবির সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে পরিচালক গ্রেপ্তার হন দুবার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৪
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় গত শুক্রবার সকালে একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। মাদ্রাসাটি শেখ আল আমিন নামের এক ব্যক্তি পরিচালনা করতেন। যিনি এর আগে নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাতটি মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, ভবনটি বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, হাসনাবাদ বাজারের ফলপট্টি গলিতে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিশুদের পাঠদান করা হয়। বিস্ফোরণে চার কক্ষের একতলা ভবনটির পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে, সিঁড়ির পাশের ছাদের একাংশ উড়ে গেছে এবং সব কটি কক্ষের পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের ক্রাইম সিন ইউনিটের কর্মীরা আলামত সংগ্রহ করছেন। তাঁরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। ভবনের পাশের একটি ভবনের দোতলার দেয়ালে বিস্ফোরণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরণে পাশের একটি অটোরিকশার গ্যারেজের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিনের নিচে চাপা পড়েছিলেন গ্যারেজের ম্যানেজার আবুল কালাম।

আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত বিকট শব্দ হয়েছে যে আমার কানে তব্দা লেগে যায়। আমি টিনের নিচে চাপা পড়ি। পরে হামাগুড়ি দিয়ে বের হই। এরপর দেখি মাদ্রাসার মধ্যে আগুন জ্বলছে। যারা ভেতরে ছিল, তারা দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়ে চলে যায়।’

গ্যারেজের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আমিও বাসা থেকে দৌড়ে আসি। আমার গ্যারেজের দুজন অটোচালক দুই শিশুকে ওই ভবন থেকে বের করেন। এক নারী আর এক শিশুকে নিয়ে চলে যায়। এ সময় আল আমিনও দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন এসে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।’

মাদ্রাসার পাশের ৫ তলা বাড়ির বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হয়েছিল ভূমিকম্প। কারণ, বিস্ফোরণে সব ভবনে কাঁপুনি লাগে। সবাই চিৎকার করেছিল।’

ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘মাদ্রাসাটিতে ৩০-৩৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তবে শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’

ভবনটির পশ্চিম পাশের এক পাশে তিনটি কক্ষে মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অপর পাশের একটি কক্ষে পরিচালক শেখ আল আমিন (৩২), তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৮) এবং তাঁদের তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকতেন। বিস্ফোরণে দুই ছেলে উমায়েত (১০) ও আবদুল্লাহ (৭) আহত হয়। এর মধ্যে আছিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

পাশের ভবনের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমাদের ভবনের কিছু অংশ ফেটে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবও ভেঙে পড়েছে।’

ঘটনাস্থলেই পুলিশ হেফাজতে বসে ছিলেন ভবনমালিক পারভীন বেগম। ভবনের জমি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে লিবিয়ায় থাকা তাঁর দুই ছেলে এই ভবন ২০২২ সালে তৈরি করেন। এরপর হারুন অর রশীদ নামের এক ব্যক্তি এটি মাদ্রাসা করবেন বলে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুফতি হারুন অর রশীদ মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। হারুন তাঁর শ্যালক আল আমিন ও শ্যালকের স্ত্রী আছিয়াকে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় আসতেন। আমি নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ এসে দেখি, ভবনের চারপাশ উড়ে গেছে।’

পারভীন বেগমের পাশেই ছিলেন তাঁর ছোট মেয়ে সোহানা। তিনি বলেন, ‘ভাড়া নেওয়ার সময় শুধু হারুন অর রশীদ একাই এসেছিলেন। এরপর তাঁরা মাদ্রাসা পরিচালনা শুরু করেন। তবে তাঁরা আশপাশের কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না।’

পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে কেমিক্যাল, ককটেল, ভেস্ট ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, কোনো বিস্ফোরক তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে গতকাল বিকেলে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শেখ আল আমিন পলাতক রয়েছেন। তবে কেরানীগঞ্জ থেকে তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম, আছিয়ার ভাই হারুনের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার এবং ঢাকার বাসাবো থেকে আসমানী খাতুন নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, আল আমিনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগে ২০১৭ ও ২০২০ সালে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আসমানী খাতুনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত