Ajker Patrika

যুক্তরাষ্ট্রের সুতি ট্রাউজারের বাজারে শীর্ষ রপ্তানিকারক বাংলাদেশ, ধারে কাছে নেই কেউ

যুক্তরাষ্ট্রের সুতি প্যান্টের বাজারে বাংলাদেশের জায়গা দখলের অবস্থানে নেই কোনো দেশ। প্রতীকী ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের সুতি প্যান্টের বাজারে বাংলাদেশের জায়গা দখলের অবস্থানে নেই কোনো দেশ। প্রতীকী ছবি

পুরুষদের সুতি প্যান্ট, ওভারঅল এবং শর্টস বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সারা বছরই এসব পোশাকে চাহিদা স্থিতিশীল থাকায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এসব পোশাক সরবরাহে মূল ভূমিকা পালন করে।

তবে প্রতিযোগিতার মাত্রা নির্ভর করে মূল্য নির্ধারণ, বাণিজ্যনীতি এবং উৎপাদন দক্ষতার ওপর। চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফাইবার টু ফ্যাশন বাজারের পরিবর্তিত অবস্থানে প্রধান রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান পর্যালোচনা করেছে। যেখানে দেখা গেছে, চীনের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপিত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য মার্কিন বাজারে এই পণ্য রপ্তানিতে আরও বড় অংশ দখলের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

পুরুষদের সুতি প্যান্ট, ওভারঅল ও শর্টস উৎপাদনে বাংলাদেশ অসাধারণ প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতা অর্জন করেছে, যার প্রতিফলন দেখা যায় রিভিলড কম্প্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজেস বা তুলনামূলক সুবিধার সূচকে (আরসিএ—আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ব্যবহৃত একটি সূচক, যা বাণিজ্য প্যাটার্নের ওপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদন ও রপ্তানিতে একটি দেশের আপেক্ষিক শক্তি পরিমাপ করে।)। এই সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট ১৩১ দশমিক ৯১। এর মানে হলো, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এই পণ্য উৎপাদনে বিশেষভাবে দক্ষ।

বাংলাদেশ প্রতি কেজি মাত্র ১৩ দশমিক ৫৩ ডলার ইউনিট মূল্য বা ইউভিআর (ইউভিআর—ইউনিট ভ্যালু রিয়ালাইজেশন বলতে বোঝায় রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের প্রতি ইউনিটের দামের অর্থনৈতিক মূল্য। অর্থাৎ, প্রতি একক রপ্তানি করে কত টাকা পাওয়া গেল, সেটাই ইউনিট ভ্যালু রিয়ালাইজেশন।) নিশ্চিত করে এই পণ্য সরবরাহ করছে, যা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। আরসিএ-এর উচ্চমান ও কম ইউভিআর-এর কারণে বাংলাদেশ এই খাতে শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে আধিপত্য ধরে রেখেছে। কম খরচে উৎপাদন ও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ বাংলাদেশকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে রেখেছে।

মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মেক্সিকো। কিন্তু দেশটির আরসিএ মাত্র ১ দশমিক ০৫ হওয়ায় দেশটি খুব একটা শক্ত প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিতে পারে না ক্রেতাদের। এ ছাড়া, মেক্সিকোর বাংলাদেশের তুলনায় বেশি, প্রতি কেজিতে ১৪ দশমিক ৬৪ ডলার। ফলে মূল্য প্রতিযোগিতায় মেক্সিকো অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থানে আছে।

অধিকন্তু, ২০২৫ সালের ৪ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে (যদিও যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো রপ্তানি চুক্তির আওতাভুক্ত পণ্য এতে অন্তর্ভুক্ত নয়)। এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মেক্সিকোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা আরও কমে যাবে, বিশেষ করে বাংলাদেশ যখন কম খরচে সুতি পোশাক সরবরাহ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি হওয়ায় মেক্সিকো কিছুটা সুবিধা পেলেও শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এটি পুরো বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এই পণ্যের অন্যতম উৎপাদক দেশ ভিয়েতনাম বাজার সম্প্রসারণে আগ্রহী হলেও উচ্চ মূল্যের চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ভিয়েতনামের আরসিএ ২ দশমিক ০৭, যা একটি মাঝারি প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নির্দেশ করে। তবে দেশটির ইউভিআর অত্যন্ত বেশি, প্রতি কেজিতে ব্যয় ২০ দশমিক ৬৩ ডলার, যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। যদিও সরবরাহ চেইন দক্ষতার কারণে লজিস্টিকস পারফরম্যান্স সূচকে (এলপিআই) সূচকে ভিয়েতনাম কিছুটা এগিয়ে, তবে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধার ঘাটতি ও উচ্চ মূল্যের কারণে এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দুর্বল অবস্থানে আছে।

শক্তিশালী প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা থাকার পরও বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে পাকিস্তান। পাকিস্তান উচ্চ আরসিএ, ৫৪ দশমিক ০৫ নিয়ে এই বাজারে শক্ত প্রতিযোগী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশটির ইউভিআর প্রতি কেজিতে ১২ দশমিক ৮০ ডলার, যা বাংলাদেশের তুলনায় সামান্য কম, তবে তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী। কম খরচের কারণে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে।

চীন প্রতিযোগিতায় দুর্বল এবং শুল্ক চাপের কারণে আরও সংকটে পড়েছে। চীনের আরসিএ মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬, যা দেখায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনের প্রতিযোগিতা অনেকটাই দুর্বল। তবে চীনের ইউভিআর অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম, মাত্র ৯ দশমিক ২৩ ডলার প্রতি কেজি।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির ফলে চীনের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা কমে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত চীনা রপ্তানির ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। ৪ মার্চের পর এই শুল্কহার ২০ শতাংশে উন্নীত হবে। ফলে চীনা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে পড়বে।

প্রথম দফায় ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে চীনের ইউভিআর বেড়ে প্রতি কেজিতে ১০ দশমিক ১৫ ডলারে দাঁড়াতে পারে, যার ফলে উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। পরের ধাপে ২০ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে ইউভিআর আরও বেড়ে ১১ দশমিক ০৮ ডলার প্রতি কেজি বা তার বেশি হতে পারে। এর ফলে চীনের তুলনামূলক কম দামি পণ্যও উচ্চমূল্যের পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে, যা প্রতিযোগিতায় তাদের আরও পিছিয়ে দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ শীর্ষে আছে। কারণ, বাংলাদেশ একই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি আরসিএ ১৩১ দশমিক ৯১ ও বলা চলে, সবচেয়ে (দুই একটি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে) কম ইউভিআর নিশ্চিত করছে। কম খরচে উৎপাদন ও উচ্চ পরিমাণ রপ্তানি সক্ষমতা বাংলাদেশকে এই খাতে সবার থেকে এগিয়ে রেখেছে।

পাকিস্তান প্রতিযোগিতায় শক্ত অবস্থানে থাকলেও, বাংলাদেশের বাজার দখল করা কঠিন। ভিয়েতনাম ও মেক্সিকো উচ্চ ইউভিআর এবং দুর্বল আরসিএ-এর কারণে স্পষ্টতই পিছিয়ে। চলতি বছরের ২ এপ্রিল নতুন শুল্কনীতি ঘোষিত হলে মেক্সিকোর প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা আরও কমে যেতে পারে। চীন তার ঐতিহাসিক অবস্থান হারাচ্ছে। ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বৃদ্ধির ফলে চীনা পণ্যগুলোর খরচ বেড়ে যাচ্ছে, ফলে এটি কম দামি পোশাক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারছে না।

নতুন মার্কিন শুল্ক কাঠামোর আলোকে বাংলাদেশই সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে। কম উৎপাদন ব্যয়, উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে স্থিতিশীল রপ্তানি প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ আরও বড় বাজার শেয়ার দখল করতে সক্ষম হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত