Ajker Patrika

যাদুকাটায় বালু লুটের মহোৎসব

  • হুমকিতে বসতবাড়ি, কৃষিজমি, রাস্তাঘাট।
  • অভিযোগ স্থানীয় বিএনপি ও আ.লীগের লোকজনের বিরুদ্ধে।
  • প্রয়োজনে ইজারা বাতিলের হুঁশিয়ারি জেলা প্রশাসকের।
বিশ্বজিত রায়, সুনামগঞ্জ
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০৭: ০৪
বিন্নাকুলি বাজারসংলগ্ন নদীতীরে নোঙর করা বালু বহনে ব্যবহৃত নৌকা। সম্প্রতি তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিন্নাকুলি বাজারসংলগ্ন নদীতীরে নোঙর করা বালু বহনে ব্যবহৃত নৌকা। সম্প্রতি তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদীতে চলছে বালু লুটের মহোৎসব। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে রয়েছে নদীর তীরবর্তী বসতবাড়ি ও কৃষিজমি থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, ৮৬ কোটি টাকার আরেফিন-অদ্বৈত মৈত্রী সেতু এবং ঐতিহ্যবাহী অদ্বৈত মন্দিরের মতো স্থাপনা। দীর্ঘদিন ধরে ইজারাদার এবং বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের লোকজন মিলে এই নদীতে লুটপাট চালিয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি নেতাদের মিত্র হিসেবে পেয়েছেন ইজারাদারেরা। বিশেষ করে সম্প্রতি (৭-১১ অক্টোবর) প্রায় শতকোটি টাকার বালু লুটের ঘটনায় স্থানীয়রা হতভম্ব।

যাদুকাটা নদীর উৎপত্তি ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ে। তাহিরপুর উপজেলার বারেকটিলা ও লাউড়গড়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা এই নদী একসময় ছিল মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৫৭ মিটার প্রশস্ত। কিন্তু বছরের পর বছর অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে এর গড় প্রস্থ এখন এক কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। ইজারাদার ও স্থানীয় রাজনীতিকদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশের বিরুদ্ধেও এই লুটপাটে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে ১৪ অক্টোবর তাহিরপুর থানায় বালুমহাল ও বালু ব্যবস্থাপনা আইনে মামলা করেন ইজারাদারের লোকজন। যদিও এটিকে লোকদেখানো বলছেন স্থানীয়রা। একই দিন থানার এসআই পংকজ দাশ বাদী হয়ে আরও চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ১৬ অক্টোবর সুনামগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাইমিনুল হক ৩৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ২০ জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করেন। এই মামলায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালীদের নাম উঠে এসেছে।

আসামিদের মধ্যে রয়েছেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আফতাব উদ্দিন, তাঁর ভাই উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রাকাব উদ্দিন, আওয়ামী লীগ নেতা বিশ্বজিৎ সরকার এবং নদীর তীরসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা মোশাহিদ আলম ওরফে রানু মেম্বার। রানু মেম্বার এর আগেও একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ ছাড়া অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের আব্দুল কাইয়ুম খেলু মাস্টার, খাজা মাঈন উদ্দিন, আবু বক্কর, বিএনপির রফিকুল ইসলাম, বিএনপি নেতা গোলাপ মাহমুদের চাচাতো ভাই শিপন, শোভন, শাহান, ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি প্রার্থী আব্দুল মান্নান প্রমুখ।

জানা যায়, এই লুটপাটের অগ্রভাগে ছিলেন খেলু মাস্টার ও খাজা মাঈন উদ্দিন। যদিও প্রথমে তারাই বালু সরানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে প্রভাবশালীদের সঙ্গে সমঝোতা করে তাঁরাও বালু লুটে শামিল হন।

স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী আবুল হোসেন বলেন, এখন প্রশাসনের অবস্থা ‘ঠেলার নাম বাবাজি’। নোটিশ দেওয়া, বাঁশের বেড়া দেওয়া; সবই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা। পুলিশ, বিজিবি, প্রশাসন সবাই জানে কারা এসবের পেছনে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইজারাদারের খেয়াল-খুশিতেই সব চলছে।

যাদুকাটা-১ ও যাদুকাটা-২ বালুমহাল নিয়ে দীর্ঘদিন মামলা চলার পর গত ১৯ আগস্ট আদালত শ্রমিকদের স্বার্থে এবং যান্ত্রিক পদ্ধতি ছাড়া বালু উত্তোলনের শর্তে ইজারার পক্ষে রায় দেন। এরপর জেলা প্রশাসন ১০০ কোটি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকায় বালুমহাল ইজারা দেয়। কিন্তু ইজারার শর্ত মানা হয়নি। শ্যালো ইঞ্জিন ও ড্রেজারের মাধ্যমে নদীর বুক ও তীরবর্তী এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে।

গত ২৬ আগস্ট জেলা প্রশাসন ফেসবুকে বালু লুটের আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্ক করলেও তা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়। নিরীহ শ্রমিকেরা জেল-জরিমানার শিকার হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়রা জানান, হাজার হাজার নৌকা নদীর তীরে ঢুকে পাড় কাটছে। ইজারাদার ও প্রভাবশালীরা প্রতি ফুটে ২০ টাকা এবং রয়্যালটি হিসেবে ২৫ টাকা আদায় করছেন।

ইজারাদার শাহ রুবেল আহমদ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা বালু লুট ঠেকাতে পুলিশ ক্যাম্পের আবেদন করেছি। নদীর তীরে বাঁশের বেড়া দিচ্ছি।

সরেজমিনে দেখা যায়, যাদুকাটা যেন এখন তীরহারা এক প্রশস্ত নদী। অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে হাওর-বাঁওড়, চর, ছড়া, শিমুলবাগান, বিজিবি ক্যাম্প, ঘাগটিয়া, লাউড়েরগড়, গড়কাটিসহ ১৫-২০টি গ্রাম বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।

২০০১ সাল থেকে পাড় কাটা শুরু হলেও ২০২১ সালে বালুমহাল ইজারার পর এটি মহোৎসবে পরিণত হয়। ভূমিমালিকেরা জমি রক্ষা করতে না পেরে বাধ্য হয়ে বালুখেকোদের কাছে জমি বিক্রি করছেন, কেউবা বিনামূল্যে ছেড়ে দিচ্ছেন। তাহিরপুর থানার ওসি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘নদীর পাড় কাটার ঘটনায় মামলা হয়েছে। আইনি কার্যক্রম চলছে। পরিবেশ এখন শান্ত।’

সুনামগঞ্জ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল জাকারিয়া কাদির বলেন, গভীর রাতে অবৈধ বালু উত্তোলন ঠেকানো তাঁদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘ইজারাদারকে শোকজ করা হয়েছে। এভাবে চললে ইজারা বাতিল হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ