Ajker Patrika

খুলনায় শিকারিদের দৌরাত্ম্যে ঝুঁকিতে পরিযায়ী পাখির বিচরণ

হিরামন মন্ডল সাগর, বটিয়াঘাটা (খুলনা)
আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৭: ৪৯
শিকারির হাতে ধরা পড়া পরিযায়ী পাখি। সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের বারোআরিয়া এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিকারির হাতে ধরা পড়া পরিযায়ী পাখি। সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের বারোআরিয়া এলাকায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আর শীত পড়তেই এ দেশের জলাশয়, খাল-বিল ও ধানখেতে ভিড় জমাতে শুরু করেছে পরিযায়ী পাখির দল। কিন্তু পাখি শিকারি চক্রের দৌরাত্ম্যে পরিযায়ী পাখির বিচরণ হুমকিতে পড়েছে।

শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, রূপসা, দিঘলিয়া, তেরখাদা, কয়রাসহ দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে পরিযায়ী পাখির আগমন শুরু হয়েছে। আর এসব অঞ্চলের সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাখি শিকারি চক্র। মাঠ, খাল-বিল ধানখেতে রাত-দিন ফাঁদ পাতছে তারা। পাখি ধরতে নানা রকম অপকৌশল তৈরি করছে পাখি শিকারিরা। তারা পাখির ডাক ও সুর নকল করতে সক্ষম এমন বিশেষ যন্ত্র তৈরি করে তা পাখি আকর্ষণের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে। ধানখেতে বসে বিভিন্ন পাখির ডাকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে তারা। এতে উড়ন্ত পাখি বিভ্রান্ত হয়ে আকাশ থেকে নিচে নেমে আসে এবং ফাঁদে আটকা পড়ে। শিকারিরা নাইলনের সুতা দিয়ে ছোট-বড় করে ধানখেতে ও ধানের ওপরে বিছিয়ে রাখছে। এতে ধানখেতে উড়ে আসা পাখি সুতায় আটকা পড়ছে। কেঁচো দিয়ে, বড়শি পেতে, কোচ মেরে এবং কারেন্ট জাল পেতে পাখি শিকার করছে অসাধু শিকারিরা। মোবাইল ফোনে পাখির ডাক রেকর্ড করে বাজায়। পাখিরা এই ডাক শুনে শিকারিদের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে থাকে। তখন শিকারিরা পাখি ধরে ফেলে।

বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে গোপনে পরিযায়ী পাখি বেচাকেনা চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিকারি চক্রের কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন, শীতের শুরুতেই পাখি ধরা শুরু হয়েছে। তবে এবার পাখির সংখ্যা তুলনামূলক কম হওয়ায় দাম অনেক বেশি। জলকচু, ডঙ্কুর, আলতি, বয়া, নীলপরী, কাম, হাঁস পাখি, কড়াসহ বহু নাম না জানা পরিযায়ী পাখি ধরা হচ্ছে। এর মধ্যে ডঙ্কুর ৪০০ টাকা, জল কচু ৩০০, হাঁস পাখি ৩০০ থেকে ৪০০, আলতি ৬০ টাকা, কাম পাখি এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।

জানা গেছে, ডুমুরিয়া উপজেলার শিবনগর, বান্দা, নোয়াকাটি, মাদারতলা, কাঞ্চননগর, বানিয়াখালী, শরাফপুর, জাবড়া, কাঁঠালতলা, বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা এই পাখি বিক্রি হচ্ছে। বটিয়াঘাটা উপজেলার সুন্দরমহল, কৈয়া, উত্তর-দক্ষিণ শৈলমারী, ফুলতলা, গঙ্গারামপুর, আমিরপুর, বিরাট, পুটিমারি, তেঁতুলতলা, হাটবাটিসহ ইত্যাদি স্থানে পাখি বেচাকেনা হয়ে থাকে। পাইকগাছা উপজেলার লতা, সোলাদানা, মুনকিয়া, আলোকদ্বীপ, জামতলা, কাঠামারি, দারুণমল্লিক, সৈয়দখালী, নৈয়াই, গেওয়াবুনিয়া, জিরবুনিয়া, দেলুটি ও আশপাশের হাটবাজারে পাখি বিক্রি হয়ে থাকে।

দাকোপ উপজেলার চালনা বৌমার গাছতলা, বটবুনিয়া, সালতা, বাজুয়া, লাউডোব, লক্ষ্মীখোলা, গড়খালী, কামিনী বাঁশিসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে অর্ডার নিয়ে পাখি বিক্রি করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, পাখি শিকারিদের রয়েছে একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। বিভিন্ন পাখি শিকারি মোবাইল ফোনে অর্ডার নেয় এবং বড় অঙ্কের টাকার বিনিময় গ্রাম থেকে শহরে পাখি সরবরাহ করে থাকে।

স্থানীয় পাখি শিকারি বাবলু, মনি, আক্তারুল ইসলাম, নয়নসহ আরও অনেকে বলেন, পাখি শিকার করা দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও এটি বিক্রি করে ভালো টাকা পান তাঁরা। তাই পাখি শিকার করেন তাঁরা।

বটিয়াঘাটা উপজেলা পাখি সংরক্ষণ পরিষদ ও পাখি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য অলকেশ কুমার সরকার বলেন, ‘পাখি শিকারিদের ধরতে আমরা রাতে ধানখেতে পাহারা দিই। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আমরা পাখির সংরক্ষণসহ অবাধে পাখি শিকার রোধে কাজ করে আসছি। থানা-পুলিশের সহযোগিতায় আমরা আমাদের এই কর্মকাণ্ড চলমান রেখেছি।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি সভাপতি আলকামা রমিন বলেন, একসময় বিশ্ববিদ্যালয় পাখি সংরক্ষণ ও গবেষণা নিয়ে একটি সংগঠন কাজ করত। কিন্তু এখন আর তাদের সেই অ্যাক্টিভিটি নেই।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, পরিযায়ী পাখিসহ দেশীয় পাখি সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, গণসচেতনতামূলক সভা, মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ। পাখি শিকারের ফাঁদ ও জাল কাটা হচ্ছে। গোপন তথ্য প্রদানকারী নিয়োগ করা হয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও হাট-বাজারে বন্য প্রাণী উদ্ধার অভিযান করা হচ্ছে। অপরাধ উদ্‌ঘাটনে (তথ্য প্রদানকারী) পুরস্কার বিধিমালা ২০২০ অনুযায়ী তথ্য দানকারীকে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘অতিথি পাখি শিকার করা আইনের চোখে অপরাধ। শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয়ই হতে পারে। বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী তফসিল ১ ও ২-এ উল্লেখিত কোনো পরিযায়ী পাখি শিকার করলে প্রথমবার সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একই অপরাধ আমার দ্বিতীয়বার করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

লন্ডনে চিকিৎসা যাত্রায় খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী ১৪ জন, তালিকায় ছয় চিকিৎসক ও দুই এসএসএফ

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

ঢাকার তিনটিসহ আরও ২৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা বাকি থাকল

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ