Ajker Patrika

ভূমিকম্পের ঝুঁকি: অপরিকল্পিত নগরায়ণে মৃত্যুফাঁদ রাজধানী

  • ঢাকার ৯৪% ভবনই অবৈধ ও অনুমোদনহীন। বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ৩৫ লাখ ভবনই ধসে পড়বে
  • নগরায়ণে পরিকল্পনা, বিল্ডিং কোড, উন্মুক্ত জায়গা সংরক্ষণের নিয়ম অনুসরণ হয়নি
  • গতকালের ভূমিকম্পকে মহাবিপর্যয়ের পূর্বাভাস বলছেন বিশেষজ্ঞরা
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ৪০
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভূমিকম্পে বিশ্বের যেসব নগরী অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তার একটি হলো ঢাকা। কিন্তু ঝুঁকি নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা অনেক বছর ধরেই বলে আসছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণে দিনে দিনে মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে এই নগরী। শক্তিশালী ভূমিকম্পে যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে ঢাকার অসংখ্য ভবন। গতকাল শুক্রবারের ভূমিকম্পকে মহাবিপর্যয়ের একটি সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখছেন তাঁরা।

ভূতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অবস্থান ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা—এই তিন টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে। বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে টেকটোনিকে বড় ফল্ট আছে। গুলশান লেক থেকে শুরু করে ঢাকা শহরের অনেক এলাকাই ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত। ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার ওপর নির্ভর করে যেকোনো সময় ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প ঢাকাতে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাব্য বিপর্যয় ঠেকাতে রাজধানীতে নেই কার্যকর প্রস্তুতি।

রাজধানীতে গত চার দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। বেপরোয়া হারে বেড়েছে উঁচু ভবন। কিন্তু নগরায়ণ হয়েছে নিছক বাজার চাহিদার ভিত্তিতে; যেখানে পরিকল্পনা, বিল্ডিং কোড, সড়কের প্রশস্ততা বা উন্মুক্ত জায়গা সংরক্ষণ—কোনোটিই যথাযথ অনুসরণ করা হয়নি। বিস্তৃত ফুটপাত, উদ্ধার পথে গলি খোলা রাখা, ভবনগুলোর মধ্যে পর্যাপ্ত দূরত্ব রাখা—এসব নিয়ম কাগজে আছে, বাস্তবে নেই।

রাজউকের নির্দেশনা অনুযায়ী, বহুতল ভবন নির্মাণে ‘সয়েল টেস্ট’ থেকে শুরু করে ‘স্ট্রাকচারাল ডিজাইন’ সবই অনুমোদনসাপেক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অসংখ্য ভবন কোনো প্রকৌশলী ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। অনেক ভবনের নকশা অনুমোদিত নয়, অনেক ভবনে অনুমোদিত নকশার বাইরে অতিরিক্ত তলা যোগ করা হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সমীক্ষা বলছে, ঢাকার ৯৪ শতাংশ ভবনই অবৈধ ও অনুমোদনহীন। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ‘এমন নির্মাণ ঢাকাকে একটি মৃত্যুনগরীতে পরিণত করেছে।’

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখ বাসা রয়েছে। তার মধ্যে ১৫ লাখ একতলা-দোতলা বাসা। চার থেকে ছয়তলা ভবন প্রায় ৬ লাখ। ১০ তলা ও ২০ তলা ভবনও রয়েছে অনেক। একটি বড় ভবন ধসে পড়লে কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা বোঝাতে গিয়ে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।

গতকালের ভূমিকম্পের বিষয়টি তুলে ধরে অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেন, ‘রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের যত স্থাপনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ভূমিকম্প ৭ মাত্রার হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন ভূমিকম্প হলে ২-৩ লাখ মানুষ হতাহত হবে, ঢাকা শহরের ৩৫ শতাংশ ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে, অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকায় ঝুঁকির মাত্রা সবসময় বেশি উল্লেখ করে ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘যে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে, এটি দেশের পটভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের উত্তরে আছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় বাংলাদেশ ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। শক্তি লকড অবস্থায় ছিল, আটকে ছিল। এটা আনলকিং শুরু হয়েছে। এখন পরবর্তীকালে গ্যাপ দিয়ে আবার ভূমিকম্প হতে পারে।’ ঢাকার এত কাছে গত কয়েক দশকে বড় ভূমিকম্প হয়নি বলেও জানান তিনি।

নগর পরিকল্পনাবিদেরা জানান, ঢাকা শহরে হাজার হাজার বহুতল ভবন, কিন্তু কার্যকর ফায়ার সেফটি সিস্টেম রয়েছে মাত্র অল্প কিছু ভবনে। ফায়ার সার্ভিসের তালিকা অনুযায়ী, অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবনেই সিঁড়ি সংকীর্ণ, জরুরি বহির্গমনপথ নেই, ফায়ার হাইড্রেন্ট অকেজো বা নেই। ভূমিকম্পে ভবনের ভেতর আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করতে ফায়ার সার্ভিসকে যে আধুনিক সরঞ্জাম দরকার, তার পরিমাণ নগণ্য।

ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ বা যন্ত্র দুটিই নেই। ভবনের ভেতরে ঢুকতে হবে, কিন্তু বেশির ভাগ ভবনে নিয়মমাফিক সিঁড়ি নেই। তখন হতাহতের সংখ্যা বহুগুণ বাড়বে।’

নির্মাণশ্রমিক থেকে শুরু করে ঠিকাদার, সব স্তরে নিরাপত্তাবিধির প্রতি অবহেলা প্রকট। প্রকৌশলী ছাড়া বহু ভবন নির্মাণ করা হয়, যেগুলো ভূমিকম্পের চাপ সহ্য করার মতো নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক নকশার বদলে দ্রুত কাজ শেষ করতে সস্তা উপকরণ ব্যবহারের প্রবণতা নির্মাণশিল্পে বড় সংকট তৈরি করেছে। রাজউক ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর তদারকি দুর্বল অথবা অনিয়মে জর্জরিত। তাই নিয়মভঙ্গকারী ভবনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গতকালের ভূমিকম্প যদিও সামান্য, তবুও এটি নগরবাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ঢাকা কতটা ভঙ্গুর। ভবন কাঠামোতে যে ফাটলগুলো দেখা গেল, সেগুলো বড় ভূমিকম্পে পুরো ভবন ধসে পড়তে পারে।

ঢাকা শহর দ্রুত উন্নয়নশীল। কিন্তু উন্নয়ন যদি নিরাপত্তাহীনতার ওপর দাঁড়ায়, তবে তা বিপর্যয়ের রেসিপি ছাড়া কিছুই নয়। আজকের ভূমিকম্প ছোট হলেও সতর্কবার্তা বড়। নগরায়ণকে পরিকল্পিত করতে, ভবন নির্মাণে আইন প্রয়োগ করতে এবং উদ্ধার সক্ষমতা বাড়াতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে অদূর ভবিষ্যতে একটি বড় ভূমিকম্পে ঢাকা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, যা ঠেকানোর আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ