Ajker Patrika

লিবিয়ার সৈকতে ২৩ লাশ, রাজৈরে ১০ পরিবারে মাতম

মাদারীপুর প্রতিনিধি
আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩: ২১
ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া টিটু হাওলাদারের বাড়িতে স্বজনদের শোকের মাতম। ছবি: আজকের পত্রিকা
ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া টিটু হাওলাদারের বাড়িতে স্বজনদের শোকের মাতম। ছবি: আজকের পত্রিকা

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ব্রেগার পশ্চিমের আল-আকিলা উপকূলে গত কয়েক দিন আগে অন্তত ২৩ জনের লাশ ভেসে আসে। তাঁরা অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে মারা যান। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১০ পরিবারে পড়েছে কান্নার রোল।

আজ সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে দালালেরা পরিবারগুলোকে জানিয়েছেন, তাঁদের স্বজনেরা আর নেই। এতে ১০ পরিবারসহ উপজেলাজুড়ে নেমেছে শোকের ছায়া।

দালালদের মাধ্যমে ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া ব্যক্তিরা হলেন—মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের চা বিক্রেতা হাসান হাওলাদারের ছেলে টিটু হাওলাদার, গোবিন্দপুরের বাসিন্দা আক্কাস আলী আকনের ছেলে আবুল বাশার আকন, সুন্দিকুড়ি গ্রামের নীল রতন বাড়ৈ-এর ছেলে সাগর বাড়ৈ, একই গ্রামের মহেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাস, গোবিন্দপুরের ফিরোজ শেখের ছেলে ইনসান শেখ, একই গ্রামের আশিস কীর্তনীয়া, বৌলগ্রামের নৃপেন কীর্তনীয়ার ছেলে অমল কীর্তনীয়া, একই গ্রামের চিত্র সরদারের ছেলে অনুপ সরদার, শাখারপাড়ের সজীব মোল্লা ও সাদবাড়িয়ার রাজীব।

তাঁদের সবার বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তাঁরা সবাই মারা গেছেন বলে স্বজনদের মোবাইল ফোনে জানিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন দালালেরা।

পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা ও নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দালালদের খপ্পরে পড়ে গত ১ জানুয়ারি ইতালির উদ্দ্যেশে বাড়ি ছাড়েন মাদারীপুরের রাজৈর পৌরসভার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের চা বিক্রেতা হাসান হাওলাদারের ছেলে টিটু হাওলাদার। সঙ্গে তাঁর মামা একই উপজেলার গোবিন্দপুরের বাসিন্দা আবুল বাশার আকনও যোগ দেন। প্রথমে উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায় পৌঁছান তাঁরা। এরপর গত ২৪ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাত্রা করেন তাঁরা। মাঝপথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান মামা আবুল বাশার ও তাঁর ভাগনে টিটু।

সোমবার সকালে তাঁদের মৃত্যুর খবর আসলে পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। শুধু এই মামা-ভাগ্নেই নন, এই ঘটনায় রাজৈর উপজেলায় মোট ১০ জনের মারা গেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।

কয়েকদিন আগে ২৩ জনের লাশ উদ্ধার করে রেড ক্রস লিবিয়া। লাশগুলো অর্ধগলিত অবস্থায় থাকায় সেগুলো দাফন করা হয়েছে। এদের সবাই বাংলাদেশের নাগরিক বলে লিবিয়ার রেড ক্রিসেন্ট কর্তৃপক্ষের ধারণা।

এই ১০ জনের পরিবারগুলোর প্রায় সবাই চড়া সুদে লাখ লাখ টাকা লোন করে দালালদের হাতে তুলে দেয়। অনেকেই ভিটেমাটি বিক্রি করেও দালালদের টাকা দিয়েছেন। এখন একদিকে পরিবারগুলোতে স্বজন হারানোর শোক, অন্যদিকে ঋণের বোঝা। সব মিলিয়ে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

পরিবারগুলোর দাবি, লাশগুলো দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। প্রিয়জনদের শেষ দেখা দেখতে চান তাঁরা।

ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া নিহত সজীব মোল্যা, টিটু হাওলাদার, আবুল বাশার, আশিষ কীর্ত নীয়া, ইনসান শেখ, সাগর বাড়ৈ, সাগর বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত
ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়া নিহত সজীব মোল্যা, টিটু হাওলাদার, আবুল বাশার, আশিষ কীর্ত নীয়া, ইনসান শেখ, সাগর বাড়ৈ, সাগর বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত

এই ঘটনার মূল হোতা রাজৈর হরিদাসদি গ্রামের স্বপন মাতুব্বর, মজুমদারকান্দি গ্রামের মনির হাওলাদার ও ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার আলীপুরের রফিক দালাল। এই ঘটনায় জড়িত দালালদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন নিহতের পরিবার, স্বজন ও এলাকাবাসী। তবে এই ঘটনার পর থেকেই দালালেরা ঘরবাড়িতে তালা দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন।

নিহত আবুল বাশারের বাবা আক্কাস আলী আকন বলেন, ‘মনির হাওলাদার ও স্বপন মজুমদার এই দুই দালাল ২৮ লাখ টাকা নিয়েছে। তাঁরা আমার ছেলেকে ইতালি পাঠাবে। কিন্তু আমার ছেলের এমন মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এই দালালদের কঠোর বিচার চাই।’

নিহত টিটু হাওলদারের চাচাতো ভাই রেজাউল হাওলাদার বলেন, ‘দালালেরা লোভ দেখিয়ে আমার ভাইকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে দেবে কখনোই ভাবতে পারিনি। দালালের কঠিন বিচার চাই। আর আমার ভাইয়ের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।’

রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাসুদ খান বলেন, ‘ইতালি যাওয়ার সময় লিবিয়ায় রাজৈর উপজেলার ১০ জন যুবক মারা গেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি। নিহতদের পরিবার থেকে লিখিত অভিযোগ দিলে দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ওয়ারেন্টভুক্ত দালালদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়।’

মাদারীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহ মোহাম্মদ সজীব বলেন, ‘নিহত ১০ জনের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। দূতাবাসের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত