Ajker Patrika

যে কারণে আবুল হাসানের কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম

মোশতাক আহমদ
আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২২, ১৭: ৩১
যে কারণে আবুল হাসানের কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম

তাঁর কবিতায় বিপুলসংখ্যক স্মরণযোগ্য পঙ্‌ক্তি আমি পেয়েছি, সম্ভবত এত বেশিসংখ্যক স্মরণযোগ্য পঙ্‌ক্তি আর কোনো কবির রচনাসমগ্রে পাইনি। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, যাঁর কথা বলছি, তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত কবিতার বই ছিল মাত্র তিনটি। নীরবে পেছনে ফেলে গিয়েছিলেন প্রায় সমপরিমাণ অগ্রন্থিত কবিতা আর কিছু অতি তরুণ বয়সের কবিতা, ডজনখানেক অগ্রন্থিত গল্প, একটি কাব্যনাট্য, আরও একটি নিখোঁজ কাব্যনাট্য, আর শতসহস্র চিরকুটে ভাসমান নিরুদ্দিষ্ট একগুচ্ছ কবিতা। কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটি উপন্যাসোপম ডকু-ফিকশন ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লেখার একমাত্র কারণ তাঁর কবিতার ‘উচ্চতা’ নয়। উচ্চতা শব্দটি হাসান হাফিজুর রহমান ব্যবহার করেছিলেন; বলেছিলেন, ‘হাসানের উচ্চতায় তাঁর সমসাময়িক কোনো কবিই পৌঁছাতে পারেননি’। যিনি কেবল একজন কবিই হতে চেয়েছিলেন—আবুল হাসান, সেই কবির নাম।

আবুল হাসান একজন মনোযোগ্য কবি, গবেষণা উপযোগী কবি বলে আমার মনে হয়েছে। সম্প্রতি মনে হলো, আবুল হাসান হচ্ছেন সন্ধি আর সমাসের রাজা–এ নিয়েও গবেষণা হতে পারে। উপমা আর চিত্রকল্পে তো তিনি অঘোষিত রাজা হয়েই আছেন। গবেষণা হতে পারে একুশে সংকলনে প্রকাশিত তাঁর কবিতা নিয়েও, যার অধিকাংশই হয়তোবা এখনো আমাদের চোখের আড়ালে আছে। তো, তাঁকে নিয়ে ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ কেন আর কীভাবে লিখতে বসলাম—প্রশ্নটা আমাকে একাধিক দিনে একাধিক পরিবেশে জিজ্ঞেস করা হলে আমিও প্রতিবারই নতুনভাবে উত্তর দিতে পারব। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, কোনো সংস্করণই মিথ্যাভাষণ হবে না।

আবুল হাসানের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে গত শতাব্দীর চুরাশি সালের দিকে, বিচিত্রার পাতায় বইপত্রের রিভিউ দেখে বাংলাবাজারে বই কিনতে গিয়ে বইয়ের তাকে পাওয়া আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতার মাধ্যমে; সেই থেকে এটি আমার সর্বাধিকবার পঠিত বই। এর পরপরই কবির তিনটি কবিতার বই আমার হাতে আসে। অগ্রন্থিত কবিতার বইয়ের ভূমিকা পড়ে কবিকে জানার আশ মেটে না। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জীবনী গ্রন্থমালা সিরিজে আবুল হাসানের জীবনী আর নির্মলেন্দু গুণের আত্মকথা পড়ে কবি সম্পর্কে আরও জানলাম। তখন আমি নিজে একটি সার্বক্ষণিক কবিজীবন বেছে নিতে না পারা আর বোহিমিয়ান একটি জীবন যাপন করতে না পারার গোপন কষ্টে অভিভূত হতে থাকি। আবুল হাসানের কবিতা হয়ে উঠতে থাকে হৃদয়ের প্রতিবেশী আর তাঁর জীবন আমাকে ক্রমশ করে তোলে ঈর্ষাকাতর।

মোশতাক আহমদমনে পড়ছে, আবুল হাসানের উপরোক্ত বইগুলো প্রকাশ ও পুনঃপ্রকাশের পরপর ১৯৮৮ সাল নাগাদ বাংলাদেশে আবুল হাসানের একধরনের পুনর্জাগরণ শুরু হয়। সেই ঢেউ আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এসেও লাগে। আমি তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কলেজ ক্যাম্পাসে আবুল হাসান স্মরণ অনুষ্ঠানে ‘একজন কবি আবুল হাসান’ প্রবন্ধ লিখে পাঠ করি। একই সময়ে একদিন ঘটনাক্রমে ঢাকায় এসে দেশ প্রকাশনের নয়াপল্টনের অফিসে যাই; সেখানে আবুল হাসানের গল্প সংকলন দেখি, কাব্যনাট্য ‘ওরা কয়েকজন’ দেখি। একই সন্ধ্যায় আবুল হাসানের মানসপুত্র আবিদ আজাদের শিল্পতরু অফিসেও যাই।

আবুল হাসানের কবিতা আমার কর্কশ ও কিঞ্চিৎ আঞ্চলিকতাদুষ্ট উচ্চারণে আনন্দ শংকরের আবহ সংগীত সহযোগে ক্যাসেটবন্দী করে নিজে নিজেই শুনি। কামরুল হাসান মঞ্জুর চিনে বাদামের মতো মচমচে কণ্ঠে ‘বনভূমিকে বলো ওইখানে একজন মানুষ লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে’ শুনতে শুনতে আমিও লিখে ফেলি ‘চিবুক ছুঁয়ে বলেছিলাম/ তোমার চোখে বলেছিলাম/ ভালোবাসি’ (স্মরণ করা যাক হাসানের ‘আমার চোখে বলেছিলাম’ কবিতাটি) কিংবা ‘তোমার সান্নিধ্য যদিবা অগ্নিময়/ রঙিন চোখমুখ নিয়ে অন্য কেউ/ তোমার সামনে বসে থাকুক/ আমি রইলাম নির্বাপিত নিরাপদ’ (স্মরণ করা যাক হাসানের ‘কল্যাণ মাধুরী’ কবিতাটি) ইত্যাদি। এইভাবে কিছুকাল ‘আমার এই নবযৌবনে’ আবুল হাসানের প্রতিধ্বনিময় জীবন যাপন করি।

অভিন্ন ‘সরজুদিদি’ময় শৈশব আমার, ‘স্বাতী’র আবির্ভাব ঘটে গেছে তত দিনে, ‘রোমেনা’রা বুদ্ধদেব বসুর বদলে শীর্ষেন্দুর বই ধার নেয়। বন্ধুরা কবিতা লেখে, গলায় মাফলার পেঁচিয়ে সৈয়দ হকের ‘প্যাটের বিষ’ বা ‘বাসন’ নাটকের রিহার্সাল করে, লেবু চায়ে বাড়তি চিনি চেয়ে নেয়। সামরিক শাসনের দীর্ঘ ছায়ায় আমিও তত দিনে ‘জেনে গেছি রাজনীতি এক কালো হরিণের নাম’। আর নির্মলেন্দু গুণ যেমন হাসানের জন্য এলিজি লিখেছেন, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সে আমাকেও কবিবন্ধু কামরুজ্জামান উবাইদুল্লাহর জন্য দৈনিক পূর্বকোণে ‘কুমুর বন্ধন’ শীর্ষক এলিজি লিখতে হয়! সে মারা গিয়েছিল পিজি হাসপাতালেই, ফুসফুসের ক্যানসারে।

এইভাবে আমি আবুল হাসানকে ধারণ করে বড় হতে থাকি। এ সময়ে আমি লিখে ফেলি ‘আমি কীভাবে আবুল হাসান হতে চেয়েছিলাম’।

আবুল হাসান তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মাহবুব তালুকদারকে ফোন করে প্রেসক্লাবে ডেকে এনে তাঁর নতুন প্রেমের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে এমন একজন এসেছে, তাঁকে পেয়ে আমি ধন্য। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য আমি এই একটা মুখেই খুঁজে পেয়েছি। জীবনে আমি যা কিছু চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি। জীবনের কাছে আমার আর কিছু চাওয়া নাই।’ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘সম্পাদক’ পত্রিকায় পাই, নির্মলেন্দু গুণকে আবুল হাসান চিঠিতে লিখছেন, ‘এখন সেই রমণীও আমাকে আর নিঃসঙ্গতা দিতে পারে না।’ কেউ একজন আমাকে জানালেন, আহমদ ছফার তিনটি সত্যি ঘটনাশ্রিত উপন্যাস আছে, যার একটিতে তিনি আবুল হাসান ও সুরাইয়া খানমের সঙ্গে তাঁর নিজের সম্পর্কের রসায়নের বয়ান করেছেন। আবার খোঁজ খোঁজ পড়ে গেল! এই সব নানা কথার অর্থ জানতে জানতে, নানা কাহিনির সূত্র খুঁজতে খুঁজতে আমি আবুল হাসান সম্পর্কে যেখানে যা পাই, তা-ই ক্ষুধার্তের মতো পড়তে থাকি; পাশাপাশি ফেসবুকের ‘আবুল হাসান’ পাতায় সংরক্ষণ করতে থাকি। আবুল হাসানকে আমি প্রতিদিনই খনন করতে থাকি। একপর্যায়ে কবির পুরো জীবনটাই আমার চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ভাসতে থাকে। তবে কবির জীবনকাহিনি লেখার স্পর্ধা তখনো জন্মায়নি, কেননা বৃহৎ কলেবরের লেখা লিখে আমি অভ্যস্ত তো নইই, বরং হাসনাত আবদুল হাই কিংবা শাহাদুজ্জামানের লেখা জীবনভিত্তিক উপন্যাসগুলো পড়ে আমি তাঁদের গবেষণা ও শ্রমের পরিমাণ আন্দাজ করতে পেরে এটিকে আমার পক্ষে একটি অসম্ভব প্রকল্প বলেই ভাবলাম।

এর পর আমি কবির জীবনে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট কিছু ঘটনা নিজের মতো করে লিখে রাখতে শুরু করি; কবির কোনো কোনো কবিতা লেখার কাল্পনিক ইতিহাস লিখতে শুরু করি। এইভাবে অল্প পরিসরে হলেও আমার নোটবুকে তাঁর জীবনের বাস্তবতার সাথে আমার কল্পনার কিছু মিশেল দেওয়ার একটা ঘটনা ঘটে যায়। একপর্যায়ে অধুনালুপ্ত ‘নতুনধারা’য় আবুল হাসানকে নিয়ে একগুচ্ছ সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান প্রকাশ করি। লিখতে গিয়ে হাসানকে আরও নিবিড়ভাবে অনুভব করি। তাঁর কবিতার শিরোনাম আর উজ্জ্বল পঙ্‌ক্তিগুলো আমাকে ঘিরে রাখে। আমিই হয়ে উঠি আবুল হাসান ৷ এবারে উত্তম পুরুষে হাসানের জীবনের হাহাকারময় একটি দিনের কথা লিখে ফেলি; পাঠকের বিস্ময়সূচক মন্তব্যে প্রমাণ পাই যে আমার লেখা আবুল হাসানের সেই ডায়েরির পাতাটি পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। তখন আমি আবুল হাসানকে নিয়ে কাজ করার আত্মবিশ্বাস অর্জন করি। কিন্তু যেহেতু আমার ডকু-ফিকশনে অন্যের রচনার প্রচুর উদ্ধৃতি রাখতে হবে বলে নিজে নিজে সম্মত হয়েছিলাম, উত্তম পুরুষে লেখার চিন্তাটি বাদ দিয়ে দিলাম। পরদিন থেকে কবিকে নিয়ে এযাবৎকাল যা যা লিখেছি, সেগুলো কবির জীবনকাল ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সাজাই। এর পরের এক বছর সেই হাড়ের কাঠামোতে নিরন্তর মাংস-মজ্জা যোগ করে যাই আর চেনা-অচেনা অনেক মানুষের নিরন্তর অভাবিত সহযোগিতা পেতে থাকি।

আবুল হাসানের জীবনে বাংলাদেশের সবচেয়ে চড়াই-উতরাইময় সময়টিও প্রভাব ফেলেছে। তাই শুরু থেকেই মাথায় রেখেছিলাম ‘সময়’ এই উপাখ্যানের একটি বিশেষ চরিত্র হয়ে থাকবে এবং সমান মনোযোগপ্রাপ্য হবে। কবির লেখা দু-চারটি চিঠি, প্রবন্ধ, গদ্যের নমুনা আর গল্পগুলো আমি বারবার পড়ে কবির মানসকে অনুভব করার চেষ্টা করেছি, কবির প্রাত্যহিক জীবনযাপনকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। কবির কবিতাসহ সমগ্র রচনায় একধরনের আর্তিও আছে, শুশ্রূষাও আছে—যেহেতু তিনি শেষাবধি একজন জীবনবাদী মানুষ হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি কেমন আছেন—এ কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘শরীরের খবর জানি না, মনের খবর জানি, মন ভালো আছে।’ এই সাহসের বলেই নাকে অক্সিজেনের নল নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন; পূর্ব বার্লিনে অসুস্থ শরীরে পায়ে ব্যথা আর বাইরে নববর্ষের আতশবাজির বিরক্তিকর শব্দে বিব্রত না হয়ে জার্মান বন্ধুর সঙ্গে বসে সেসব ভুলে যাওয়ার জন্যই বুঝিবা তাঁর সাথে যৌথভাবে নিজের বাংলা কবিতার ভাব অবলম্বনে জার্মান গান লিখে বন্ধুর মুখে শুনলেন। শেষে ব্যথা-বেদনা ভুলে আরামে ঘুমালেন। অসুস্থতাকে জয় করতে পারেননি, কিন্তু বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিলেন; ‘পৃথক পালঙ্ক’ বইটিতে জীবনের শ্রেষ্ঠতম আর বিধুরতম কবিতাগুলো লিখছিলেন সে সময়। কবির এই বিস্ময়কর সময়টুকু ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনের কঠিনতম সময়েও প্রেরণা জুগিয়েছে, যখন আমি প্রাণঘাতী অসুখে হাসপাতালবাসী হয়ে ‘ঝিনুক নীরবে সহো’ লেখার শেষ পর্যায়ের কাজ আর সম্পাদনার কাজ করছিলাম। সে অন্য গল্প। এই ডকু-ফিকশনে আবুল হাসান তো বটেই, আরও অনেক কবি, লেখক ও গবেষকের রচনা, কথাবার্তা, মন্তব্য ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে—কখনো উদ্ধৃতির ভেতরে, কখনো রচনাটিকে নির্ঘণ্ট-কণ্টকিত না করার অভিপ্রায়ে অন্তর্বয়নের মাধ্যমে আত্মস্থ করা হয়েছে। যে লেখায় সব চরিত্রই বাস্তব, আমি মনে করি এই পরিস্থিতিটা লেখকের পক্ষে ঈষৎ ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্তু সব চরিত্র কাল্পনিক—এই কথা তো আর বলার সুযোগ নাই!

শুরুতে বলছিলাম, আবুল হাসান গবেষণা উপযোগী কবি। তার শব্দচয়নও অভিনব এবং এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা তাঁর আগে আর কারও লেখায় আমি দেখিনি। আবুল হাসানের একটি গল্পের নাম ‘নির্বাসনায় মাইল মাইল’। নির্বাসনা শব্দটি নির্বাসন শব্দের বিকল্প ভেবেও মনের খটকা দূর হয় না। তারপর খুঁজে দেখি নির্বাসনার অর্থ বাসনামুক্ত হওয়া—“বাসনামুক্ত হওয়া সম্ভব। সেই জন্যই জপ, ধ্যান, সাধনা এসব দরকার। যদি তুমি নির্বাসনা হও, তবে ভক্তি লাভ করতে পারবে।” আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘হাসানের মৃত্যু হলেও ক্ষতি কী; অমৃতের সন্ধান সে তো পেয়েই গেছে!’ জীবনের একপর্যায়ে গিয়ে আবুল হাসান বাসনামুক্ত হতে পেরেছিলেন, সন্তের আসনে তাঁকে অধিষ্ঠিত হতে দেখি, আর কবির সুনাম বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল, এ এক পাঠক পরম্পরা; যে কারণে তিনি আজও সমান জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত