সৌভিক রেজা

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’ আর এসবের পাশাপাশি ‘প্রতিভা’র দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিভার একটা কাজ হলো তাঁর জনগোষ্ঠীর অচেতন এবং অবচেতন মনস্ক্রিয়ায় যেসব আবেগ ও আইডিয়া তোলপাড় করে, সেগুলোকে বাইরে ফুটিয়ে তোলা।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পুরোনো এই কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণ করতে হলো। কেননা, বুদ্ধদেব বসুর মতো মানুষও সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। নিজের বক্তব্যকে বিস্তারে নিয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি...একটি প্রশ্ন মাঝে-মাঝে আমার মনে জাগছে: যাকে আমরা প্রতিভা বলি, সে-বস্তুটি কী?’ বুদ্ধদেব যে সরাসরি উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন, তা নয়। বোধকরি, এসব প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর আমাদের কারওরই জানা নেই। অগত্যা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে হয়েছিল, ‘তা [প্রতিভা] কি বুদ্ধিরই কোনো উচ্চতর স্তর, না কি বুদ্ধির সীমাতিক্রম্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা, যার প্রয়োগের ক্ষেত্র এক ও অনন্য?’ তিনিও এই সব প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে না-পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এটি ভাবা অনুচিত হবে যে, সেটি ছিল বুদ্ধদেবের অক্ষমতা। কেননা বুদ্ধদেবের ওই গুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের একটি আভাস আমরা কিন্তু ঠিকই পেয়ে যায়।
২.
নিজের বিষয়ে কী অকপটেই-না সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘পিতৃদেব (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে, আমি...অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলুম।’ শুধু তা-ই নয়, কবিতা রচনায় সোজাসুজি প্রেরণার গুরুত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে, প্রেরণার মধ্যে অলৌকিকের আভাস রয়েছে। ফলে, প্রেরণার পরিবর্তে তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল অভিজ্ঞতা। তিনি মনে করতেন যে কাব্যের সৃষ্টির উৎসে উক্তি ও উপলব্ধি একদম অবিচ্ছেদ্য। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রতিভা থাকলেই কবিতা রচনা সম্ভব নয়, কেননা কাব্য হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, ‘অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার।’ সেই পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের শৈল্পিক নমুনা আমরা সুধীন্দ্রনাথের কাব্যেই নানাভাবে দেখতে পাই―
‘অকস্মাৎ স্বপ্ন গেল টুটে। দেখিলাম ত্রস্ত চোখে
জনশূন্য রঙ্গালয়ে নির্বাপিত সমস্ত দেউটি,
নিস্তব্ধ সকল যন্ত্র, মঞ্চ-’পরে যবনিকা ঢাকা।
অলক্ষ্যে কখন পার্শ্ব হতে প্রেমিক-প্রেমিকা চলে
গেছে অমৃতসংকেতে। শান্তি, শান্তি, শান্তি চারিধারে!
কেবল অন্তর মোর উত্তরঙ্গ ক্ষুব্ধ হাহাকারে।’ (অর্কেস্ট্রা)
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যরচনার নেপথ্যের শক্তি হিসেবে বুদ্ধদেব বসু এই কবির ‘জাগ্রত আত্মচেতনা’র কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ সেই সঙ্গে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যে ‘বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এতে করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই, ব্যক্তিগতভাবে সুধীন্দ্রনাথ পাঠকের কাছ থেকে সাড়া পেলেন কম। পাঠককে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য অবশ্য তাঁর ছিল, যে-কারণে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘জনসাধারণের রুচির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দা-প্রশংসায় আমি উদাসীন।’ এই মনোভাবের জন্য সুধীন্দ্রনাথকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে।
৩.
কবির দিক থেকে পাঠকের রুচিকে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য ও তাঁর আত্মচেতনাকে স্বীকার করে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘তোমার রচনায় যে বিশেষ আত্মকীয়তা দেখেছি, সেটাকে অনাদর করা যায় না।’ আর এরপরেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমার রচনাকে থিওরি দ্বারা পীড়ন না করে...সাংঘাতিক ঘনসন্নদ্ধ অলংকারের দ্বারা তার অঙ্গকে আচ্ছন্ন না করে তার দেহকে সহজ সজীবতার লাবণ্যে যদি প্রকাশ করো, তাহলে তোমার এই লেখাগুলি রসিক সমাজের উপাদেয় ভোজের আয়োজনে লাগবে।’
সুধীন্দ্রনাথকে এসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবির দিকে না তাকিয়ে যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করবার চেষ্টা কোরো।’
এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের সেই উপদেশকে মান্যতা দেবার গরজ সুধীন্দ্রনাথ সেদিন দেখাননি। এখানেও হয়তো, তাঁর সেই জাগ্রত আত্মচেতনা, তাঁকে অন্যের উপদেশে পথ চলতে নিষেধ করেছিল।
৪.
সাহিত্যে প্রেরণার বদলে সুধীন্দ্রনাথ যেমন অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ঠিক অনেকটা সেরকমই তিনি রবীন্দ্রনাথের বদলে টিএস এলিয়টের সাহিত্য-ভাবনাকেই খানিকটা শিরোধার্য করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথের নিজের বয়ানে দেখতে পাই, তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন; এবং আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের সার্থকতা।’
আর এলিয়টের প্রণোদনায় উজ্জীবিত হয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘বিষয় নির্বাচনে কবির স্বাধীনতা যদিও অনন্ত, তবু বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে কবিতার মৌলিকতা বা সাফল্য বিজড়িত নয়।’ এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল বাংলা ‘কাব্যের মুখ্য সম্বল আবেগ; এবং আমাদের আবেগ সংখ্যা যেহেতু অত্যল্প, তাই প্রসঙ্গের দিক থেকে কবিতাবিশেষকে যত অপূর্বই দেখাক না কেন, ফলাফলের বিচারে তার মধ্যে একটা আনুপূর্বিকতা ধরা পড়বেই।’
সে-কারণেই তিনি ওই পথে চরতে চাননি। বরং তিন আজীবন এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে, ‘ভাব ও ভাষার অবিচ্ছেদ্য সমীকরণই...কবির একমাত্র কর্তব্য।’ সেই আত্ম-উপলব্ধির জায়গা থেকেই তিনি লিখেছিলেন―
‘নির্বাপিত চক্ষে জাগে সংসারীর ভীরু কাণ্ডজ্ঞান।
ঊর্ধ্ববাহু আজ রিক্তাকাশে
যৌবনযজ্ঞানি মোর যে-অনাম দেবতার আশে,
জানি সে-অচেনা
কোনও দিন আমার হবে না;
তবুও নিশ্চয়
আমার উদ্যত অর্ঘ্য, প্রেয়সী, তোমার তরে নয়।’ (কস্মৈ দেবায়)
৫.
যিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’, সেই জীবনানন্দ দাশও মনে করতেন যে, সুধীন্দ্রনাথের ‘প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিশ। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশি-বিদেশি খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা।’
আর সেই সঙ্গে এটিও জীবনানন্দ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘আধুনিক সাহিত্যের প্রায় বারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ।’ রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সুধীন্দ্রনাথের বইখানিতে (‘স্বগত’) জমেছে তাঁর মনন-সাধনার ফসল।’ সেই মনন-সাধনার ফসল যেমন তাঁর কাব্যে, তেমনই তাঁর প্রবন্ধে স্বকীয়তায় স্থান করে নিতে পেরেছিল।
সম্ভবত সে-জন্যই রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘সুধীন্দ্র দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যক্ষেত্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন—মনের অভিজ্ঞতা কেবলি বাড়িয়ে চলায় তাঁর শখ— সেই শখ নিছক আরামে মেটাবার নয় বলেই আমাদের দেশে মননভূমির ভবঘুরে এত অল্প।’
তাঁর সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব সুধীন্দ্রনাথ জানতেন, বুঝতেও তো পারতেন। দুজনের সাহিত্যদৃষ্টির যে পার্থক্য, সেটাকে মান্যতা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার: আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদ্গতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।’
নিজের ভবিষ্যৎ যেন এই কবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যিক জীবনের অন্তিমপর্বের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই যে-কারও মনে হবে, এই সেই কবি, যিনি অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন!
৬.
কবির কর্তব্য, তাঁর উদ্দেশ্য ও ব্রত সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবির কর্তব্য তার প্রতিদিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা পরম উপলব্ধির মাল্যরচনা। কবির উদ্দেশ্য তার চারপাশের অবচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতন্যের উদ্ভাবন।’
জীবনের শেষ দশটি বছরে এক ‘দশমী’ ছাড়া তাঁর আর কোনো নতুন কবিতার বই বের হয়নি, প্রবন্ধ-গ্রন্থও নয়। তাতে বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু এই কবি তাঁর বিশ্বাস থেকে, নিজের স্বভাবধর্ম থেকে আমৃত্যু একচুলও নড়েননি।
৭.
২৫ জুন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’ আর এসবের পাশাপাশি ‘প্রতিভা’র দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিভার একটা কাজ হলো তাঁর জনগোষ্ঠীর অচেতন এবং অবচেতন মনস্ক্রিয়ায় যেসব আবেগ ও আইডিয়া তোলপাড় করে, সেগুলোকে বাইরে ফুটিয়ে তোলা।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পুরোনো এই কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণ করতে হলো। কেননা, বুদ্ধদেব বসুর মতো মানুষও সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। নিজের বক্তব্যকে বিস্তারে নিয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি...একটি প্রশ্ন মাঝে-মাঝে আমার মনে জাগছে: যাকে আমরা প্রতিভা বলি, সে-বস্তুটি কী?’ বুদ্ধদেব যে সরাসরি উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন, তা নয়। বোধকরি, এসব প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর আমাদের কারওরই জানা নেই। অগত্যা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে হয়েছিল, ‘তা [প্রতিভা] কি বুদ্ধিরই কোনো উচ্চতর স্তর, না কি বুদ্ধির সীমাতিক্রম্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা, যার প্রয়োগের ক্ষেত্র এক ও অনন্য?’ তিনিও এই সব প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে না-পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এটি ভাবা অনুচিত হবে যে, সেটি ছিল বুদ্ধদেবের অক্ষমতা। কেননা বুদ্ধদেবের ওই গুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের একটি আভাস আমরা কিন্তু ঠিকই পেয়ে যায়।
২.
নিজের বিষয়ে কী অকপটেই-না সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘পিতৃদেব (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে, আমি...অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলুম।’ শুধু তা-ই নয়, কবিতা রচনায় সোজাসুজি প্রেরণার গুরুত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে, প্রেরণার মধ্যে অলৌকিকের আভাস রয়েছে। ফলে, প্রেরণার পরিবর্তে তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল অভিজ্ঞতা। তিনি মনে করতেন যে কাব্যের সৃষ্টির উৎসে উক্তি ও উপলব্ধি একদম অবিচ্ছেদ্য। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রতিভা থাকলেই কবিতা রচনা সম্ভব নয়, কেননা কাব্য হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, ‘অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার।’ সেই পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের শৈল্পিক নমুনা আমরা সুধীন্দ্রনাথের কাব্যেই নানাভাবে দেখতে পাই―
‘অকস্মাৎ স্বপ্ন গেল টুটে। দেখিলাম ত্রস্ত চোখে
জনশূন্য রঙ্গালয়ে নির্বাপিত সমস্ত দেউটি,
নিস্তব্ধ সকল যন্ত্র, মঞ্চ-’পরে যবনিকা ঢাকা।
অলক্ষ্যে কখন পার্শ্ব হতে প্রেমিক-প্রেমিকা চলে
গেছে অমৃতসংকেতে। শান্তি, শান্তি, শান্তি চারিধারে!
কেবল অন্তর মোর উত্তরঙ্গ ক্ষুব্ধ হাহাকারে।’ (অর্কেস্ট্রা)
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যরচনার নেপথ্যের শক্তি হিসেবে বুদ্ধদেব বসু এই কবির ‘জাগ্রত আত্মচেতনা’র কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ সেই সঙ্গে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যে ‘বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এতে করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই, ব্যক্তিগতভাবে সুধীন্দ্রনাথ পাঠকের কাছ থেকে সাড়া পেলেন কম। পাঠককে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য অবশ্য তাঁর ছিল, যে-কারণে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘জনসাধারণের রুচির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দা-প্রশংসায় আমি উদাসীন।’ এই মনোভাবের জন্য সুধীন্দ্রনাথকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে।
৩.
কবির দিক থেকে পাঠকের রুচিকে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য ও তাঁর আত্মচেতনাকে স্বীকার করে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘তোমার রচনায় যে বিশেষ আত্মকীয়তা দেখেছি, সেটাকে অনাদর করা যায় না।’ আর এরপরেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমার রচনাকে থিওরি দ্বারা পীড়ন না করে...সাংঘাতিক ঘনসন্নদ্ধ অলংকারের দ্বারা তার অঙ্গকে আচ্ছন্ন না করে তার দেহকে সহজ সজীবতার লাবণ্যে যদি প্রকাশ করো, তাহলে তোমার এই লেখাগুলি রসিক সমাজের উপাদেয় ভোজের আয়োজনে লাগবে।’
সুধীন্দ্রনাথকে এসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবির দিকে না তাকিয়ে যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করবার চেষ্টা কোরো।’
এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের সেই উপদেশকে মান্যতা দেবার গরজ সুধীন্দ্রনাথ সেদিন দেখাননি। এখানেও হয়তো, তাঁর সেই জাগ্রত আত্মচেতনা, তাঁকে অন্যের উপদেশে পথ চলতে নিষেধ করেছিল।
৪.
সাহিত্যে প্রেরণার বদলে সুধীন্দ্রনাথ যেমন অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ঠিক অনেকটা সেরকমই তিনি রবীন্দ্রনাথের বদলে টিএস এলিয়টের সাহিত্য-ভাবনাকেই খানিকটা শিরোধার্য করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথের নিজের বয়ানে দেখতে পাই, তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন; এবং আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের সার্থকতা।’
আর এলিয়টের প্রণোদনায় উজ্জীবিত হয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘বিষয় নির্বাচনে কবির স্বাধীনতা যদিও অনন্ত, তবু বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে কবিতার মৌলিকতা বা সাফল্য বিজড়িত নয়।’ এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল বাংলা ‘কাব্যের মুখ্য সম্বল আবেগ; এবং আমাদের আবেগ সংখ্যা যেহেতু অত্যল্প, তাই প্রসঙ্গের দিক থেকে কবিতাবিশেষকে যত অপূর্বই দেখাক না কেন, ফলাফলের বিচারে তার মধ্যে একটা আনুপূর্বিকতা ধরা পড়বেই।’
সে-কারণেই তিনি ওই পথে চরতে চাননি। বরং তিন আজীবন এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে, ‘ভাব ও ভাষার অবিচ্ছেদ্য সমীকরণই...কবির একমাত্র কর্তব্য।’ সেই আত্ম-উপলব্ধির জায়গা থেকেই তিনি লিখেছিলেন―
‘নির্বাপিত চক্ষে জাগে সংসারীর ভীরু কাণ্ডজ্ঞান।
ঊর্ধ্ববাহু আজ রিক্তাকাশে
যৌবনযজ্ঞানি মোর যে-অনাম দেবতার আশে,
জানি সে-অচেনা
কোনও দিন আমার হবে না;
তবুও নিশ্চয়
আমার উদ্যত অর্ঘ্য, প্রেয়সী, তোমার তরে নয়।’ (কস্মৈ দেবায়)
৫.
যিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’, সেই জীবনানন্দ দাশও মনে করতেন যে, সুধীন্দ্রনাথের ‘প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিশ। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশি-বিদেশি খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা।’
আর সেই সঙ্গে এটিও জীবনানন্দ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘আধুনিক সাহিত্যের প্রায় বারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ।’ রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সুধীন্দ্রনাথের বইখানিতে (‘স্বগত’) জমেছে তাঁর মনন-সাধনার ফসল।’ সেই মনন-সাধনার ফসল যেমন তাঁর কাব্যে, তেমনই তাঁর প্রবন্ধে স্বকীয়তায় স্থান করে নিতে পেরেছিল।
সম্ভবত সে-জন্যই রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘সুধীন্দ্র দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যক্ষেত্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন—মনের অভিজ্ঞতা কেবলি বাড়িয়ে চলায় তাঁর শখ— সেই শখ নিছক আরামে মেটাবার নয় বলেই আমাদের দেশে মননভূমির ভবঘুরে এত অল্প।’
তাঁর সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব সুধীন্দ্রনাথ জানতেন, বুঝতেও তো পারতেন। দুজনের সাহিত্যদৃষ্টির যে পার্থক্য, সেটাকে মান্যতা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার: আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদ্গতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।’
নিজের ভবিষ্যৎ যেন এই কবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যিক জীবনের অন্তিমপর্বের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই যে-কারও মনে হবে, এই সেই কবি, যিনি অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন!
৬.
কবির কর্তব্য, তাঁর উদ্দেশ্য ও ব্রত সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবির কর্তব্য তার প্রতিদিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা পরম উপলব্ধির মাল্যরচনা। কবির উদ্দেশ্য তার চারপাশের অবচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতন্যের উদ্ভাবন।’
জীবনের শেষ দশটি বছরে এক ‘দশমী’ ছাড়া তাঁর আর কোনো নতুন কবিতার বই বের হয়নি, প্রবন্ধ-গ্রন্থও নয়। তাতে বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু এই কবি তাঁর বিশ্বাস থেকে, নিজের স্বভাবধর্ম থেকে আমৃত্যু একচুলও নড়েননি।
৭.
২৫ জুন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সৌভিক রেজা

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’ আর এসবের পাশাপাশি ‘প্রতিভা’র দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিভার একটা কাজ হলো তাঁর জনগোষ্ঠীর অচেতন এবং অবচেতন মনস্ক্রিয়ায় যেসব আবেগ ও আইডিয়া তোলপাড় করে, সেগুলোকে বাইরে ফুটিয়ে তোলা।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পুরোনো এই কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণ করতে হলো। কেননা, বুদ্ধদেব বসুর মতো মানুষও সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। নিজের বক্তব্যকে বিস্তারে নিয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি...একটি প্রশ্ন মাঝে-মাঝে আমার মনে জাগছে: যাকে আমরা প্রতিভা বলি, সে-বস্তুটি কী?’ বুদ্ধদেব যে সরাসরি উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন, তা নয়। বোধকরি, এসব প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর আমাদের কারওরই জানা নেই। অগত্যা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে হয়েছিল, ‘তা [প্রতিভা] কি বুদ্ধিরই কোনো উচ্চতর স্তর, না কি বুদ্ধির সীমাতিক্রম্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা, যার প্রয়োগের ক্ষেত্র এক ও অনন্য?’ তিনিও এই সব প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে না-পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এটি ভাবা অনুচিত হবে যে, সেটি ছিল বুদ্ধদেবের অক্ষমতা। কেননা বুদ্ধদেবের ওই গুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের একটি আভাস আমরা কিন্তু ঠিকই পেয়ে যায়।
২.
নিজের বিষয়ে কী অকপটেই-না সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘পিতৃদেব (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে, আমি...অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলুম।’ শুধু তা-ই নয়, কবিতা রচনায় সোজাসুজি প্রেরণার গুরুত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে, প্রেরণার মধ্যে অলৌকিকের আভাস রয়েছে। ফলে, প্রেরণার পরিবর্তে তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল অভিজ্ঞতা। তিনি মনে করতেন যে কাব্যের সৃষ্টির উৎসে উক্তি ও উপলব্ধি একদম অবিচ্ছেদ্য। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রতিভা থাকলেই কবিতা রচনা সম্ভব নয়, কেননা কাব্য হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, ‘অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার।’ সেই পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের শৈল্পিক নমুনা আমরা সুধীন্দ্রনাথের কাব্যেই নানাভাবে দেখতে পাই―
‘অকস্মাৎ স্বপ্ন গেল টুটে। দেখিলাম ত্রস্ত চোখে
জনশূন্য রঙ্গালয়ে নির্বাপিত সমস্ত দেউটি,
নিস্তব্ধ সকল যন্ত্র, মঞ্চ-’পরে যবনিকা ঢাকা।
অলক্ষ্যে কখন পার্শ্ব হতে প্রেমিক-প্রেমিকা চলে
গেছে অমৃতসংকেতে। শান্তি, শান্তি, শান্তি চারিধারে!
কেবল অন্তর মোর উত্তরঙ্গ ক্ষুব্ধ হাহাকারে।’ (অর্কেস্ট্রা)
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যরচনার নেপথ্যের শক্তি হিসেবে বুদ্ধদেব বসু এই কবির ‘জাগ্রত আত্মচেতনা’র কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ সেই সঙ্গে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যে ‘বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এতে করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই, ব্যক্তিগতভাবে সুধীন্দ্রনাথ পাঠকের কাছ থেকে সাড়া পেলেন কম। পাঠককে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য অবশ্য তাঁর ছিল, যে-কারণে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘জনসাধারণের রুচির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দা-প্রশংসায় আমি উদাসীন।’ এই মনোভাবের জন্য সুধীন্দ্রনাথকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে।
৩.
কবির দিক থেকে পাঠকের রুচিকে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য ও তাঁর আত্মচেতনাকে স্বীকার করে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘তোমার রচনায় যে বিশেষ আত্মকীয়তা দেখেছি, সেটাকে অনাদর করা যায় না।’ আর এরপরেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমার রচনাকে থিওরি দ্বারা পীড়ন না করে...সাংঘাতিক ঘনসন্নদ্ধ অলংকারের দ্বারা তার অঙ্গকে আচ্ছন্ন না করে তার দেহকে সহজ সজীবতার লাবণ্যে যদি প্রকাশ করো, তাহলে তোমার এই লেখাগুলি রসিক সমাজের উপাদেয় ভোজের আয়োজনে লাগবে।’
সুধীন্দ্রনাথকে এসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবির দিকে না তাকিয়ে যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করবার চেষ্টা কোরো।’
এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের সেই উপদেশকে মান্যতা দেবার গরজ সুধীন্দ্রনাথ সেদিন দেখাননি। এখানেও হয়তো, তাঁর সেই জাগ্রত আত্মচেতনা, তাঁকে অন্যের উপদেশে পথ চলতে নিষেধ করেছিল।
৪.
সাহিত্যে প্রেরণার বদলে সুধীন্দ্রনাথ যেমন অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ঠিক অনেকটা সেরকমই তিনি রবীন্দ্রনাথের বদলে টিএস এলিয়টের সাহিত্য-ভাবনাকেই খানিকটা শিরোধার্য করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথের নিজের বয়ানে দেখতে পাই, তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন; এবং আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের সার্থকতা।’
আর এলিয়টের প্রণোদনায় উজ্জীবিত হয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘বিষয় নির্বাচনে কবির স্বাধীনতা যদিও অনন্ত, তবু বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে কবিতার মৌলিকতা বা সাফল্য বিজড়িত নয়।’ এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল বাংলা ‘কাব্যের মুখ্য সম্বল আবেগ; এবং আমাদের আবেগ সংখ্যা যেহেতু অত্যল্প, তাই প্রসঙ্গের দিক থেকে কবিতাবিশেষকে যত অপূর্বই দেখাক না কেন, ফলাফলের বিচারে তার মধ্যে একটা আনুপূর্বিকতা ধরা পড়বেই।’
সে-কারণেই তিনি ওই পথে চরতে চাননি। বরং তিন আজীবন এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে, ‘ভাব ও ভাষার অবিচ্ছেদ্য সমীকরণই...কবির একমাত্র কর্তব্য।’ সেই আত্ম-উপলব্ধির জায়গা থেকেই তিনি লিখেছিলেন―
‘নির্বাপিত চক্ষে জাগে সংসারীর ভীরু কাণ্ডজ্ঞান।
ঊর্ধ্ববাহু আজ রিক্তাকাশে
যৌবনযজ্ঞানি মোর যে-অনাম দেবতার আশে,
জানি সে-অচেনা
কোনও দিন আমার হবে না;
তবুও নিশ্চয়
আমার উদ্যত অর্ঘ্য, প্রেয়সী, তোমার তরে নয়।’ (কস্মৈ দেবায়)
৫.
যিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’, সেই জীবনানন্দ দাশও মনে করতেন যে, সুধীন্দ্রনাথের ‘প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিশ। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশি-বিদেশি খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা।’
আর সেই সঙ্গে এটিও জীবনানন্দ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘আধুনিক সাহিত্যের প্রায় বারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ।’ রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সুধীন্দ্রনাথের বইখানিতে (‘স্বগত’) জমেছে তাঁর মনন-সাধনার ফসল।’ সেই মনন-সাধনার ফসল যেমন তাঁর কাব্যে, তেমনই তাঁর প্রবন্ধে স্বকীয়তায় স্থান করে নিতে পেরেছিল।
সম্ভবত সে-জন্যই রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘সুধীন্দ্র দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যক্ষেত্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন—মনের অভিজ্ঞতা কেবলি বাড়িয়ে চলায় তাঁর শখ— সেই শখ নিছক আরামে মেটাবার নয় বলেই আমাদের দেশে মননভূমির ভবঘুরে এত অল্প।’
তাঁর সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব সুধীন্দ্রনাথ জানতেন, বুঝতেও তো পারতেন। দুজনের সাহিত্যদৃষ্টির যে পার্থক্য, সেটাকে মান্যতা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার: আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদ্গতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।’
নিজের ভবিষ্যৎ যেন এই কবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যিক জীবনের অন্তিমপর্বের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই যে-কারও মনে হবে, এই সেই কবি, যিনি অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন!
৬.
কবির কর্তব্য, তাঁর উদ্দেশ্য ও ব্রত সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবির কর্তব্য তার প্রতিদিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা পরম উপলব্ধির মাল্যরচনা। কবির উদ্দেশ্য তার চারপাশের অবচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতন্যের উদ্ভাবন।’
জীবনের শেষ দশটি বছরে এক ‘দশমী’ ছাড়া তাঁর আর কোনো নতুন কবিতার বই বের হয়নি, প্রবন্ধ-গ্রন্থও নয়। তাতে বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু এই কবি তাঁর বিশ্বাস থেকে, নিজের স্বভাবধর্ম থেকে আমৃত্যু একচুলও নড়েননি।
৭.
২৫ জুন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’ আর এসবের পাশাপাশি ‘প্রতিভা’র দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘প্রতিভার একটা কাজ হলো তাঁর জনগোষ্ঠীর অচেতন এবং অবচেতন মনস্ক্রিয়ায় যেসব আবেগ ও আইডিয়া তোলপাড় করে, সেগুলোকে বাইরে ফুটিয়ে তোলা।’
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে পুরোনো এই কথাগুলো আবার আমাদের স্মরণ করতে হলো। কেননা, বুদ্ধদেব বসুর মতো মানুষও সুধীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। নিজের বক্তব্যকে বিস্তারে নিয়ে তিনি এ-ও জানিয়েছিলেন, ‘তাঁর মতো নানাগুণসমন্বিত পুরুষ রবীন্দ্রনাথের পরে আমি অন্য কাউকে দেখিনি...একটি প্রশ্ন মাঝে-মাঝে আমার মনে জাগছে: যাকে আমরা প্রতিভা বলি, সে-বস্তুটি কী?’ বুদ্ধদেব যে সরাসরি উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন, তা নয়। বোধকরি, এসব প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর আমাদের কারওরই জানা নেই। অগত্যা বুদ্ধদেব বসুকে বলতে হয়েছিল, ‘তা [প্রতিভা] কি বুদ্ধিরই কোনো উচ্চতর স্তর, না কি বুদ্ধির সীমাতিক্রম্য কোনো বিশেষ ক্ষমতা, যার প্রয়োগের ক্ষেত্র এক ও অনন্য?’ তিনিও এই সব প্রশ্নের কোনো সুরাহা করতে না-পেরে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এটি ভাবা অনুচিত হবে যে, সেটি ছিল বুদ্ধদেবের অক্ষমতা। কেননা বুদ্ধদেবের ওই গুচ্ছ প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরের একটি আভাস আমরা কিন্তু ঠিকই পেয়ে যায়।
২.
নিজের বিষয়ে কী অকপটেই-না সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘পিতৃদেব (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত) ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে, আমি...অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলুম।’ শুধু তা-ই নয়, কবিতা রচনায় সোজাসুজি প্রেরণার গুরুত্বকে অস্বীকার করেছিলেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে, প্রেরণার মধ্যে অলৌকিকের আভাস রয়েছে। ফলে, প্রেরণার পরিবর্তে তাঁর কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল অভিজ্ঞতা। তিনি মনে করতেন যে কাব্যের সৃষ্টির উৎসে উক্তি ও উপলব্ধি একদম অবিচ্ছেদ্য। তিনি এ-ও বিশ্বাস করতেন, শুধু প্রতিভা থাকলেই কবিতা রচনা সম্ভব নয়, কেননা কাব্য হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, ‘অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের পুরস্কার।’ সেই পরিশ্রম ও নিরন্তর প্রযত্নের শৈল্পিক নমুনা আমরা সুধীন্দ্রনাথের কাব্যেই নানাভাবে দেখতে পাই―
‘অকস্মাৎ স্বপ্ন গেল টুটে। দেখিলাম ত্রস্ত চোখে
জনশূন্য রঙ্গালয়ে নির্বাপিত সমস্ত দেউটি,
নিস্তব্ধ সকল যন্ত্র, মঞ্চ-’পরে যবনিকা ঢাকা।
অলক্ষ্যে কখন পার্শ্ব হতে প্রেমিক-প্রেমিকা চলে
গেছে অমৃতসংকেতে। শান্তি, শান্তি, শান্তি চারিধারে!
কেবল অন্তর মোর উত্তরঙ্গ ক্ষুব্ধ হাহাকারে।’ (অর্কেস্ট্রা)
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যরচনার নেপথ্যের শক্তি হিসেবে বুদ্ধদেব বসু এই কবির ‘জাগ্রত আত্মচেতনা’র কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ সেই সঙ্গে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন যে ‘বুদ্ধির আদেশ শিরোধার্য করে অতি ধীরে সাহিত্যের পথে’ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এতে করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে ঠিকই, ব্যক্তিগতভাবে সুধীন্দ্রনাথ পাঠকের কাছ থেকে সাড়া পেলেন কম। পাঠককে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য অবশ্য তাঁর ছিল, যে-কারণে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘জনসাধারণের রুচির প্রতি আমার অশ্রদ্ধা এত গভীর যে তাদের নিন্দা-প্রশংসায় আমি উদাসীন।’ এই মনোভাবের জন্য সুধীন্দ্রনাথকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো দিতে হচ্ছে।
৩.
কবির দিক থেকে পাঠকের রুচিকে অগ্রাহ্য করবার সামর্থ্য ও তাঁর আত্মচেতনাকে স্বীকার করে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে সুধীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘তোমার রচনায় যে বিশেষ আত্মকীয়তা দেখেছি, সেটাকে অনাদর করা যায় না।’ আর এরপরেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তোমার রচনাকে থিওরি দ্বারা পীড়ন না করে...সাংঘাতিক ঘনসন্নদ্ধ অলংকারের দ্বারা তার অঙ্গকে আচ্ছন্ন না করে তার দেহকে সহজ সজীবতার লাবণ্যে যদি প্রকাশ করো, তাহলে তোমার এই লেখাগুলি রসিক সমাজের উপাদেয় ভোজের আয়োজনে লাগবে।’
সুধীন্দ্রনাথকে এসবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবির দিকে না তাকিয়ে যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করবার চেষ্টা কোরো।’
এখানে বলে রাখা ভালো যে, রবীন্দ্রনাথের সেই উপদেশকে মান্যতা দেবার গরজ সুধীন্দ্রনাথ সেদিন দেখাননি। এখানেও হয়তো, তাঁর সেই জাগ্রত আত্মচেতনা, তাঁকে অন্যের উপদেশে পথ চলতে নিষেধ করেছিল।
৪.
সাহিত্যে প্রেরণার বদলে সুধীন্দ্রনাথ যেমন অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ঠিক অনেকটা সেরকমই তিনি রবীন্দ্রনাথের বদলে টিএস এলিয়টের সাহিত্য-ভাবনাকেই খানিকটা শিরোধার্য করেছিলেন। সুধীন্দ্রনাথের নিজের বয়ানে দেখতে পাই, তিনি জানিয়েছিলেন, ‘এলিয়ট কবিকে ঘটক আখ্যা দিয়েছেন; এবং আমিও মনে করি যে ব্যক্তিগত মনীষায় জাতীয় মানস ফুটিয়ে তোলাই কবিজীবনের সার্থকতা।’
আর এলিয়টের প্রণোদনায় উজ্জীবিত হয়েই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘বিষয় নির্বাচনে কবির স্বাধীনতা যদিও অনন্ত, তবু বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে কবিতার মৌলিকতা বা সাফল্য বিজড়িত নয়।’ এর অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল বাংলা ‘কাব্যের মুখ্য সম্বল আবেগ; এবং আমাদের আবেগ সংখ্যা যেহেতু অত্যল্প, তাই প্রসঙ্গের দিক থেকে কবিতাবিশেষকে যত অপূর্বই দেখাক না কেন, ফলাফলের বিচারে তার মধ্যে একটা আনুপূর্বিকতা ধরা পড়বেই।’
সে-কারণেই তিনি ওই পথে চরতে চাননি। বরং তিন আজীবন এই বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে, ‘ভাব ও ভাষার অবিচ্ছেদ্য সমীকরণই...কবির একমাত্র কর্তব্য।’ সেই আত্ম-উপলব্ধির জায়গা থেকেই তিনি লিখেছিলেন―
‘নির্বাপিত চক্ষে জাগে সংসারীর ভীরু কাণ্ডজ্ঞান।
ঊর্ধ্ববাহু আজ রিক্তাকাশে
যৌবনযজ্ঞানি মোর যে-অনাম দেবতার আশে,
জানি সে-অচেনা
কোনও দিন আমার হবে না;
তবুও নিশ্চয়
আমার উদ্যত অর্ঘ্য, প্রেয়সী, তোমার তরে নয়।’ (কস্মৈ দেবায়)
৫.
যিনি বিশ্বাস করতেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থি-র ভেতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’, সেই জীবনানন্দ দাশও মনে করতেন যে, সুধীন্দ্রনাথের ‘প্রতিভা এবং আন্তরিকতা এঁর নিজের জিনিশ। আর কিছু জানাবার নেই মেনে হয়তো তিনি আত্মজিজ্ঞাসায় চুপ হয়ে আছেন। এ রকম আত্মপ্রসাদহীন সংযম দেশি-বিদেশি খুব কম লেখকের বেলাই দেখা যায়। তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা।’
আর সেই সঙ্গে এটিও জীবনানন্দ স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘আধুনিক সাহিত্যের প্রায় বারো আনা তথাকথিত প্রাগ্রসর কবিতার চেয়ে সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বেশি প্রবীণ।’ রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ‘সুধীন্দ্রনাথের বইখানিতে (‘স্বগত’) জমেছে তাঁর মনন-সাধনার ফসল।’ সেই মনন-সাধনার ফসল যেমন তাঁর কাব্যে, তেমনই তাঁর প্রবন্ধে স্বকীয়তায় স্থান করে নিতে পেরেছিল।
সম্ভবত সে-জন্যই রবীন্দ্রনাথ অমিয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘সুধীন্দ্র দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্যক্ষেত্র ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন—মনের অভিজ্ঞতা কেবলি বাড়িয়ে চলায় তাঁর শখ— সেই শখ নিছক আরামে মেটাবার নয় বলেই আমাদের দেশে মননভূমির ভবঘুরে এত অল্প।’
তাঁর সাহিত্যের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব সুধীন্দ্রনাথ জানতেন, বুঝতেও তো পারতেন। দুজনের সাহিত্যদৃষ্টির যে পার্থক্য, সেটাকে মান্যতা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর (রবীন্দ্রনাথ) আর আমার ধর্ম আকাশ-পাতালের মতো পৃথক। তিনি সূর্য, উদয়াস্ত নির্বিকার: আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি; সদ্গতির আগেই হয়তো তমসায় আবার তলাব।’
নিজের ভবিষ্যৎ যেন এই কবি দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যিক জীবনের অন্তিমপর্বের দিকে যদি তাকাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই যে-কারও মনে হবে, এই সেই কবি, যিনি অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন!
৬.
কবির কর্তব্য, তাঁর উদ্দেশ্য ও ব্রত সম্পর্কে সুধীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ‘কবির কর্তব্য তার প্রতিদিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা পরম উপলব্ধির মাল্যরচনা। কবির উদ্দেশ্য তার চারপাশের অবচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতন্যের উদ্ভাবন।’
জীবনের শেষ দশটি বছরে এক ‘দশমী’ ছাড়া তাঁর আর কোনো নতুন কবিতার বই বের হয়নি, প্রবন্ধ-গ্রন্থও নয়। তাতে বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো বটে, কিন্তু এই কবি তাঁর বিশ্বাস থেকে, নিজের স্বভাবধর্ম থেকে আমৃত্যু একচুলও নড়েননি।
৭.
২৫ জুন এই প্রতিভাবান সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫তৌহিদুল হক

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

রক্ত লাল
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে
গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়
ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের
জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে
রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে
প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা
উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।
কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত
শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।
এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়
দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব
মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।
এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ
ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার
অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে
ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে
বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।
যত দেখি
যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে
জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা
শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।
যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।
হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।
যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।
ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত
করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!
সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।
জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ
আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।
তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে
অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই
কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার
প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।
এ যেন কেমন
গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে
চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে
একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির
মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে
এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ
কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা
আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।
সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে
নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার
অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।
জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?
চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার
যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।
চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?
যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!
চলে আসুন সবজি বাজারে
মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু
যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার
উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে
হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।
প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো
পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?
হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে
যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!
চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা
ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।
যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।
আহা! দেখার কেউ নেই!
এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।
কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ
কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?
কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।
চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।
ইতিহাস
আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই
নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব
ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।
আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---
আমি নই কারও!
সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম
ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে
অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু
এক মুখচ্ছবি।
আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে
হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার
কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।
কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।
দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!
আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না
হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে
ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে
সবকিছুর-ই সময় থাকে---
এরপর---ইতিহাস!

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’
২৭ জুন ২০২৩
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’
‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’
হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,
‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।
হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।
তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’
ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’
হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’
২৭ জুন ২০২৩
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।
হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।
নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’
২৭ জুন ২০২৩
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল।
২০ অক্টোবর ২০২৫আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’
গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।
ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’
মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’
মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

বিশিষ্ট সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ এবং ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ুন কবির একবার বলেছিলেন, ‘প্রতিভার জন্মরহস্য কেউ বলতে পারে না। প্রতিভা তো সব সময়েই তা-ই যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।’
২৭ জুন ২০২৩
আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায় ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।
১৩ দিন আগে
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’
২২ দিন আগে
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।
০৮ নভেম্বর ২০২৫