Ajker Patrika

আসাদ চৌধুরী: নতুন পথের সন্ধানী

আকিফ গালিব
আসাদ চৌধুরী: নতুন পথের সন্ধানী

‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী ৫ অক্টোবর, ২০২৩ স্থানীয় সময় রাত পৌনে ৩টার দিকে টরন্টোর অদূরে আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যু শব্দটির সাথে স্তব্ধ হয়ে গেল কাঁধে ঝোলা, পানের রঙে রঞ্জিত লাল ঠোঁটে সদা হাস্য একজন কবির দিলখোলা হাসির অনুরণন। বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলায় প্রথম পরিচয়, কবিতায় চিনি তাঁকে আরও বহু বছর আগে—
গোলাপের মধ্যে যাব। 
বাড়ালাম হাত
ফিরে এলো রক্তাক্ত আঙুল। 
সাপিনীর কারুকার্য
নগ্ন নতজানু
চরাচরে আবেগ বিলায়। 
আমার অধরে শুধু
দাঁতের আঘাত। 

চাঁদের ভেতরে খাদ্য
আমাকে কেবল
নিয়ে যায়
নিঅনের কাছে
হায় দেহ, শুধুই শরীর
বিদ্যুৎবিহীন। 
(আত্মজীবনী: ১)
‘তবক দেওয়া পান’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে যেমন লিখেছিলেন—‘আমার গোটা শরীর কিছুতেই ঘরে আসতে চায় না, হয়তো সবটা দেহ কোনো দিন ঘরে ফেরেনি। এটা আমি আগে টের পাইনি, আর পেলেই বা কি হতো? চিকিৎসার জন্য আমি তো আর ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি না সাহানা, তোমার কাছেই এসেছি। এবার দ্যাখো তো আমার শরীরের কিছু অংশ বাইরে কোথাও ফেলে এলাম কি না?’ প্রথম পরিচয়ের দিন জেনেছিলাম উৎসর্গপত্রে লেখা কথাগুলো কতটা ধ্রুব সত্য সদা গাল্পিক প্রাণময় মায়াময় আড্ডাবাজ কবির জীবনে। সত্যিই বাহির তাঁকে পাগল করে রাখে। ষাটের দশকে বাংলাদেশের কবিতায় যে স্বর, কবিতার বিনির্মাণে যে ঝাঁজালো শব্দগুচ্ছ, রাগ, ঘৃণা আর অস্থিরতা সেই পথ অবলীলায় ফেলে এসে আসাদ চৌধুরী নতুন পথের সন্ধান করেছেন। তিনি গতানুগতিকতার ভেতর থেকে সচেতনভাবেই বাইরে আসার দৃষ্টান্ত হয়ে নিজের সময়-পর্বে চিহ্নিত হয়েছেন। হতাশা, অবক্ষয় আর জীবনসংঘাতকে পরিপূর্ণ করে প্রকাশের বেদনায় নীলকণ্ঠ হয়ে তিনি ব্যক্তির অনুভূতিপুঞ্জকে নিজের মতো সাজিয়ে তুলেছেন। একমুখী প্রচলের মধ্য থেকে বেরিয়ে, তবে তাকে অস্বীকার করে নয়, বরং আত্মস্থ করে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরী ষাটের দশকের কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
কবিকে পলায়নবাদী মনে হতে পারে, মনে হতে পারে সমকালকে অস্বীকার করতে চেয়েছেন? একজন কবি ও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ভুলে থাকতে চেয়েছেন সময়, অন্ধকার থেকে পালিয়ে থাকতে চেয়েছেন? মিলান কুন্ডেরার একটি কথা কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘উপন্যাস বা শিল্প হলো বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম।’ আমার মনে হয়, আসাদ চৌধুরী ঠিক তেমনি একজন কবি, যিনি কবিতার মধ্যে দিয়ে জারি রেখেছেন সে সংগ্রাম। আসাদ চৌধুরীর কবিতা স্পষ্ট করে—তিনি জীবন ও শিল্পচেতনার সমন্বয় খুঁজেছেন। তিনি নিরাসক্ত নন, তবে তার আসক্তি প্রমাণের জন্য তিনি ঝাঁ-চকচকে, রাগী শব্দ ব্যবহার করেননি। তিনি শিল্প বিনির্মাণের প্রশ্নে মনোযোগ দিয়েছেন মননশীলতার দিকে। সেখানে উচ্চকিত এবং জোরালো ভাবের ব্যবহার নিশ্চিত করলেও বর্ণনার প্রশ্নে তিনি ধীরস্থির। সেই স্থিরতা কিন্তু তার আবেগ, তার প্রকাশকে বাঁধতে পারেনি বরং সেই স্থিরতার ভেতর দিয়েই তিনি নিজের বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন; যা তাঁকে দিয়েছে ধ্যানীর মগ্নতা। তাই হয়তো তিনি বলতে পারেন—
‘তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ?’ 

(শহীদদের প্রতি) 

আসাদ চৌধুরীর কবিতা অবদমিত ইচ্ছার কাছে হেরে না গিয়ে সময়কে বিবৃত করেছে। সময়ের মধ্যে থেকেই সময়কে আত্মস্থ করে চেতনাস্রোতকে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর কবিতার শক্তিশালী দিক শব্দ ব্যবহার, যা পাঠককে বিব্রত করে না, বরং কাছে টানে। সেই সহজসরল শব্দের পিঠে শব্দ জুড়ে জুড়ে তিনি দক্ষ কারিগরের মতো সমাজজীবনের এবং ব্যক্তিমানসের অন্তর্বেদনার ছবি আঁকেন। যেখানে শব্দের নিজস্ব গতির বাইরে এসে তার শব্দেরা খেয়ালি মনের বর্ণনায় মেতে ওঠে। স্মরণযোগ্যতার বিন্দুবিভা ছড়িয়ে যায় বাঙালির হৃদয়জুড়ে: 
‘দিন যায়, 
দিন যেতে থাকে। 
তাঁর জন্যে যত শ্রদ্ধা নিজেদের প্রতি ততখানি ঘৃণা, 
কারাগার তাঁকে চেনে, 
ঘাতক বুলেট তাঁকে চেনে
শুধু অকৃতজ্ঞ আমরা চিনি না।’ 

(স্মরণের মীঢ়ে ধীরেন) 

ষাটের দশকে বাংলাদেশে যেসব কবিতা লেখা হয়েছে, তার প্রায় সবই বিবৃতিমূলক, কবিতার শরীরে প্রচুর মেদ, অধিক কথা, ত্রিশের দশকের বাংলা কবিতার স্ফুরণ ঘটেছিল রবীন্দ্রবিরোধিতার মধ্য দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর প্রভাবকে অস্বীকার করে কাব্য রচনার মধ্য দিয়ে কবিতাকে আধুনিকতার ফ্রেমে ফেলার স্বেচ্ছা-উদ্যোগের ধারা পরবর্তীকালেও চলে আসে। ষাটের দশকের যে অস্থির সময়-পর্ব, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংঘাতের মধ্যে দিয়ে একটি নতুন স্বপ্নের আশায় মানুষ নৈরাশ্য, দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। সেই জটিল সময়াবর্তের ভেতর রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করে রাবীন্দ্রিক শব্দপুঞ্জকে ক্রিয়াশীল রেখে শুরু থেকেই আসাদ চৌধুরী নিজেকে ব্যতিক্রম করে তুলতে চেয়েছেন। আসাদ চৌধুরীর কবিতা বিবৃতিময় না। তিনি অল্প কথায়, সীমিত শব্দের বন্ধনে ভাবকে মুক্তি দেন। অতীত এবং ভবিষ্যতের মাঝে দাঁড়িয়ে সেতুবন্ধনের সূত্র খোঁজেন। সেই সঙ্গে তিনি রবীন্দ্রপ্রভাবকে স্বীকার করে, আত্মস্থ করে ব্যক্তিত্ববোধকে নির্মাণ করেন। যখন নিজেকে প্রকাশের, আত্মবিবৃতির মধ্য দিয়ে মানুষ মুক্তি দিতে চাইছে ভাবনাকে। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত শব্দে, উপমায়, বর্ণনায় বারবার ঘুরে আসে রাবীন্দ্রিক আবহ। যেখানে উজ্জীবিত হওয়ার মতো উপাদান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কবির চেতনার মুক্তি অন্বেষাও। সময়ের সঙ্গে অঙ্গীভূত যে লোকাচার-লোকাভ্যাস লুপ্তপ্রায়, তাকে স্মৃতিতে জায়মান রাখেন কবি কবিতার রূপকে। 

কোথায় পালালো সত্য? 
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে, 
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে, 
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে, 
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো। 

গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো, 
চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ, 
সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা, 
জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা, 
নকশী পাতিল, চৌকির তলা, 
সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো! 

(সত্য ফেরারী) 

কবিতা সম্ভাবনার কথা বলে, আশাবাদী হতে শেখায়, অনুসন্ধানী হতে উৎসাহী করে তোলে। আসাদ চৌধুরীর কবিতা এড়িয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা দেয় না, বরং তার পরিণতিকে প্রকাশ করে। ফলে তার কবিতা একান্তভাবে ব্যক্তিআশ্রয়ী হয়ে পড়ে না। ব্যক্তির বিবর্তনকে প্রাধান্য দিলেও তাঁর কবিতায় মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে মানুষের বস্তুগত অবস্থান। তাই সুয়োরানি রাজধানী ও কেন্দ্রের দাপটে ম্রিয়মাণ মফস্বলের কথা তাঁর কবিতায় নিখুঁত বুননে কথা বলে ওঠে। 
‘মফস্বল, হায় দুয়োরানী, 
চেয়ে আছ সামনের দিকে, হাতে এখনো
পানের বাটা
আর নস্যির কৌটো। 
একটি চোখে অতীতের সোনালি আভা, 
একটি চোখে, ক্লান্ত চোখে, 
ভবিষ্যতের একঘেয়ে স্বপ্ন, 
বর্তমানকে ভোলার কী চমৎকার দাওয়াই
কী বিপুল মেধা নিয়ে, সুযোগের অপেক্ষায় আছ, 
মফস্বল, আমার দুঃখিনী মা। 
মেলোডির মতো শান্ত, স্নিগ্ধ
মফস্বল তোমার কী হলো?’ 

(মফস্বল, হায় দুয়োরানী) 

কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘কবি কোনো হাটে বসে কবিতা লেখেন না। তাঁর কবিতায় হাটের কোলাহল ভেসে আসতে পারে, থাকতে পারে মাঠের উদার শোভা, কিন্তু কবিতা নির্জনতারই প্রসূন। অর্থাৎ কবি যখন কবিতা লেখেন, তখন তিনি নিঃসঙ্গ। কিন্তু এই নিঃসঙ্গতা তাঁকে তাঁর সময় ও সমাজ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করে না।’ আসাদ চৌধুরীর কবিতার ক্ষেত্রে এই কথা যেন ধ্রুবতারার মতো সত্য। আর তাই হয়তো নিঃসঙ্গ নাগরিক আসাদ চৌধুরী যখন কবি আসাদ চৌধুরী, তিনি তখন তাঁর বুকের মধ্যে ধারণ করেন এক গ্রামীণ পটভূমি। যেখানে আছে নদী, গাছের শ্যামল ছায়া, প্রাচীন জনপদ, সেই জনপদের মানুষ, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনাসহ জীবনের বিচিত্র সব সম্ভার। সেখানে নানা রঙের সুর আছে, আছে নানাবিধ স্বর। আর সবকিছুর ওপরে আছে তাঁর নিজের একান্ত ব্যক্তিগত ধর্ম, নিজস্ব বাঙালিয়ানা। আরও আছে সৌন্দর্যের মায়াময় স্পর্শ, আছে ধ্বনির বৈচিত্র্য, রসময় অভিঘাত। 

ঠিক আছে
হাত ছেড়ে দিচ্ছি। 
ঠিকই বুঝেছ
টাকার এপিঠ ওপিঠের চেয়ে ঢের সত্য
আমার নিজের ধর্ম, 
আমার বাঙালিয়ানা। 
(‘ঠিক আছে’) 
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কবিতা আসলে ভালোও নয়, মন্দও নয়, কবিতার রস গ্রহণের মধ্যে আছে স্বীকৃতি।’ আসাদ চৌধুরীর কবিতায় বহুকৌণিক ব্যাখ্যা এবং দ্যোতনা যেমন স্পষ্ট, তেমনিভাবে তার সত্য আবিষ্কারের নেশাও দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। শহরকেন্দ্রিক জীবন, যেখানে মানিয়ে নেওয়া, খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠতে থাকে বিচ্ছিন্নতাবোধ, যা মানুষকে করে তোলে স্মৃতিকাতর, আবেগায়িত। মানুষ ফেলে আসা সময়, গ্রাম যাকে যে ধারণ করে বুকের নিভৃতে তার জন্য বিপন্ন বোধ করে, সেই নিঃসঙ্গ, সেই সংকটায়িত জীবনের দিকে বা বিচ্ছিন্নতাবোধকে আসাদ চৌধুরী সঙ্গী করেন না। তিনি নৈরাশ্য বা সংশয়কে অতিক্রম করে সচেতনভাবেই হয়ে ওঠেন জীবনের গুণগ্রাহী। কবির কাব্যপ্রত্যয় ব্যক্ত করে উচ্চারিত হয়—

শব্দ আর রঙ নিয়ে
এইসব মূলধন করে
তবু
কেউ কেউ পথের সন্ধানে নামে। 

(পথের কাব্য)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত