Ajker Patrika

ফরেন অ্যাফেয়ার্সের নিবন্ধ

অলিগার্কদের রাষ্ট্র লুণ্ঠনের আখ্যান: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ ও অন্যান্য

গত কয়েক দশকে বিশ্বজুড়ে লুটেরা শাসকদের উত্থান ও পতন দেখা যাচ্ছে। তিউনিসিয়া থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশ—সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রেও সেই লক্ষণ দৃশ্যমান। অলিগার্করা কীভাবে ‘রাষ্ট্রকে দখল’ করে, লুণ্ঠন করে এবং এর অর্থনৈতিক পরিণতি কী, তা নিয়ে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে লিখেছেন এলিজাবেথ ডেভিট ব্যারেট। একই সঙ্গে, এই অলিগার্কদের কারণে পরে যাঁরা নেতা হয়ে আসেন, তাঁদের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে, তা নিয়েও আলাপ করেছেন তিনি। এই লেখার অন্যতম প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে, সেটিরও ইঙ্গিত আছে এই নিবন্ধে। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৮: ১৮
শেখ হাসিনার পতনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাধারণ জনতার উচ্ছ্বাস। ছবি: আজকের পত্রিকা
শেখ হাসিনার পতনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাধারণ জনতার উচ্ছ্বাস। ছবি: আজকের পত্রিকা

ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ইলন মাস্ক যুগল মার্কিন প্রশাসনে যেন করাত চালিয়ে যাচ্ছেন! মাত্র তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে মাস্ক বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মী ছাঁটাই করেছেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বরখাস্ত কর্মকর্তাদের স্থলে অনুগতদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।

ট্রাম্প বিভিন্ন বিভাগের মহাপরিদর্শকদের বরখাস্ত করেছেন এবং সরকারি নৈতিকতা বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করেছেন। এই যুগল মিলে কংগ্রেসের অনুমিত বরাদ্দ নিজেদের হস্তগত করতে এবং তাঁদের প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে ‘পাওয়ার অব দ্য পার্স’ (অর্থ বরাদ্দের ক্ষমতা)-এর অপব্যবহার করেছেন।

ট্রাম্প প্রশাসন আরও বেশি করে মাস্কের কোম্পানির স্টারলিংক স্যাটেলাইট ডিশ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাস্কের কোম্পানিগুলোকে আরও বিলিয়ন ডলারের চুক্তির জন্য তালিকায় রাখা হয়েছে। অথচ এই কোম্পানিগুলো আগে থেকেই বিপুল পরিমাণ সরকারি ভর্তুকি পেয়ে আসছে। একই সময়ে ট্রাম্প তাঁর অ্যাজেন্ডা সমর্থন করে না, এমন বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দ তহবিল বাতিল করেছেন।

বেশির ভাগ আমেরিকানের কাছেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে ‘দুর্নীতি’ বলে মনে হবে না। আধুনিক মার্কিন ইতিহাসে কোনো ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের ফেডারেল সরকারব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেনি। ফলে সাধারণ নাগরিক সেই অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে অনেক কিছুই তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই চিত্র বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বৃহৎ পরিসরের একটি খণ্ডাংশমাত্র।

দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোতে রাজনীতিক, অভিজাত ব্যবসায়ী এবং ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদদের ছোট ছোট গোষ্ঠী—যাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় ‘পলিগার্ক’ বলা হয়—নিজেদের স্বার্থে রাষ্ট্রের স্বাভাবিক চরিত্রের বিকার ঘটিয়েছে। এই অশুভ আঁতাতগুলো একসঙ্গে মিলে বিদ্যমান আইন, নিয়ম পরিবর্তন করে, আমলাদের বরখাস্ত করে, সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে এবং এরপর দেশের সম্পদ গ্রাস করে। রাজনীতিবিদেরা ব্যাংক দখল করে, বিধিবিধান পরিবর্তন এবং সরকারি ক্রয় চুক্তি দখলে নেয়। একই সময়ে, তাদের বেসরকারি খাতের মিত্ররা ঘুষ, অনুদান এবং অনুকূল মিডিয়া কাভারেজ দেয়।

এই প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে ‘স্টেট ক্যাপচার’ বা ‘রাষ্ট্র লুণ্ঠন’। ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তারা এটি করে। বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক এবং আরও অনেক দেশে এটি ঘটেছে। এর সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাব কতটা, তা নির্ধারণ করা কঠিন এবং এর সম্পূর্ণ প্রভাব পুরোপুরি প্রকাশ পেতে বহু বছর লেগে যায়। তবে ঘটনাগুলো গুরুতর।

দখল করা অর্থনীতিতে প্রতিভা এবং সাফল্যের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়। রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই এমন দক্ষ কর্মীরা দেশ ছেড়ে চলে যান এবং সক্ষম সংস্থাগুলো দেউলিয়া হয়ে যায়। অন্যদিকে, ভালো যোগাযোগ আছে এমন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্ভাবন বা মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করা ছাড়াই (বা কখনো কখনো পণ্য সরবরাহ না করেও) ফুলে-ফেঁপে ওঠে। দেশের অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। ব্যাংকগুলো পছন্দের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ব্যাড লোন’ বা মন্দ ঋণ দিয়ে দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে প্রবৃদ্ধি কমে যায়, কর্মসংস্থান হ্রাস পায়, বৈষম্য বাড়ে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, রাষ্ট্র লুণ্ঠন ঠেকানো এবং সেই প্রক্রিয়াকে বিপরীতমুখী করা এক কঠিন কাজ। এ জন্য প্রয়োজন হুইসেলব্লোয়ার, সাংবাদিক এবং অ্যাকটিভিস্টদের নাগাড়ে সোচ্চার থাকা। দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের অধ্যবসায় ফলপ্রসূ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে—বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকেরা শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কিন্তু প্রায়শই সাফল্য আসে তখন, যখন দখলদারেরা অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে শোষণ করে ধ্বংস করে ফেলে এবং তত দিনে পুনর্গঠন অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।

লুণ্ঠিত রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে কোনো খাতই নিরাপদ নয়। তবে ব্যাংকগুলো বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়ে। বস্তুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই একটি অর্থনীতিকে মূলধন সরবরাহ এবং লেনদেন সহজ করে। আর রাষ্ট্র লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে এ দুটো খাতই দখলে অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মতে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকগুলোর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে দেশ থেকে অন্তত ১৭ বিলিয়ন ডলার লুট করেছেন।

মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক সরকারসমর্থিত বন্ড পছন্দের কোম্পানির কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন রকমের স্বজনতোষণমূলক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছেন। আর এ কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন ওয়ান এমডিবি নামের একটি রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ব্যাংককে। বিনিময়ে কোম্পানিগুলো নাজিবের দলকে তহবিল জুগিয়েছে। মোট ৭০০ মিলিয়ন ডলার তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।

আবার, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাঁকে সমর্থনকারী স্থানীয় মেয়রদের বেশি বেশি ঋণ দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করেন। ওই মেয়ররা তখন সেই তহবিল ব্যবহার করেন ব্যয়বহুল প্রকল্পের জন্য, যা তাঁদের এবং এরদোয়ানকে নির্বাচনে জিততে সাহায্য করে।

একটি দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। তুরস্কে এরদোয়ান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে তাঁর মিত্রদের নিয়োগ দিতে নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন। নাজিব রাজাক ওয়ান এমডিবিকে একেবারে নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছিলেন, যাতে এটি তাঁর ব্যক্তিগত জমিদারিতে পরিণত হয়। হাঙ্গেরিতে প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবান দেশের বৃহত্তম বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে ছাড়কৃত মূল্যে ব্যাংক শেয়ার কেনাবেচার এক জটিল কৌশল ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের মতে, শেখ হাসিনা তাঁর অলিগার্ক মিত্রদের কাছে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য করতে দেশের গোয়েন্দা বাহিনীকে ব্যাংক পরিচালক এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের অপহরণ ও হুমকি দিয়েছিলেন।

এ ধরনের দখলের অর্থনৈতিক ক্ষতি ধ্বংসাত্মক হতে পারে। সবচেয়ে স্পষ্ট যে বিষয়টি সেটি হলো—এই প্রক্রিয়া একটি দেশের অর্থনীতি থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সরিয়ে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, নাজিব তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংক ব্যবহার করে মালয়েশিয়া থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার (দেশের জিডিপির ১ শতাংশ) লুট করেছিলেন এবং শেখ হাসিনা সম্ভবত ৩০ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশের জিডিপির ৭ শতাংশ) পর্যন্ত লুট করেছেন।

বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ব্যাংক দখলের বিষয়টি আরও কৌশলী উপায়ে বাজারকে নষ্ট করে। কোম্পানিগুলোকে দেওয়ার জন্য অর্থাৎ বিনিয়োগ করার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে সীমিত পরিমাণ অর্থ থাকে। তাই যখন কোনো ব্যাংক রাজনৈতিক সংযোগের কারণে ঋণ দেয়, তখন তারা সুস্থ বা সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার সুযোগ হারায়। এমনকি তারা রাজনৈতিক সংযোগ থাকা কোম্পানিগুলোকে ঋণ দিতে দিতে একসময় ফতুর হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তাদের আমানত হারায় এবং আর্থিক সংকট দেখা দেয়। শ্রীলঙ্কা ও তুরস্কে এর ফলে চরম মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। কারণ, সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণে ক্রমাগত টাকা ছাপাতে থাকে। তুরস্ক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার আশায় সুদের হার বাড়াতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

অবশ্য, রাষ্ট্র লুণ্ঠনকারীরা কেবল ব্যাংকেই তাদের কারসাজি সীমাবদ্ধ রাখে না; তারা সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও বিধিনিষেধও পরিবর্তন করে। শ্রীলঙ্কায় ২০০৫-২২ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা রাজাপক্ষে পরিবার চিনি আমদানিতে শুল্ক ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়। মূলত, এটি তাদের ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী কোম্পানিকে বিশাল অঙ্কের কর ছাড় দেওয়ার জন্যই করা হয়েছিল। এর ফলে কোম্পানিটি সস্তায় আমদানি করা চিনি বর্ধিত মূল্যে বিক্রি করে বিপুল মুনাফা করে। এতে দেশটির রাজস্বে বড় ক্ষতি হয়। এই ছাড়ের কারণে শ্রীলঙ্কা ২০২১ সালের মোট রাজস্বের ১ দশমিক ৩ শতাংশ পরিমাণ অর্থ হারায়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র লুণ্ঠনকারীরা পছন্দের কোম্পানিগুলোকে নিয়মকানুন ও আইনের বিধিনিষেধ থেকে অব্যাহতি দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিউনিসিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইন এল-আবেদিন বেন আলি ও তাঁর পরিবার গাড়ি ও ইলেকট্রনিকসের মতো ভোগ্যপণ্য আমদানি করা কয়েকটি কোম্পানির মালিক ছিল। এসব পণ্য আমদানিতে তাদের প্রচুর শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু তাঁর সরকার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোকে কর ফাঁকির সুযোগ দেয়। ফলে বেন আলি পরিবার বিশাল মুনাফা অর্জন করে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক সংযোগ না থাকা কোম্পানিগুলোকে কর দিতে হয়েছিল। ফলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে এবং বৈষম্য আরও বাড়ে।

এই লুণ্ঠনকারীরা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে ভেঙে ফেলতে সচেষ্ট থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকায়, ২০০৯-১৮ সাল পর্যন্ত দেশটির নেতৃত্ব দেওয়া জ্যাকব জুমা, তিন ব্যবসায়ী ভাই অজয়, অতুল ও রাজেশ গুপ্তের অংশীদার হয়ে রাজস্ব পরিষেবাকে (সার্স) দুর্বল করার চেষ্টা করেছিলেন।

সংস্থা হিসেবে সার্স কর ফাঁকি ও আর্থিক অপরাধ তদন্তের জন্য অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিল। ২০১৩ সালে ওই তিন ভাই জানতে পারেন, তাঁদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে জুমা সার্সে অনুগত কমিশনার নিয়োগ করেন, যিনি সংস্থার শীর্ষ পদে ব্যাপক রদবদল ঘটান। সার্সের তদন্ত করার ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষ করে দেওয়া হয়।

রাজনৈতিক সমালোচনা মোকাবিলা করতে, গুপ্ত ভাইয়েরা নিজেদের সংবাদপত্র ও টেলিভিশন স্টেশন ব্যবহার করে সার্সের সুনাম নষ্ট করার জন্য কুৎসা রটাতে শুরু করে।

জুমা ও গুপ্ত ভাইয়েরা নিজেদের রক্ষায় যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, তা সফল হয়েছিল। গুপ্তদের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত বাতিল হয়। ক্ষতি কাটাতে পরে পুনর্গঠন করা হলেও সার্স উল্লেখযোগ্যভাবে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ব্যয় কমাতে হয়েছে।

রাষ্ট্র লুণ্ঠনের জন্য যেসব কাজ প্রয়োজন, সেগুলোর সবটাই খুব একটা জটিল নয়। মাঝে মাঝে, অলিগার্করা সরাসরি রাষ্ট্র থেকেই চুরি করে। উদাহরণস্বরূপ, এরদোয়ান তুরস্কের সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত আইন বহুবার পরিবর্তন করেছেন, যাতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে দরপত্রের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারেন। এরপর থেকে তিনি এই ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি ব্যবসা পাঁচটি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছেন। এই কোম্পানিগুলো সরকারি টেন্ডার জেতার দিক থেকে বিশ্বের দশটি সফল কোম্পানির মধ্যে অন্যতম। বিনিময়ে, এই কোম্পানিগুলো এরদোয়ানকে বিপুল পরিমাণ ইতিবাচক সংবাদের মাধ্যমে আনুকূল্য দিয়েছে। কারণ, এসব কোম্পানির প্রায় সব কটিরই গণমাধ্যম আছে। কেবল তা-ই নয়, এসব কোম্পানি এরদোয়ানের দল পরিচালিত দাতব্য প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়েছে এবং নিজ কর্মীদের এরদোয়ানের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে।

একই পথে হেঁটেছে দক্ষিণ আফ্রিকাও। জুমার আমলে গুপ্ত ভাইয়েরা একের পর এক ঠিকাদারি পেয়েছে এবং অন্যান্য সংস্থা থেকে ঘুষ আদায়ে নিজেদের প্রভাব ব্যবহার করেন। ছোটখাটো একটি কম্পিউটার কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুতই বিলিয়ন ডলারের ব্যবসার মালিক বনে যান তাঁরা। ডেইরি থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং হয়ে কয়লার মতো বিভিন্ন খাতে চুটিয়ে ব্যবসা করেছে গুপ্ত ভাইয়েরা। তাঁরা জুমার সরকারের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, এমনকি মন্ত্রিপরিষদে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর প্রধানও তাঁরা ঠিক করতেন। বিনিময়ে, গুপ্তরা জুমার পকেটে অর্থ সরবরাহ করতেন এবং জুমাকে সমর্থন করে প্রচারণা চালাতেন।

এ ধরনের দুর্নীতি উন্নয়নের গতি অনেক কমিয়ে দেয়। একটি সুস্থ অর্থনীতির দেশে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো গুণমান ও দামের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করে। কিন্তু একটি লুণ্ঠিত রাষ্ট্রে তারা অর্থনীতিতে ‘কার্যকর সম্পর্ক’ তৈরির মাধ্যমে সফল হয়। এর সঙ্গে আর উদ্ভাবন বা দক্ষতার তেমন একটা যোগ থাকে না।

অনেক দক্ষ ও সেরা কোম্পানি কেবল সঠিক যোগাযোগ না থাকায় পিছিয়ে পড়ে। উদ্যোক্তা হতে আগ্রহীরা ব্যবসা শুরু করার চেষ্টাও করেন না। অনেক দক্ষ কর্মী এমন বাজারের সন্ধানে দেশ ছাড়েন যেখানে প্রতিভা পুরস্কৃত হয়, ক্ষমতার নৈকট্য নয়। সুবিধাপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলো বেশি দাম নিয়ে কম পরিষেবা দেয়। ফলে অর্থনৈতিক উৎপাদন হ্রাস পায়, জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়। এমনকি, কখনো কখনো মানুষ তাদের প্রাণও হারায়।

একাধিক গবেষণা অনুসারে, তুরস্কের অবকাঠামো উন্নত হলে ২০২৩ সালের ভূমিকম্পে কম প্রাণঘাতী হতে পারত। কারণ, এরদোয়ান প্রতিযোগিতামূলক কোম্পানিগুলোকে ঠেকিয়ে পছন্দের কোম্পানিগুলো অবকাঠামো খাতে সুযোগ দিয়েছিলেন। এতে নির্মাণের মান খারাপ হয়।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখল কীভাবে দুর্নীতির কারণে আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা এস্কম। একসময়ের অত্যন্ত সফল সংস্থা ছিল। কিন্তু জুমার আমলে এস্কম খোলা বাজার থেকে কয়লা না কিনে গুপ্ত পরিবারের কাছ থেকে কিনতে বাধ্য হয়। নিম্নমানের কয়লা চড়া দামে কিনতে হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, এস্কম এবং অন্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা রেলওয়ে অপারেটর ট্রান্সনেটের ব্যর্থতার কারণে গত ১৫ বছরে দেশটির অর্থনীতি প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষতির শিকার হয়েছে।

একপর্যায়ে, এই অর্থনৈতিক সংকট ‘রাষ্ট্র লুণ্ঠনকারীদের’ জন্যও সমস্যা তৈরি করে। কারণ, চুরি করার মতো অর্থের পরিমাণ তো সীমিত। তবে বাজার ভেঙে পড়লেও পলিগার্করা কদাচিৎ নীতি পরিবর্তন করে। বরং তারা অর্থনীতিকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়; যতক্ষণ না সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় এবং ততক্ষণ তারা চুরি করতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় দেশটির জিডিপির ১১৪ গুণ বেশি। ফলে দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সংকট তৈরি হয়, জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতি দেখা দেয়। মূল্যস্ফীতি ৪৯ শতাংশে পৌঁছায়।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তাঁর ভাই ঘনিষ্ঠ মিত্রদের জন্য কর ছাড় বজায় রেখেছিলেন। বৈদেশিক মুদ্রা কেনায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও মিত্রদের ডলার খরচে সীমা ছিল না। তাঁরা ঋণখেলাপি হতে পারত এবং জনগণের নাম করে আইএমএফের কাছে সাহায্য চাইতে পারত। কিন্তু পরিবর্তে, তারা তাদের অধিভুক্ত সংস্থাগুলোর মালিকানাধীন বন্ডের অর্থ পরিশোধ করতে থাকে। এতে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে যায়।

পলিগার্করা পুরোপুরি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারলে, একটা পর্যায়ে বিরোধীদের মুখোমুখি হয়। এমনকি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রেও এমন সব প্রতিষ্ঠান থাকে, যেগুলো নির্বাহী ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করে। আদালত বেআইনি সিদ্ধান্ত বাতিল করে, নিরীক্ষা সংস্থাগুলো জালিয়াতি উদ্ঘাটন করে এবং সাংবাদিকেরা দুর্নীতিগ্রস্ত চুক্তি ফাঁস করেন। সাহসী নাগরিকেরা অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি নেয়। কখনো কখনো তারা প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। কিন্তু এই লুণ্ঠনকারীরা প্রায়শই জবাবদিহি এড়িয়ে যেতে সফল হয়।

তবে বিরোধীরাও সফল হয় কখনো কখনো। হাসিনা, রাজাপক্ষে ও জুমা তার উদাহরণ। কিন্তু প্রায়শই অর্থনীতি গভীর সংকটে পড়ার পরেই কেবল লুণ্ঠনকারীরা উচ্ছেদ হয়। রাজাপক্ষের পতনের আগে শ্রীলঙ্কায় ভোগ্যপণ্যের সংকট ও আকাশছোঁয়া মূল্যস্ফীতি দেখা গিয়েছিল। শেখ হাসিনা অনুগতদের সরকারি চাকরি দেওয়ার চেষ্টা করলে বিক্ষোভকারীরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু তত দিনে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আজ ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধসের দ্বারপ্রান্তে। মানুষ তাদের আমানত তুলতে এবং মৌলিক অনেক পণ্যও কিনতে অক্ষম (অবশ্য পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে)।

এই ব্যাপক ক্ষতি থেকে দেশগুলোর পুনরুদ্ধার পাওয়া কঠিন। নতুন নেতারা চুরি করা সম্পদের কারণে সৃষ্ট বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষত ভরাট করতে হিমশিম খান। কারণ, তাঁদের বিধ্বস্ত অর্থনীতির কোনো সুস্পষ্ট করের ভিত্তি নেই। আর্থিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত, তাই তাঁরা ঋণ নিতেও হিমশিম খান। তাঁরা সেই অলিগার্কদের পেছনে লাগতে পারেন, যারা এই চুরি করা সম্পদের বেশির ভাগ অংশের মালিক। কিন্তু প্রায়শই, সেই অভিজাতেরা বিদেশে থাকেন। যাঁরা রয়ে গেছেন, তাঁরাও তাঁদের সম্পদ বিদেশে সরিয়ে ফেলেছেন, ফলে রাষ্ট্রের পক্ষে সেই অর্থ আদায় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন আরও বেশি কঠিন। নতুন নেতৃত্ব হয়তো আমলাতন্ত্রকে পরিশুদ্ধ করতে চাইতে পারে, কিন্তু ব্যাপক হারে বরখাস্ত করলে তা প্রতিশোধমূলক মনে হবে এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় কর্মীশূন্য হয়ে পড়বে। ফলে নেতাদের পুনর্গঠনের জন্য একটি ধীরস্থির পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যার অর্থ হলো, কিছু সময়ের জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বেতন দেওয়া চালিয়ে যাওয়া।

একইভাবে, আরও বিপর্যয় এড়াতে নতুন সরকারগুলো দেখতে পায় যে তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানিগুলোকে অর্থ প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। সমাজের কিছু নির্দিষ্ট সম্পদের প্রয়োজন—খাবার, পানি, বিদ্যুৎ, ওষুধ—এবং বছরের পর বছর ধরে দখলের পর, উপযুক্ত সরবরাহকারী খুঁজে বের করতে সময় লাগে। নতুন ব্যবসাগুলো বাজারে প্রবেশের আগে নিশ্চিত হতে চায় পরিস্থিতি আগের মতো নেই।

এখন ট্রাম্প-মাস্ক মার্কিন অর্থনীতিকে দখল করতে সফল হলে তাঁরা কেবল মার্কিন বাজারকেই উলটপালট করবেন না; বরং বিশ্ব অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং প্রধান আর্থিক কেন্দ্র, সুতরাং সেখানে যা ঘটে, তার প্রভাব সর্বত্র পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে ওয়াশিংটন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পরিচ্ছন্ন শাসনের প্রবক্তা হিসেবে অন্য দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু ট্রাম্প ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিস আইনের প্রয়োগ স্থগিত করতে এবং করপোরেট স্বচ্ছতাবিষয়ক প্রয়োজনীয়তাগুলো শিথিল করতে পদক্ষেপ নিয়েছেন।

অন্যভাবে বলতে গেলে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল বিশ্বের পরিচ্ছন্ন শাসনের পাহারাদারের ঐতিহাসিক ভূমিকা ত্যাগ করছে না; বরং পক্ষ পরিবর্তন করে একটি মাফিয়া প্রধানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের রোল মডেলে পরিণত হচ্ছে।

লেখক: এলিজাবেথ ডেভিড ব্যারেট, ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের দুর্নীতিবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৪২
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত
খামেনির ইরান ও নেতানিয়াহুর ইসরায়েল নতুন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেছে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের সঙ্গে নতুন করে বড় ধরনের সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক তৎপরতা। দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কমিটির এক গোপন বৈঠকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেছেন।

হিব্রু ভাষার ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম মারিভের খবরে বলা হয়েছে, ওই বৈঠকে এক সামরিক প্রতিনিধি সংসদ সদস্যদের জানান, তেহরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং হামলার সক্ষমতা পুরোপুরি পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। আইডিএফের আশঙ্কা, আগের মতোই ইরান একযোগে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের ভূখণ্ডে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।

গত এক মাসে পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতেও ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা নিয়ে সতর্কবার্তা জোরালো হয়েছে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ও কিছু বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘর্ষ এড়ানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় পক্ষ দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, পরোক্ষ বা প্রক্সি ফ্রন্ট বিস্তৃত করছে এবং কূটনৈতিক পথ থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বর্তমান উত্তেজনার একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির (জেসিপিওএ) মেয়াদ শেষ হওয়া। চলতি বছরের অক্টোবরে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। ফলে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তেহরানের দাবি অনুযায়ী তারা উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের সব মজুত ধ্বংস করেছে। কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, এর একটি অংশ গোপনে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যেও উদ্বেগ বাড়ছে—তাদের মতে, ইরানে ইসরায়েলের আরেকটি হামলা ‘হবে কি না’ এটা প্রশ্ন নয়, হামলা ‘কবে হবে’—সেটাই বড় প্রশ্ন। ইসরায়েলের দৃষ্টিতে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তেল আবিবের এই মনোভাব সামরিক হামলার সম্ভাবনাকে প্রায় অনিবার্য করে তুলছে।

এদিকে, আন্তর্জাতিক সংকট বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরান প্রকল্পের পরিচালক আলি ভায়েজ জানান, তাঁর ইরানি সূত্র অনুযায়ী দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো দিনে ২৪ ঘণ্টাই চালু আছে। তাঁর ভাষায়, নতুন কোনো সংঘাত হলে ইরান আগের মতো ১২ দিনে ৫০০টি নয়, বরং একযোগে ২ হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দিতে চায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের মূল কারণগুলো এখনো অমীমাংসিত থাকায় সংঘাতের একটি চক্রাকার ধারা তৈরি হয়েছে, যেখানে উত্তেজনা প্রায় কাঠামোগতভাবেই অনিবার্য। ইরানের দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ (যার মধ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক মিত্র ও গোষ্ঠী রয়েছে) গত জুনে ১২ দিনের যুদ্ধে এবং বিশেষ করে গত বছর সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের পর বড় ধাক্কা খেয়েছে। তবু ইরানের হাতে এখনো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক রসদ রয়েছে। যেমন—ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ (হুতি), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরাকের বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া। এসব শক্তির মাধ্যমে তেহরান এখনো এক ধরনের অপ্রতিসম প্রতিরোধ সক্ষমতা ধরে রেখেছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কার্সরইনফোর বরাতে জানা যায়, দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার এক শীর্ষ সূত্রের দাবি—ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই, অর্থাৎ ২০২৯ সালের জানুয়ারির আগে ইরানে শাসক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বিবেচনায় রেখেছে ইসরায়েল। সূত্রটি জানায়, ইরান একদিকে যেমন ক্ষেপণাস্ত্র ভান্ডার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও প্রতিরক্ষা স্থাপনাগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে নজরদারিতে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আরেকটি সামরিক সংঘাত এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ইরান নাতানজের দক্ষিণে ‘পিকঅ্যাক্স মাউন্টেন’ নামে একটি নতুন ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মূল উপাদান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ করছে। সেখানে এখনো আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পরিদর্শকদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি।

এই প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, তেহরান শান্তি ও সংলাপ চায়, তবে চাপের কাছে মাথা নত করবে না, পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিও পরিত্যাগ করবে না। তাঁর মতে, এসব কর্মসূচি জাতীয় সার্বভৌমত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি বহুপক্ষীয় আলোচনায় ফেরার আগ্রহ দেখালেও শর্ত দিয়েছেন—‘ইরানের বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে’।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও তাতে জড়াবে?

গেল নভেম্বরের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেন, জুনে ইরানে ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্র সম্পৃক্ত ছিল। বিষয়টি এত দিন হোয়াইট হাউস অস্বীকার করে আসছিল। ওই সময় ট্রাম্প আরও বলেন, ওয়াশিংটন চাইলে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতেও প্রস্তুত।

ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওয়াশিংটনে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সেখানে ট্রাম্প আবার বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি চায় এবং ওয়াশিংটন আলোচনায় প্রস্তুত। একই দিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা কামাল খারাজি জানান, পারস্পরিক সম্মান ও সমতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইরান, তবে প্রথম পদক্ষেপ ওয়াশিংটনকেই নিতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আলোচনার বাইরে, কারণ এটি জাতীয় প্রতিরোধের মূল স্তম্ভ। কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়েই সীমিত আলোচনার সুযোগ রয়েছে, তাও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না হলে।

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক চাপে আরেকটি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু ইসরায়েল এই পরিস্থিতিকে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে দেখছে। ইসরায়েল চাচ্ছে, তারা এই সুযোগে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে দেবে।

সব মিলিয়ে, তেহরান আশাবাদী কথাবার্তায় ভরসা করছে না। ইরানি কূটনীতিকদের ধারণা, ইসরায়েল আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি উপেক্ষা করেই সামরিক পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। তাদের মতে, ইসরায়েল হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্রকে যেকোনোভাবে সংঘাতে টেনে আনার চেষ্টা করবে—যদিও ট্রাম্প নতুন যুদ্ধ এড়াতে চান।

যুক্তরাষ্ট্র চাক বা না চাক, পরিস্থিতির চাপে তাকে শেষ পর্যন্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হতে পারে। আর যদি ইরান ইসরায়েলি হামলার জবাবে আরও কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাহলে ওয়াশিংটনের সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত এসে দাঁড়াবে—হস্তক্ষেপ করবে, নাকি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ইরান অবশ্য স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে—তারা ধ্বংসের ভয় পায় না এবং সর্বাত্মক যুদ্ধে নামলে ‘ইসরায়েলকেও সঙ্গে নিয়ে ডুববে’।

আরটি থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত