Ajker Patrika

পরিবর্তিত যুদ্ধকৌশলে নতুন রণক্ষেত্র হয়ে উঠছে শহর

মাহবুবুর রহমান
আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২২, ১১: ২৭
পরিবর্তিত যুদ্ধকৌশলে নতুন রণক্ষেত্র হয়ে উঠছে শহর

বর্তমানে যুদ্ধের ময়দান আর খোলা মাঠে নেই। মাঠ পেরিয়ে শহরে শহরে যুদ্ধ এখন নিয়মিত ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেনের কথাই ধরা যাক। গত এপ্রিলে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেছিলেন, ‘মারিউপোল শহরটির অস্তিত্ব আর নেই।’ রাশিয়ার আক্রমণের সাত সপ্তাহের মধ্যেই বোমা, গোলা ও রকেট হামলায় আজভ সাগরের তীরবর্তী শহরটি রাশিয়ার দখলে চলে যায়। এর এক মাস পরই শহরটির পতন হয়। মারিউপোলের মেয়র জানিয়েছেন, ১ হাজার ৩০০ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা গেছে, শহরটির অর্ধেক এলাকাই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে সংকটে পড়েছে শহরটির ৪ লাখ জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই।

সামরিক ও নিরাপত্তা জার্নাল টেক্সাস ন্যাশনাল সিকিউরিটি রিভিউয়ে লন্ডনের কিংস কলেজের শিক্ষক ও ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হুগো স্ট্যানফোর্ড-টাক লিখেছেন, ‘মারিউপোলের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা হয়ে থাকবে। শহরে যুদ্ধ করার বিষয়টি জেনারেলরা সব সময়ই অবজ্ঞা করেছেন, এড়িয়ে গেছেন।’ তবে জেনারেলরা না চাইলেও এখন শহরে যুদ্ধ করতে হচ্ছে এবং এই নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা অতীত থেকে শিখছেন এবং আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে যুদ্ধকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

গত জুলাইয়ে ব্রিটেনের চিফ অব জেনারেল স্টাফ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এমন লড়াইয়ে রত ছিল, যেখানে খুবই নিম্নমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যতের যুদ্ধে শহরই রণক্ষেত্র হয়ে উঠবে। এ বিষয়ে মার্কিন মিলিটারি একাডেমিতে দেওয়া এক ভাষণে মার্কিন সেনাবাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফসের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি বলেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই শহরে যুদ্ধের উপযোগী হয়ে উঠতে হবে।’ তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, সব মিলিয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিশেষ করে ছদ্মবেশ থেকে শুরু করে যানবাহন এবং অন্যান্য সরঞ্জামেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।

এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, শহরের রণক্ষেত্র হয়ে ওঠা এবং এ নিয়ে বিশ্বের সেনাবাহিনীগুলোর ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এক অর্থে, সেনাবাহিনীগুলো নিকট ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ের যুদ্ধগুলোর কেন্দ্রবিন্দুই ছিল শহর। ২০২০ সালে আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্র ছিল নাগরনো-কারাবাখের শহর শুশা, ২০১৪ সালে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কা শহরে আইএসের বিজয় এবং দুই বছর পর ওই দুই শহরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের হাতে জিহাদিদের পতন শহুরে যুদ্ধের অন্যতম উদাহরণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনের শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ করেছে এবং এর মাধ্যমে মারিউপোল, দনবাসের সেভেরোদোনেৎস্ক এবং লিসিশানস্ক দখলে নিয়েছে। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে ইউক্রেন আশা করেছিল তারা দক্ষিণাঞ্চলের শহর খেরসন পুনরুদ্ধার করতে পারবে।

ইসলামিক স্টেট ও মার্কিন সৈন্যদের সংঘর্ষে বিধ্বস্ত ইরাকের মসুল শহরএই প্রবণতার আরেকটি বড় কারণ হলো—২১ শতক শুরুর আগ পর্যন্ত শহরের তুলনায় গ্রামে মানুষ বেশি বাস করত। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বাস করে শহরে। ২০৫০ সালের মধ্যে তা মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ পৌঁছাবে। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গায় এই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, তাইওয়ানের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই বাস করে শহরে। ফলে তাইওয়ানে আক্রমণ করলে চীনকে তাইওয়ানের শহরাঞ্চলেই যুদ্ধ করতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের শহরগুলো ক্রমেই আকারে বড় হয়ে উঠছে। বাড়ছে শহুরে জনসংখ্যাও। ১৯৫০ সালেই নিউইয়র্ক ও টোকিও মেগাসিটির খ্যাতি অর্জন করে। সে সময় শহর দুটির বাসিন্দা ছিল ১ কোটিরও বেশি। সম্প্রতি জাতিসংঘ ‘২৩০০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা’-শীর্ষক এক প্রতিবেদনে সতর্ক করেছে, সাধারণ শহরগুলোও দ্রুত মেগাসিটিতে পরিণত হবে।

প্রাচীনকালে শহরের আশপাশে যুদ্ধ হলেও ভেতরে হয়েছে খুবই অল্প। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি কিং ইকোনমিস্টকে বলেছেন, ‘শহরগুলোর আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের চ্যালেঞ্জও বেড়েছে। অতীতে শহরগুলোর যুদ্ধে শহরবাসীও যুক্ত হতো। সে সময় আক্রমণকারীরা শহরের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করত এবং শহরের ওপর তাণ্ডব চালাত। যেমন, ৮০ বছর আগে স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল প্রায় ৫ লাখ সৈন্য, আর শহরটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ। বিপরীতে, বর্তমানে শহরের জনসংখ্যার তুলনায় সেনাবাহিনীর আকার খুবই ছোট হয়। যেমন, ২০১৬ সালে ১৭ লাখ মানুষের শহরের নিয়ন্ত্রণে নিতে যুদ্ধ শুরু করেছিল মাত্র ১ লাখের কাছাকাছি সৈন্য। 

ধ্বংসাত্মক প্রবণতা এবং বর্বরতার জন্য বর্তমানের শহুরে যুদ্ধের কুখ্যাতি রয়েছে। নির্মাণাধীন এলাকাগুলোয় সৈন্যদের লুকানোর প্রচুর জায়গা থাকে এবং এই প্রবণতার কারণে প্রায়ই খুবই অল্প দূরত্বের ব্যবধানে দুই বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। এ ছাড়া শহুরে যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রায়ই বুবি ট্র্যাপ এবং ল্যান্ড মাইন ব্যবহার করে বড় বড় দালান ধসিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শহরে যুদ্ধরত সৈনিকদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়, যা সৈন্যদের মানসিক অবস্থাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বনভূমিতে যুদ্ধের সময়ও একইরকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে শহরে যুদ্ধের ক্ষেত্রে সর্বদা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখতে হয়। কিন্তু বন বা খোলা প্রান্তরে যুদ্ধ হলে এমন হয় না। ফলে শহরে যুদ্ধ করাটা সব সময়ই কঠিন। একজন ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তাকে ‘কোথায় লড়াই করতে পছন্দ করবেন’—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘একটি শহরকে ধ্বংস করার কোনো অনুমতিই আমার নেই।’

কংক্রিটের জঙ্গল
অ্যান্থনি কিংয়ের মতে, ছোট আকারের সেনাবাহিনী কর্তৃক শহর আক্রমণের ফলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঘটে তা হলো—‘স্থানীয় ভূখণ্ড দখলের’ মাধ্যমেই তা অনেক সময় শেষ হয়ে যায়। আবার অনেক সময় কিছু অবকাঠামো দখলে নেওয়া হলেও যুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। তবে এর বিপরীত দিকও রয়েছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর আর্মড ডিভিশনের সাবেক ব্রিগেড অধিনায়ক পিটার মনসুর বলেন, ‘অনেক সময় একটি মাত্র দালান দখল করতে গিয়েও পুরো একটি ব্রিগেড নাই হয়ে যেতে পারে।’

আধুনিক বিস্ফোরক অস্ত্রগুলো ইউরোপের সমভূমিতে স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই অস্ত্রগুলো কোনো জনবহুল এলাকায় ব্যবহারের ফলে হতাহত প্রতি দশজনের নয়জনই হয় বেসামরিক নাগরিক। সাম্প্রতিক সময়েই এর বাস্তব উদাহরণ রয়েছে। রুশ বাহিনী কর্তৃক এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার কেবল মারিউপোল, সেভেরোদোনেৎস্কসহ ইউক্রেনের আরও অনেক ছোট শহরই ধ্বংস করেনি, ধ্বংস করেছে সিরিয়ার আলেপ্পো এবং চেচনিয়ার গ্রোজনিকেও।

ইরাকের মসুলে ইসলামিক স্টেট (আইএস) গ্রুপকে লক্ষ্য করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোট বাহিনীর হামলার পর বিধ্বস্ত শহর

এমনকি একটি সর্বাধুনিক বোমা একটি শহরকে সম্পূর্ণরূপে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারে। ইরাকের মসুলে মার্কিন বিমান হামলায় ভবনগুলোতে নির্ভুলভাবে আঘাত করেছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা পালিয়ে যেতে শুরু করায় মার্কিন বাহিনী তাদের ধাওয়া করে বোমা বর্ষণ করতে থাকে। এর ফলে পুরো শহর বোমার আঘাতে জর্জরিত হয়। মার্কিন সেনাবাহিনীর মেজর অ্যামোস ফক্স এই হামলার বিষয়ে বলেছিলেন, বোমাগুলো একের পর এক বিভিন্ন দালানে আঘাত করে। এর ফলে সেই সময় মসুলে ১০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক লোক প্রাণ হারায়। এই প্রাণহানির এক-তৃতীয়াংশই ঘটেছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট দ্বারা।

কোনো একটি শহরে যুদ্ধের সময় শহরটির বাসিন্দারা নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে বসে থাকেন না। মার্কিন থিংকট্যাংক মেডিসন পলিসি ফোরামের আরবান ওয়ারফেয়ার স্টাডিজের চেয়ারপারসন ও সাবেক মেজর জন স্পেনসার গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ আক্রমণের কয়েক দিনের মাথায় ইউক্রেনের শহরবাসীদের সামরিক পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন। গত জুন মাসে তিনি কিয়েভ পরিদর্শনকালে জেনেছিলেন কীভাবে স্থানীয় একটি মাত্র ব্রিগেড বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবকেদের সহায়তায় কেবল একে-৪৭ রাইফেলের সহায়তায় তাদের শহরটির সুরক্ষা দিয়েছিল। সে সময় শহরটির বাসিন্দারা নিজেরাই ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হয়ে গোয়েন্দার কাজ করেছে। তাঁর শহরটির ভেতরে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যাওয়ার নাম করে রাশিয়ার সৈন্যদের অবস্থান চিহ্নিত করে তা ইউক্রেনের সৈন্যদের জানিয়ে দিত।

ইকোনমিস্ট বলছে, আধুনিক শহরগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, শহরের ভূগর্ভস্থ যোগাযোগ প্রসারিত করা। এ বিষয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর গবেষক মার্কো বুমার জানিয়েছেন, কীভাবে প্রতিরোধ যোদ্ধারা মসুলের সিঙ্কহোল এবং গুহাগুলো ব্যবহার করে নতুন সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। বেশ কিছু সুড়ঙ্গ এতটাই চওড়া ছিল যে, সেখান দিয়ে অনায়াসে যানবাহন চলাচল সম্ভব হতো। খালি হাত থেকে শুরু করে বোরিং মেশিন ব্যবহার করে এসব সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। অধিকাংশ সুড়ঙ্গেই আবাসন, হাসপাতাল এবং উত্তম বায়ু চলাচল ব্যবস্থা ছিল। গত বছরই ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, তারা গাজায় অন্তত ১০০ কিলোমিটার এমন সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে দিয়েছে। সর্বশেষ, ইউক্রেনের মারিউপোলের আজভস্টাল কারখানায়ও সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ইউক্রেনের বাহিনী দীর্ঘ সময় শক্ত অবস্থান বজায় রেখেছিল। 

পশ্চিমারা দীর্ঘদিন ধরে যেসব নতুন প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে আসছে সেগুলো অনেকাংশেই ভূপৃষ্ঠের নিচে কাজ করে না। যেমন, স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে নজরদারি। ভূপৃষ্ঠের নিচে তো বটেই ওপরও অনেক সময় এসব প্রযুক্তি যথাযথ কাজ করতে পারে না।

এ বিষয়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গ্যাল হারশ ইকোনমিস্টকে বলেছেন, আধুনিক শহরের উঁচু উঁচু ভবনের মধ্যবর্তী ‘শহুরে গিরিখাতে’ সামরিক রেডিও সংকেত বাধাগ্রস্ত হতে পারে। কারণ শহরগুলো নানা ধরনের রেডিও এবং টেলিভিশন তরঙ্গে ভরপুর। গ্যাল হারশ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো—এ রকম জনবহুল জটিল এলাকায়, আমাদের যা দেখানো হয় আমরা কেবল তাই দেখতে পাই। আমরা এমন কিছু দেখতে পারি না, যা শত্রু বাহিনী আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখছে।’

ইসলামিক স্টেট বাহিনী থেকে শহরটি পুনরুদ্ধারে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধে সংকুচিত এক সৈনিক

মার্কিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল লিয়াম কলিন্সের দাবি, এ ধরনের অসুবিধাগুলো আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে যে—কেন মার্কিন সেনাবাহিনী এখন অবধি শহুরে যুদ্ধ সম্পর্কে চিন্তা করা থেকে দূরে রয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে যুদ্ধ চিন্তা, তা শহুরে যুদ্ধের মডেলের সঙ্গে খাপ খায় না। আমরা যেন আবারও উপসাগরীয় যুদ্ধের মতোই ভবিষ্যতের যুদ্ধে লড়তে চাই।’

এখন সশস্ত্রগুলো বাহিনী বুঝতে পেরেছে, শহুরে যুদ্ধ আরও নিয়মিত হয়ে উঠতে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে একটি ইউরোপীয় যুদ্ধ শুরু হলে তাঁর গতিপ্রকৃতি কেমন হতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এবং কীভাবে সেই যুদ্ধে জয়লাভ করা যাবে, সেই উপায় নিয়েও ভাবছে। এই বিষয় নিয়ে কাজ করা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জেমস বাউডার সতর্ক করে বলেছেন, ‘আগামী দিনগুলোতে সৈন্যদের জন্য খোলা জায়গায় যুদ্ধ করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে উঠবে। বহুমুখী সেন্সর-স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে নজরদারি অতি সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব আগ্নেয়াস্ত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তা ক্রমেই আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে।’

জেনারেল বাউডারের মতে, সৈন্যদের শহরের মধ্যে চলাচলের সময় নজিরবিহীন বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। আগামী দিনের যুদ্ধে শহরগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে তা কেবল শহরগুলোর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মূল্যের জন্য নয় বরং সেখানে নিজেদের তুলনামূলক নিরাপদে রাখার সুবিধা থাকার কারণেই সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এ ছাড়া প্রতিপক্ষ বাহিনী কর্তৃক শহরে তাদের শত্রুদের খুঁজে বের করা এবং আক্রমণ করার ক্ষমতা দুইই হ্রাস পাবে। ঠিক এই কৌশলের কারণেই তাল্লিন, রিগা ও ভিলনিয়াসের মতো তুলনামূলক ছোট শহরগুলো ন্যাটো বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠবে। সেখান থেকে রাশিয়ার সরবরাহ ব্যবস্থা ও রুশ বাহিনীর ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হবে।

যা হোক, বর্তমানে অন্য কৌশলগত বিষয়গুলো আলোচনার পাশাপাশি যুদ্ধকৌশল নিয়েও ভাবছে সেনাবাহিনীগুলো। যাদের শহরে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের কাছ থেকে শিখছে অন্য দেশগুলো। ইসরায়েলি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্থপতি ইয়াল উইজম্যান জানিয়েছেন, কীভাবে ২০০২ সালে ফিলিস্তিনের নাবলুসে ইসরায়েলি সৈন্যরা ‘ওয়াকিং থ্রো দ্য ওয়ালস’ কৌশল ব্যবহার করেছিল। যে পদ্ধতিতে গতানুগতিক দরজা-জানালা কিংবা পরিচিত রাস্তা ব্যবহার না করে বরং সরাসরি অন্য কোনো পথ ব্যবহার করা হয়। ১৯ শতকে প্যারিস যুদ্ধের সময় ফরাসি বাহিনী এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করেছিল।

ইসরায়েলের সেনাপ্রধান জেনারেল আভিভ কোহাভি উইজম্যানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি শহরের গলি-ঘুপচিগুলোকে কেবল একটি ফাঁকা জায়গা হিসেবেই ব্যাখ্যা করেন, যেমনটা করে থাকেন অন্যান্য স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ?’ জবাবে উইজম্যান বলেছিলেন, ‘শত্রু যদি কোনো ফাঁকা জায়গাকে প্রথাগত পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করে তবে আমি এই ব্যাখ্যা মানতে চাই না এবং ফাঁদেও পড়তে চাই না।’ যার ফলাফল উত্তরাধুনিক যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে শহর এবং এই যুদ্ধে শহরের ধারণা হলো তা কেবল একটি জায়গা নয় বরং তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ রণক্ষেত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কে এই আতাউর রহমান বিক্রমপুরী

আতাউর রহমান বিক্রমপুরী কারাগারে

জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ব্যক্তিগত অপরাধ গণ্য করে আ.লীগের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান ৫ মার্কিন আইনপ্রণেতার

বিএনপিতে রেদোয়ান আহমেদ-ববি হাজ্জাজ, ছেড়ে দিচ্ছে আরও ৮ আসন

আজকের রাশিফল: ফেসবুকে জ্ঞান ঝাড়বেন না— বন্ধুরা জানে আপনি কপি মাস্টার, স্ত্রীর কথা শুনুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত