Ajker Patrika

সিএনএনের প্রতিবেদন /যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাতে রাজনীতি নয়, প্রভাব ফেলছে ধর্মীয় মতবাদ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৫, ১৯: ০০
একদিন যিশু আসবেন এবং অবিশ্বাসীদের দমন করে বিশ্বাসীদের স্বর্গারোহণ করবেন, এটাই র‍্যাপচার। অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান এমনটাই বিশ্বাস করেন। ছবি: এএফপি
একদিন যিশু আসবেন এবং অবিশ্বাসীদের দমন করে বিশ্বাসীদের স্বর্গারোহণ করবেন, এটাই র‍্যাপচার। অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান এমনটাই বিশ্বাস করেন। ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পেছনে শুধু কূটনৈতিক কৌশল বা রাজনৈতিক অভিসন্ধি নয়, কাজ করেছে এক গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস—এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকেরা।

মার্কিন ধর্ম বিশ্লেষক ও লেখিকা ডায়ানা বাটলার ব্যাস মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং তা অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ভাবনা দ্বারা, যাঁরা মনে করেন, ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে ‘শেষ যুগ’ বা End Times শুরু হবে। এই ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা হলেন প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টধর্মের একটি শাখা, যাঁদের বাইবেলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। তাঁরা যিশুকে একমাত্র ত্রাণকর্তা ও পালনকর্তা হিসেবে মানেন। ইভানজেলিক্যাল শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘ইউএঞ্জেলিয়ন’ থেকে, যার অর্থ সুসংবাদ বা সুসমাচার। এই ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করেন, যিশু একদিন ফিরে আসবেন এবং তাঁদের উদ্ধার করবেন।

ব্যাস বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের একধরনের ‘‘আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা’’ রয়েছে এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে।’ তাঁর মতে, এই ধর্মীয় গোষ্ঠীটি বিশ্বাস করে ইসরায়েলকে ঘিরে যুদ্ধ হলে সেটি যিশুখ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমনের পথ খুলে দেবে।

সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। সেনাবাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত, কিন্তু ধর্মবিশারদদের মতে, এর পেছনে রয়েছে ‘ভবিষ্যদ্বাণীমূলক’ রাজনৈতিক চিন্তা। ব্যাস বলেন, এই যুদ্ধ ট্রাম্পকে তাঁর অনুসারীদের চোখে ‘ঈশ্বরের মনোনীত ব্যক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতি দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলপ্রীতি দ্বারা প্রভাবিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি আরও গভীর ধর্মীয় রূপ নিয়েছে। এর পেছনে রয়েছে ১৯ শতকের ব্রিটিশ ধর্মগুরুদের লেখা ও ‘লেফট বিহাইন্ড’ সিরিজের মতো জনপ্রিয় ধর্মীয় সাহিত্য।

ধর্মতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ জেমার টিসবি বলেন, ‘এই ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীগুলো কেবল মতবাদ নয়, এর সরাসরি ও ভয়ানক প্রভাব রয়েছে। এসব বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে বিপজ্জনক দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’

সাবেক গভর্নর মাইক হাকাবি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে একটি টেক্সট মেসেজে লিখেছিলেন, ‘ঈশ্বর আপনাকে বাঁচিয়েছেন, কারণ, আপনার ওপর তাঁর বিশেষ কাজের দায়িত্ব রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আপনি স্বর্গের বার্তা শুনতে পান।’ হাকাবি বর্তমানে ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত।

অনেক শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান বিশ্বাস করেন, বাইবেলের ইসরায়েল ও আজকের রাষ্ট্র ইসরায়েল অভিন্ন। তাঁদের মতে, বাইবেল অনুযায়ী ইসরায়েলকে সমর্থন না করা মানে ঈশ্বরকে অমান্য করা।

২০১৭ সালের ২২ মে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমে অবস্থিত ইহুদিদের পবিত্রতম স্থান ওয়েস্টার্ন ওয়াল পরিদর্শন করেন। ছবি: এএফপি
২০১৭ সালের ২২ মে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমে অবস্থিত ইহুদিদের পবিত্রতম স্থান ওয়েস্টার্ন ওয়াল পরিদর্শন করেন। ছবি: এএফপি

বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁরা বলেন, ‘যারা তোমাকে আশীর্বাদ করবে, আমি তাদের আশীর্বাদ করব; আর যারা তোমাকে অভিশাপ দেবে, আমি তাদের অভিশাপ দেব। পৃথিবীর সব গোত্র তোমার মাধ্যমে আশীর্বাদ পাবে।’ (জেনেসিস ১২: ৩)। বাইবেলের এই উদ্ধৃতির ভিত্তিতেই অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল সমর্থনকে ‘ধর্মীয় দায়িত্ব’ হিসেবে দেখে থাকেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর ও ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি এসব ধর্মীয় বিশ্বাসকে আরও জোরালো করেছে।

২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রায় ৮০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান ভোটার ট্রাম্পকে সমর্থন করেন। সাম্প্রতিক সিএনএন জরিপে দেখা গেছে, ইরানে বিমান হামলার পর ৮৭ শতাংশ রিপাবলিকান ট্রাম্পের সামরিক সিদ্ধান্তে আস্থা প্রকাশ করেন।

ধর্ম বিশ্লেষক ও লেখিকা ব্যাস মনে করেন, এই সমর্থনের ভিত্তি শুধুই রাজনৈতিক নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে এক ভবিষ্যদ্বাণী প্রসূত আশা—‘যুদ্ধ হলে যিশু ফিরে আসবেন এবং ইসরায়েল চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের ইরান হামলার পর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে দাঁড়িয়েছেন দেশটির শীর্ষ ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান নেতারা। ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়ে তাঁরা এই হামলাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা হিসেবেই তুলে ধরছেন। তবে ধর্মতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদেরা বলছেন, এই মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রের বহু সাংস্কৃতিক ও বহুধর্মীয় গণতন্ত্রের জন্য এক গভীর ঝুঁকি।

ইভানজেলিক্যাল নেতা ফ্রাঙ্কলিন গ্রাহাম প্রয়াত ধর্মীয় নেতা বিলি গ্রাহামের পুত্র। ইরানে হামলার পর ফ্রাঙ্কলিন এক্সে লেখেন, ‘বিশ্ব এখন অনেক বেশি নিরাপদ।’ অপর দিকে ডালাসভিত্তিক প্যাস্টর রবার্ট জেফ্রেসও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ঈশ্বরের নির্দেশ বলেই ব্যাখ্যা করেন। তিনি গত রোববার চার্চে যখন ধর্মোপদেশ দেন, তা শুনে শ্রোতারা দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান।

জেফ্রেস বলেন, ‘যারা ইসরায়েলের বিরোধিতা করে, তারা সব সময় ইতিহাসের ভুল দিকে থাকে। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, তারা ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়। আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই, কারণ এখন আমাদের একজন এমন প্রেসিডেন্ট আছেন— ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি সত্য বোঝেন।’

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, বাইবেলের ইসরায়েল ও আধুনিক রাষ্ট্র ইসরায়েলকে এক করে দেখার এই প্রবণতা শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও বিপজ্জনক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

২০১২ সালের ৩ জুন নিউ ইয়র্কে ইসরায়েল দিবসের কুচকাওয়াজে এক ব্যক্তি একটি প্ল্যাকার্ড ধরে আছেন, যেখানে লেখা, ‘যিশু ফিরে আসবেন।’ ছবি: সংগৃহীত
২০১২ সালের ৩ জুন নিউ ইয়র্কে ইসরায়েল দিবসের কুচকাওয়াজে এক ব্যক্তি একটি প্ল্যাকার্ড ধরে আছেন, যেখানে লেখা, ‘যিশু ফিরে আসবেন।’ ছবি: সংগৃহীত

ধর্মতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ জেমার টিসবি সিএনএনকে বলেন, যদি কেউ বাইবেলের ইসরায়েল ও আধুনিক ইসরায়েলকে এক করে দেখে, তাহলে নানা ধরনের সহিংসতা, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক অপব্যবহারকেও ধর্মের নামে সমর্থন করতে শুরু করে। তিনি বলেন, এই বিশ্বাস প্যালেস্টাইনের জনগণের অধিকার অস্বীকার করে এবং মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকারের প্রশ্নগুলোকে আড়াল করে দেয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের ইরান নীতিকে প্রভাবিত করেছে একটি বিতর্কিত ধর্মীয় মতবাদ, যা গড়ে তোলা হয়েছিল ১৯ শতকে অ্যাংলো-আইরিশ যাজক বা প্যাস্টর জন নেলসন ডারবির দ্বারা। তিনি বাইবেলের ‘রিভেলেশন’ অধ্যায় থেকে ‘ডিসপেনসেশনালিজম’ নামে একটি মতবাদ তৈরি করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, মানব ইতিহাসকে ঈশ্বরের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন যুগে যোগাযোগের মাধ্যমে বিভক্ত করা হয়েছে। এতে বিশ্বাস করা হয়, পৃথিবী একদিন ধ্বংস হবে এবং ‘র‍্যাপচার’-এর মাধ্যমে খ্রিষ্টানরা স্বর্গে টেলিপোর্ট হয়ে যাবেন। অর্থাৎ যেদিন পৃথিবী ধ্বংস হবে, সেদিন যিশু এসে এই খ্রিষ্টানদের নিয়ে স্বর্গারোহণ করবেন।

এই তত্ত্ব ১৯৯০ ও ২০০০ সালের জনপ্রিয় ‘লেফট বিহাইন্ড’ উপন্যাস ও টিভি সিরিজের মাধ্যমে আরও বেশি পরিচিত হয়। সিরিজটির ৬৫ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। যদিও এগুলো কাল্পনিক গল্প, তবে অনেক ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান তা বাস্তবধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবেই দেখেছেন।

আর এই বিশ্বাসের কেন্দ্রে রয়েছে ইসরায়েল। এই মতাবলম্বীরা মনে করেন, আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো শেষ সময়ের সূচনাবিন্দু। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই যিশুখ্রিষ্টের দ্বিতীয় আগমন ঘটবে।

ইতিহাসবিদ জেমার টিসবি বলেন, ‘আজকের অনেক ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান এই তত্ত্ব মানেন, যদিও তারা হয়তো ডিসপেনসেশনালিজম শব্দটি জানেন না। এটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, নাম না জেনেও অনেকেই এই বিশ্বাসে দীক্ষিত।’

ধর্ম বিশ্লেষক ও লেখিকা ডায়ানা বাটলার ব্যাস বলেন, র‍্যাপচার মতবাদ একটি ‘সম্পূর্ণ মনগড়া ধর্মতত্ত্ব’। তিনি বলেন, ‘এটি খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল বিভ্রান্তিগুলোর একটি।’ ব্যাস বলেন, অনেক শিশু-কিশোর এই বিশ্বাসে আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে—রাতে ঘুম থেকে উঠে যদি বাড়ি নীরব থাকে, তবে তারা ভয় পেয়ে মা-বাবার ঘরে গিয়ে দেখে নিত, তারা উধাও হয়ে গেছে কি না। মানে যিশু এসে তাদের মা-বাবাকে নিয়ে গেছেন কি না। তিনি বলেন, বাইবেলের রিভেলেশন বইটি আসলে রোমান সাম্রাজ্যের বিরোধিতা করে লেখা একটি প্রতীকী গ্রন্থ। আক্ষরিক অর্থে, একদিন পৃথিবীতে ‘শেষ দিন’ আসবে এমন কোনো বর্ণনা এর মধ্যে নেই।

ব্যাস বলেন, এ ধরনের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি রাজনৈতিক নেতাদের যুদ্ধ এড়ানোর উৎসাহ দেয় না। বরং, এসব বিশ্বাসের কারণে ধ্বংস ও সহিংসতাকেই ঈশ্বরের কাজ বলে মনে করা হয়। এই ধর্মতত্ত্বে, যত খারাপ কিছু ঘটে, ততই ঈশ্বরের ফিরে আসার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই যুদ্ধ, দারিদ্র্য কিংবা জলবায়ু সংকট প্রতিরোধে কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।

টিসবি বলেন, ‘যখন কোনো গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকেরা মনে করেন, তাঁদের নেতা ঈশ্বর-নির্বাচিত এবং একটি ভবিষ্যদ্বাণী পূরণের জন্য কাজ করছেন, তখন গণতান্ত্রিক আলোচনা ও সমালোচনার জায়গা আর থাকে না। এমন অন্ধ ও নিঃশর্ত সমর্থন, সেটা যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্যই হোক না কেন, গণতন্ত্রের জন্য এক চরম বিপদ।’

ধর্মতাত্ত্বিক ও বিশ্লেষকদের প্রশ্ন—ইরানও একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যাদের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি। যাদের পররাষ্ট্রনীতিও ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর নির্ভর করে চলে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিও যদি আংশিকভাবে একই রকম ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা চালিত হয়, তাহলে কি দুই দেশের সংঘর্ষ এক অন্ধ ধর্মীয় সংঘাতে রূপ নেবে? এই প্রশ্নই এখন মার্কিন-মধ্যপ্রাচ্য নীতির ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যার কেন্দ্রে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত