Ajker Patrika

বৈশ্বিক সংকটের জন্য দায়ী কে—ব্যক্তি, না রাষ্ট্র? 

আব্দুর রহমান
আপডেট : ০১ মার্চ ২০২২, ১০: ৫৭
বৈশ্বিক সংকটের জন্য দায়ী কে—ব্যক্তি, না রাষ্ট্র? 

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে একাধিক সংকট চলছে বর্তমানে। মধ্যপ্রাচ্যের—ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, আফ্রিকার—লিবিয়া, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়াসহ আরও একাধিক দেশ। হালে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বিশ্বের দুই পরাশক্তির ব্যাটলগ্রাউন্ড ইউক্রেন। এ ছাড়া আরও একাধিক দেশের কথা আনা যায়, কিন্তু তালিকা দীর্ঘ করার চেয়ে এটা জানা জরুরি যে এসব সংকট সৃষ্টির পেছনে দায়ী কে—রাষ্ট্র, নাকি ব্যক্তি। 

বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের ভূমিকা কী ও কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ধারণ করে দেয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, এসব বিষয় নির্ধারণ করে কে বা কী? উত্তর দেওয়াটা খুব একটা সহজ নয়। তবে এটা সত্য যে, জনগণই রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রমের কেন্দ্র। এই কার্যক্রম পরিচালিত হয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কিংবা অনির্বাচিত কারও দ্বারা এবং দিন শেষে রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করেন এঁরাই। 

এ প্রসঙ্গে ফরাসি তাত্ত্বিক লুই আলথ্যুসার তাঁর ‘রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ’ বইতে উল্লেখ করেছেন, রাষ্ট্রের দুই ধরনের অ্যাপারেটাস বা যন্ত্রাংশ আছে। এর একটি হলো ‘আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস’, যাকে সহজ বাংলায় ভাবাদর্শ বলা যায়। আলথ্যুসারের মতে, কোনো একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে এই ভাবাদর্শের অধীনে বিভিন্ন শ্রেণি থাকে। এসব শ্রেণির কেউ চালকের আসনে, কেউ সহযোগী এবং কেউ শোষিত। ফলে এ থেকে আমরা একটি বিষয় সহজভাবে উপলব্ধি করতে পারি, তা হলো—সমাজ বা রাষ্ট্রে বিদ্যমান ভাবাদর্শ নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা থাকেন, তাঁদের দ্বারাই। 

শাসকদের ভূমিকার জন্যই যে জনগণকে ভুগতে হয়, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের কথা। বিশ্বজুড়ে যখন করোনাভাইরাসের দাপট, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারো করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, ‘একে স্বাগত জানাচ্ছি।’ কেবল তাই নয়, বোলসোনারোর আরও বিতর্কিত মন্তব্য রয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘একমাত্র ঈশ্বরই পারে আমাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে।’ ফলে তিনি যে তাঁর জনগণের মতামতকে পাত্তা না দিয়েই তাঁদের মর্জিমাফিক শাসন চালিয়ে গেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বশেষ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ঠাট্টাও করেছেন তিনি। বলেছেন, ‘ইউক্রেনীয়রা এক কমেডিয়ানের হাতে তাদের ভাগ্য তুলে দিয়েছে।’ এই নিজ দেশের জনমত, এমনকি অন্য দেশের নেতাকে নিয়েও তুচ্ছতাচ্ছিল্য, তা থেকেই নির্ধারিত হয় ব্রাজিল আসলে কোন পথে যাবে; অবশ্যই সেই পথে, যে পথে বোলসোনারো নিয়ে যাবেন। 

ব্রাজিলের অবস্থা ততটা খারাপ নয়, যতটা খারাপ সিরিয়ার। দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিগত ২২ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন বিরোধীদের প্রবলভাবে দমন করে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সহায়তা দিয়েছে তাঁরই মতো আরও কয়েক শাসক। বাশার সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন আক্রমণ করায় তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বাশার আল আসাদ পুতিনকে এক টেলিফোন কলে এ হামলার জন্য প্রশংসা করেছেন। বিগত ২২ বছরে বাশারের গোঁয়ার্তুমির কারণে দেশটির অন্তত ৩ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। দেশছাড়া হয়েছে অন্তত ৬০ লাখ মানুষ। ২০২১ সালের ২৮ মে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। 

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ইতিহাস তো প্রায় কমবেশি সবারই জানা। ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে দেশটিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত রয়েছে—এমন অভিযোগ তুলে হামলা চালানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইরাকে কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্রই পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তা জন চিলকট ইরাক যুদ্ধ নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, তাতে বলা হয়, ইরাকে হামলার কোনো যৌক্তিকতাই ছিল না। 

চিলকট কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে এবং বিস্তারিত পরিস্থিতি অনুধাবন ছাড়াই ইরাকে হামলা চালানোর ঘটনা, ব্রিটিশ সৈন্য ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বড় ধরনের ক্ষতি সাধন করেছে। সেই সঙ্গে ইরাকসহ ওই অঞ্চলের দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি করেছে। অথচ, ২০০৩ সালে করা হামলার ৭ বছর পর ২০১০ সালে যখন বুশ হোয়াইট হাউস থেকে বের হয়ে যান, তখনো তিনি দাবি করেন, ‘ইরাকে হামলা ঠিক ছিল’। 

 ২০১০ সালের ৯ নভেম্বর বিবিসির এক প্রতিবেদনে বুশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এনবিসিতে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে বুশ এ কথাও স্বীকার করেছেন যে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুতের জন্য তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। বুশ তাঁর আত্মজীবনী ‘ডিসিশন পয়েন্টস’-এর প্রচারের অংশ হিসেবে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘ইরাকে বিপুল বিধ্বংসী অস্ত্র না পাওয়া যাওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তবে দেশটিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল।’ 

তবে বুশ ইরাক আক্রমণ করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, ইতিহাসখ্যাত ৯/১১-এর পর ‘ওয়ার অন টেরর’ নামে তিনি আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিলেন। টানা ২০ বছর যুদ্ধ চালিয়ে বলা যায় কোনো ধরনের অর্জন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে হয়েছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, যুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র যে তালেবানকে টার্গেট করেছিল, যুদ্ধ শেষের দিনে সেই তালেবানই আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে। ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট ফ্রেঞ্চ ২৪-এর এক নিবন্ধে ২০ বছর ধরে চলা ‘ওয়ার অন টেরর’কে ‘টোটাল ফেইলিওর’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। অথচ এই ওয়ার অন টেররের কারণেই ইরাক ও আফগানিস্তানের দুই যুদ্ধে সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ মারা গেছে। 

শুধু বুশই নন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন তাঁর পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্টরাও। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর দুই মেয়াদে ইরাক ও আফগানিস্তানে চলা যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগই নেননি। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি অন্তত আফগানিস্তান যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছাড়াও তিনি একাধিকার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর শাসনামলের প্রথম দিকেই তিনি প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের ঘোষণা দেন। যদিও মার্কিন কংগ্রেস সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে দেয়নি। এ ছাড়া, মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো হোয়াইট হাউসের এক গোপন মেমোর বরাত দিয়ে জানিয়েছে, ট্রাম্প সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ব্যালট বাক্স জব্দ করার নির্দেশ দেওয়ার এক খসড়া নোট লিখেছিলেন তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে। যদিও তাঁর সেই খসড়া নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়নি। কেবল তাই নয়, অভিবাসী রুখতে ট্রাম্প যেসব খ্যাপাটে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তা কার না জানা। 

এখানে বলা যেতে পারে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হওয়া এই কয়েক বছর আগের বাণিজ্যযুদ্ধ, দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে অনিঃশেষ উত্তেজনা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তো বটেই, তাইওয়ান, ম্যাকাও, হংকংয়ের সঙ্গে তার যে আচরণ, তার পুরোটাই ওই সি চিন পিং ও তাঁর ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে উৎসারিত। মনে রাখা দরকার, এমনকি আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মাও তাঁর পদ ছেড়েছেন রাষ্ট্রীয় চাপেই। নিজ দেশে যে নেতার এমন কঠোর মনোভাব তিনি তো সীমান্ত ইস্যুতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাবেনই। এরই ফল হিসেবে লাদাখসহ বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব গত কয়েক বছরে বারবার ফিরে আসতে দেখা গেছে। দেখা গেছে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপালের মতো দেশে নিজেদের প্রভাব সম্প্রসারণের চেষ্টা। 

একই অবস্থা ভারতের প্রসঙ্গেও বলা যায়। এনআরসি, কৃষি আইন ইত্যাদি নিয়ে দেশটির বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকার যে জলঘোলা করল, তার মূলটি তো রয়েছে ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের মধ্যে। বহুত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়ে আজ যে তা মোটাদাগে কট্টর জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের দিকে যাত্রা করেছে, তা কিন্তু তার রাষ্ট্রীয় উপাদানগুলোর কারণে নয়। এটা করেছে রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের নিয়ন্ত্রকেরা। এরই ফল হিসেবে কাশ্মীরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে উত্তেজনা ফিরে ফিরে আসছে। এর বৈশ্বিক প্রভাব হিসেবে চীনের সঙ্গে দেশটির দ্বন্দ্বের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। শুধু চীন কেন, বড় দুই রাষ্ট্রের ফেরে পড়ে এই গোটা অঞ্চলের ছোট ছোট দেশগুলো ভুগছে। 

তবে খ্যাপামিতে বোধ হয় ট্রাম্পকেও ছাড়িয়ে গিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়ার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে কেজিবির সাবেক এই কর্মকর্তা মার্কিন বিরোধী শিবির গড়া থেকে শুরু করে কী করেননি? তাঁর সর্বশেষ পদক্ষেপ, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণ রোধে ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার জের ধরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান। এই অভিযানের পর আবার আলোচনাও শুরু হয়েছে। কিন্তু তার আগেই পুতিন তাঁর সেনাবাহিনীকে ‘পারমাণবিক অস্ত্র’ প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেন। তারপরই ইউক্রেন ও তাঁর পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো পুতিনের এমন হুমকিতে খানিকটা হলেও ভীত হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ আখ্যা দেয়। 

কিন্তু ঘটনা সেখানে নয়। যে বিষয়টি মুখ্য তা হলো, এই হামলার জের ধরে রাশিয়ায় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো একাধিক অবরোধ আরোপ করেছে। বৈশ্বিক ব্যাংকিং লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে কার্যত থেমে গেছে দেশটির বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেন। অবরোধ আরোপ করা হয়েছে দেশটির ব্যাংকিং খাত, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর। নরওয়েভিত্তিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ইকুইনর রাশিয়া থেকে তাদের ব্যবসা গুটাচ্ছে। আকাশসীমা ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে আরও কয়েকটি দেশ। সব মিলিয়ে রাশিয়ার সাধারণ জনগণ বেশ বড় ধরনের বিপদেই পড়তে যাচ্ছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। কিন্তু সে বিষয় আমলেই আনেননি পুতিন। নিজ মর্জিমাফিক দেশে ‘হারানো সম্মান পুনরুদ্ধারে’ নিয়েছেন যুদ্ধের মতো সিদ্ধান্তও। 

একই অবস্থা বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। ১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল সংকটের সময় রাশিয়া যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে কিউবা থেকে সরে এসেছিল, তেমনটা হয়নি ইউক্রেন সংকটের বেলায়। রাশিয়ার তরফ থেকে ইউরোপ ও রাশিয়ার নিরাপত্তার বিষয়ে আশঙ্কা জানিয়ে ন্যাটোর পূর্ব ইউরোপমুখী সম্প্রসারণ বন্ধের কথা বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্র তাতে কর্ণপাত করেনি। বরং, বিষয়টি ক্রমশ কঠিন করে তুলেছে ওয়াশিংটন। দেশটি বারবার রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছে। হুমকি-পাল্টা হুমকিতে আলোচনা হারিয়েছে অতল গহ্বরে। যার ফলাফল আমরা দেখছি। যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। কত মানুষের প্রাণহানি হবে কিংবা কবে থামবে, তা আসলে নির্ণয় করা কঠিন। 

শেষের আগে, রাষ্ট্রকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী জৈবিক সত্তা বললেও রাষ্ট্র আসলে কাজ করে একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে। এবং এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে মানুষই। ফলে রাষ্ট্রের যে আদর্শ বা চরিত্র, তা নির্ধারণ করে দেয় রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকা মানুষই। যেমনটা নির্ধারণ করেছে ১৯৪৫ সালের আগের জার্মানি, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রে। আজ চিহ্নিত করছে রাশিয়া, ইউক্রেনের মতো দেশগুলোকেও। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আদর্শেই চিহ্নিত হয় রাষ্ট্রের আদর্শ। সুতরাং, এ কথা বলা যেতেই পারে—আবহমানকাল ধরে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের জন্য রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্রের পরিচালনায় থাকা ব্যক্তিরাই দায়ী। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হলে এই ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে একটা সীমা পর্যন্ত জবাবদিহির আওতায় রাখা যেতে পারে শুধু।

বিষয়:

যুদ্ধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত