Ajker Patrika

শুকিয়ে যাচ্ছে পানামা খাল, কোন পথে বিশ্ব বাণিজ্যের নৌ–রুট

আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২৪, ২১: ৩২
শুকিয়ে যাচ্ছে পানামা খাল, কোন পথে বিশ্ব বাণিজ্যের নৌ–রুট

কয়েক মাস ধরে পানামা খালের পানি ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে। পানির স্তর কমে যাওয়ায় বড় ধরনের নৌ–জটের সৃষ্টি হয়েছে, চলাচল করছরে নগণ্যসংখ্যক জাহাজ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই খরা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই প্রতিকূল অবস্থার কারণে নৌযান চলাচলে বেশি সময় লাগছে, এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। 

লেথ এজেন্সির আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যবস্থাপক সোরেন স্টোকেবেক অ্যান্ডারসেন বলেছেন, ‘খরা এই খালে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের গতিপ্রকৃতি আমূল বদলে দিয়েছে।’

পানামা খালের খরা আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিবহন শিল্পকেও ব্যাহত করছে। বিশ্বে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের প্রায় ৫ শতাংশ ও মার্কিন কনটেইনারের ৪০ শতাংশ এই খাল দিয়ে যাতায়াত করে। শুষ্ক মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে পানামা খাল হয়ে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে পরিবহন সংস্থাগুলোর অপেক্ষার প্রহর আরও বাড়তে থাকে। ফলে দীর্ঘকাল ধরে এই খালের ওপর নির্ভরশীল প্রতিষ্ঠানগুলো এখন রুট পরিবর্তনের কথা ভাবছে। বিকল্প হিসেবে সুয়েজ খালের মতো বিশ্বের অন্যান্য প্রধান সহজ রুটে পণ্য পরিবহনে প্রতিষ্ঠানগুলো লজিস্টিক ধাঁধায় পড়েছে।

চরম জলবায়ুর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন শিপিং কোম্পানি, বিশ্লেষক এবং সরকার আশঙ্কা করছে, পানামা খাল সংকট কোনো বিপর্যয় নয় বরং নতুন বাস্তবতা হতে পারে। সময়মতো পণ্য সরবরাহের জন্য খালটি বিশ্ব বাণিজ্যের একটি নির্ভরযোগ্য ধমনি হয়ে থাকবে কি না—তা নিয়ে শিপিং কোম্পানিগুলো প্রশ্ন তুলেছে এবং খালের বিকল্প খোঁজার আগ্রহ বাড়ছে।

নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রকৌশলের ইমেরিটাস অধ্যাপক জোসেফ এল. শোফার বলেন, ‘খরা পানামা খালের জন্য গুরুতর হুমকি। ১০০ বছরেরও আগে তৈরি খালটি স্বল্প বৃষ্টিসহনীয় করে বানানো হয়নি।’ 

খালটি সচল রাখতে নিয়মমাফিক বৃষ্টিপাত অপরিহার্য। প্রতিটি ট্রানজিটের জন্য প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। এই পানি আসে কৃত্রিম হ্রদ থেকে, যেটি বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। 

পানামায় বর্ষাকাল সাধারণত এপ্রিলের শেষ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলে। কিন্তু গত বছর অক্টোবরে গড় থেকে ৪১ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং চলতি বছরের বর্ষাকাল পর্যন্ত কম বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ডিসেম্বরে খালের প্রধান জলাধার লেক গাতুনের পানি বছরের এই সময়ের জন্য অস্বাভাবিক মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে এবং আগামী মাসগুলোতে পানির স্তর আরও নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাবে এই খরা দেখা দিয়েছে। এল নিনো জলবায়ুর একটি চক্র, যা প্রতি দুই থেকে সাত বছরে সমুদ্রের উষ্ণতা দিয়ে পরিমাপ করা হয়। এল নিনো বায়ু ও সমুদ্র স্রোতের স্বাভাবিক সঞ্চালনকে ব্যাহত করে। এমনটি না হলে পানামা এবং অন্যান্য গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোতে বেশি বৃষ্টিপাত হতো। 

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের ইসাম ফারেস ইনস্টিটিউটের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ কর্মসূচির পরিচালক নাদিম ফারাজাল্লা বলেন, ‘পানামা এল নিনোর সঙ্গে পরিচিত হলেও এবারের খরা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। জলবায়ু পরিবর্তন তীব্র হওয়ার কারণে পানামায় এমন ঘটনাগুলো আরও ঘন ঘন আসবে। আর আমরা এখনো এল নিনোর প্রকৃত ভয়ংকর রূপ দেখিনি।’ 

পানামার জন্য এল নিনোর প্রভাব হবে ভয়াবহ। প্রথমত, পানামার অর্থনীতি এই খালের ওপর নির্ভরশীল। ২০২২ সালে পানামা এই খাল থেকে ৪৩২ কোটি ডলার আয় করেছে, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এল নিনো সৃষ্ট খরার কারণে চলতি অর্থবছরে খালটি আনুমানিক ২০ কোটি ডলার রাজস্ব হারাতে পারে। খরা পানামার পানি সরবরাহকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। 

পানামার কর্মকর্তারা খাল দিয়ে জাহাজ চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পানামা খাল কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন মাত্র ৩৬–২৪টি জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এই সংখ্যা ১৮–তে নামিয়ে আনা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফরেন পলিসির কাছে একটি ই–মেইল পাঠিয়ে পানামা খাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাঁরা অতিরিক্ত পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছেন। কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন লক চেম্বারের জন্য পানি পুনর্ব্যবহার শুরু করেছে এবং জাহাজগুলো যথেষ্ট ছোট হলে একসঙ্গে দুটি জাহাজ ট্রানজিটের অনুমতি দিচ্ছে। খাল কর্তৃপক্ষ সঞ্চারণ সীমাও কঠোর করেছে, এটি বোঝায় কতটা গভীরে জাহাজের তলা যেতে পারে তার সীমা নির্ধারণ। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, এটি কিছু জাহাজকে পণ্যের ভার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে বাধ্য করতে পারে। 

ইমেরিটাস অধ্যাপক শোফার বলেন, এগুলো কঠোর ব্যবস্থা। এসব জলপথে পণ্য পরিবহন কোম্পানিগুলোর মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। 

২০০৬ সালে খালের ক্ষমতা দ্বিগুণ করার একটি প্রকল্পের নেতৃত্ব দানকারী পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট মার্টিন টোরিজোস বলেন, অপ্রত্যাশিত বিধিনিষেধ খাল ব্যবহারকারীদের ভবিষ্যতে সক্ষমতা এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বাণিজ্য ব্যবস্থাপক অ্যান্ডারসন বলেন, খরার আগে জাহাজগুলো মাত্র তিন সপ্তাহ আগে পারাপারের জন্য বুকিং দিতে পারত বা বুকিং ছাড়াই লাইনে অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু এখন কিছু ক্ষেত্রে অপেক্ষার সময় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে এবং কখনো কখনো কয়েক মাস আগে বুকিং করতে হচ্ছে। খাল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ লাইন এড়াতে অতিরিক্ত স্লটের নিলাম শুরু করেছে। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠান নিলামে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ ডলারে রাজি হয়েছে।

শিপিং কোম্পানিগুলোর সামনে এখন তিনটি বিকল্প পথ খোলা আছে, যার সবকটিই ব্যয়বহুল: লাইনে দাঁড়াতে না চাইলে টাকা ঢালো, অপেক্ষা করো অথবা অন্য কোনো রুট খোঁজো। 

ভিন্ন রুট বেছে নেওয়া জাহাজগুলোর জন্য আবার তিনটি পথ খোলা। সেগুলো হলো—মিসরের সুয়েজ খাল, চিলির ম্যাগেলান প্রণালি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ। পরের দুটি নির্ভরযোগ্য কিন্তু যাত্রাপথ অতি দীর্ঘ। সংক্ষিপ্ততম বিকল্প পথ হলো মানবসৃষ্ট জলপথ সুয়েজ খাল, যা ভূমধ্যসাগরকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। সুয়েজ খাল দিয়ে দিনে ১০০ টির মতো জাহাজ চলাচল করতে পারে, যা পানামা খালের বর্তমান সক্ষমতার চারগুণ বেশি। 

তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলায় সুয়েজ নিয়েও গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। লোহিত সাগরে ইরান–সমর্থিত ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ২৭টি জাহাজে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা এবং নেদারল্যান্ডসের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বাহিনী গত বৃহস্পতিবার ইয়েমেনজুড়ে ১৬টি স্থানে কমপক্ষে ৬০টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রকাশ্যে এটিকে ‘লোহিত সাগরে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক জাহাজে হুথি হামলার প্রতিক্রিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন। 

নৌ–সংকট বেড়ে যাওয়ায় জাহাজগুলো রুট পরিবর্তন করছে। বিশ্বের পাঁচটি বৃহত্তম কন্টেইনার-শিপিং সংস্থাগুলোর মধ্যে চারটি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত স্থগিত করেছে। 

এদিকে বিকল্প পথের অনুসন্ধান লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে অবস্থিত বাণিজ্য রুটের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়েছে। দেশগুলো পানামা খালের ট্র্যাফিক থেকে জাহাজগুলো নিজেদের দিকে টানার আশা করছে। 

এসব প্রণালি নির্মাণ এখনো বাকি। নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট দানিয়েল ওর্তেগা বলেছেন, তিনি একটি আন্তঃমহাসাগরীয় খাল নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান। তবে অনেক নিকারাগুয়ান এই অঞ্চলের সবচেয়ে দরিদ্র এবং সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশটিতে এমন সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করেন।

অন্যদিকে কলম্বিয়ার পরিকল্পনা সম্ভবত কিছুটা বাস্তবসম্মত। ফরেন পলিসি সাময়িকীকে পাঠানো একটি ই–মেইলে কলম্বিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয় বলেছে, সরকার এরই মধ্যে দেশের প্রশান্ত মহাসাগর এবং ক্যারিবীয় উপকূলগুলোকে সংযুক্ত করার জন্য ৭ মাইল টানেলসহ ১২৩ মাইল দীর্ঘ আন্তঃমহাসাগরীয় ট্রেনের পরিকল্পনার প্রথম ধাপ এগিয়েছে। মন্ত্রণালয় আশা করছে, প্রকল্পটি ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ টেন্ডারের জন্য প্রস্তুত হবে। 

অন্যান্য প্রকল্প এরই মধ্যে সম্পন্ন বা চলমান। ২০২২ সালে প্যারাগুয়ে একটি ডুয়েল–ক্যারেজ মোটরওয়ের প্রথমার্ধের উদ্বোধন করেছে। এই বায়োসেনিক রোড করিডর চিলি থেকে শুরু হয়ে আর্জেন্টিনা এবং প্যারাগুয়ের মধ্য দিয়ে প্রসারিত হয়ে ব্রাজিলে গিয়ে শেষ হবে। এ ছাড়া, গত বছরের ২২ ডিসেম্বর মেক্সিকো পণ্য পরিবহনে পানামা খালের সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে রেলওয়ে প্রকল্পের জন্য ২৮০ কোটি ডলার রেলওয়ে প্রকল্পের উদ্বোধন করেছে। 

এই প্রকল্পগুলো শিগগিরই পানামা খালের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও অধ্যাপক শোফার মেক্সিকোর প্রকল্পটিকে প্রতিশ্রুতিশীল বলে মনে করেন। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, এটি আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে পণ্য পরিবহনের একটি ছোট অংশের জন্যই কাজ করবে এবং ব্যায়বহুল হওয়ায় এটি পানামা খালের চেয়ে কম আকর্ষণীয় হবে। যেখানে অ্যান্ডারসেন বলেন, বিশ্বব্যাপী শিপিং সংস্থাগুলোর এসব অপরীক্ষিত রুটে মুখ ফেরানোর সম্ভাবনা নেই, কারণ এই শিল্পে নির্ভরযোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ। 

আপাতত, পানামা খালই এ অঞ্চলের প্রধান বাণিজ্য রুট থাকছে। কিন্তু খাল কর্তৃপক্ষ যদি জলবায়ু পরিবর্তনের চরম মাত্রাকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে তারা ব্যবসা হারাতে পারে।

পানামা খালের বোর্ড প্রস্তাবিত একটি সমাধান হলো ইন্দিও নদীতে বাঁধ দেওয়া এবং নিকটবর্তী একটি পাহাড়ের মাঝ দিয়ে খাল খনন করে গাতুন হ্রদে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ৯০ কোটি ডলার খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এটি সম্পন্ন হতে ছয় বছর লাগতে পারে। ২০০৬ সালে খাল সম্প্রসারণে এই প্রকল্পের ব্যাপক সমর্থন থাকলেও এটি এখন বেশ বিতর্কিত। একটি নতুন বাঁধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অনেক ভূমি প্লাবিত করবে এবং স্থানীয় অনেক সম্প্রদায়কে বাস্তুচ্যুত করবে। চলতি বছরের মে মাসে পানামার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এটিকে সমর্থন করার বিষয়ে বেশ সতর্ক রাজনীতিকরা। 

এই নতুন জলাধার সৃষ্টির প্রস্তাব এরই মধ্যে চরম বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গত বসন্তের পর থেকে দেশটিতে রাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়েছে। যেখানে বিক্ষোভে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানামা অচল ছিল। পানামাবাসী তড়িঘড়ি করে নেওয়া একটি সরকারি চুক্তির প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী, পানামার সরকার কানাডীয় কোম্পানি ফার্স্ট কোয়ান্টাম মিনারেলসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘মিনেরা পানামা’কে অন্তত ২০ বছরের জন্য দেশটির একটি জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জঙ্গলে বিশাল ওপেন–পিট (উন্মুক্ত) তামার খনি পরিচালনার অনুমতি দিয়েছিল। সে সময় পানামাবাসী রাজপথে নেমে ‘আমরা একটি খালের দেশ, খনির দেশ নয়’ স্লোগান দিয়েছিল। 

পানামা সিটির সাবেক ভাইস মেয়র এবং পরিবেশবাদী সংস্থা ‘সাসটেইনেবল পানামার’ প্রেসিডেন্ট রাইসা ব্যানফিল্ড বলেছেন, বিক্ষোভটি দেশের ‘আত্মপরিচয় সংকটকে’ প্রকাশ করেছে। কারণ এটি তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারক। পানামার জনগণ খাল ও খনিজ শিল্পের সঙ্গে জলজ সম্পদের জন্যও লড়াই করে। 

তাই অধ্যাপক শোফার বলেন, ‘তাঁরা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করুক বা না করুক, খাল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আগে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।’ 

তবে পানামার সাবেক প্রেসিডেন্ট টোরিজোস এখনো আশাবাদী। তিনি বিশ্বাস করেন, পানামা এটিকে শেষ জলবায়ু দুর্ঘটনা হিসেবে নিতে পারে, যেখানে খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। আমি মনে করি, [প্রতিযোগিতা] একটি ইতিবাচক চাপ তৈরি করে, কারণ এটি আমাদের বিকাশের সুযোগ দেয়। 

শোফার আরও আশাবাদী যে, প্রতিযোগিতা খালটিকে আরও উপযুক্ত করে তোলার প্রকৃত পরিবেশ তৈরি করতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, পানামা খাল কর্তৃপক্ষ সমাধান নিয়ে আসবে—ঠিক যেমনটি ২০১৬ সালে এটি একটি ছোট পরিসরে করেছিল, যখন এটি সফলভাবে পানি অপচয় রোধ করেছিল। 

পরিশেষে অধ্যাপক শোফার বলেন, ‘তবে এতে সময় লাগবে এবং অন্তর্বর্তী সময়ে তারা কীভাবে এটি পরিচালনা করে তা সত্যিই আগ্রহের বিষয় হবে।’ 

ফরেন পলিসি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত