Ajker Patrika

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের আড়ালে বেলুচিস্তানে কী ঘটছে

আপডেট : ১০ মে ২০২৫, ১১: ৪৫
বেলুচিস্তানজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। বেলুচ জনগণ অনেক এলাকায় পাকিস্তানি পতাকা সরিয়ে তাদের নিজস্ব পতাকা উত্তোলন করেছে। ছবি: সংগৃহীত
বেলুচিস্তানজুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)। বেলুচ জনগণ অনেক এলাকায় পাকিস্তানি পতাকা সরিয়ে তাদের নিজস্ব পতাকা উত্তোলন করেছে। ছবি: সংগৃহীত

চলতি মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সামরিক উত্তেজনা ঘনীভূত হয়েছে। কাশ্মীর সীমান্তে নিয়মিত পাল্টাপাল্টি গোলাগুলি, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার খবর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহল দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে সরব।

এই উত্তেজনার ছায়ায় চাপা পড়ে রয়েছে পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী ও নীরব সংকট—বেলুচিস্তান। নির্বিচার ধরপাকড়, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও অর্থনৈতিক শোষণের নির্মম বাস্তবতার মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছে সেখানকার মানুষ। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ছায়ায় ‘অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র’ হয়ে উঠেছে বেলুচিস্তান। ব্রিটিশ ভারতের প্রেক্ষাপটে এই অঞ্চলের মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসও জড়িত।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: বেলুচ জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি

ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ বেলুচিস্তান, যা দেশের মোট ভূমির ৪৪ শতাংশজুড়ে বিস্তৃত। তবে এখানকার জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, যার বড় একটি অংশ বেলুচ জাতিগোষ্ঠী।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জনের সময়, বেলুচিস্তানের খান (খান অব কালাত) বেলুচকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির চেষ্টা চালান। কিন্তু ১৯৪৮ সালে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকার বেলুচিস্তানকে জোরপূর্বক পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত করে, যেটাকে বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতারা ‘জবরদখল’ বলে থাকেন।

এর পর থেকে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার প্রশ্নে বেলুচদের সঙ্গে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সংঘাত শুরু হয়। ফলে ১৯৪৮, ১৯৫৮-৫৯, ১৯৬২-৬৩, ১৯৭৩-৭৭ এবং ২০০৪ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মোট পাঁচটি সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা গেছে। রাজনৈতিক স্বীকৃতি, অর্থনৈতিক সম্পদে আঞ্চলিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের দাবি ছিল প্রতিটি বিদ্রোহের মূল রসদ। কিন্তু প্রতিবারই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দমন-পীড়ন চালিয়ে আন্দোলন বন্ধ করেছে।

বাংলাদেশ ও বেলুচিস্তান—পথ ভিন্ন হলেও গন্তব্য এক

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও বেলুচিস্তানের আন্দোলনের মধ্যে রয়েছে কিছু গভীর সামঞ্জস্য। দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভাষাগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র অর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। একইভাবে বেলুচরাও ১৯৪৮ সাল থেকে সাংস্কৃতিক অবদমন, সম্পদের শোষণ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনগণ গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে দমন করে, যা গণহত্যায় পরিণত হয়। বেলুচিস্তানেও আমরা দেখি, প্রতিটি আন্দোলনে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বকে অস্বীকার করে সামরিক দমন চালানো হয়েছে; বিশেষ করে ১৯৭৩ সালের বিদ্রোহের সময় সেনা অভিযানের কথা উল্লেখ না করলে নয়। বেলুচ নেতা আতাউল্লাহ মেঙ্গলের নির্বাচিত সরকার ভেঙে দিয়ে দমন-পীড়ন চালায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার, যা পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তোলে।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমর্থন পেয়েছিল—বিশেষত ভারতের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন। কিন্তু বেলুচদের আন্দোলন এখনো তেমন আন্তর্জাতিক সহায়তা পায়নি, বরং আঞ্চলিক ভূরাজনীতির খেলায় তাদের সমস্যা উপেক্ষিত রয়েছে।

‘অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র’ বেলুচিস্তান

এবারের বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে এক ভিন্ন বাস্তবতায়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং স্থানীয় সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বেলুচিস্তানে পাঁচ শতাধিক গুম, শতাধিক মৃতদেহ উদ্ধার ও অসংখ্য নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে।

খুজদার, তুরবত, পানজগুর ও গওয়াদর—এসব এলাকায় সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ পরিচালনা করছে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই অভিযান আসলে সাধারণ বেলুচদের বিরুদ্ধে দমননীতি চালানোর একটি উপায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, নিরাপত্তা বাহিনী রাতের আঁধারে গ্রামে ঢুকে পুরুষদের ধরে নিয়ে যায়। পরে অনেককে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায় না। যাদের পাওয়া যায়, তারা ফিরে আসে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে বা লাশ হয়ে।

সিইপিসি ও গওয়াদর: উন্নয়নের নামে বিতাড়ন ও শোষণ

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিইপিসি) হলো চীনের বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোর অন্যতম। চীনের জিনজিয়াং অঞ্চল থেকে গওয়াদর বন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

বেলুচিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানকে কেন্দ্র করে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। তবে বেলুচদের কাছে প্রকল্পটি উন্নয়নের প্রতীক নয়; বরং এটিকে তারা নিজেদের জমি ও সম্পদ দখলের মাধ্যম হিসেবে দেখছে।

গওয়াদর শহরে স্থানীয় জনগণকে না জানিয়ে এবং উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বেলুচদের অভিযোগ, গওয়াদরকে ‘মেগা সিটি’ হিসেবে গড়ে তোলার নামে বেলুচ জনগণকে বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে। অথচ চীনা ও পাঞ্জাবি শ্রমিকদের জন্য বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল—সবই তৈরি হচ্ছে। গোটা প্রক্রিয়াকে অনেক বেলুচ বিশ্লেষক ‘সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন’ হিসেবে দেখছেন।

সামরিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী প্রতিরোধ

বর্তমানে বেলুচিস্তানে দুই ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলন একসঙ্গে চলছে—একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ, অন্যটি অহিংস গণ-আন্দোলন। সশস্ত্র প্রতিরোধে বিএলএ, বিআরএ ও বিএলএফের মতো সংগঠন সক্রিয়ভাবে জড়িত। পাকিস্তান সরকার তাদের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর দমননীতি চালাচ্ছে।

অন্যদিকে ছাত্রসংগঠন, নারী অধিকারকর্মী, মানবাধিকার সংস্থা এবং প্রবাসী বেলুচ সম্প্রদায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের কায়েমি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘নিখোঁজ ব্যক্তি’ বা গুম ইস্যু এখন বেলুচ জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক যেমনটি দেখা গিয়েছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অথবা শেখ হাসিনার আমলে বহু মা-বাবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সন্তানদের সন্ধান দাবি করছেন।

বেলুচিস্তানে ট্রেনে হামলা: বিদ্রোহের নতুন মাত্রা

২০২৫ সালের মার্চে বিএলএর সংঘটিত ট্রেন বিস্ফোরণ বেলুচিস্তানে নিরাপত্তাহীনতার গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত তৈরি করে। কোয়েটা থেকে রাওয়ালপিন্ডি অভিমুখী যাত্রীবাহী জাফর এক্সপ্রেসে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় অনেক লোক নিহত ও আহত হয়। রেললাইনের নিচে স্থাপন করা বোমা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে বিস্ফোরণটি ঘটানো হয়েছিল বলে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে।

এ ঘটনার দায় স্বীকার করে বিএলএ বিবৃতিতে বলেছে, ‘দখলদার পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে দুর্বল করাই আমাদের লক্ষ্য।’

এই হামলায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বেলুচ বিদ্রোহীরা শুধু প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় নয়, বরং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগব্যবস্থাকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের হামলা একদিকে যেমন সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীর দমননীতি কঠোর করতে বাধ্য করবে, তেমনি বেলুচিস্তানের সাধারণ জনগণের জীবনে অনিশ্চয়তা এবং ভয় আরও বাড়াবে।

সেনাপ্রধানের হুঁশিয়ারি: ১০ প্রজন্মের সন্ত্রাসীও বেলুচিস্তানকে....

এ ঘটনার কিছুদিন পর ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আসিম মুনির ইসলামাবাদে বিএলএসহ বেলুচ বিদ্রোহীদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা শিগগির এই সন্ত্রাসীদের চুরমার করে দেব...আপনারা কী মনে করেন, বিএলএফ ও বিএলএর মতো সংগঠনের এই ১ হাজার ৫০০ সন্ত্রাসী আমাদের কাছ থেকে বেলুচিস্তান ছিনিয়ে নিতে পারবে?’

জেনারেল আসিম মুনির আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের শত্রুরা যদি মনে করে যে একটি মুষ্টিমেয় সন্ত্রাসী দল পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে, তবে তারা মারাত্মক ভুল করছে। এমনকি ১০ প্রজন্মের সন্ত্রাসী একত্র হলেও তারা বেলুচিস্তান ও পাকিস্তানের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’

জেনারেল মুনির আরও বলেন, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি। যারা এ নিয়ে সন্দেহ ছড়াচ্ছে, তারা আসলে পাকিস্তানকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করছে। বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখাওয়া কিংবা সিন্ধু—সব অঞ্চল পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সেনাবাহিনীর দায়িত্ব।’ শুধু দেশীয় সন্ত্রাসীদের নয়, বরং তাদের পেছনে ইঙ্গিত করেন। বেলুচদের বিদ্রোহকে পাকিস্তানের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, এর পেছনে বিদেশি শক্তির মদদ রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর মূল কারণ, যেমন আর্থসামাজিক বৈষম্য, জাতিগত বঞ্চনা ও রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে নজর ঘুরিয়ে আন্তর্জাতিক বিরোধের আবরণে নিজস্ব অবস্থানকে বৈধতা দিতে চাইছে।

দ্বিজাতিতত্ত্বের পুনরুজ্জীবন ও কাশ্মীর

সেই প্রবাসী সভায় সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির কাশ্মীর প্রসঙ্গও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর পাকিস্তানের শিরার স্পন্দন। এটি শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, এটি আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা কাশ্মীরি ভাইদের সঙ্গে ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকব। ভারত যদি আমাদের সীমানা লঙ্ঘন করে, তবে তার জবাব দেওয়ার মতো ক্ষমতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে।’

জেনারেল আসিম মুনির অভিযোগ করেন, ভারত একতরফাভাবে ২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে অবৈধ দখলদারত্ব জারি রেখেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের প্রস্তাবের পরিপন্থী।

এই বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাপ্রধান ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দেন এবং একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সংকট; যেমন বেলুচিস্তান পরিস্থিতিকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’ হিসেবে চিত্রিত করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন।

বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক সংকট যখন আন্তর্জাতিকভাবে নজর কাড়ছে, তখন এ ধরনের বক্তব্য পাকিস্তানি রাষ্ট্রের শক্ত অবস্থান এবং বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে ‘কাশ্মীর পাকিস্তানের শিরার স্পন্দন’ এবং ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতিতত্ত্ব পুনরুজ্জীবনের কথা বলে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জাতিগত ও ধর্মীয় সংঘাত উসকে দিয়েছেন বলে অনেক বিশ্লেষকের মত। তাঁর এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা এসেছে ভারত থেকে।

কাশ্মীরে হামলা: সীমান্ত উত্তেজনার বিস্তার

ভারতের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে নজিরবিহীন হামলার ঘটনা ঘটে। সেখানে বন্দুকধারী সন্ত্রাসীরা ২৬ পর্যটককে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ভারত এসব হামলার পেছনে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তাইয়েবার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু পাকিস্তান অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবু ভারত পানি আটকে দিয়ে এবং বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে। পাকিস্তানও বেশ কিছু পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর দুই পক্ষের মধ্যে টানা কয়েক রাত গোলাগুলির পর অবশেষে গত বুধবার ভারত পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে বসে।

মঙ্গলবার মাঝরাতের কিছু পরে ২৫ মিনিট ধরে পাকিস্তানের নির্দিষ্ট কিছু স্থাপনা লক্ষ্য করে আকাশপথে হামলা চালিয়েছে ভারত। ভারত তাদের এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার নাম দিয়েছে ‘অপারেশন সিঁদুর’। এ ঘটনায় পাকিস্তানের অন্তত ৩৬ জন নিহত হয়েছে এবং পাল্টা হামলায় ভারতে প্রায় ১২ জন নিহত হয়েছে। দুই পক্ষে এরপর ড্রোন হামলা চলছে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান চলমান উত্তেজনার মধ্যে বেলুচ বিদ্রোহীরাও পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালাচ্ছে।

সাম্প্রতিক বিদ্রোহী হামলা: সহিংসতার নতুন মাত্রা

মে মাসে বেলুচিস্তানে একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা সংঘটিত হয়েছে, যার জন্য বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) দায় স্বীকার করেছে। এসব হামলা শুধু পাকিস্তানের নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা তুলে ধরেনি, বরং আন্দোলন কতটা সংগঠিত ও সংঘবদ্ধ; তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে।

  • ৬ মে: কাচ্চি জেলার মাচ এলাকায় একটি আইইডি বিস্ফোরণে সাত সেনাসদস্য নিহত হন।
  • ৭ মে: শোরকান্দ ও মাচ এলাকায় পৃথক দুটি হামলায় নিহত হন ১৪ সেনা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন একাধিক উচ্চপদস্থ অফিসার।
  • ৮ মে: একযোগে একাধিক সেনা পোস্টে হামলা চালিয়ে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে বিএলএ।

বিএলএর মুখপাত্র জিয়ান্দ বালুচ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা বেলুচ জনগণের মুক্তির জন্য এই প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে যাব। সিপিইসি প্রকল্প বেলুচিস্তান থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।’

পাকিস্তান কি বেলুচিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হারাল

এই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসি এক বিস্ময়কর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী বেলুচিস্তানে কার্যত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, বিশেষ করে রাতের বেলায়।’

শাহিদ খাকান আব্বাসি আরও বলেন, ‘প্রশাসনিকভাবে আমাদের হাতে এখন আর কিছু নেই। বিদ্রোহীরা যেভাবে শহরে এবং গ্রামে প্রবেশ করছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র সেখানে কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তবে নেই।’

আব্বাসি বলেন, ‘আমরা যদি সংবিধান অনুযায়ী বেলুচ জনগণের অধিকার স্বীকার না করি, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য যদি পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে সংকটের স্বীকারোক্তি হয়, তাহলে বাস্তব পরিস্থিতি কতটা উদ্বেগজনক, তা সহজে অনুমান করা যায়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: নীরবতা, কৌশল ও দ্বৈত নীতি

কিন্তু বেলুচিস্তান ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিক্রিয়া হতাশাজনক। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মাঝেমধ্যে বিবৃতি দিলেও তা কার্যকর রাজনৈতিক চাপে পরিণত হয়নি। মুসলিমপ্রধান দেশগুলো যেহেতু পাকিস্তানের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে থাকে। ফলে বেলুচদের স্বাধিকার প্রশ্নে তাদের সমর্থন নেই।

একইভাবে চীনের পক্ষেও পুরোনো মিত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে সিপিইসিসহ নানা স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার কোনো কারণ নেই; বরং সেনা দমনকে নীরব সমর্থন দিচ্ছে দেশটি।

ভারত কিছুটা ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বেলুচিস্তানের মানুষের পক্ষে কথা বলেন। কিন্তু পাকিস্তান এই বক্তব্যকে ‘অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখায়। শুধু তা-ই নয়, গোয়েন্দা সংস্থা র-এর (আরএডব্লিউ) মাধ্যমে ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অর্থায়ন করছে বলেও অভিযোগ তোলে দেশটি।

এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক মহলে আশঙ্কা, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চলমান উত্তেজনা বৃহত্তর সংঘাতে রূপ নেবে। পাকিস্তান যদি একদিকে বেলুচিস্তানে সশস্ত্র বিদ্রোহ সামাল দিতে ব্যর্থ হয় এবং অন্যদিকে কাশ্মীর সীমান্তে ভারতের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তবে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্ব—দুই দিক থেকে চরম হুমকির মুখে পড়বে। বেলুচিস্তানের ‘নীরব সংকট’ ক্রমেই সরব হয়ে উঠছে। সেখানে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ, নির্যাতিত, বাস্তুচ্যুত ও অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

সামরিক দমন দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাকে শুধু গভীরতর করে তুলেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহিদ খাকান আব্বাসির মন্তব্য, সাম্প্রতিক বিদ্রোহী হামলা ও আন্তর্জাতিক নীরবতা এই সংকটকে আরও বেশি গভীর করে তুলে ধরছে। মানবাধিকার সংগঠন ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি সত্যি স্থিতিশীলতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে বেলুচিস্তানের মতো সমস্যাগুলোর প্রতি আন্তরিক মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, একটি জাতিকে তার ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষা করা যায় না। বেলুচিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংলাপ, স্বায়ত্তশাসনের স্বীকৃতি এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ হতে পারে ভবিষ্যতের একমাত্র টেকসই পথ।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক

আজকের পত্রিকা

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।

গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।

মিলার কী বলেছেন

গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’

মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।

মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।

ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।

২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।

অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।

যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে

২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।

১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।

পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।

কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা

২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে

না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।

১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে

যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।

২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।

শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।

ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।

আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ /চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৩৪
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।

ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।

শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।

ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’

ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।

‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।

ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।

এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।

তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।

যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।

বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে
২০২৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তারের পর থেকে ইমরান খান কারাগারে আছেন। ছবি: শাটারস্টকের সৌজন্যে

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’

ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।

কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’

কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’

কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’

তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি
১৯৯২ সালে ইমরান খানের নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। ছবি: এএফপি

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো

পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।

মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি
১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। ছবি: এএফপি

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’

এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।

ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত
ইমরান খানের দুই ছেলে কাসিম খান ও সুলাইমান ইসা খান। ছবি: সংগৃহীত

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।

অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।

কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’

ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’

শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত