ইজাজুল হক

‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর বাংলা তর্জমা দাঁড়ায় ‘শব্দে শব্দে বিলাপ’। ১৯৯৫ সালে নাজকির এ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে আগের পর্বগুলোতে আমরা কিছু কথা জেনেছি। বিশেষ করে ফারুক নাজকির কবিতাশৈলী এবং গজল ও নজমের বৈশিষ্ট্য আলোচনায় ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর বেশ কিছু কবিতা উঠে এসেছে। কবিতাবিষয়ক সেসব ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ আলোচনা এড়িয়ে এবার আমরা বইয়ের পাতায় পাতায় শব্দমালার বিলাপ-ধ্বনি শুনতে চাই। অবশ্য ‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ পর্বেও আগুনের লেলিহান শিখা ও তাপ-উত্তাপের মোড়কে নাজকির বিলাপের ভিন্ন একটি রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর উৎসর্গপত্র থেকেই শুরু হয় ফারুকের বিলাপযাত্রা। জীবনের অন্যতম সেরা কাজটি তিনি সেই মানুষটির করকমলে অর্পণ করতে ভোলেননি, যাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, কাব্যপ্রতিভা ও জীবন-অভিজ্ঞতা ফারুকের জীবনের মোড়ে-মোড়ে আলো ফেলেছে; তমসাচ্ছন্ন রাতে দুর্বার গতিতে জীবনের পিচঢালা সড়ক ধরে ছুটে যেতে দ্রুত গতির বাহনের কাজ করেছে। তিনি আর কেউ নন, নাজকির জীবন রোদ্দুরে আমৃত্যু ছায়া দিয়ে যাওয়া বটবৃক্ষ ও অনন্ত অনুপ্রেরণার বাতিঘর বাবা মির গোলাম রসুল নাজকি।
উৎসর্গপত্রের ভাষ্য এখানে থেমে যায়নি। ভেতরের বিলাপের সুরে পাঠকের মন ছুঁয়ে দিতে নাজকি আরেকজন ব্যক্তির হাতেও বইটি অর্পণ করেন। সোমনাথ সাধু নামের সেই ভাগ্যবান হয়তো বড় কেউ নন; তবুও তাঁর মায়ের প্রয়াণে নাজকি আকুল হন; বিলাপ করেন এবং তাঁর মাথায় বুলিয়ে দেন সান্ত্বনার পরশ। ফলে বিলাপের পাশাপাশি নাজকি এখানে কাশ্মীরের বহুরৈখিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারানোর বেদনা কিছুটা লাঘব করার সুযোগ পান এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি তাঁর উষ্ণতার নজির স্থাপন করেন। ‘আরও একটি অর্পণ—সোমনাথ সাধু, তোমার নামে’ শিরোনামে তিনি লেখেন—
‘জানো, তোমার মা কামেলি
কাশ্মীর ছেড়ে গেছেন?
সঙ্গে নিয়ে গেছেন
সেই রুপোর থালাও—
যে থালায়
তিনি আমাদের একসঙ্গে খাওয়াতেন।
জানো কি, আমার ভয়েই তিনি
কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়েছেন?’
সোমনাথ সাধুর প্রতি শোক জানানোর পাশাপাশি কাশ্মীরের সমাজবাস্তবতাও দারুণভাবে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে নাজকির এই কয়েক ছত্রে। নাজকির কলম কাশ্মীরের প্রতি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণের সঙ্গে কখনো আপস করেনি, বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেওয়া ‘দ্রোহের আগুন’-এও ঘি ঢালেননি তিনি। বরং সব ধরনের নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও অশান্তির জন্য হৃদয়ের গহিনে গুঞ্জরিত বিলাপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার শব্দে-শব্দে।
‘শহরজুড়েই কারবালা প্রান্তর
রক্তখেকোর দল ছিল সর্বত্রই
ত্রাসের কাঁটাতারে ঘেরা কল্পনা-দেবালয়
উত্তরে আছি, না দক্ষিণে—জানা নেই।
রাতের হিংস্রতা সইতে পারব না আমি—
ক্রমেই ভেঙে পড়ছি, হে অপেক্ষাসন্ধ্যা।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেউ-ই দেবে না
কিংবা সতর্ক সাইরেন, হে শূন্য তেপান্তর
চোখের পলকেই আগুন জ্বলে লোকালয়ে
প্রত্যহ লুণ্ঠিত হয় হাসিমুখ নতুন সংসার
গাছে-গাছে জেঁকে বসে মৃত্যুর নীরবতা;
এ কেমন অস্ত্রবাজির মৌসুম এল—
বিষণ্ন উদ্যানের ফুল যায় শুকিয়ে
শরতের আঘাতে বিধ্বস্ত গুলশান।’
এমন মৃত্যুপুরীর মধ্যে কবির জীবন দুঃখ-বিষণ্নতার কালো মেঘে ঢেকে যায়। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে যায়। সন্ধ্যার আগেই পৃথিবীতে নেমে আসে আঁধারের প্রেতাত্মারা। কাশ্মীরের প্রকৃতি ও আবহাওয়ায় ঘুমোনোর সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘুমোতে পারেন না। নিঃসঙ্গ নক্ষত্র হয়ে চাঁদের কোলে জেগে থাকেন রাতের পর রাত। পৃথিবীর সকল ঘরে ঘুমপরী এলেও নাজকির কাশ্মীরে সে আসে না। তাই তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা—‘ঘুম কেন আসে না?’
‘নীরবতা সাঙ্গ করে
বৃক্ষে ঝোলে রাত—
মাঠ-ঘাট জনশূন্য;
উঁচু-নিচু টিলায়
বিষাদ ঝরায়
আলোর কোলাহল—
ঘুম কেন আসে না?
দিনের উষ্ণ মেলায়
আমি বিষণ্ন থাকি
সন্ধ্যার কোলাহলে
আমি হতাশ থাকি
সচেতন থাকি আমি
মাদক নিয়েও
হৃদয়ে বিদ্ধ তিরের
আঘাত সয়ে যাই,
ভাবি—পৃথিবীতে
আমিও কত একা!
চাঁদের বাহুডোরে
জোছনার আলো
মুড়িয়ে শুয়ে আছি—
ঘুম কেন আসে না?
ঘুম খুশবু—
রাতের বাতাসে
এখানে-সেখানে ঘোরে;
আমার ঘরে আসে না
দূরত্ব বজায় রেখে চলে;
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি—
ঘুম কেন আসে না?’
দুই.
‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ একদিকে যেমন সময়ের বিড়ম্বনার ক্যানভাস, অন্যদিকে কাশ্মীরের ঋতুবৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের অনন্য আলপনাও বটে। তবে তাতেও নাজকির বিলাপের সুর মিশে যায় দূরের কোনো পর্বতে কিংবা জলপ্রপাতের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে।
‘লাস্যময়ী শাহজাদি—মৌসুম
আমার রূপকরাজ্যে লুকায়
প্রথম বর্ষণ থেকে তুষারকাল—
একাই সয়ে গেছি সবকিছু;
জিজ্ঞেস করি—তোমার রুটি-রুজি?
ঝিলম বলে—ভেসে গেছে সব।
শীতে তুষারঝড় হবে
এবং ডেকে আনবে বিপদ;
আমার অস্তিত্বজুড়েই বৈপরিত্যের চাষ
বসন্তের শোক-গীত গাইব আমি।
মৌসুমের ছকে বাধা নেই শিলাবৃষ্টিও—
নিত্য আমাদের মাথা খুঁজে নেয় তা;
বিতস্তায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে
মানুষ—খড়কুটোর মতো করে।’
কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্রিয়তমার সান্নিধ্য পেতে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে ওঠে।
‘এখানে, শূন্য মরুতে প্রলম্বিত হচ্ছে ছায়া
গুলরিজ থেকে কেউ আমাকে আবার ডাকুক;
বিষাদকালে তোমার স্বপ্নযোগে আসাও
অসুস্থকে অমৃত খাইয়ে দেওয়ার মতো;
স্থির না হও, সম্মতি না দাও আমাকে—
অবিশ্বাস থেকে তো অন্তত মুক্তি দেবে!’
নাজকির তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মেনে সে স্বপ্নে হলেও আসে; আসতেই থাকে। এ এক নতুন যন্ত্রণা—তাকে ভুলে থাকার জন্য কবি শহর থেকে দূরে অজানা গন্তব্যে চলে যান। সেখানেও কবির নিস্তার নেই। চোখ বুঁজতেই সে তাঁর তনু-মনে শিহরণ জাগায়।
‘শ্রাবণ-শ্রাবণ জল-ফেলা চোখ
তোমার নামে সদকা দিলাম
মরুর সমান আকাঙ্ক্ষা-পা
মাতাল হস্ত আঁচল সমান
শহর ছেড়ে এলাম বনে
ভেবেছিলাম—থাকব একা
চোখ বুজতেই তুমি এসে
করলে সবই ওলটপালট।’
নাজকির চোখ প্রিয়তমার রূপ-ঐশ্বর্য্যের অনুপুঙ্খ হিসেব রাখে। প্রিয়তমার সকল সৌন্দর্য খুঁজে ফেরেন তিনি কাশ্মীরের পাহাড়, ঝিরি, নদী ও উপত্যকার পরতে-পরতে। নিবিড় প্রেমের উষ্ণতায় প্রকৃতি তাঁর সামনে সকল সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে। কবি বিস্মিত হন, তৃপ্ত হন এবং আধ্যাত্মিক হন। এমন অপার সৌন্দর্যের প্রতিটি উপাদানে স্রষ্টার খোঁজ করেন।
‘মাঠ থেকে মাঠে আলো ছড়ায় সত্যের মুক্তোরা
বাগানে-বাগানে তোমার নিদর্শন নিয়ে আসে কে
আঙিনার এই সব ঝরাপাতাদের
জিজ্ঞেস করো সৃষ্টিকর্তার কথা।’
তিন.
ফিরে যাই বিলাপ প্রসঙ্গে। নাজকি একটানা বিলাপ করেই যান না, মাঝেমধ্যে শ্লেষ মিশিয়ে ছুড়ে দেন কথার তিরও। কাশ্মীরিদের সবকিছু কেড়ে নিলেও খুব সীমিত পরিসরে কথা বলার জায়গা তো রাখা হয়েছে, সে জন্য কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে অধিকার হরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অবশ্য এ পর্যায়েও সত্য উচ্চারণে তিনি দ্বিধাহীন।
‘পরিস্থিতি এত বেশি খারাপ নয়—
বলতে পারব না এমন কথাও নেই;
তোমার পথে বিছিয়েছিলাম আমরা চোখের পাতা
আর তুমি, তুমি আমাদের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিলে!’
মূলত পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, নিজের ছায়াকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন নাজকি। কথা বলার স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই সেখানে। অফিস, বাসা, স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতেও তাঁর যত ভয়। কাশ্মীরের অবারিত প্রকৃতির বুকে এমন গুমোট সন্ধ্যা কখনো নামেনি। নাজকি বলেন—
‘স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়
মেপে-মেপে শব্দ চয়ন করি
অফিসে সহকর্মীদের সামনে
লিখিত বক্তব্য পাঠ করি।
কলিজার টুকরো মেয়েটির
চোখোচোখি হতে কাঁপন ধরে যায়—
এ কেমন বসন্ত এল, খোদা
সকাল থেকে খুশবুরাও আতঙ্কিত;
এ কেমন মাতাল মৌসুম এল
ফুলবানুদের সঙ্গে মিলিয়ে গেল ভোরে হাওয়াও।’
নাজকির বিলাপ থামে না। ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর শব্দে শব্দে, লাইনে-লাইনে, পদে-পদে এক নিঃস্ব-পরাধীন আহত মানবাত্মার করুণ কান্না শোনা যায়। দেশের মাটি-মানুষ ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সুরক্ষার জন্য এই বিলাপ অত্যন্ত দরকারি; নাজকির কণ্ঠ থেকে তা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সকল জনপদে ছড়িয়ে পড়বে।
কবি ফারুক নাজকির গল্প বলা এখানেই শেষ করতে চাই। কোনো এক বিদেশি কবি বলেছিলেন, ‘একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।’ সুতরাং আমার দুর্বলতম অনুবাদে নিশ্চয়ই নাজকিকে বিচার করবেন না পাঠক। ভিনদেশের একজন কবির জীবনপাঠের মাধ্যমে সে দেশের সংস্কৃতির ভেতরে প্রবেশ করাই আমাদের লক্ষ্য। নাজকির কবিতার অনুবাদক হিসেবে এটুকই আমার কৈফিয়ত। চলুন, নাজকির রোমান্টিক কবিতা ‘মধ্যরাতের বিলাপ’ শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যাক—
‘আমি ও তুমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি
নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে
প্রথমে শিথিল পরে শীতল হয়ে পড়ে জরায়ু
এবং স্বরূপে ফিরে আসে আমাদের মুখচ্ছবি
তখন এলোমেলো ভাবি
বিচ্ছেদ হলে আমাদের কী হবে
তোমার কী হবে আমাকে ছাড়া
আমার কী হবে তোমাকে ছাড়া
আমি বেঁচে থাকতে তুমি মরে যাবে
আমি তো ভাবতেই পারি না
এবং এও ভাবতে পারি না—
যদি আমি তোমার আগে মরে যাই
তুমি কীভাবে কাঁদবে
আমরা কত অসহায় ও একা
আমাদের প্রাণ দুটো একদেহে মিশিয়ে নেওয়া কি সম্ভব নয়
আমি-তুমির দ্বন্দ্বই যেন মিটে যায়?
আমরা একই শাখার দুটি ফুল
আমাদের রুচি ও রসনা এক
আমাদের দেহের রসায়ন এক
সত্যিকারের হৃদয়ও এক আমাদের—
তো আমাদের বিচ্ছেদ কেন হবে
কোনো পথ কি নেই
কোনো উপায় কি নেই—
এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করো
যাতে আমরা দুই হৃদয়কে স্পন্দিত
এবং দিনগুলোকে আলোঝরা রাখতে পারি
এবং এর পর
আমি শহর-নগরে ঘুরে বেড়াব
অলিগলি-বাজারে দৌড়াব
এবং সতত তোমার কণ্ঠ ওপরের আকাশ থেকে
নামতে থাকবে এবং পৃথিবী সজীব করতে থাকবে
এবং আমি ভালোবাসা-সাগরে সুরের নৃত্য দেখব
দেহ কতই না দুর্বল
এবং আমরা এ অবয়বে এ জন্যই সৃজিত হয়েছি
যে নিঃশেষিত হওয়ার স্বাদের মজনু হই
মৃত্যু নিয়ে আমি একটু বেশিই ভাবি
তোমার নিশ্বাস আমার কাঁধ স্পর্শ না করলে
আমি কেঁপে-কেঁপে উঠি
মৃত্যুর নীরবতাকে আমি ভয় পাই
কিন্তু সেই মুহূর্ত তো আসবেই—
শুভ্র লিলি ও হলদে সূর্যমুখীর চাদর পরে
আমাদের একজন যখন প্রথম মাটির নিচে চলে যাবে
তখন সব দিক থেকে ভেসে আসবে কান্নার শব্দ
এর পর নীরবতা…
নৈঃশব্দ…
এবং কবরের নীরবতা ভালোই লাগবে
তবে কবরের বাইরে যে মানুষটি এ নীরবতা সয়ে যাওয়ার দণ্ড পাবে
তার অবস্থা কত ভয়ানক হবে
এখন তুমিই বলো—কী করব
কত কঠিন পরিস্থিতি দেখো—
তোমার কোমল দেহের স্পর্শে এবং
তোমার কণ্ঠস্বরের ঝনঝনানিতেই
তোমার ভালোবাসা টের পাই আমি;
জৈবিকতা থেকে দূরে
অনুভব-সীমান্তের ওপারে
তুমি পর্যন্ত পৌঁছাতে আমি অক্ষম
এবং দেহের এ বাঁধন যেদিন ছিন্ন হবে
সেদিন এখানে, যেখানে আজ আমরা ভাবের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছি
সেখানে পড়ে থাকবে একটি শূন্য পিঞ্জর।’
আরও পড়ুন:

‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর বাংলা তর্জমা দাঁড়ায় ‘শব্দে শব্দে বিলাপ’। ১৯৯৫ সালে নাজকির এ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে আগের পর্বগুলোতে আমরা কিছু কথা জেনেছি। বিশেষ করে ফারুক নাজকির কবিতাশৈলী এবং গজল ও নজমের বৈশিষ্ট্য আলোচনায় ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর বেশ কিছু কবিতা উঠে এসেছে। কবিতাবিষয়ক সেসব ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ আলোচনা এড়িয়ে এবার আমরা বইয়ের পাতায় পাতায় শব্দমালার বিলাপ-ধ্বনি শুনতে চাই। অবশ্য ‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ পর্বেও আগুনের লেলিহান শিখা ও তাপ-উত্তাপের মোড়কে নাজকির বিলাপের ভিন্ন একটি রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর উৎসর্গপত্র থেকেই শুরু হয় ফারুকের বিলাপযাত্রা। জীবনের অন্যতম সেরা কাজটি তিনি সেই মানুষটির করকমলে অর্পণ করতে ভোলেননি, যাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, কাব্যপ্রতিভা ও জীবন-অভিজ্ঞতা ফারুকের জীবনের মোড়ে-মোড়ে আলো ফেলেছে; তমসাচ্ছন্ন রাতে দুর্বার গতিতে জীবনের পিচঢালা সড়ক ধরে ছুটে যেতে দ্রুত গতির বাহনের কাজ করেছে। তিনি আর কেউ নন, নাজকির জীবন রোদ্দুরে আমৃত্যু ছায়া দিয়ে যাওয়া বটবৃক্ষ ও অনন্ত অনুপ্রেরণার বাতিঘর বাবা মির গোলাম রসুল নাজকি।
উৎসর্গপত্রের ভাষ্য এখানে থেমে যায়নি। ভেতরের বিলাপের সুরে পাঠকের মন ছুঁয়ে দিতে নাজকি আরেকজন ব্যক্তির হাতেও বইটি অর্পণ করেন। সোমনাথ সাধু নামের সেই ভাগ্যবান হয়তো বড় কেউ নন; তবুও তাঁর মায়ের প্রয়াণে নাজকি আকুল হন; বিলাপ করেন এবং তাঁর মাথায় বুলিয়ে দেন সান্ত্বনার পরশ। ফলে বিলাপের পাশাপাশি নাজকি এখানে কাশ্মীরের বহুরৈখিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারানোর বেদনা কিছুটা লাঘব করার সুযোগ পান এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি তাঁর উষ্ণতার নজির স্থাপন করেন। ‘আরও একটি অর্পণ—সোমনাথ সাধু, তোমার নামে’ শিরোনামে তিনি লেখেন—
‘জানো, তোমার মা কামেলি
কাশ্মীর ছেড়ে গেছেন?
সঙ্গে নিয়ে গেছেন
সেই রুপোর থালাও—
যে থালায়
তিনি আমাদের একসঙ্গে খাওয়াতেন।
জানো কি, আমার ভয়েই তিনি
কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়েছেন?’
সোমনাথ সাধুর প্রতি শোক জানানোর পাশাপাশি কাশ্মীরের সমাজবাস্তবতাও দারুণভাবে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে নাজকির এই কয়েক ছত্রে। নাজকির কলম কাশ্মীরের প্রতি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণের সঙ্গে কখনো আপস করেনি, বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেওয়া ‘দ্রোহের আগুন’-এও ঘি ঢালেননি তিনি। বরং সব ধরনের নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও অশান্তির জন্য হৃদয়ের গহিনে গুঞ্জরিত বিলাপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার শব্দে-শব্দে।
‘শহরজুড়েই কারবালা প্রান্তর
রক্তখেকোর দল ছিল সর্বত্রই
ত্রাসের কাঁটাতারে ঘেরা কল্পনা-দেবালয়
উত্তরে আছি, না দক্ষিণে—জানা নেই।
রাতের হিংস্রতা সইতে পারব না আমি—
ক্রমেই ভেঙে পড়ছি, হে অপেক্ষাসন্ধ্যা।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেউ-ই দেবে না
কিংবা সতর্ক সাইরেন, হে শূন্য তেপান্তর
চোখের পলকেই আগুন জ্বলে লোকালয়ে
প্রত্যহ লুণ্ঠিত হয় হাসিমুখ নতুন সংসার
গাছে-গাছে জেঁকে বসে মৃত্যুর নীরবতা;
এ কেমন অস্ত্রবাজির মৌসুম এল—
বিষণ্ন উদ্যানের ফুল যায় শুকিয়ে
শরতের আঘাতে বিধ্বস্ত গুলশান।’
এমন মৃত্যুপুরীর মধ্যে কবির জীবন দুঃখ-বিষণ্নতার কালো মেঘে ঢেকে যায়। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে যায়। সন্ধ্যার আগেই পৃথিবীতে নেমে আসে আঁধারের প্রেতাত্মারা। কাশ্মীরের প্রকৃতি ও আবহাওয়ায় ঘুমোনোর সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘুমোতে পারেন না। নিঃসঙ্গ নক্ষত্র হয়ে চাঁদের কোলে জেগে থাকেন রাতের পর রাত। পৃথিবীর সকল ঘরে ঘুমপরী এলেও নাজকির কাশ্মীরে সে আসে না। তাই তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা—‘ঘুম কেন আসে না?’
‘নীরবতা সাঙ্গ করে
বৃক্ষে ঝোলে রাত—
মাঠ-ঘাট জনশূন্য;
উঁচু-নিচু টিলায়
বিষাদ ঝরায়
আলোর কোলাহল—
ঘুম কেন আসে না?
দিনের উষ্ণ মেলায়
আমি বিষণ্ন থাকি
সন্ধ্যার কোলাহলে
আমি হতাশ থাকি
সচেতন থাকি আমি
মাদক নিয়েও
হৃদয়ে বিদ্ধ তিরের
আঘাত সয়ে যাই,
ভাবি—পৃথিবীতে
আমিও কত একা!
চাঁদের বাহুডোরে
জোছনার আলো
মুড়িয়ে শুয়ে আছি—
ঘুম কেন আসে না?
ঘুম খুশবু—
রাতের বাতাসে
এখানে-সেখানে ঘোরে;
আমার ঘরে আসে না
দূরত্ব বজায় রেখে চলে;
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি—
ঘুম কেন আসে না?’
দুই.
‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ একদিকে যেমন সময়ের বিড়ম্বনার ক্যানভাস, অন্যদিকে কাশ্মীরের ঋতুবৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের অনন্য আলপনাও বটে। তবে তাতেও নাজকির বিলাপের সুর মিশে যায় দূরের কোনো পর্বতে কিংবা জলপ্রপাতের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে।
‘লাস্যময়ী শাহজাদি—মৌসুম
আমার রূপকরাজ্যে লুকায়
প্রথম বর্ষণ থেকে তুষারকাল—
একাই সয়ে গেছি সবকিছু;
জিজ্ঞেস করি—তোমার রুটি-রুজি?
ঝিলম বলে—ভেসে গেছে সব।
শীতে তুষারঝড় হবে
এবং ডেকে আনবে বিপদ;
আমার অস্তিত্বজুড়েই বৈপরিত্যের চাষ
বসন্তের শোক-গীত গাইব আমি।
মৌসুমের ছকে বাধা নেই শিলাবৃষ্টিও—
নিত্য আমাদের মাথা খুঁজে নেয় তা;
বিতস্তায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে
মানুষ—খড়কুটোর মতো করে।’
কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্রিয়তমার সান্নিধ্য পেতে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে ওঠে।
‘এখানে, শূন্য মরুতে প্রলম্বিত হচ্ছে ছায়া
গুলরিজ থেকে কেউ আমাকে আবার ডাকুক;
বিষাদকালে তোমার স্বপ্নযোগে আসাও
অসুস্থকে অমৃত খাইয়ে দেওয়ার মতো;
স্থির না হও, সম্মতি না দাও আমাকে—
অবিশ্বাস থেকে তো অন্তত মুক্তি দেবে!’
নাজকির তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মেনে সে স্বপ্নে হলেও আসে; আসতেই থাকে। এ এক নতুন যন্ত্রণা—তাকে ভুলে থাকার জন্য কবি শহর থেকে দূরে অজানা গন্তব্যে চলে যান। সেখানেও কবির নিস্তার নেই। চোখ বুঁজতেই সে তাঁর তনু-মনে শিহরণ জাগায়।
‘শ্রাবণ-শ্রাবণ জল-ফেলা চোখ
তোমার নামে সদকা দিলাম
মরুর সমান আকাঙ্ক্ষা-পা
মাতাল হস্ত আঁচল সমান
শহর ছেড়ে এলাম বনে
ভেবেছিলাম—থাকব একা
চোখ বুজতেই তুমি এসে
করলে সবই ওলটপালট।’
নাজকির চোখ প্রিয়তমার রূপ-ঐশ্বর্য্যের অনুপুঙ্খ হিসেব রাখে। প্রিয়তমার সকল সৌন্দর্য খুঁজে ফেরেন তিনি কাশ্মীরের পাহাড়, ঝিরি, নদী ও উপত্যকার পরতে-পরতে। নিবিড় প্রেমের উষ্ণতায় প্রকৃতি তাঁর সামনে সকল সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে। কবি বিস্মিত হন, তৃপ্ত হন এবং আধ্যাত্মিক হন। এমন অপার সৌন্দর্যের প্রতিটি উপাদানে স্রষ্টার খোঁজ করেন।
‘মাঠ থেকে মাঠে আলো ছড়ায় সত্যের মুক্তোরা
বাগানে-বাগানে তোমার নিদর্শন নিয়ে আসে কে
আঙিনার এই সব ঝরাপাতাদের
জিজ্ঞেস করো সৃষ্টিকর্তার কথা।’
তিন.
ফিরে যাই বিলাপ প্রসঙ্গে। নাজকি একটানা বিলাপ করেই যান না, মাঝেমধ্যে শ্লেষ মিশিয়ে ছুড়ে দেন কথার তিরও। কাশ্মীরিদের সবকিছু কেড়ে নিলেও খুব সীমিত পরিসরে কথা বলার জায়গা তো রাখা হয়েছে, সে জন্য কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে অধিকার হরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অবশ্য এ পর্যায়েও সত্য উচ্চারণে তিনি দ্বিধাহীন।
‘পরিস্থিতি এত বেশি খারাপ নয়—
বলতে পারব না এমন কথাও নেই;
তোমার পথে বিছিয়েছিলাম আমরা চোখের পাতা
আর তুমি, তুমি আমাদের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিলে!’
মূলত পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, নিজের ছায়াকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন নাজকি। কথা বলার স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই সেখানে। অফিস, বাসা, স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতেও তাঁর যত ভয়। কাশ্মীরের অবারিত প্রকৃতির বুকে এমন গুমোট সন্ধ্যা কখনো নামেনি। নাজকি বলেন—
‘স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়
মেপে-মেপে শব্দ চয়ন করি
অফিসে সহকর্মীদের সামনে
লিখিত বক্তব্য পাঠ করি।
কলিজার টুকরো মেয়েটির
চোখোচোখি হতে কাঁপন ধরে যায়—
এ কেমন বসন্ত এল, খোদা
সকাল থেকে খুশবুরাও আতঙ্কিত;
এ কেমন মাতাল মৌসুম এল
ফুলবানুদের সঙ্গে মিলিয়ে গেল ভোরে হাওয়াও।’
নাজকির বিলাপ থামে না। ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর শব্দে শব্দে, লাইনে-লাইনে, পদে-পদে এক নিঃস্ব-পরাধীন আহত মানবাত্মার করুণ কান্না শোনা যায়। দেশের মাটি-মানুষ ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সুরক্ষার জন্য এই বিলাপ অত্যন্ত দরকারি; নাজকির কণ্ঠ থেকে তা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সকল জনপদে ছড়িয়ে পড়বে।
কবি ফারুক নাজকির গল্প বলা এখানেই শেষ করতে চাই। কোনো এক বিদেশি কবি বলেছিলেন, ‘একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।’ সুতরাং আমার দুর্বলতম অনুবাদে নিশ্চয়ই নাজকিকে বিচার করবেন না পাঠক। ভিনদেশের একজন কবির জীবনপাঠের মাধ্যমে সে দেশের সংস্কৃতির ভেতরে প্রবেশ করাই আমাদের লক্ষ্য। নাজকির কবিতার অনুবাদক হিসেবে এটুকই আমার কৈফিয়ত। চলুন, নাজকির রোমান্টিক কবিতা ‘মধ্যরাতের বিলাপ’ শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যাক—
‘আমি ও তুমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি
নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে
প্রথমে শিথিল পরে শীতল হয়ে পড়ে জরায়ু
এবং স্বরূপে ফিরে আসে আমাদের মুখচ্ছবি
তখন এলোমেলো ভাবি
বিচ্ছেদ হলে আমাদের কী হবে
তোমার কী হবে আমাকে ছাড়া
আমার কী হবে তোমাকে ছাড়া
আমি বেঁচে থাকতে তুমি মরে যাবে
আমি তো ভাবতেই পারি না
এবং এও ভাবতে পারি না—
যদি আমি তোমার আগে মরে যাই
তুমি কীভাবে কাঁদবে
আমরা কত অসহায় ও একা
আমাদের প্রাণ দুটো একদেহে মিশিয়ে নেওয়া কি সম্ভব নয়
আমি-তুমির দ্বন্দ্বই যেন মিটে যায়?
আমরা একই শাখার দুটি ফুল
আমাদের রুচি ও রসনা এক
আমাদের দেহের রসায়ন এক
সত্যিকারের হৃদয়ও এক আমাদের—
তো আমাদের বিচ্ছেদ কেন হবে
কোনো পথ কি নেই
কোনো উপায় কি নেই—
এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করো
যাতে আমরা দুই হৃদয়কে স্পন্দিত
এবং দিনগুলোকে আলোঝরা রাখতে পারি
এবং এর পর
আমি শহর-নগরে ঘুরে বেড়াব
অলিগলি-বাজারে দৌড়াব
এবং সতত তোমার কণ্ঠ ওপরের আকাশ থেকে
নামতে থাকবে এবং পৃথিবী সজীব করতে থাকবে
এবং আমি ভালোবাসা-সাগরে সুরের নৃত্য দেখব
দেহ কতই না দুর্বল
এবং আমরা এ অবয়বে এ জন্যই সৃজিত হয়েছি
যে নিঃশেষিত হওয়ার স্বাদের মজনু হই
মৃত্যু নিয়ে আমি একটু বেশিই ভাবি
তোমার নিশ্বাস আমার কাঁধ স্পর্শ না করলে
আমি কেঁপে-কেঁপে উঠি
মৃত্যুর নীরবতাকে আমি ভয় পাই
কিন্তু সেই মুহূর্ত তো আসবেই—
শুভ্র লিলি ও হলদে সূর্যমুখীর চাদর পরে
আমাদের একজন যখন প্রথম মাটির নিচে চলে যাবে
তখন সব দিক থেকে ভেসে আসবে কান্নার শব্দ
এর পর নীরবতা…
নৈঃশব্দ…
এবং কবরের নীরবতা ভালোই লাগবে
তবে কবরের বাইরে যে মানুষটি এ নীরবতা সয়ে যাওয়ার দণ্ড পাবে
তার অবস্থা কত ভয়ানক হবে
এখন তুমিই বলো—কী করব
কত কঠিন পরিস্থিতি দেখো—
তোমার কোমল দেহের স্পর্শে এবং
তোমার কণ্ঠস্বরের ঝনঝনানিতেই
তোমার ভালোবাসা টের পাই আমি;
জৈবিকতা থেকে দূরে
অনুভব-সীমান্তের ওপারে
তুমি পর্যন্ত পৌঁছাতে আমি অক্ষম
এবং দেহের এ বাঁধন যেদিন ছিন্ন হবে
সেদিন এখানে, যেখানে আজ আমরা ভাবের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছি
সেখানে পড়ে থাকবে একটি শূন্য পিঞ্জর।’
আরও পড়ুন:
ইজাজুল হক

‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর বাংলা তর্জমা দাঁড়ায় ‘শব্দে শব্দে বিলাপ’। ১৯৯৫ সালে নাজকির এ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে আগের পর্বগুলোতে আমরা কিছু কথা জেনেছি। বিশেষ করে ফারুক নাজকির কবিতাশৈলী এবং গজল ও নজমের বৈশিষ্ট্য আলোচনায় ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর বেশ কিছু কবিতা উঠে এসেছে। কবিতাবিষয়ক সেসব ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ আলোচনা এড়িয়ে এবার আমরা বইয়ের পাতায় পাতায় শব্দমালার বিলাপ-ধ্বনি শুনতে চাই। অবশ্য ‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ পর্বেও আগুনের লেলিহান শিখা ও তাপ-উত্তাপের মোড়কে নাজকির বিলাপের ভিন্ন একটি রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর উৎসর্গপত্র থেকেই শুরু হয় ফারুকের বিলাপযাত্রা। জীবনের অন্যতম সেরা কাজটি তিনি সেই মানুষটির করকমলে অর্পণ করতে ভোলেননি, যাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, কাব্যপ্রতিভা ও জীবন-অভিজ্ঞতা ফারুকের জীবনের মোড়ে-মোড়ে আলো ফেলেছে; তমসাচ্ছন্ন রাতে দুর্বার গতিতে জীবনের পিচঢালা সড়ক ধরে ছুটে যেতে দ্রুত গতির বাহনের কাজ করেছে। তিনি আর কেউ নন, নাজকির জীবন রোদ্দুরে আমৃত্যু ছায়া দিয়ে যাওয়া বটবৃক্ষ ও অনন্ত অনুপ্রেরণার বাতিঘর বাবা মির গোলাম রসুল নাজকি।
উৎসর্গপত্রের ভাষ্য এখানে থেমে যায়নি। ভেতরের বিলাপের সুরে পাঠকের মন ছুঁয়ে দিতে নাজকি আরেকজন ব্যক্তির হাতেও বইটি অর্পণ করেন। সোমনাথ সাধু নামের সেই ভাগ্যবান হয়তো বড় কেউ নন; তবুও তাঁর মায়ের প্রয়াণে নাজকি আকুল হন; বিলাপ করেন এবং তাঁর মাথায় বুলিয়ে দেন সান্ত্বনার পরশ। ফলে বিলাপের পাশাপাশি নাজকি এখানে কাশ্মীরের বহুরৈখিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারানোর বেদনা কিছুটা লাঘব করার সুযোগ পান এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি তাঁর উষ্ণতার নজির স্থাপন করেন। ‘আরও একটি অর্পণ—সোমনাথ সাধু, তোমার নামে’ শিরোনামে তিনি লেখেন—
‘জানো, তোমার মা কামেলি
কাশ্মীর ছেড়ে গেছেন?
সঙ্গে নিয়ে গেছেন
সেই রুপোর থালাও—
যে থালায়
তিনি আমাদের একসঙ্গে খাওয়াতেন।
জানো কি, আমার ভয়েই তিনি
কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়েছেন?’
সোমনাথ সাধুর প্রতি শোক জানানোর পাশাপাশি কাশ্মীরের সমাজবাস্তবতাও দারুণভাবে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে নাজকির এই কয়েক ছত্রে। নাজকির কলম কাশ্মীরের প্রতি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণের সঙ্গে কখনো আপস করেনি, বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেওয়া ‘দ্রোহের আগুন’-এও ঘি ঢালেননি তিনি। বরং সব ধরনের নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও অশান্তির জন্য হৃদয়ের গহিনে গুঞ্জরিত বিলাপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার শব্দে-শব্দে।
‘শহরজুড়েই কারবালা প্রান্তর
রক্তখেকোর দল ছিল সর্বত্রই
ত্রাসের কাঁটাতারে ঘেরা কল্পনা-দেবালয়
উত্তরে আছি, না দক্ষিণে—জানা নেই।
রাতের হিংস্রতা সইতে পারব না আমি—
ক্রমেই ভেঙে পড়ছি, হে অপেক্ষাসন্ধ্যা।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেউ-ই দেবে না
কিংবা সতর্ক সাইরেন, হে শূন্য তেপান্তর
চোখের পলকেই আগুন জ্বলে লোকালয়ে
প্রত্যহ লুণ্ঠিত হয় হাসিমুখ নতুন সংসার
গাছে-গাছে জেঁকে বসে মৃত্যুর নীরবতা;
এ কেমন অস্ত্রবাজির মৌসুম এল—
বিষণ্ন উদ্যানের ফুল যায় শুকিয়ে
শরতের আঘাতে বিধ্বস্ত গুলশান।’
এমন মৃত্যুপুরীর মধ্যে কবির জীবন দুঃখ-বিষণ্নতার কালো মেঘে ঢেকে যায়। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে যায়। সন্ধ্যার আগেই পৃথিবীতে নেমে আসে আঁধারের প্রেতাত্মারা। কাশ্মীরের প্রকৃতি ও আবহাওয়ায় ঘুমোনোর সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘুমোতে পারেন না। নিঃসঙ্গ নক্ষত্র হয়ে চাঁদের কোলে জেগে থাকেন রাতের পর রাত। পৃথিবীর সকল ঘরে ঘুমপরী এলেও নাজকির কাশ্মীরে সে আসে না। তাই তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা—‘ঘুম কেন আসে না?’
‘নীরবতা সাঙ্গ করে
বৃক্ষে ঝোলে রাত—
মাঠ-ঘাট জনশূন্য;
উঁচু-নিচু টিলায়
বিষাদ ঝরায়
আলোর কোলাহল—
ঘুম কেন আসে না?
দিনের উষ্ণ মেলায়
আমি বিষণ্ন থাকি
সন্ধ্যার কোলাহলে
আমি হতাশ থাকি
সচেতন থাকি আমি
মাদক নিয়েও
হৃদয়ে বিদ্ধ তিরের
আঘাত সয়ে যাই,
ভাবি—পৃথিবীতে
আমিও কত একা!
চাঁদের বাহুডোরে
জোছনার আলো
মুড়িয়ে শুয়ে আছি—
ঘুম কেন আসে না?
ঘুম খুশবু—
রাতের বাতাসে
এখানে-সেখানে ঘোরে;
আমার ঘরে আসে না
দূরত্ব বজায় রেখে চলে;
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি—
ঘুম কেন আসে না?’
দুই.
‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ একদিকে যেমন সময়ের বিড়ম্বনার ক্যানভাস, অন্যদিকে কাশ্মীরের ঋতুবৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের অনন্য আলপনাও বটে। তবে তাতেও নাজকির বিলাপের সুর মিশে যায় দূরের কোনো পর্বতে কিংবা জলপ্রপাতের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে।
‘লাস্যময়ী শাহজাদি—মৌসুম
আমার রূপকরাজ্যে লুকায়
প্রথম বর্ষণ থেকে তুষারকাল—
একাই সয়ে গেছি সবকিছু;
জিজ্ঞেস করি—তোমার রুটি-রুজি?
ঝিলম বলে—ভেসে গেছে সব।
শীতে তুষারঝড় হবে
এবং ডেকে আনবে বিপদ;
আমার অস্তিত্বজুড়েই বৈপরিত্যের চাষ
বসন্তের শোক-গীত গাইব আমি।
মৌসুমের ছকে বাধা নেই শিলাবৃষ্টিও—
নিত্য আমাদের মাথা খুঁজে নেয় তা;
বিতস্তায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে
মানুষ—খড়কুটোর মতো করে।’
কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্রিয়তমার সান্নিধ্য পেতে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে ওঠে।
‘এখানে, শূন্য মরুতে প্রলম্বিত হচ্ছে ছায়া
গুলরিজ থেকে কেউ আমাকে আবার ডাকুক;
বিষাদকালে তোমার স্বপ্নযোগে আসাও
অসুস্থকে অমৃত খাইয়ে দেওয়ার মতো;
স্থির না হও, সম্মতি না দাও আমাকে—
অবিশ্বাস থেকে তো অন্তত মুক্তি দেবে!’
নাজকির তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মেনে সে স্বপ্নে হলেও আসে; আসতেই থাকে। এ এক নতুন যন্ত্রণা—তাকে ভুলে থাকার জন্য কবি শহর থেকে দূরে অজানা গন্তব্যে চলে যান। সেখানেও কবির নিস্তার নেই। চোখ বুঁজতেই সে তাঁর তনু-মনে শিহরণ জাগায়।
‘শ্রাবণ-শ্রাবণ জল-ফেলা চোখ
তোমার নামে সদকা দিলাম
মরুর সমান আকাঙ্ক্ষা-পা
মাতাল হস্ত আঁচল সমান
শহর ছেড়ে এলাম বনে
ভেবেছিলাম—থাকব একা
চোখ বুজতেই তুমি এসে
করলে সবই ওলটপালট।’
নাজকির চোখ প্রিয়তমার রূপ-ঐশ্বর্য্যের অনুপুঙ্খ হিসেব রাখে। প্রিয়তমার সকল সৌন্দর্য খুঁজে ফেরেন তিনি কাশ্মীরের পাহাড়, ঝিরি, নদী ও উপত্যকার পরতে-পরতে। নিবিড় প্রেমের উষ্ণতায় প্রকৃতি তাঁর সামনে সকল সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে। কবি বিস্মিত হন, তৃপ্ত হন এবং আধ্যাত্মিক হন। এমন অপার সৌন্দর্যের প্রতিটি উপাদানে স্রষ্টার খোঁজ করেন।
‘মাঠ থেকে মাঠে আলো ছড়ায় সত্যের মুক্তোরা
বাগানে-বাগানে তোমার নিদর্শন নিয়ে আসে কে
আঙিনার এই সব ঝরাপাতাদের
জিজ্ঞেস করো সৃষ্টিকর্তার কথা।’
তিন.
ফিরে যাই বিলাপ প্রসঙ্গে। নাজকি একটানা বিলাপ করেই যান না, মাঝেমধ্যে শ্লেষ মিশিয়ে ছুড়ে দেন কথার তিরও। কাশ্মীরিদের সবকিছু কেড়ে নিলেও খুব সীমিত পরিসরে কথা বলার জায়গা তো রাখা হয়েছে, সে জন্য কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে অধিকার হরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অবশ্য এ পর্যায়েও সত্য উচ্চারণে তিনি দ্বিধাহীন।
‘পরিস্থিতি এত বেশি খারাপ নয়—
বলতে পারব না এমন কথাও নেই;
তোমার পথে বিছিয়েছিলাম আমরা চোখের পাতা
আর তুমি, তুমি আমাদের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিলে!’
মূলত পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, নিজের ছায়াকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন নাজকি। কথা বলার স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই সেখানে। অফিস, বাসা, স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতেও তাঁর যত ভয়। কাশ্মীরের অবারিত প্রকৃতির বুকে এমন গুমোট সন্ধ্যা কখনো নামেনি। নাজকি বলেন—
‘স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়
মেপে-মেপে শব্দ চয়ন করি
অফিসে সহকর্মীদের সামনে
লিখিত বক্তব্য পাঠ করি।
কলিজার টুকরো মেয়েটির
চোখোচোখি হতে কাঁপন ধরে যায়—
এ কেমন বসন্ত এল, খোদা
সকাল থেকে খুশবুরাও আতঙ্কিত;
এ কেমন মাতাল মৌসুম এল
ফুলবানুদের সঙ্গে মিলিয়ে গেল ভোরে হাওয়াও।’
নাজকির বিলাপ থামে না। ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর শব্দে শব্দে, লাইনে-লাইনে, পদে-পদে এক নিঃস্ব-পরাধীন আহত মানবাত্মার করুণ কান্না শোনা যায়। দেশের মাটি-মানুষ ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সুরক্ষার জন্য এই বিলাপ অত্যন্ত দরকারি; নাজকির কণ্ঠ থেকে তা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সকল জনপদে ছড়িয়ে পড়বে।
কবি ফারুক নাজকির গল্প বলা এখানেই শেষ করতে চাই। কোনো এক বিদেশি কবি বলেছিলেন, ‘একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।’ সুতরাং আমার দুর্বলতম অনুবাদে নিশ্চয়ই নাজকিকে বিচার করবেন না পাঠক। ভিনদেশের একজন কবির জীবনপাঠের মাধ্যমে সে দেশের সংস্কৃতির ভেতরে প্রবেশ করাই আমাদের লক্ষ্য। নাজকির কবিতার অনুবাদক হিসেবে এটুকই আমার কৈফিয়ত। চলুন, নাজকির রোমান্টিক কবিতা ‘মধ্যরাতের বিলাপ’ শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যাক—
‘আমি ও তুমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি
নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে
প্রথমে শিথিল পরে শীতল হয়ে পড়ে জরায়ু
এবং স্বরূপে ফিরে আসে আমাদের মুখচ্ছবি
তখন এলোমেলো ভাবি
বিচ্ছেদ হলে আমাদের কী হবে
তোমার কী হবে আমাকে ছাড়া
আমার কী হবে তোমাকে ছাড়া
আমি বেঁচে থাকতে তুমি মরে যাবে
আমি তো ভাবতেই পারি না
এবং এও ভাবতে পারি না—
যদি আমি তোমার আগে মরে যাই
তুমি কীভাবে কাঁদবে
আমরা কত অসহায় ও একা
আমাদের প্রাণ দুটো একদেহে মিশিয়ে নেওয়া কি সম্ভব নয়
আমি-তুমির দ্বন্দ্বই যেন মিটে যায়?
আমরা একই শাখার দুটি ফুল
আমাদের রুচি ও রসনা এক
আমাদের দেহের রসায়ন এক
সত্যিকারের হৃদয়ও এক আমাদের—
তো আমাদের বিচ্ছেদ কেন হবে
কোনো পথ কি নেই
কোনো উপায় কি নেই—
এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করো
যাতে আমরা দুই হৃদয়কে স্পন্দিত
এবং দিনগুলোকে আলোঝরা রাখতে পারি
এবং এর পর
আমি শহর-নগরে ঘুরে বেড়াব
অলিগলি-বাজারে দৌড়াব
এবং সতত তোমার কণ্ঠ ওপরের আকাশ থেকে
নামতে থাকবে এবং পৃথিবী সজীব করতে থাকবে
এবং আমি ভালোবাসা-সাগরে সুরের নৃত্য দেখব
দেহ কতই না দুর্বল
এবং আমরা এ অবয়বে এ জন্যই সৃজিত হয়েছি
যে নিঃশেষিত হওয়ার স্বাদের মজনু হই
মৃত্যু নিয়ে আমি একটু বেশিই ভাবি
তোমার নিশ্বাস আমার কাঁধ স্পর্শ না করলে
আমি কেঁপে-কেঁপে উঠি
মৃত্যুর নীরবতাকে আমি ভয় পাই
কিন্তু সেই মুহূর্ত তো আসবেই—
শুভ্র লিলি ও হলদে সূর্যমুখীর চাদর পরে
আমাদের একজন যখন প্রথম মাটির নিচে চলে যাবে
তখন সব দিক থেকে ভেসে আসবে কান্নার শব্দ
এর পর নীরবতা…
নৈঃশব্দ…
এবং কবরের নীরবতা ভালোই লাগবে
তবে কবরের বাইরে যে মানুষটি এ নীরবতা সয়ে যাওয়ার দণ্ড পাবে
তার অবস্থা কত ভয়ানক হবে
এখন তুমিই বলো—কী করব
কত কঠিন পরিস্থিতি দেখো—
তোমার কোমল দেহের স্পর্শে এবং
তোমার কণ্ঠস্বরের ঝনঝনানিতেই
তোমার ভালোবাসা টের পাই আমি;
জৈবিকতা থেকে দূরে
অনুভব-সীমান্তের ওপারে
তুমি পর্যন্ত পৌঁছাতে আমি অক্ষম
এবং দেহের এ বাঁধন যেদিন ছিন্ন হবে
সেদিন এখানে, যেখানে আজ আমরা ভাবের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছি
সেখানে পড়ে থাকবে একটি শূন্য পিঞ্জর।’
আরও পড়ুন:

‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর বাংলা তর্জমা দাঁড়ায় ‘শব্দে শব্দে বিলাপ’। ১৯৯৫ সালে নাজকির এ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে আগের পর্বগুলোতে আমরা কিছু কথা জেনেছি। বিশেষ করে ফারুক নাজকির কবিতাশৈলী এবং গজল ও নজমের বৈশিষ্ট্য আলোচনায় ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর বেশ কিছু কবিতা উঠে এসেছে। কবিতাবিষয়ক সেসব ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ আলোচনা এড়িয়ে এবার আমরা বইয়ের পাতায় পাতায় শব্দমালার বিলাপ-ধ্বনি শুনতে চাই। অবশ্য ‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ পর্বেও আগুনের লেলিহান শিখা ও তাপ-উত্তাপের মোড়কে নাজকির বিলাপের ভিন্ন একটি রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
‘লফ্জ লফজ নোহা’-এর উৎসর্গপত্র থেকেই শুরু হয় ফারুকের বিলাপযাত্রা। জীবনের অন্যতম সেরা কাজটি তিনি সেই মানুষটির করকমলে অর্পণ করতে ভোলেননি, যাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, কাব্যপ্রতিভা ও জীবন-অভিজ্ঞতা ফারুকের জীবনের মোড়ে-মোড়ে আলো ফেলেছে; তমসাচ্ছন্ন রাতে দুর্বার গতিতে জীবনের পিচঢালা সড়ক ধরে ছুটে যেতে দ্রুত গতির বাহনের কাজ করেছে। তিনি আর কেউ নন, নাজকির জীবন রোদ্দুরে আমৃত্যু ছায়া দিয়ে যাওয়া বটবৃক্ষ ও অনন্ত অনুপ্রেরণার বাতিঘর বাবা মির গোলাম রসুল নাজকি।
উৎসর্গপত্রের ভাষ্য এখানে থেমে যায়নি। ভেতরের বিলাপের সুরে পাঠকের মন ছুঁয়ে দিতে নাজকি আরেকজন ব্যক্তির হাতেও বইটি অর্পণ করেন। সোমনাথ সাধু নামের সেই ভাগ্যবান হয়তো বড় কেউ নন; তবুও তাঁর মায়ের প্রয়াণে নাজকি আকুল হন; বিলাপ করেন এবং তাঁর মাথায় বুলিয়ে দেন সান্ত্বনার পরশ। ফলে বিলাপের পাশাপাশি নাজকি এখানে কাশ্মীরের বহুরৈখিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারানোর বেদনা কিছুটা লাঘব করার সুযোগ পান এবং সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের প্রতি তাঁর উষ্ণতার নজির স্থাপন করেন। ‘আরও একটি অর্পণ—সোমনাথ সাধু, তোমার নামে’ শিরোনামে তিনি লেখেন—
‘জানো, তোমার মা কামেলি
কাশ্মীর ছেড়ে গেছেন?
সঙ্গে নিয়ে গেছেন
সেই রুপোর থালাও—
যে থালায়
তিনি আমাদের একসঙ্গে খাওয়াতেন।
জানো কি, আমার ভয়েই তিনি
কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়েছেন?’
সোমনাথ সাধুর প্রতি শোক জানানোর পাশাপাশি কাশ্মীরের সমাজবাস্তবতাও দারুণভাবে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে নাজকির এই কয়েক ছত্রে। নাজকির কলম কাশ্মীরের প্রতি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণের সঙ্গে কখনো আপস করেনি, বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেওয়া ‘দ্রোহের আগুন’-এও ঘি ঢালেননি তিনি। বরং সব ধরনের নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও অশান্তির জন্য হৃদয়ের গহিনে গুঞ্জরিত বিলাপের প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার শব্দে-শব্দে।
‘শহরজুড়েই কারবালা প্রান্তর
রক্তখেকোর দল ছিল সর্বত্রই
ত্রাসের কাঁটাতারে ঘেরা কল্পনা-দেবালয়
উত্তরে আছি, না দক্ষিণে—জানা নেই।
রাতের হিংস্রতা সইতে পারব না আমি—
ক্রমেই ভেঙে পড়ছি, হে অপেক্ষাসন্ধ্যা।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেউ-ই দেবে না
কিংবা সতর্ক সাইরেন, হে শূন্য তেপান্তর
চোখের পলকেই আগুন জ্বলে লোকালয়ে
প্রত্যহ লুণ্ঠিত হয় হাসিমুখ নতুন সংসার
গাছে-গাছে জেঁকে বসে মৃত্যুর নীরবতা;
এ কেমন অস্ত্রবাজির মৌসুম এল—
বিষণ্ন উদ্যানের ফুল যায় শুকিয়ে
শরতের আঘাতে বিধ্বস্ত গুলশান।’
এমন মৃত্যুপুরীর মধ্যে কবির জীবন দুঃখ-বিষণ্নতার কালো মেঘে ঢেকে যায়। চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে যায়। সন্ধ্যার আগেই পৃথিবীতে নেমে আসে আঁধারের প্রেতাত্মারা। কাশ্মীরের প্রকৃতি ও আবহাওয়ায় ঘুমোনোর সব উপাদান থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘুমোতে পারেন না। নিঃসঙ্গ নক্ষত্র হয়ে চাঁদের কোলে জেগে থাকেন রাতের পর রাত। পৃথিবীর সকল ঘরে ঘুমপরী এলেও নাজকির কাশ্মীরে সে আসে না। তাই তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা—‘ঘুম কেন আসে না?’
‘নীরবতা সাঙ্গ করে
বৃক্ষে ঝোলে রাত—
মাঠ-ঘাট জনশূন্য;
উঁচু-নিচু টিলায়
বিষাদ ঝরায়
আলোর কোলাহল—
ঘুম কেন আসে না?
দিনের উষ্ণ মেলায়
আমি বিষণ্ন থাকি
সন্ধ্যার কোলাহলে
আমি হতাশ থাকি
সচেতন থাকি আমি
মাদক নিয়েও
হৃদয়ে বিদ্ধ তিরের
আঘাত সয়ে যাই,
ভাবি—পৃথিবীতে
আমিও কত একা!
চাঁদের বাহুডোরে
জোছনার আলো
মুড়িয়ে শুয়ে আছি—
ঘুম কেন আসে না?
ঘুম খুশবু—
রাতের বাতাসে
এখানে-সেখানে ঘোরে;
আমার ঘরে আসে না
দূরত্ব বজায় রেখে চলে;
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি—
ঘুম কেন আসে না?’
দুই.
‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ একদিকে যেমন সময়ের বিড়ম্বনার ক্যানভাস, অন্যদিকে কাশ্মীরের ঋতুবৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও পরিবেশের অনন্য আলপনাও বটে। তবে তাতেও নাজকির বিলাপের সুর মিশে যায় দূরের কোনো পর্বতে কিংবা জলপ্রপাতের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে।
‘লাস্যময়ী শাহজাদি—মৌসুম
আমার রূপকরাজ্যে লুকায়
প্রথম বর্ষণ থেকে তুষারকাল—
একাই সয়ে গেছি সবকিছু;
জিজ্ঞেস করি—তোমার রুটি-রুজি?
ঝিলম বলে—ভেসে গেছে সব।
শীতে তুষারঝড় হবে
এবং ডেকে আনবে বিপদ;
আমার অস্তিত্বজুড়েই বৈপরিত্যের চাষ
বসন্তের শোক-গীত গাইব আমি।
মৌসুমের ছকে বাধা নেই শিলাবৃষ্টিও—
নিত্য আমাদের মাথা খুঁজে নেয় তা;
বিতস্তায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে
মানুষ—খড়কুটোর মতো করে।’
কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্রিয়তমার সান্নিধ্য পেতে তাঁর হৃদয় হাহাকার করে ওঠে।
‘এখানে, শূন্য মরুতে প্রলম্বিত হচ্ছে ছায়া
গুলরিজ থেকে কেউ আমাকে আবার ডাকুক;
বিষাদকালে তোমার স্বপ্নযোগে আসাও
অসুস্থকে অমৃত খাইয়ে দেওয়ার মতো;
স্থির না হও, সম্মতি না দাও আমাকে—
অবিশ্বাস থেকে তো অন্তত মুক্তি দেবে!’
নাজকির তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে হার মেনে সে স্বপ্নে হলেও আসে; আসতেই থাকে। এ এক নতুন যন্ত্রণা—তাকে ভুলে থাকার জন্য কবি শহর থেকে দূরে অজানা গন্তব্যে চলে যান। সেখানেও কবির নিস্তার নেই। চোখ বুঁজতেই সে তাঁর তনু-মনে শিহরণ জাগায়।
‘শ্রাবণ-শ্রাবণ জল-ফেলা চোখ
তোমার নামে সদকা দিলাম
মরুর সমান আকাঙ্ক্ষা-পা
মাতাল হস্ত আঁচল সমান
শহর ছেড়ে এলাম বনে
ভেবেছিলাম—থাকব একা
চোখ বুজতেই তুমি এসে
করলে সবই ওলটপালট।’
নাজকির চোখ প্রিয়তমার রূপ-ঐশ্বর্য্যের অনুপুঙ্খ হিসেব রাখে। প্রিয়তমার সকল সৌন্দর্য খুঁজে ফেরেন তিনি কাশ্মীরের পাহাড়, ঝিরি, নদী ও উপত্যকার পরতে-পরতে। নিবিড় প্রেমের উষ্ণতায় প্রকৃতি তাঁর সামনে সকল সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে। কবি বিস্মিত হন, তৃপ্ত হন এবং আধ্যাত্মিক হন। এমন অপার সৌন্দর্যের প্রতিটি উপাদানে স্রষ্টার খোঁজ করেন।
‘মাঠ থেকে মাঠে আলো ছড়ায় সত্যের মুক্তোরা
বাগানে-বাগানে তোমার নিদর্শন নিয়ে আসে কে
আঙিনার এই সব ঝরাপাতাদের
জিজ্ঞেস করো সৃষ্টিকর্তার কথা।’
তিন.
ফিরে যাই বিলাপ প্রসঙ্গে। নাজকি একটানা বিলাপ করেই যান না, মাঝেমধ্যে শ্লেষ মিশিয়ে ছুড়ে দেন কথার তিরও। কাশ্মীরিদের সবকিছু কেড়ে নিলেও খুব সীমিত পরিসরে কথা বলার জায়গা তো রাখা হয়েছে, সে জন্য কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে অধিকার হরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। অবশ্য এ পর্যায়েও সত্য উচ্চারণে তিনি দ্বিধাহীন।
‘পরিস্থিতি এত বেশি খারাপ নয়—
বলতে পারব না এমন কথাও নেই;
তোমার পথে বিছিয়েছিলাম আমরা চোখের পাতা
আর তুমি, তুমি আমাদের পথে কাঁটা বিছিয়ে দিলে!’
মূলত পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, নিজের ছায়াকেও সন্দেহ করতে শুরু করেন নাজকি। কথা বলার স্বাধীনতা বলতে কিছুই নেই সেখানে। অফিস, বাসা, স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতেও তাঁর যত ভয়। কাশ্মীরের অবারিত প্রকৃতির বুকে এমন গুমোট সন্ধ্যা কখনো নামেনি। নাজকি বলেন—
‘স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়
মেপে-মেপে শব্দ চয়ন করি
অফিসে সহকর্মীদের সামনে
লিখিত বক্তব্য পাঠ করি।
কলিজার টুকরো মেয়েটির
চোখোচোখি হতে কাঁপন ধরে যায়—
এ কেমন বসন্ত এল, খোদা
সকাল থেকে খুশবুরাও আতঙ্কিত;
এ কেমন মাতাল মৌসুম এল
ফুলবানুদের সঙ্গে মিলিয়ে গেল ভোরে হাওয়াও।’
নাজকির বিলাপ থামে না। ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর শব্দে শব্দে, লাইনে-লাইনে, পদে-পদে এক নিঃস্ব-পরাধীন আহত মানবাত্মার করুণ কান্না শোনা যায়। দেশের মাটি-মানুষ ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সুরক্ষার জন্য এই বিলাপ অত্যন্ত দরকারি; নাজকির কণ্ঠ থেকে তা নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সকল জনপদে ছড়িয়ে পড়বে।
কবি ফারুক নাজকির গল্প বলা এখানেই শেষ করতে চাই। কোনো এক বিদেশি কবি বলেছিলেন, ‘একটি কবিতার সেইটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার অনুবাদ সম্ভব নয়।’ সুতরাং আমার দুর্বলতম অনুবাদে নিশ্চয়ই নাজকিকে বিচার করবেন না পাঠক। ভিনদেশের একজন কবির জীবনপাঠের মাধ্যমে সে দেশের সংস্কৃতির ভেতরে প্রবেশ করাই আমাদের লক্ষ্য। নাজকির কবিতার অনুবাদক হিসেবে এটুকই আমার কৈফিয়ত। চলুন, নাজকির রোমান্টিক কবিতা ‘মধ্যরাতের বিলাপ’ শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যাক—
‘আমি ও তুমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি
নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে
প্রথমে শিথিল পরে শীতল হয়ে পড়ে জরায়ু
এবং স্বরূপে ফিরে আসে আমাদের মুখচ্ছবি
তখন এলোমেলো ভাবি
বিচ্ছেদ হলে আমাদের কী হবে
তোমার কী হবে আমাকে ছাড়া
আমার কী হবে তোমাকে ছাড়া
আমি বেঁচে থাকতে তুমি মরে যাবে
আমি তো ভাবতেই পারি না
এবং এও ভাবতে পারি না—
যদি আমি তোমার আগে মরে যাই
তুমি কীভাবে কাঁদবে
আমরা কত অসহায় ও একা
আমাদের প্রাণ দুটো একদেহে মিশিয়ে নেওয়া কি সম্ভব নয়
আমি-তুমির দ্বন্দ্বই যেন মিটে যায়?
আমরা একই শাখার দুটি ফুল
আমাদের রুচি ও রসনা এক
আমাদের দেহের রসায়ন এক
সত্যিকারের হৃদয়ও এক আমাদের—
তো আমাদের বিচ্ছেদ কেন হবে
কোনো পথ কি নেই
কোনো উপায় কি নেই—
এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করো
যাতে আমরা দুই হৃদয়কে স্পন্দিত
এবং দিনগুলোকে আলোঝরা রাখতে পারি
এবং এর পর
আমি শহর-নগরে ঘুরে বেড়াব
অলিগলি-বাজারে দৌড়াব
এবং সতত তোমার কণ্ঠ ওপরের আকাশ থেকে
নামতে থাকবে এবং পৃথিবী সজীব করতে থাকবে
এবং আমি ভালোবাসা-সাগরে সুরের নৃত্য দেখব
দেহ কতই না দুর্বল
এবং আমরা এ অবয়বে এ জন্যই সৃজিত হয়েছি
যে নিঃশেষিত হওয়ার স্বাদের মজনু হই
মৃত্যু নিয়ে আমি একটু বেশিই ভাবি
তোমার নিশ্বাস আমার কাঁধ স্পর্শ না করলে
আমি কেঁপে-কেঁপে উঠি
মৃত্যুর নীরবতাকে আমি ভয় পাই
কিন্তু সেই মুহূর্ত তো আসবেই—
শুভ্র লিলি ও হলদে সূর্যমুখীর চাদর পরে
আমাদের একজন যখন প্রথম মাটির নিচে চলে যাবে
তখন সব দিক থেকে ভেসে আসবে কান্নার শব্দ
এর পর নীরবতা…
নৈঃশব্দ…
এবং কবরের নীরবতা ভালোই লাগবে
তবে কবরের বাইরে যে মানুষটি এ নীরবতা সয়ে যাওয়ার দণ্ড পাবে
তার অবস্থা কত ভয়ানক হবে
এখন তুমিই বলো—কী করব
কত কঠিন পরিস্থিতি দেখো—
তোমার কোমল দেহের স্পর্শে এবং
তোমার কণ্ঠস্বরের ঝনঝনানিতেই
তোমার ভালোবাসা টের পাই আমি;
জৈবিকতা থেকে দূরে
অনুভব-সীমান্তের ওপারে
তুমি পর্যন্ত পৌঁছাতে আমি অক্ষম
এবং দেহের এ বাঁধন যেদিন ছিন্ন হবে
সেদিন এখানে, যেখানে আজ আমরা ভাবের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছি
সেখানে পড়ে থাকবে একটি শূন্য পিঞ্জর।’
আরও পড়ুন:

আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

দক্ষিণ ভারতের কোচি শহরের সরু, নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট্ট একটি ফলক। তাতে লেখা, ‘সারা কোহেনের বাড়ি।’ জনাকীর্ণ এই রাস্তাটির নাম জু টাউন। কয়েক দশক আগেও এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বসবাস করত ইহুদি পরিবার। প্রাচীন সামগ্রী, পারস্যের কার্পেট আর মসলার দোকানে ঠাসা এই এলাকাই একসময় পরিচিত ছিল কোচির ইহুদি পাড়া হিসেবে।
এই রাস্তাতেই রয়েছে থাহা ইব্রাহিমের দোকান। কোচির শেষ ইহুদি নকশার দোকান। এক তপ্ত দুপুরে কয়েকজন মার্কিন পর্যটক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেল, ৫৫ বছর বয়সী থাহা মনোযোগ দিয়ে একটি কিপ্পা (ইহুদি পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী ছোট, বৃত্তাকার টুপি যা তারা ঈশ্বরকে সম্মান জানাতে এবং নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে পরে থাকে) সেলাই করছেন। দোকানের দেয়ালে ঝোলানো একটি ছবির সামনে পর্যটকেরা ভিড় জমালেন। ছবিটি ২০১৩ সালের। তৎকালীন ব্রিটিশ যুবরাজ (বর্তমানে রাজা) চার্লস জু টাউনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
ছবির দিকে আঙুল তুলে থাহা বললেন, ‘ওই ইনিই সারা আন্টি।’ এরপর যোগ করলেন, ‘এটা ছিল সারা কোহেনের বাড়ি ও তাঁর সেলাইয়ের দোকান।’
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর পুরোপুরি দায়িত্ব নেন তিনি।
থাহা বলেন, ‘আমি ছিলাম তাঁর ছেলের মতো। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি সময় তাঁর দেখাশোনা করেছি। আমি তাঁর জন্য কোশার (ইহুদিদের এক ধরনের খাবার) আর মাছ কিনে আনতাম। সময় কাটাতাম আর দোকান বন্ধ করার পরই কেবল ফিরতাম।’
এক ইহুদি নারী আর ভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির এক মুসলমান পুরুষের এই বন্ধুত্ব প্রায় চার দশক ধরে টিকে ছিল। মৃত্যুর আগে সারা তাঁর দোকানটি থাহার নামে উইল করে যান। থাহা প্রতিজ্ঞা করেন, জু টাউনে তিনি সারার স্মৃতি আর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখবেন। যেখানে আঠারো শতকে প্রায় আড়াই হাজার ইহুদি বাস করতেন, সেখানে এখন কেবল একজন অবশিষ্ট। থাহা বলেন, ‘এক দিক থেকে, এখানকার ইহুদি সম্প্রদায় যাতে বিস্মৃত না হয়, আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
কেরালায় ইহুদিদের আগমনের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে উল্লিখিত রাজা সোলোমনের সময়ের, প্রায় দুই হাজার বছর আগেকার। প্রথমে তাঁরা মালাবার উপকূলে ক্রাঙ্গানোরে, বর্তমান কোডুঙ্গাল্লুরের কাছে প্রাচীন বন্দরের আশপাশে বণিক হিসেবে বসতি গড়েন। পরে তাঁরা কোচিতে চলে আসেন। এই প্রাচীন বসতির কারণে তাঁরা পরিচিত হন মালাবারি ইহুদি নামে।
এর বহু পরে, ১৫৯২ সালে, স্প্যানিশ নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা সেফার্ডিক ইহুদিরা কেরালায় পৌঁছান। পর্তুগাল, তুরস্ক আর বাগদাদ হয়ে তাঁরা কোচিতে বসতি গড়ে তোলেন এবং পরিচিত হন পারাদেসি বা বিদেশি ইহুদি নামে। মালাবারি ও পারাদেসি—এই দুই ধারার মানুষ মিলেই পরিচিত হন কোচিন ইহুদি নামে।

পর্তুগিজ, আরব, ব্রিটিশ আর ওলন্দাজদের দীর্ঘদিনের বাণিজ্যকেন্দ্র কোচিতে তাঁরা রাজাদের সুরক্ষায় নিরাপদে বসবাস করতেন। বিশ শতকের গোড়ায় সারা কোহেনের জন্ম। তখন জু টাউন ছিল প্রাণবন্ত। সারা আর তাঁর স্বামী জ্যাকব—যাঁর জন্মও এখানেই—১৯৪৪ সালে বিয়ে করেন।
আশির দশকের গোড়ায় আচমকাই থাহার সঙ্গে কোহেন দম্পতির পরিচয় হয়। তেরো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেওয়া থাহা তখন পর্যটকদের কাছে পোস্টকার্ড বিক্রি করে জীবিকা চালাতেন। জু টাউনে আসা পর্যটকেরা নিয়মিতই যেতেন পারাদেসি সিনাগগে, যা ১৫৬৮ সালে কোচিনের রাজার দেওয়া জমিতে নির্মিত।
থাহা বলেন, ‘তখন প্রচুর পর্যটক আসত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পোস্টকার্ড বেচতাম।’ এক রোববার, যে গুদামঘরে থাহা পোস্টকার্ড রাখতেন, তার মালিক না আসায় জ্যাকব তাঁকে তাঁদের বাড়িতে জায়গা দেন। সারা এতে খুশি ছিলেন না। থাহার মনে আছে, প্রায় তিন বছর তিনি তাঁর সঙ্গে তেমন কথা বলেননি।
ইব্রাহিম থাহা বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমি তাঁর স্বামীর ছোটখাটো কাজ করে দিতাম। অথবা যখন তাঁদের জানালার বাইরে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখতাম, তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলতেন।’ একদিন সারা তাঁকে সিনাগগের জন্য একটি কুশন কভার সেলাই করতে সাহায্য করতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, থাহার মধ্যে সেলাই ও নকশার সহজাত দক্ষতা আছে। সম্ভবত দরজি বাবাকে ছোটবেলা থেকে সাহায্য করার ফলেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে নকশা আঁকতে আর সেলাই করতে পারি, তা জানতামই না।’
উনিশ বছর বয়সে থাহা সারাকে সাহায্য করেন তাঁদের বৈঠকখানা থেকে ‘সারার হস্ত-সেলাই’ নামে একটি দোকান খুলতে। দোকানটি আজও সেই নামেই পরিচিত। সেখানে বিক্রি হতো কিপ্পাহ, চাল্লাহ কভার আর মেনোরাহ। তিনি বলেন, ‘তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন।’
এই বন্ধুত্ব নিয়ে থাহা বেশ দার্শনিক। তিনি বলেন, ‘জু টাউনে ইহুদি আর মুসলমানেরা একে অপরের সঙ্গে তেমন মিশতেন না। তাঁরা একে অপরের প্রতি সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সারা আন্টি আর জ্যাকব আংকেল কখনোই আমাকে বহিরাগত মনে করতে দেননি, যদিও আমাদের পটভূমি আলাদা ছিল।’

থাহার বাবা-মা এই সম্পর্কে আপত্তি করেননি। তাঁরা দেখেছিলেন, কোহেন পরিবার তাঁদের ছেলেকে জীবনের একটি উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার সময়েই কোচির ইহুদি জনসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। চল্লিশের দশকে যেখানে ছিল প্রায় ২৫০ জন, নব্বইয়ের দশকে তা নেমে আসে ২০ জনে। এখন মাত্র একজন আছেন—৬৭ বছর বয়সী কিথ হ্যালেগুয়া।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর অনেক পরিবার সেখানে চলে যায়। কেরালার ইহুদিদের ওপর ডক্টরেট থিসিস করা আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘কোচিন ইহুদিরা হয়তো স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ধারণায় ইসরায়েলে গিয়েছিলেন। তবে উন্নত জীবনের আকর্ষণের মতো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। তাঁরা এটাও অনুভব করেছিলেন যে কেরালায় উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর অভাব ছিল।’
ধর্মীয় নিপীড়ন কখনোই তাঁদের কোচি ছাড়ার কারণ ছিল না। শহরটি শত শত বছর ধরে তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে। কিছু বয়স্ক ইহুদি থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে নিঃসন্তান কোহেন দম্পতিও ছিলেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাকব মারা যাওয়ার আগে থাহাকে সারার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে যান। তখন থাহা বিবাহিত, তিন সন্তানের জনক।
থাহা বলেন, ‘আমি জ্যাকব আংকেলকে বলেছিলাম, সারা আন্টি যদি আমাকে সুযোগ দেন, তবে আমি তাঁর দেখাশোনা করব। আমি তাঁকে সুযোগ দিতে বলেছিলাম, কারণ ইসলামে মৃতপ্রায় ব্যক্তির শেষ ইচ্ছা পূরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। না করলে পাপ হয়।’
সারার স্বাস্থ্যের অবনতি হলে থাহা তাঁর পরিবারকে জু টাউনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন। সারা মারা গেলে তিনি তাঁর কফিনের জন্য স্টার অব ডেভিড (ইসরায়েলি পতাকায় অঙ্কিত তারকা) আঁকা একটি কফিন কভার তৈরি করান। আজও তিনি নিয়মিত ইহুদি কবরস্থানে তাঁর সমাধিতে যান। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক কোচি ঘুরতে আসেন। তাঁদের মধ্যে অনেক ইহুদিও থাকেন। আনা জাখারিয়াস বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা জু টাউনে আসেন এক ধরনের আপন অনুভব করার জন্য।’
তিনি বলেন, এখানকার ইহুদিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজের মধ্যেও নিজেদের পরিচয় বজায় রেখেছিলেন। একই সঙ্গে সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ভাষা মালয়ালমই ছিল তাঁদের দৈনন্দিন ভাষা। থাহা যেভাবে সারা কোহেনের ঐতিহ্য আগলে রেখেছেন, তা তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি বলেন, ‘একজন মুসলমান কীভাবে এক ইহুদি নারীর যত্ন নিয়েছেন, তা দৃষ্টান্তস্বরূপ। তিনি এখনো সারা-র ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো বজায় রেখেছেন।’
থাহা দোকানটিকে ঠিক সেভাবেই রেখেছেন, যেমনটি সারা চালাতেন। ইহুদিদের সাব্বাথ উপলক্ষে তিনি শনিবার দোকান বন্ধ রাখেন। ইব্রাহিম থাহা আরও বলেন, ‘আমি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মুসলমান, কিন্তু সারা আন্টির জন্য এটা খুব জরুরি ছিল বলে আমি শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালাই। কারণ, এই ক্ষণ সাব্বাথের শুরু হওয়াকে চিহ্নিত করে। এই বিষয়টি আমার কাছে এটা ধর্ম সংক্রান্ত নয়, পুরোটাই মানবিক।’
বিবিসি থেকে অনূদিত

কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্র
০৩ জুলাই ২০২২
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। ঢাকার গাবতলীর পাশের তুরাগ নদের উত্তর পারেই সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের ইসাকাবাদ গ্রাম অবস্থিত। গ্রামটি থেকে স্পষ্ট দেখা যেত গাবতলী সেতু। সেই গ্রামেরই বয়স্ক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রতিদিন রাতের বেলা মিলিটারি আর বিহারিরা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে এই সেতুতে মানুষদের নিয়ে আসত। রাত গভীর হলে সেতুর দুই পাশের বাতি নিভিয়ে গুলি চালানো হতো। পুরো যুদ্ধের সময় এখানে এমন রাত ছিল না, যে রাতের বেলা সেখানে লাশ ফেলানো হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ দশকের বেশি সময় পার হলেও এখনো এ জায়গাকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্র
০৩ জুলাই ২০২২
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
অনেক লেখকই আছেন যাঁরা খুব ধর্মপ্রাণ, কেউবা আবার কমিউনিস্ট ৷ হিউম্যানিস্ট লেখক যেমন আছেন, তেমনই আছেন অথোরিটারিয়ান লেখক।
তবে সে যা-ই হোক, ভালো সাহিত্যিকের মধ্যে দুটো কমিটমেন্ট থাকতেই হবে—সততা আর স্টাইলের দক্ষতা। নিজের কাছেই যে-লেখক অসৎ, যা লেখেন তা যদি তিনি নিজেই না বিশ্বাস করেন, তাহলে সেই লেখকের পতন অনিবার্য।
কোনো লেখক আবার যদি নিজের ভাষার ঐশ্বর্যকে ছেঁকে তুলতে ব্যর্থ হন, একজন সংগীতশিল্পীকে ঠিক যেভাবে তাঁর যন্ত্রটিকে নিজের বশে আনতে হয়, ভাষার ক্ষেত্রেও তেমনটা যদি কোনো লেখক করতে না পারেন, তাহলে একজন সাংবাদিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারবেন না তিনি। সত্য এবং স্টাইল—একজন সাহিত্যিকের বেসিক কমিটমেন্ট হলো শুধু এই দুটো।
সূত্র: সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ টুডে’ পত্রিকার মার্চ, ১৯৮৪ সংখ্যায়, সাক্ষাৎকার গ্রহীতা সেরাজুল ইসলাম কাদির, অনুবাদক নীলাজ্জ দাস, শিবনারায়ণ রায়ের সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা-২৭।

কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্র
০৩ জুলাই ২০২২
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৯ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

কাশ্মীরে মৌসুমের সেই জৌলুশ আর নেই। খড়কুটোর মতো করে মানুষকে যেখানে বিতস্তা তথা ঝিলমের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে কোনো কিছুই আর ঠিকমতো চলতে পারে না। ঠিকমতো বৃষ্টি নামে না। তুষারঝড় ও শিলাবৃষ্টির পিঠে ভর করে ধেয়ে আসে দানবেরা। নাজকির দিনকাল ভালো যায় না। হতাশা জেঁকে বসে তাঁর ভেতর। গুলরিজ শহরের পুরোনো প্র
০৩ জুলাই ২০২২
আরব সাগরের রানি নামে পরিচিত কোচি একসময় ছিল বন্দর আর মসলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কয়েক শতাব্দী আগে এখানেই গড়ে উঠেছিল ইহুদিদের একটি নিবিড় জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন সারা কোহেন। ২০০০ সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছেন থাহা। সারা জীবিত থাকাকালে তাঁর পক্ষ থেকে, আর ২০১৯ সালে সারা ৯৬
১ দিন আগে
মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র মিরপুর পরিণত হয়েছিল এক বধ্যভূমিতে। আর বৃহত্তর মিরপুরে অবস্থিত গাবতলী এলাকা। তুরাগ নদের ওপরই গাবতলী সেতু অবস্থিত। সেই গাবতলীতে কয়েক বছর আগেও নদের ওপর ছিল পুরোনো একটি লোহার সেতু। সেই পুরোনো সেতুতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা চালিয়েছিল...
২ দিন আগে
সৃজনশীল সাহিত্য কিন্তু দেয়াললিখন বা স্লোগান দেওয়া নয়। জীবন এতই জটিল যে তাকে কোনো ফর্মুলায় বেঁধে ফেলা যায় না। মানুষের মূল্যবোধ নানা রকমের। আর সেগুলো দিয়ে যে সিস্টেমগুলো পাওয়া যেতে পারে, তা-ও নানা রকমের। একেক লেখকের কমিটমেন্ট একেক রকম মূল্যবোধের কাছে।
৩ দিন আগে