ইজাজুল হক

গজলের ধারাকে নতুন গাম্ভীর্য দেওয়ার যে যাত্রা ফারুক নাজকি শুরু করেন, সেটির পরবর্তী গন্তব্য তাঁর সতেজ-তরতাজা আধুনিক উর্দু কবিতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়। আধুনিক কবিতা এ যুগে অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। কবিতার বৈশ্বিক অলংকারই একালের উর্দু কবিতার প্রধান নিয়ামক। ফারুক নাজকির কাব্যগ্রন্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁর প্রথম দিকের কবিতার তুলনায় শেষের দিকের কবিতাগুলো অনেক বেশি পরিপক্ব, বলিষ্ঠ ও কালোত্তীর্ণ। কবিতার সুর, ধাঁচ ও ভাবের বৈচিত্র্যও এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
নাজকির সর্বশেষ উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর কবিতাগুলো তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে লিখেছেন। সময়টি কাশ্মীরের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বেদনার ছিল। তিনি কাশ্মীরে বসেই সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। চারদিকে দ্রোহের আগুন। ঝিলমে বইছিল রক্তের স্রোত। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ ও করুণ অস্ত্রবাজির মুখে কাশ্মীর জাহান্নামে পরিণত তখন। খুব কাছ থেকে দেখা এসব দৃশ্য নাজকির কবিতাকে প্রভাবিত করে সত্য; তবে কালের ভাষায় নিজের কবিতাকে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে বাস্তববাদী করে তোলে। ফলে কবিতার শরীরে পরিস্থিতির দাগ থাকলেও পুরো কাঠামো বিনির্মাণে তিনি আধুনিক নির্মোহ কাব্যধারা ভালোই রপ্ত করেন।
কাশ্মীরের উত্তাল পরিস্থিতিকে কবিতার ইট-সুরকিতে মিশিয়ে, আধুনিক নিরাসক্ত কবিতার ছাঁচে রেখে, সময়ের সীমারেখা পেরিয়ে, অসীমের আকাশে নাজকি নির্মাণ করেন কবিতার প্রাসাদ। ফলে ফারুকের হাত ধরে কাশ্মীরের বিরাজমান বাস্তবতা কালজয়ী কাব্যভাষায় চিরায়ত সাহিত্যের পাতায় স্থান করে নেয়। ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার তাপ-উত্তাপ থেকে বের হয়ে তা সর্বজনীন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে নাজকির ‘সোনালি দরজার বাইরে’ কবিতাটি দেখা যাক—
‘কম্পিত দেহ
ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থাকা রং
আধমরা আলোর কাফন জড়িয়ে
মৃত্যু জনপদের আগুনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
নিজের অনুভবের আঁচ সয়ে যায়।
সন্ধ্যা
আধো আঁধার সড়কে মাথা ঘষতে থাকে
থরথর কাঁপা রাত দুঃখের ছাঁচে-ঢালাই হওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
আলোহীন ঝাড়বাতির পাশে দাঁড়িয়ে রয়।
চাঁদ
আকাশের গভীর নীল সমুদ্রে তারাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
মৃত্যুর জনপদে আগুনের ফুল-লুকানো-খেলা খেলছিল
কবর থেকে কবরে ছায়া নেই, দেহ নেই
পা থেকে পায়ের দূরত্বে ঘরে ফেরার চিহ্নরাও গুম
ঘরের দহলিজ মানবশূন্য
মনিবের পথ চেয়ে-চেয়ে দরজা-কপাট
দীর্ঘ সময়জুড়ে অপেক্ষায় ছিল তবে
কোনো টোকা নেই কিংবা পায়ের আওয়াজ।
এদিকে
নির্বাক শহরের আঁধারে
কম্পিত দেহ
‘কীভাবে ও কত’-এর বদলাতে থাকা প্রান্তে প্রান্তে
বিভ্রান্ত উত্তাল বিক্ষিপ্ত কুঞ্চিত হতে থাকে
এবং ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থেকে
ডালে-ডালে আলোর পথ মাড়িয়ে
ক্রুশের ছায়ায় নিশ্বাস নিচ্ছে।
কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছে, অপমানের ধারাবাহিকতা আছে এবং ক্রুশের সেই ছায়া আছে, যা ঘটে যাওয়া বিষয়ের নিদর্শন হয়ে কাঁপতে কাঁপতে জীবনের অস্তিত্ব-প্রয়াণের পয়গাম দিচ্ছে। তবে কবিতার ধাঁচ, ভাব ও কাঠামো সময়কে অতিক্রম করে অসীমে মিলিয়ে গেছে। জগতের যেকোনো প্রান্তের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে অতি সহজিয়া ঢঙে তা মিশে যেতে সক্ষম।
দুই.
নাজকির ‘আমাদের কথা’ কবিতায় পূর্ণ এক যুদ্ধগাথা রচনা করেন। গদ্য ধাঁচের কবিতা হলেও গদ্যের ভাষা তাতে নেই; বরং তা একটি ডাইনামিক কাব্য ধাঁচের প্রতিনিধিত্ব করে। কবিতাটি আপনাকে একালের কাশ্মীরের সঙ্গে, সেখানকার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত করাবে। পড়তে-পড়তে আপনার মনে হবে, আধুনিক কবিতায় সৌন্দর্যনীতি থেকে সরে গেছেন নাজকি; বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণধর্মী গদ্য ধাঁচের রাজনীতি থেকে আঁচল গুটিয়েছেন। কোনো স্বতন্ত্র চরিত্র নির্মাণ না করে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের কথা’ বলে ব্যক্তিগত কবিতাকাঠামো নির্মাণ করেছেন। উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই কেবল এসব কল্পনা করা যায়। কবিতায় কাশ্মীরকে নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকার প্রয়াস লক্ষণীয়। এ যেন কাশ্মীরের অতীত-বর্তমানের ইতিহাস ও ভূবৈচিত্র্যের নিখুঁত রেখাচিত্র। উপত্যকার সাংস্কৃতিক অবদান প্রকাশ্যে আনার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। উত্তর ভারত কাশ্মীরকে কখনো বুঝতে চায়নি। এখানকার স্বতন্ত্র ভূবৈচিত্র্যের প্রতি মোটেও নজর দেয়নি—এমন অভিযোগও তোলেন কবি। দীর্ঘ কবিতাটির এ অংশটি পড়ুন—
‘জুবাইর রেজভির আলি বিন মুত্তাকির কথা মানুষ শোনে
তবে সবজ্ আলি সুকুতির সুর শোনে না
অথচ সেই কুণ্ডলিত সুর আজও পিরপানসালের পর্বতশৃঙ্গে ধাক্কা খেয়ে
শিলাবহরের শিরায়-শিরায় দৌড়ায়;
এর পর বরফ গলা শুরু করলে প্রপাতে-প্রপাতে তার গুঞ্জরণ শোনা যায়
সবজ আলি সুকুতির সুরও দারুণ বৈচিত্র্যময়।’
আধুনিক উর্দু কবি জুবাইর রেজভির কবিতার কাশ্মীরি চরিত্র আলি বিন মুত্তাকির মোটেও এই উপত্যকার প্রতিনিধিত্ব করে না বলে অভিযোগ করেন কবি। অথচ পুরো ভারত তাঁকে নিয়েই মেতে থাকে। অথচ কাশ্মীরের কিংবদন্তি গায়ক সবজ আলি সুকুতির সুরবৈচিত্র্যই উপত্যকার ভূবৈচিত্র্যের সেরা উপমা হতে পারে। কাশ্মীরের সকল সৌন্দর্যের সুর যেন তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে গভীর নীল আকাশে মেঘ হয়ে ভাসতে থাকে। এক সময় তা কাশ্মীরের পিরপানচালের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণিকে একত্ববাদের গান শোনাতে যায়। সেখানে মিলিত হয় উপত্যকার সকল আধ্যাত্মিকতার ধারা। তবে উপত্যকার এমন স্বতন্ত্র রূপ কখনোই উত্তর ভারতের সানগ্লাস পরা চোখে ধরা পড়ে না। ফলে এই উপত্যকাকে উত্তর ভারত কিংবা কাশ্মীরের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা দেখা যায়।
কবিতার শেষাংশে এসে পাঠককে অবাক করে দিয়ে কবি বলেন—
‘বসন্ত এসে গেছে
তবে গাছে না ধরেছে আপেল, না নাশপাতি
বরং তাতে ধরেছে মানুষের খুলি
আমরা খুব খুশি হলাম
এবং নিমন্ত্রণ করলাম শাহজাদাদের;
এবং অভিবাদন জানালাম তাদের ককটেল ফাটিয়ে।’
এই জায়গায় টিএস এলিয়টের সঙ্গে এক আশ্চর্য মিল রয়েছে নাজকির। এলিয়ট এক কবিতায় বলেন—
‘গত বছর নিজেদের বাগানে তোমরা
যে লাশগুলো বপন করেছিলে—
এত দিনে তা হয়তো ফল-ফুলে পরিণত হয়েছে
এবং থোকায় থোকায় বেরিয়ে পড়েছে।’
এলিয়ট নিজের যুগের অস্থিরতা এবং মানুষের অনুভূতিহীনতা প্রকাশের জন্য জমিতে রোপণ করা লাশের রূপক ব্যবহার করেন। নাজকিও একই অবস্থার বয়ান দিতে গাছে-গাছে মানুষের খুলি ফলার উপমা খুঁজে নেন। ‘আমাদের কথা’য় কাশ্মীরি মানুষের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের গাদ্দারির বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রূপ প্রতিভাত হয়।

তিন.
নাজকির আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘খুশবুর খোলসে অ্যাসিড’। কবিতাটির শরীর দুঃখের ক্ষত বয়ে বেড়ায়; আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেও ব্যর্থ হন কবি। চির নিষ্পাপকালের কোলে শুরু করা কবির জীবনটি আধুনিককালে এসে বিধ্বংসী অ্যাসিডে পরিণত হয়, যা তাঁর নিষ্পাপ চেহারায় দাগের জন্ম দেয় এবং সম্মানের রূপ শোভাকে কলঙ্কিত করে। সময়ের দুটি প্রান্তে ভ্রমণ করে এই কবিতা। একদিকে নির্মল গ্রাম, সৃজনানন্দ ও মুক্ত ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে হাজির হন কবির সহজ-সরল মা, যিনি আপেলের মতো লাল এবং গোলাপের মতো কোমল। অন্যদিকে সময়ের শেষ প্রান্তকে তিনি ‘আমি’-এর ভেতর দিয়ে ধরার চেষ্টা করেন। মাঝখানের সময়টিকে তিনি তাঁর বাবার রূপে দেখতে পান। তবে একটি উপসংহারে পৌঁছেও যেন শেষ পর্যন্ত তিনি জীবনের অর্থ স্পর্শ করতে ব্যর্থ হন। ফলে শেষ লাইনে এসে নিজেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন—‘আমি কে?’ কবিতাটি পড়া যাক—
‘নিবু পাহাড়ের আঁচলতলে
একটি গ্রাম—
মাদরাবন
জন্মেছিলাম আমি
(আমার নাম মুহাম্মদ ফারুক)
আমার মা ছিলেন আপেলের মতো লাল ও মিষ্টি
গোলাপের মতো কোমল ও সুরভিত
ছিলেন সুঘ্রাণের আকর;
জড়ানো লেপটানো ছলচাতুরী কপটতা মিথ্যা—
এসব শব্দ তিনি শুনেছিলেন সত্য
তবে কখনো পরখ করেননি
মুখে-মুখে আওড়াননি একবারও।
রেডিওতে প্রচারিত হয় নিজার কাব্বানির ভৌতিক কবিতা
অথবা কোনো গায়ক শোনায় কালিদাসের ঋতু সমাচার—
ডুকরে-ডুকরে কাঁদেন তিনি;
আমি কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করি
তিনি বলেন—
দেবতাদের এসব ভাষা
বড়ই জাদুকরী
সত্যের দিশা
এবং সরল পথের পাথেয় রয়েছে এতে;
আমি তাঁর সরলতায় কয়েকবার কেঁদে দিই।
বাবা আমার ডিনামাইট চিবোতেন
আঙুলের মাঝে ফলাতেন অ্যাসিডের বন
এবং মরা পাতলা হলদে কাগজের কপোলে
সাজাতেন রক্তের ফুল
নিজ থেকে পৃথক হয়ে নিজের সঙ্গে মিশে গিয়ে
মায়ায় পড়তে থাকেন নিজেরই সম্পদের;
গোটা আটটি জাহাজের মালিক তিনি—
ভাসিয়েছেন সময়ের সমুদ্রজলে
এবং কন্ট্রোল রুমে বসে নিজেই
নির্ধারণ করতে থাকেন তাদের চলার পথ।
আমিও একটি জাহাজ
পাথর চিবোনো, চোখের পাতার ঝোপে বরই গাছ লাগানো
খুব ভোরে মসজিদের দরোজা দিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে
চোখ লুকিয়ে চলে যাওয়া
এবং আল্লাহপ্রেমিকের ভক্ত হয়ে
আল্লাহরই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া
যার স্বভাবে পরিণত হয়েছে;
লাল মাটির আপেল ও অ্যাসিডের সেই
মিলনের ফসল আমি—
আমি কে?’
কবিতাটি উত্তরাধুনিক কাব্যচিন্তার যথার্থ উদাহরণ। রোনাল্ড বার্থার এই ধরনের সৃজন-অভিজ্ঞতার জন্য শুধু একটি পরিভাষাই প্রণয়ন করেন—‘সিজোফ্রেনিক মুড অব স্পেস অ্যান্ড টাইম’। নাজকির এই কবিতার জন্য যা যথাযথ এবং রূপকগুলোকে স্পষ্ট করে দেওয়ার মতো। স্থান-কালের এই পাগলামি-ধাঁচ নাজকির অন্যান্য কবিতায়ও দেখা যায়। তবে যেসব কবিতায় পরিস্থিতির প্রভাব বেশি থাকে, সেখানে পাগলামির চেয়ে কবিতার মূলভাব স্পষ্ট করার প্রতি বেশি মনোযোগী দেখতে পাই তাঁকে। যেমন—‘শিরোনামগুলো’, ‘একটি শোকগাথা, ‘এ কেমন আবহাওয়া’, ‘রক্তনদী উন্মাতাল’ ‘পরামর্শ’, ‘বনের নামে পদ্য’ এবং ‘১৯৯০-এর এক সকাল’ ইত্যাদি কবিতাগুলো প্রণিধানযোগ্য। এর মধ্যে ‘শিরোনামগুলো’ কবিতাটিতে বর্ণিত ঘটনাপরম্পরা ও বাস্তবতার শ্লেষাত্মক উপস্থাপন পাঠকের অনুভবের জগৎ নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে এই পঙ্ক্তিগুলো—
‘মাসুমুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ—
মুজাহিদ নেতা বাবা-মাকে উপহার দিয়েছেন
পবিত্র কোরআনের একটি কপি
মাসুমুল ইসলামের নিরক্ষর মা মখমলের গেলাফে
মুড়িয়ে সেটি তাকের ওপর রেখে দিয়েছেন;
জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া বাতাস বলল—
‘পড়ো’।’
নাজকির কবিতামানস কিংবদন্তি উর্দু কবি মীরাজির সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ। তাঁর কিছু কবিতায় মীরাজির কঠোরতা, ব্যথার তীব্রতা, অনিন্দ্য ভূ-বর্ণনার মতো উত্তুঙ্গ রূপ দেখা যায়। যেমন ‘মান্টোর সুলতানা বললেন’ কবিতার এ অংশটি দেখুন—
‘দুনিয়া কী করে জানবে—হৃদয়ের গহিনে কত নদী বহমান
আমাদের দেহ তো মহাসড়ক—মানুষের চলাচল থামেই না
চুপচাপ থাকে, নীরবে দুঃখ সয়ে যায় এবং সতত বলে বেড়ায়—
হৃদয়ের রহস্য জানা সেই যোগী কবে আসবে?’
নাজকির কবিতার বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। কবিতার মাধ্যমে জীবনের নতুন সংস্করণের কাজ করেন তিনি। এই কবিতাগুলো আধুনিকতম উর্দু কবিতার নতুন তাঁবু। যেখানে জীবনের উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে আধুনিক দর্শনের হিরে-মুক্তো-জহরত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। নাজকির কবিতা পৃথিবীকে আলোকিত করা এক আলোর ফোয়ারা।
আরও পড়ুন:

গজলের ধারাকে নতুন গাম্ভীর্য দেওয়ার যে যাত্রা ফারুক নাজকি শুরু করেন, সেটির পরবর্তী গন্তব্য তাঁর সতেজ-তরতাজা আধুনিক উর্দু কবিতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়। আধুনিক কবিতা এ যুগে অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। কবিতার বৈশ্বিক অলংকারই একালের উর্দু কবিতার প্রধান নিয়ামক। ফারুক নাজকির কাব্যগ্রন্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁর প্রথম দিকের কবিতার তুলনায় শেষের দিকের কবিতাগুলো অনেক বেশি পরিপক্ব, বলিষ্ঠ ও কালোত্তীর্ণ। কবিতার সুর, ধাঁচ ও ভাবের বৈচিত্র্যও এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
নাজকির সর্বশেষ উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর কবিতাগুলো তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে লিখেছেন। সময়টি কাশ্মীরের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বেদনার ছিল। তিনি কাশ্মীরে বসেই সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। চারদিকে দ্রোহের আগুন। ঝিলমে বইছিল রক্তের স্রোত। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ ও করুণ অস্ত্রবাজির মুখে কাশ্মীর জাহান্নামে পরিণত তখন। খুব কাছ থেকে দেখা এসব দৃশ্য নাজকির কবিতাকে প্রভাবিত করে সত্য; তবে কালের ভাষায় নিজের কবিতাকে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে বাস্তববাদী করে তোলে। ফলে কবিতার শরীরে পরিস্থিতির দাগ থাকলেও পুরো কাঠামো বিনির্মাণে তিনি আধুনিক নির্মোহ কাব্যধারা ভালোই রপ্ত করেন।
কাশ্মীরের উত্তাল পরিস্থিতিকে কবিতার ইট-সুরকিতে মিশিয়ে, আধুনিক নিরাসক্ত কবিতার ছাঁচে রেখে, সময়ের সীমারেখা পেরিয়ে, অসীমের আকাশে নাজকি নির্মাণ করেন কবিতার প্রাসাদ। ফলে ফারুকের হাত ধরে কাশ্মীরের বিরাজমান বাস্তবতা কালজয়ী কাব্যভাষায় চিরায়ত সাহিত্যের পাতায় স্থান করে নেয়। ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার তাপ-উত্তাপ থেকে বের হয়ে তা সর্বজনীন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে নাজকির ‘সোনালি দরজার বাইরে’ কবিতাটি দেখা যাক—
‘কম্পিত দেহ
ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থাকা রং
আধমরা আলোর কাফন জড়িয়ে
মৃত্যু জনপদের আগুনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
নিজের অনুভবের আঁচ সয়ে যায়।
সন্ধ্যা
আধো আঁধার সড়কে মাথা ঘষতে থাকে
থরথর কাঁপা রাত দুঃখের ছাঁচে-ঢালাই হওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
আলোহীন ঝাড়বাতির পাশে দাঁড়িয়ে রয়।
চাঁদ
আকাশের গভীর নীল সমুদ্রে তারাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
মৃত্যুর জনপদে আগুনের ফুল-লুকানো-খেলা খেলছিল
কবর থেকে কবরে ছায়া নেই, দেহ নেই
পা থেকে পায়ের দূরত্বে ঘরে ফেরার চিহ্নরাও গুম
ঘরের দহলিজ মানবশূন্য
মনিবের পথ চেয়ে-চেয়ে দরজা-কপাট
দীর্ঘ সময়জুড়ে অপেক্ষায় ছিল তবে
কোনো টোকা নেই কিংবা পায়ের আওয়াজ।
এদিকে
নির্বাক শহরের আঁধারে
কম্পিত দেহ
‘কীভাবে ও কত’-এর বদলাতে থাকা প্রান্তে প্রান্তে
বিভ্রান্ত উত্তাল বিক্ষিপ্ত কুঞ্চিত হতে থাকে
এবং ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থেকে
ডালে-ডালে আলোর পথ মাড়িয়ে
ক্রুশের ছায়ায় নিশ্বাস নিচ্ছে।
কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছে, অপমানের ধারাবাহিকতা আছে এবং ক্রুশের সেই ছায়া আছে, যা ঘটে যাওয়া বিষয়ের নিদর্শন হয়ে কাঁপতে কাঁপতে জীবনের অস্তিত্ব-প্রয়াণের পয়গাম দিচ্ছে। তবে কবিতার ধাঁচ, ভাব ও কাঠামো সময়কে অতিক্রম করে অসীমে মিলিয়ে গেছে। জগতের যেকোনো প্রান্তের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে অতি সহজিয়া ঢঙে তা মিশে যেতে সক্ষম।
দুই.
নাজকির ‘আমাদের কথা’ কবিতায় পূর্ণ এক যুদ্ধগাথা রচনা করেন। গদ্য ধাঁচের কবিতা হলেও গদ্যের ভাষা তাতে নেই; বরং তা একটি ডাইনামিক কাব্য ধাঁচের প্রতিনিধিত্ব করে। কবিতাটি আপনাকে একালের কাশ্মীরের সঙ্গে, সেখানকার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত করাবে। পড়তে-পড়তে আপনার মনে হবে, আধুনিক কবিতায় সৌন্দর্যনীতি থেকে সরে গেছেন নাজকি; বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণধর্মী গদ্য ধাঁচের রাজনীতি থেকে আঁচল গুটিয়েছেন। কোনো স্বতন্ত্র চরিত্র নির্মাণ না করে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের কথা’ বলে ব্যক্তিগত কবিতাকাঠামো নির্মাণ করেছেন। উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই কেবল এসব কল্পনা করা যায়। কবিতায় কাশ্মীরকে নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকার প্রয়াস লক্ষণীয়। এ যেন কাশ্মীরের অতীত-বর্তমানের ইতিহাস ও ভূবৈচিত্র্যের নিখুঁত রেখাচিত্র। উপত্যকার সাংস্কৃতিক অবদান প্রকাশ্যে আনার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। উত্তর ভারত কাশ্মীরকে কখনো বুঝতে চায়নি। এখানকার স্বতন্ত্র ভূবৈচিত্র্যের প্রতি মোটেও নজর দেয়নি—এমন অভিযোগও তোলেন কবি। দীর্ঘ কবিতাটির এ অংশটি পড়ুন—
‘জুবাইর রেজভির আলি বিন মুত্তাকির কথা মানুষ শোনে
তবে সবজ্ আলি সুকুতির সুর শোনে না
অথচ সেই কুণ্ডলিত সুর আজও পিরপানসালের পর্বতশৃঙ্গে ধাক্কা খেয়ে
শিলাবহরের শিরায়-শিরায় দৌড়ায়;
এর পর বরফ গলা শুরু করলে প্রপাতে-প্রপাতে তার গুঞ্জরণ শোনা যায়
সবজ আলি সুকুতির সুরও দারুণ বৈচিত্র্যময়।’
আধুনিক উর্দু কবি জুবাইর রেজভির কবিতার কাশ্মীরি চরিত্র আলি বিন মুত্তাকির মোটেও এই উপত্যকার প্রতিনিধিত্ব করে না বলে অভিযোগ করেন কবি। অথচ পুরো ভারত তাঁকে নিয়েই মেতে থাকে। অথচ কাশ্মীরের কিংবদন্তি গায়ক সবজ আলি সুকুতির সুরবৈচিত্র্যই উপত্যকার ভূবৈচিত্র্যের সেরা উপমা হতে পারে। কাশ্মীরের সকল সৌন্দর্যের সুর যেন তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে গভীর নীল আকাশে মেঘ হয়ে ভাসতে থাকে। এক সময় তা কাশ্মীরের পিরপানচালের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণিকে একত্ববাদের গান শোনাতে যায়। সেখানে মিলিত হয় উপত্যকার সকল আধ্যাত্মিকতার ধারা। তবে উপত্যকার এমন স্বতন্ত্র রূপ কখনোই উত্তর ভারতের সানগ্লাস পরা চোখে ধরা পড়ে না। ফলে এই উপত্যকাকে উত্তর ভারত কিংবা কাশ্মীরের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা দেখা যায়।
কবিতার শেষাংশে এসে পাঠককে অবাক করে দিয়ে কবি বলেন—
‘বসন্ত এসে গেছে
তবে গাছে না ধরেছে আপেল, না নাশপাতি
বরং তাতে ধরেছে মানুষের খুলি
আমরা খুব খুশি হলাম
এবং নিমন্ত্রণ করলাম শাহজাদাদের;
এবং অভিবাদন জানালাম তাদের ককটেল ফাটিয়ে।’
এই জায়গায় টিএস এলিয়টের সঙ্গে এক আশ্চর্য মিল রয়েছে নাজকির। এলিয়ট এক কবিতায় বলেন—
‘গত বছর নিজেদের বাগানে তোমরা
যে লাশগুলো বপন করেছিলে—
এত দিনে তা হয়তো ফল-ফুলে পরিণত হয়েছে
এবং থোকায় থোকায় বেরিয়ে পড়েছে।’
এলিয়ট নিজের যুগের অস্থিরতা এবং মানুষের অনুভূতিহীনতা প্রকাশের জন্য জমিতে রোপণ করা লাশের রূপক ব্যবহার করেন। নাজকিও একই অবস্থার বয়ান দিতে গাছে-গাছে মানুষের খুলি ফলার উপমা খুঁজে নেন। ‘আমাদের কথা’য় কাশ্মীরি মানুষের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের গাদ্দারির বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রূপ প্রতিভাত হয়।

তিন.
নাজকির আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘খুশবুর খোলসে অ্যাসিড’। কবিতাটির শরীর দুঃখের ক্ষত বয়ে বেড়ায়; আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেও ব্যর্থ হন কবি। চির নিষ্পাপকালের কোলে শুরু করা কবির জীবনটি আধুনিককালে এসে বিধ্বংসী অ্যাসিডে পরিণত হয়, যা তাঁর নিষ্পাপ চেহারায় দাগের জন্ম দেয় এবং সম্মানের রূপ শোভাকে কলঙ্কিত করে। সময়ের দুটি প্রান্তে ভ্রমণ করে এই কবিতা। একদিকে নির্মল গ্রাম, সৃজনানন্দ ও মুক্ত ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে হাজির হন কবির সহজ-সরল মা, যিনি আপেলের মতো লাল এবং গোলাপের মতো কোমল। অন্যদিকে সময়ের শেষ প্রান্তকে তিনি ‘আমি’-এর ভেতর দিয়ে ধরার চেষ্টা করেন। মাঝখানের সময়টিকে তিনি তাঁর বাবার রূপে দেখতে পান। তবে একটি উপসংহারে পৌঁছেও যেন শেষ পর্যন্ত তিনি জীবনের অর্থ স্পর্শ করতে ব্যর্থ হন। ফলে শেষ লাইনে এসে নিজেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন—‘আমি কে?’ কবিতাটি পড়া যাক—
‘নিবু পাহাড়ের আঁচলতলে
একটি গ্রাম—
মাদরাবন
জন্মেছিলাম আমি
(আমার নাম মুহাম্মদ ফারুক)
আমার মা ছিলেন আপেলের মতো লাল ও মিষ্টি
গোলাপের মতো কোমল ও সুরভিত
ছিলেন সুঘ্রাণের আকর;
জড়ানো লেপটানো ছলচাতুরী কপটতা মিথ্যা—
এসব শব্দ তিনি শুনেছিলেন সত্য
তবে কখনো পরখ করেননি
মুখে-মুখে আওড়াননি একবারও।
রেডিওতে প্রচারিত হয় নিজার কাব্বানির ভৌতিক কবিতা
অথবা কোনো গায়ক শোনায় কালিদাসের ঋতু সমাচার—
ডুকরে-ডুকরে কাঁদেন তিনি;
আমি কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করি
তিনি বলেন—
দেবতাদের এসব ভাষা
বড়ই জাদুকরী
সত্যের দিশা
এবং সরল পথের পাথেয় রয়েছে এতে;
আমি তাঁর সরলতায় কয়েকবার কেঁদে দিই।
বাবা আমার ডিনামাইট চিবোতেন
আঙুলের মাঝে ফলাতেন অ্যাসিডের বন
এবং মরা পাতলা হলদে কাগজের কপোলে
সাজাতেন রক্তের ফুল
নিজ থেকে পৃথক হয়ে নিজের সঙ্গে মিশে গিয়ে
মায়ায় পড়তে থাকেন নিজেরই সম্পদের;
গোটা আটটি জাহাজের মালিক তিনি—
ভাসিয়েছেন সময়ের সমুদ্রজলে
এবং কন্ট্রোল রুমে বসে নিজেই
নির্ধারণ করতে থাকেন তাদের চলার পথ।
আমিও একটি জাহাজ
পাথর চিবোনো, চোখের পাতার ঝোপে বরই গাছ লাগানো
খুব ভোরে মসজিদের দরোজা দিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে
চোখ লুকিয়ে চলে যাওয়া
এবং আল্লাহপ্রেমিকের ভক্ত হয়ে
আল্লাহরই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া
যার স্বভাবে পরিণত হয়েছে;
লাল মাটির আপেল ও অ্যাসিডের সেই
মিলনের ফসল আমি—
আমি কে?’
কবিতাটি উত্তরাধুনিক কাব্যচিন্তার যথার্থ উদাহরণ। রোনাল্ড বার্থার এই ধরনের সৃজন-অভিজ্ঞতার জন্য শুধু একটি পরিভাষাই প্রণয়ন করেন—‘সিজোফ্রেনিক মুড অব স্পেস অ্যান্ড টাইম’। নাজকির এই কবিতার জন্য যা যথাযথ এবং রূপকগুলোকে স্পষ্ট করে দেওয়ার মতো। স্থান-কালের এই পাগলামি-ধাঁচ নাজকির অন্যান্য কবিতায়ও দেখা যায়। তবে যেসব কবিতায় পরিস্থিতির প্রভাব বেশি থাকে, সেখানে পাগলামির চেয়ে কবিতার মূলভাব স্পষ্ট করার প্রতি বেশি মনোযোগী দেখতে পাই তাঁকে। যেমন—‘শিরোনামগুলো’, ‘একটি শোকগাথা, ‘এ কেমন আবহাওয়া’, ‘রক্তনদী উন্মাতাল’ ‘পরামর্শ’, ‘বনের নামে পদ্য’ এবং ‘১৯৯০-এর এক সকাল’ ইত্যাদি কবিতাগুলো প্রণিধানযোগ্য। এর মধ্যে ‘শিরোনামগুলো’ কবিতাটিতে বর্ণিত ঘটনাপরম্পরা ও বাস্তবতার শ্লেষাত্মক উপস্থাপন পাঠকের অনুভবের জগৎ নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে এই পঙ্ক্তিগুলো—
‘মাসুমুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ—
মুজাহিদ নেতা বাবা-মাকে উপহার দিয়েছেন
পবিত্র কোরআনের একটি কপি
মাসুমুল ইসলামের নিরক্ষর মা মখমলের গেলাফে
মুড়িয়ে সেটি তাকের ওপর রেখে দিয়েছেন;
জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া বাতাস বলল—
‘পড়ো’।’
নাজকির কবিতামানস কিংবদন্তি উর্দু কবি মীরাজির সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ। তাঁর কিছু কবিতায় মীরাজির কঠোরতা, ব্যথার তীব্রতা, অনিন্দ্য ভূ-বর্ণনার মতো উত্তুঙ্গ রূপ দেখা যায়। যেমন ‘মান্টোর সুলতানা বললেন’ কবিতার এ অংশটি দেখুন—
‘দুনিয়া কী করে জানবে—হৃদয়ের গহিনে কত নদী বহমান
আমাদের দেহ তো মহাসড়ক—মানুষের চলাচল থামেই না
চুপচাপ থাকে, নীরবে দুঃখ সয়ে যায় এবং সতত বলে বেড়ায়—
হৃদয়ের রহস্য জানা সেই যোগী কবে আসবে?’
নাজকির কবিতার বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। কবিতার মাধ্যমে জীবনের নতুন সংস্করণের কাজ করেন তিনি। এই কবিতাগুলো আধুনিকতম উর্দু কবিতার নতুন তাঁবু। যেখানে জীবনের উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে আধুনিক দর্শনের হিরে-মুক্তো-জহরত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। নাজকির কবিতা পৃথিবীকে আলোকিত করা এক আলোর ফোয়ারা।
আরও পড়ুন:
ইজাজুল হক

গজলের ধারাকে নতুন গাম্ভীর্য দেওয়ার যে যাত্রা ফারুক নাজকি শুরু করেন, সেটির পরবর্তী গন্তব্য তাঁর সতেজ-তরতাজা আধুনিক উর্দু কবিতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়। আধুনিক কবিতা এ যুগে অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। কবিতার বৈশ্বিক অলংকারই একালের উর্দু কবিতার প্রধান নিয়ামক। ফারুক নাজকির কাব্যগ্রন্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁর প্রথম দিকের কবিতার তুলনায় শেষের দিকের কবিতাগুলো অনেক বেশি পরিপক্ব, বলিষ্ঠ ও কালোত্তীর্ণ। কবিতার সুর, ধাঁচ ও ভাবের বৈচিত্র্যও এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
নাজকির সর্বশেষ উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর কবিতাগুলো তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে লিখেছেন। সময়টি কাশ্মীরের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বেদনার ছিল। তিনি কাশ্মীরে বসেই সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। চারদিকে দ্রোহের আগুন। ঝিলমে বইছিল রক্তের স্রোত। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ ও করুণ অস্ত্রবাজির মুখে কাশ্মীর জাহান্নামে পরিণত তখন। খুব কাছ থেকে দেখা এসব দৃশ্য নাজকির কবিতাকে প্রভাবিত করে সত্য; তবে কালের ভাষায় নিজের কবিতাকে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে বাস্তববাদী করে তোলে। ফলে কবিতার শরীরে পরিস্থিতির দাগ থাকলেও পুরো কাঠামো বিনির্মাণে তিনি আধুনিক নির্মোহ কাব্যধারা ভালোই রপ্ত করেন।
কাশ্মীরের উত্তাল পরিস্থিতিকে কবিতার ইট-সুরকিতে মিশিয়ে, আধুনিক নিরাসক্ত কবিতার ছাঁচে রেখে, সময়ের সীমারেখা পেরিয়ে, অসীমের আকাশে নাজকি নির্মাণ করেন কবিতার প্রাসাদ। ফলে ফারুকের হাত ধরে কাশ্মীরের বিরাজমান বাস্তবতা কালজয়ী কাব্যভাষায় চিরায়ত সাহিত্যের পাতায় স্থান করে নেয়। ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার তাপ-উত্তাপ থেকে বের হয়ে তা সর্বজনীন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে নাজকির ‘সোনালি দরজার বাইরে’ কবিতাটি দেখা যাক—
‘কম্পিত দেহ
ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থাকা রং
আধমরা আলোর কাফন জড়িয়ে
মৃত্যু জনপদের আগুনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
নিজের অনুভবের আঁচ সয়ে যায়।
সন্ধ্যা
আধো আঁধার সড়কে মাথা ঘষতে থাকে
থরথর কাঁপা রাত দুঃখের ছাঁচে-ঢালাই হওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
আলোহীন ঝাড়বাতির পাশে দাঁড়িয়ে রয়।
চাঁদ
আকাশের গভীর নীল সমুদ্রে তারাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
মৃত্যুর জনপদে আগুনের ফুল-লুকানো-খেলা খেলছিল
কবর থেকে কবরে ছায়া নেই, দেহ নেই
পা থেকে পায়ের দূরত্বে ঘরে ফেরার চিহ্নরাও গুম
ঘরের দহলিজ মানবশূন্য
মনিবের পথ চেয়ে-চেয়ে দরজা-কপাট
দীর্ঘ সময়জুড়ে অপেক্ষায় ছিল তবে
কোনো টোকা নেই কিংবা পায়ের আওয়াজ।
এদিকে
নির্বাক শহরের আঁধারে
কম্পিত দেহ
‘কীভাবে ও কত’-এর বদলাতে থাকা প্রান্তে প্রান্তে
বিভ্রান্ত উত্তাল বিক্ষিপ্ত কুঞ্চিত হতে থাকে
এবং ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থেকে
ডালে-ডালে আলোর পথ মাড়িয়ে
ক্রুশের ছায়ায় নিশ্বাস নিচ্ছে।
কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছে, অপমানের ধারাবাহিকতা আছে এবং ক্রুশের সেই ছায়া আছে, যা ঘটে যাওয়া বিষয়ের নিদর্শন হয়ে কাঁপতে কাঁপতে জীবনের অস্তিত্ব-প্রয়াণের পয়গাম দিচ্ছে। তবে কবিতার ধাঁচ, ভাব ও কাঠামো সময়কে অতিক্রম করে অসীমে মিলিয়ে গেছে। জগতের যেকোনো প্রান্তের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে অতি সহজিয়া ঢঙে তা মিশে যেতে সক্ষম।
দুই.
নাজকির ‘আমাদের কথা’ কবিতায় পূর্ণ এক যুদ্ধগাথা রচনা করেন। গদ্য ধাঁচের কবিতা হলেও গদ্যের ভাষা তাতে নেই; বরং তা একটি ডাইনামিক কাব্য ধাঁচের প্রতিনিধিত্ব করে। কবিতাটি আপনাকে একালের কাশ্মীরের সঙ্গে, সেখানকার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত করাবে। পড়তে-পড়তে আপনার মনে হবে, আধুনিক কবিতায় সৌন্দর্যনীতি থেকে সরে গেছেন নাজকি; বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণধর্মী গদ্য ধাঁচের রাজনীতি থেকে আঁচল গুটিয়েছেন। কোনো স্বতন্ত্র চরিত্র নির্মাণ না করে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের কথা’ বলে ব্যক্তিগত কবিতাকাঠামো নির্মাণ করেছেন। উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই কেবল এসব কল্পনা করা যায়। কবিতায় কাশ্মীরকে নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকার প্রয়াস লক্ষণীয়। এ যেন কাশ্মীরের অতীত-বর্তমানের ইতিহাস ও ভূবৈচিত্র্যের নিখুঁত রেখাচিত্র। উপত্যকার সাংস্কৃতিক অবদান প্রকাশ্যে আনার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। উত্তর ভারত কাশ্মীরকে কখনো বুঝতে চায়নি। এখানকার স্বতন্ত্র ভূবৈচিত্র্যের প্রতি মোটেও নজর দেয়নি—এমন অভিযোগও তোলেন কবি। দীর্ঘ কবিতাটির এ অংশটি পড়ুন—
‘জুবাইর রেজভির আলি বিন মুত্তাকির কথা মানুষ শোনে
তবে সবজ্ আলি সুকুতির সুর শোনে না
অথচ সেই কুণ্ডলিত সুর আজও পিরপানসালের পর্বতশৃঙ্গে ধাক্কা খেয়ে
শিলাবহরের শিরায়-শিরায় দৌড়ায়;
এর পর বরফ গলা শুরু করলে প্রপাতে-প্রপাতে তার গুঞ্জরণ শোনা যায়
সবজ আলি সুকুতির সুরও দারুণ বৈচিত্র্যময়।’
আধুনিক উর্দু কবি জুবাইর রেজভির কবিতার কাশ্মীরি চরিত্র আলি বিন মুত্তাকির মোটেও এই উপত্যকার প্রতিনিধিত্ব করে না বলে অভিযোগ করেন কবি। অথচ পুরো ভারত তাঁকে নিয়েই মেতে থাকে। অথচ কাশ্মীরের কিংবদন্তি গায়ক সবজ আলি সুকুতির সুরবৈচিত্র্যই উপত্যকার ভূবৈচিত্র্যের সেরা উপমা হতে পারে। কাশ্মীরের সকল সৌন্দর্যের সুর যেন তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে গভীর নীল আকাশে মেঘ হয়ে ভাসতে থাকে। এক সময় তা কাশ্মীরের পিরপানচালের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণিকে একত্ববাদের গান শোনাতে যায়। সেখানে মিলিত হয় উপত্যকার সকল আধ্যাত্মিকতার ধারা। তবে উপত্যকার এমন স্বতন্ত্র রূপ কখনোই উত্তর ভারতের সানগ্লাস পরা চোখে ধরা পড়ে না। ফলে এই উপত্যকাকে উত্তর ভারত কিংবা কাশ্মীরের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা দেখা যায়।
কবিতার শেষাংশে এসে পাঠককে অবাক করে দিয়ে কবি বলেন—
‘বসন্ত এসে গেছে
তবে গাছে না ধরেছে আপেল, না নাশপাতি
বরং তাতে ধরেছে মানুষের খুলি
আমরা খুব খুশি হলাম
এবং নিমন্ত্রণ করলাম শাহজাদাদের;
এবং অভিবাদন জানালাম তাদের ককটেল ফাটিয়ে।’
এই জায়গায় টিএস এলিয়টের সঙ্গে এক আশ্চর্য মিল রয়েছে নাজকির। এলিয়ট এক কবিতায় বলেন—
‘গত বছর নিজেদের বাগানে তোমরা
যে লাশগুলো বপন করেছিলে—
এত দিনে তা হয়তো ফল-ফুলে পরিণত হয়েছে
এবং থোকায় থোকায় বেরিয়ে পড়েছে।’
এলিয়ট নিজের যুগের অস্থিরতা এবং মানুষের অনুভূতিহীনতা প্রকাশের জন্য জমিতে রোপণ করা লাশের রূপক ব্যবহার করেন। নাজকিও একই অবস্থার বয়ান দিতে গাছে-গাছে মানুষের খুলি ফলার উপমা খুঁজে নেন। ‘আমাদের কথা’য় কাশ্মীরি মানুষের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের গাদ্দারির বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রূপ প্রতিভাত হয়।

তিন.
নাজকির আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘খুশবুর খোলসে অ্যাসিড’। কবিতাটির শরীর দুঃখের ক্ষত বয়ে বেড়ায়; আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেও ব্যর্থ হন কবি। চির নিষ্পাপকালের কোলে শুরু করা কবির জীবনটি আধুনিককালে এসে বিধ্বংসী অ্যাসিডে পরিণত হয়, যা তাঁর নিষ্পাপ চেহারায় দাগের জন্ম দেয় এবং সম্মানের রূপ শোভাকে কলঙ্কিত করে। সময়ের দুটি প্রান্তে ভ্রমণ করে এই কবিতা। একদিকে নির্মল গ্রাম, সৃজনানন্দ ও মুক্ত ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে হাজির হন কবির সহজ-সরল মা, যিনি আপেলের মতো লাল এবং গোলাপের মতো কোমল। অন্যদিকে সময়ের শেষ প্রান্তকে তিনি ‘আমি’-এর ভেতর দিয়ে ধরার চেষ্টা করেন। মাঝখানের সময়টিকে তিনি তাঁর বাবার রূপে দেখতে পান। তবে একটি উপসংহারে পৌঁছেও যেন শেষ পর্যন্ত তিনি জীবনের অর্থ স্পর্শ করতে ব্যর্থ হন। ফলে শেষ লাইনে এসে নিজেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন—‘আমি কে?’ কবিতাটি পড়া যাক—
‘নিবু পাহাড়ের আঁচলতলে
একটি গ্রাম—
মাদরাবন
জন্মেছিলাম আমি
(আমার নাম মুহাম্মদ ফারুক)
আমার মা ছিলেন আপেলের মতো লাল ও মিষ্টি
গোলাপের মতো কোমল ও সুরভিত
ছিলেন সুঘ্রাণের আকর;
জড়ানো লেপটানো ছলচাতুরী কপটতা মিথ্যা—
এসব শব্দ তিনি শুনেছিলেন সত্য
তবে কখনো পরখ করেননি
মুখে-মুখে আওড়াননি একবারও।
রেডিওতে প্রচারিত হয় নিজার কাব্বানির ভৌতিক কবিতা
অথবা কোনো গায়ক শোনায় কালিদাসের ঋতু সমাচার—
ডুকরে-ডুকরে কাঁদেন তিনি;
আমি কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করি
তিনি বলেন—
দেবতাদের এসব ভাষা
বড়ই জাদুকরী
সত্যের দিশা
এবং সরল পথের পাথেয় রয়েছে এতে;
আমি তাঁর সরলতায় কয়েকবার কেঁদে দিই।
বাবা আমার ডিনামাইট চিবোতেন
আঙুলের মাঝে ফলাতেন অ্যাসিডের বন
এবং মরা পাতলা হলদে কাগজের কপোলে
সাজাতেন রক্তের ফুল
নিজ থেকে পৃথক হয়ে নিজের সঙ্গে মিশে গিয়ে
মায়ায় পড়তে থাকেন নিজেরই সম্পদের;
গোটা আটটি জাহাজের মালিক তিনি—
ভাসিয়েছেন সময়ের সমুদ্রজলে
এবং কন্ট্রোল রুমে বসে নিজেই
নির্ধারণ করতে থাকেন তাদের চলার পথ।
আমিও একটি জাহাজ
পাথর চিবোনো, চোখের পাতার ঝোপে বরই গাছ লাগানো
খুব ভোরে মসজিদের দরোজা দিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে
চোখ লুকিয়ে চলে যাওয়া
এবং আল্লাহপ্রেমিকের ভক্ত হয়ে
আল্লাহরই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া
যার স্বভাবে পরিণত হয়েছে;
লাল মাটির আপেল ও অ্যাসিডের সেই
মিলনের ফসল আমি—
আমি কে?’
কবিতাটি উত্তরাধুনিক কাব্যচিন্তার যথার্থ উদাহরণ। রোনাল্ড বার্থার এই ধরনের সৃজন-অভিজ্ঞতার জন্য শুধু একটি পরিভাষাই প্রণয়ন করেন—‘সিজোফ্রেনিক মুড অব স্পেস অ্যান্ড টাইম’। নাজকির এই কবিতার জন্য যা যথাযথ এবং রূপকগুলোকে স্পষ্ট করে দেওয়ার মতো। স্থান-কালের এই পাগলামি-ধাঁচ নাজকির অন্যান্য কবিতায়ও দেখা যায়। তবে যেসব কবিতায় পরিস্থিতির প্রভাব বেশি থাকে, সেখানে পাগলামির চেয়ে কবিতার মূলভাব স্পষ্ট করার প্রতি বেশি মনোযোগী দেখতে পাই তাঁকে। যেমন—‘শিরোনামগুলো’, ‘একটি শোকগাথা, ‘এ কেমন আবহাওয়া’, ‘রক্তনদী উন্মাতাল’ ‘পরামর্শ’, ‘বনের নামে পদ্য’ এবং ‘১৯৯০-এর এক সকাল’ ইত্যাদি কবিতাগুলো প্রণিধানযোগ্য। এর মধ্যে ‘শিরোনামগুলো’ কবিতাটিতে বর্ণিত ঘটনাপরম্পরা ও বাস্তবতার শ্লেষাত্মক উপস্থাপন পাঠকের অনুভবের জগৎ নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে এই পঙ্ক্তিগুলো—
‘মাসুমুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ—
মুজাহিদ নেতা বাবা-মাকে উপহার দিয়েছেন
পবিত্র কোরআনের একটি কপি
মাসুমুল ইসলামের নিরক্ষর মা মখমলের গেলাফে
মুড়িয়ে সেটি তাকের ওপর রেখে দিয়েছেন;
জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া বাতাস বলল—
‘পড়ো’।’
নাজকির কবিতামানস কিংবদন্তি উর্দু কবি মীরাজির সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ। তাঁর কিছু কবিতায় মীরাজির কঠোরতা, ব্যথার তীব্রতা, অনিন্দ্য ভূ-বর্ণনার মতো উত্তুঙ্গ রূপ দেখা যায়। যেমন ‘মান্টোর সুলতানা বললেন’ কবিতার এ অংশটি দেখুন—
‘দুনিয়া কী করে জানবে—হৃদয়ের গহিনে কত নদী বহমান
আমাদের দেহ তো মহাসড়ক—মানুষের চলাচল থামেই না
চুপচাপ থাকে, নীরবে দুঃখ সয়ে যায় এবং সতত বলে বেড়ায়—
হৃদয়ের রহস্য জানা সেই যোগী কবে আসবে?’
নাজকির কবিতার বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। কবিতার মাধ্যমে জীবনের নতুন সংস্করণের কাজ করেন তিনি। এই কবিতাগুলো আধুনিকতম উর্দু কবিতার নতুন তাঁবু। যেখানে জীবনের উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে আধুনিক দর্শনের হিরে-মুক্তো-জহরত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। নাজকির কবিতা পৃথিবীকে আলোকিত করা এক আলোর ফোয়ারা।
আরও পড়ুন:

গজলের ধারাকে নতুন গাম্ভীর্য দেওয়ার যে যাত্রা ফারুক নাজকি শুরু করেন, সেটির পরবর্তী গন্তব্য তাঁর সতেজ-তরতাজা আধুনিক উর্দু কবিতার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়। আধুনিক কবিতা এ যুগে অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে। কবিতার বৈশ্বিক অলংকারই একালের উর্দু কবিতার প্রধান নিয়ামক। ফারুক নাজকির কাব্যগ্রন্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁর প্রথম দিকের কবিতার তুলনায় শেষের দিকের কবিতাগুলো অনেক বেশি পরিপক্ব, বলিষ্ঠ ও কালোত্তীর্ণ। কবিতার সুর, ধাঁচ ও ভাবের বৈচিত্র্যও এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
নাজকির সর্বশেষ উর্দু কাব্যগ্রন্থ ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’-এর কবিতাগুলো তিনি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে লিখেছেন। সময়টি কাশ্মীরের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বেদনার ছিল। তিনি কাশ্মীরে বসেই সবকিছু প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। চারদিকে দ্রোহের আগুন। ঝিলমে বইছিল রক্তের স্রোত। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ ও করুণ অস্ত্রবাজির মুখে কাশ্মীর জাহান্নামে পরিণত তখন। খুব কাছ থেকে দেখা এসব দৃশ্য নাজকির কবিতাকে প্রভাবিত করে সত্য; তবে কালের ভাষায় নিজের কবিতাকে হারিয়ে যেতে না দেওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে বাস্তববাদী করে তোলে। ফলে কবিতার শরীরে পরিস্থিতির দাগ থাকলেও পুরো কাঠামো বিনির্মাণে তিনি আধুনিক নির্মোহ কাব্যধারা ভালোই রপ্ত করেন।
কাশ্মীরের উত্তাল পরিস্থিতিকে কবিতার ইট-সুরকিতে মিশিয়ে, আধুনিক নিরাসক্ত কবিতার ছাঁচে রেখে, সময়ের সীমারেখা পেরিয়ে, অসীমের আকাশে নাজকি নির্মাণ করেন কবিতার প্রাসাদ। ফলে ফারুকের হাত ধরে কাশ্মীরের বিরাজমান বাস্তবতা কালজয়ী কাব্যভাষায় চিরায়ত সাহিত্যের পাতায় স্থান করে নেয়। ইতিহাস ও সমাজবাস্তবতার তাপ-উত্তাপ থেকে বের হয়ে তা সর্বজনীন সৃষ্টিসুখের উল্লাসে পরিণত হয়। উদাহরণ হিসেবে নাজকির ‘সোনালি দরজার বাইরে’ কবিতাটি দেখা যাক—
‘কম্পিত দেহ
ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থাকা রং
আধমরা আলোর কাফন জড়িয়ে
মৃত্যু জনপদের আগুনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
নিজের অনুভবের আঁচ সয়ে যায়।
সন্ধ্যা
আধো আঁধার সড়কে মাথা ঘষতে থাকে
থরথর কাঁপা রাত দুঃখের ছাঁচে-ঢালাই হওয়ার আগে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
আলোহীন ঝাড়বাতির পাশে দাঁড়িয়ে রয়।
চাঁদ
আকাশের গভীর নীল সমুদ্রে তারাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক থেকে
দীর্ঘ সময়জুড়ে
মৃত্যুর জনপদে আগুনের ফুল-লুকানো-খেলা খেলছিল
কবর থেকে কবরে ছায়া নেই, দেহ নেই
পা থেকে পায়ের দূরত্বে ঘরে ফেরার চিহ্নরাও গুম
ঘরের দহলিজ মানবশূন্য
মনিবের পথ চেয়ে-চেয়ে দরজা-কপাট
দীর্ঘ সময়জুড়ে অপেক্ষায় ছিল তবে
কোনো টোকা নেই কিংবা পায়ের আওয়াজ।
এদিকে
নির্বাক শহরের আঁধারে
কম্পিত দেহ
‘কীভাবে ও কত’-এর বদলাতে থাকা প্রান্তে প্রান্তে
বিভ্রান্ত উত্তাল বিক্ষিপ্ত কুঞ্চিত হতে থাকে
এবং ঘন কুয়াশায় লেপ্টে থেকে
ডালে-ডালে আলোর পথ মাড়িয়ে
ক্রুশের ছায়ায় নিশ্বাস নিচ্ছে।
কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছে, অপমানের ধারাবাহিকতা আছে এবং ক্রুশের সেই ছায়া আছে, যা ঘটে যাওয়া বিষয়ের নিদর্শন হয়ে কাঁপতে কাঁপতে জীবনের অস্তিত্ব-প্রয়াণের পয়গাম দিচ্ছে। তবে কবিতার ধাঁচ, ভাব ও কাঠামো সময়কে অতিক্রম করে অসীমে মিলিয়ে গেছে। জগতের যেকোনো প্রান্তের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে অতি সহজিয়া ঢঙে তা মিশে যেতে সক্ষম।
দুই.
নাজকির ‘আমাদের কথা’ কবিতায় পূর্ণ এক যুদ্ধগাথা রচনা করেন। গদ্য ধাঁচের কবিতা হলেও গদ্যের ভাষা তাতে নেই; বরং তা একটি ডাইনামিক কাব্য ধাঁচের প্রতিনিধিত্ব করে। কবিতাটি আপনাকে একালের কাশ্মীরের সঙ্গে, সেখানকার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যিক কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত করাবে। পড়তে-পড়তে আপনার মনে হবে, আধুনিক কবিতায় সৌন্দর্যনীতি থেকে সরে গেছেন নাজকি; বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণধর্মী গদ্য ধাঁচের রাজনীতি থেকে আঁচল গুটিয়েছেন। কোনো স্বতন্ত্র চরিত্র নির্মাণ না করে ‘আমরা’ ও ‘আমাদের কথা’ বলে ব্যক্তিগত কবিতাকাঠামো নির্মাণ করেছেন। উত্তরাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই কেবল এসব কল্পনা করা যায়। কবিতায় কাশ্মীরকে নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকার প্রয়াস লক্ষণীয়। এ যেন কাশ্মীরের অতীত-বর্তমানের ইতিহাস ও ভূবৈচিত্র্যের নিখুঁত রেখাচিত্র। উপত্যকার সাংস্কৃতিক অবদান প্রকাশ্যে আনার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। উত্তর ভারত কাশ্মীরকে কখনো বুঝতে চায়নি। এখানকার স্বতন্ত্র ভূবৈচিত্র্যের প্রতি মোটেও নজর দেয়নি—এমন অভিযোগও তোলেন কবি। দীর্ঘ কবিতাটির এ অংশটি পড়ুন—
‘জুবাইর রেজভির আলি বিন মুত্তাকির কথা মানুষ শোনে
তবে সবজ্ আলি সুকুতির সুর শোনে না
অথচ সেই কুণ্ডলিত সুর আজও পিরপানসালের পর্বতশৃঙ্গে ধাক্কা খেয়ে
শিলাবহরের শিরায়-শিরায় দৌড়ায়;
এর পর বরফ গলা শুরু করলে প্রপাতে-প্রপাতে তার গুঞ্জরণ শোনা যায়
সবজ আলি সুকুতির সুরও দারুণ বৈচিত্র্যময়।’
আধুনিক উর্দু কবি জুবাইর রেজভির কবিতার কাশ্মীরি চরিত্র আলি বিন মুত্তাকির মোটেও এই উপত্যকার প্রতিনিধিত্ব করে না বলে অভিযোগ করেন কবি। অথচ পুরো ভারত তাঁকে নিয়েই মেতে থাকে। অথচ কাশ্মীরের কিংবদন্তি গায়ক সবজ আলি সুকুতির সুরবৈচিত্র্যই উপত্যকার ভূবৈচিত্র্যের সেরা উপমা হতে পারে। কাশ্মীরের সকল সৌন্দর্যের সুর যেন তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে গভীর নীল আকাশে মেঘ হয়ে ভাসতে থাকে। এক সময় তা কাশ্মীরের পিরপানচালের সুউচ্চ পর্বতশ্রেণিকে একত্ববাদের গান শোনাতে যায়। সেখানে মিলিত হয় উপত্যকার সকল আধ্যাত্মিকতার ধারা। তবে উপত্যকার এমন স্বতন্ত্র রূপ কখনোই উত্তর ভারতের সানগ্লাস পরা চোখে ধরা পড়ে না। ফলে এই উপত্যকাকে উত্তর ভারত কিংবা কাশ্মীরের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মেলানোর ব্যর্থ চেষ্টা দেখা যায়।
কবিতার শেষাংশে এসে পাঠককে অবাক করে দিয়ে কবি বলেন—
‘বসন্ত এসে গেছে
তবে গাছে না ধরেছে আপেল, না নাশপাতি
বরং তাতে ধরেছে মানুষের খুলি
আমরা খুব খুশি হলাম
এবং নিমন্ত্রণ করলাম শাহজাদাদের;
এবং অভিবাদন জানালাম তাদের ককটেল ফাটিয়ে।’
এই জায়গায় টিএস এলিয়টের সঙ্গে এক আশ্চর্য মিল রয়েছে নাজকির। এলিয়ট এক কবিতায় বলেন—
‘গত বছর নিজেদের বাগানে তোমরা
যে লাশগুলো বপন করেছিলে—
এত দিনে তা হয়তো ফল-ফুলে পরিণত হয়েছে
এবং থোকায় থোকায় বেরিয়ে পড়েছে।’
এলিয়ট নিজের যুগের অস্থিরতা এবং মানুষের অনুভূতিহীনতা প্রকাশের জন্য জমিতে রোপণ করা লাশের রূপক ব্যবহার করেন। নাজকিও একই অবস্থার বয়ান দিতে গাছে-গাছে মানুষের খুলি ফলার উপমা খুঁজে নেন। ‘আমাদের কথা’য় কাশ্মীরি মানুষের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের গাদ্দারির বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রূপ প্রতিভাত হয়।

তিন.
নাজকির আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘খুশবুর খোলসে অ্যাসিড’। কবিতাটির শরীর দুঃখের ক্ষত বয়ে বেড়ায়; আত্মপরিচয়ের সন্ধান করেও ব্যর্থ হন কবি। চির নিষ্পাপকালের কোলে শুরু করা কবির জীবনটি আধুনিককালে এসে বিধ্বংসী অ্যাসিডে পরিণত হয়, যা তাঁর নিষ্পাপ চেহারায় দাগের জন্ম দেয় এবং সম্মানের রূপ শোভাকে কলঙ্কিত করে। সময়ের দুটি প্রান্তে ভ্রমণ করে এই কবিতা। একদিকে নির্মল গ্রাম, সৃজনানন্দ ও মুক্ত ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে হাজির হন কবির সহজ-সরল মা, যিনি আপেলের মতো লাল এবং গোলাপের মতো কোমল। অন্যদিকে সময়ের শেষ প্রান্তকে তিনি ‘আমি’-এর ভেতর দিয়ে ধরার চেষ্টা করেন। মাঝখানের সময়টিকে তিনি তাঁর বাবার রূপে দেখতে পান। তবে একটি উপসংহারে পৌঁছেও যেন শেষ পর্যন্ত তিনি জীবনের অর্থ স্পর্শ করতে ব্যর্থ হন। ফলে শেষ লাইনে এসে নিজেকেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন—‘আমি কে?’ কবিতাটি পড়া যাক—
‘নিবু পাহাড়ের আঁচলতলে
একটি গ্রাম—
মাদরাবন
জন্মেছিলাম আমি
(আমার নাম মুহাম্মদ ফারুক)
আমার মা ছিলেন আপেলের মতো লাল ও মিষ্টি
গোলাপের মতো কোমল ও সুরভিত
ছিলেন সুঘ্রাণের আকর;
জড়ানো লেপটানো ছলচাতুরী কপটতা মিথ্যা—
এসব শব্দ তিনি শুনেছিলেন সত্য
তবে কখনো পরখ করেননি
মুখে-মুখে আওড়াননি একবারও।
রেডিওতে প্রচারিত হয় নিজার কাব্বানির ভৌতিক কবিতা
অথবা কোনো গায়ক শোনায় কালিদাসের ঋতু সমাচার—
ডুকরে-ডুকরে কাঁদেন তিনি;
আমি কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করি
তিনি বলেন—
দেবতাদের এসব ভাষা
বড়ই জাদুকরী
সত্যের দিশা
এবং সরল পথের পাথেয় রয়েছে এতে;
আমি তাঁর সরলতায় কয়েকবার কেঁদে দিই।
বাবা আমার ডিনামাইট চিবোতেন
আঙুলের মাঝে ফলাতেন অ্যাসিডের বন
এবং মরা পাতলা হলদে কাগজের কপোলে
সাজাতেন রক্তের ফুল
নিজ থেকে পৃথক হয়ে নিজের সঙ্গে মিশে গিয়ে
মায়ায় পড়তে থাকেন নিজেরই সম্পদের;
গোটা আটটি জাহাজের মালিক তিনি—
ভাসিয়েছেন সময়ের সমুদ্রজলে
এবং কন্ট্রোল রুমে বসে নিজেই
নির্ধারণ করতে থাকেন তাদের চলার পথ।
আমিও একটি জাহাজ
পাথর চিবোনো, চোখের পাতার ঝোপে বরই গাছ লাগানো
খুব ভোরে মসজিদের দরোজা দিয়ে আল্লাহর কাছ থেকে
চোখ লুকিয়ে চলে যাওয়া
এবং আল্লাহপ্রেমিকের ভক্ত হয়ে
আল্লাহরই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া
যার স্বভাবে পরিণত হয়েছে;
লাল মাটির আপেল ও অ্যাসিডের সেই
মিলনের ফসল আমি—
আমি কে?’
কবিতাটি উত্তরাধুনিক কাব্যচিন্তার যথার্থ উদাহরণ। রোনাল্ড বার্থার এই ধরনের সৃজন-অভিজ্ঞতার জন্য শুধু একটি পরিভাষাই প্রণয়ন করেন—‘সিজোফ্রেনিক মুড অব স্পেস অ্যান্ড টাইম’। নাজকির এই কবিতার জন্য যা যথাযথ এবং রূপকগুলোকে স্পষ্ট করে দেওয়ার মতো। স্থান-কালের এই পাগলামি-ধাঁচ নাজকির অন্যান্য কবিতায়ও দেখা যায়। তবে যেসব কবিতায় পরিস্থিতির প্রভাব বেশি থাকে, সেখানে পাগলামির চেয়ে কবিতার মূলভাব স্পষ্ট করার প্রতি বেশি মনোযোগী দেখতে পাই তাঁকে। যেমন—‘শিরোনামগুলো’, ‘একটি শোকগাথা, ‘এ কেমন আবহাওয়া’, ‘রক্তনদী উন্মাতাল’ ‘পরামর্শ’, ‘বনের নামে পদ্য’ এবং ‘১৯৯০-এর এক সকাল’ ইত্যাদি কবিতাগুলো প্রণিধানযোগ্য। এর মধ্যে ‘শিরোনামগুলো’ কবিতাটিতে বর্ণিত ঘটনাপরম্পরা ও বাস্তবতার শ্লেষাত্মক উপস্থাপন পাঠকের অনুভবের জগৎ নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে এই পঙ্ক্তিগুলো—
‘মাসুমুল ইসলামের মহাপ্রয়াণ—
মুজাহিদ নেতা বাবা-মাকে উপহার দিয়েছেন
পবিত্র কোরআনের একটি কপি
মাসুমুল ইসলামের নিরক্ষর মা মখমলের গেলাফে
মুড়িয়ে সেটি তাকের ওপর রেখে দিয়েছেন;
জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া বাতাস বলল—
‘পড়ো’।’
নাজকির কবিতামানস কিংবদন্তি উর্দু কবি মীরাজির সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ। তাঁর কিছু কবিতায় মীরাজির কঠোরতা, ব্যথার তীব্রতা, অনিন্দ্য ভূ-বর্ণনার মতো উত্তুঙ্গ রূপ দেখা যায়। যেমন ‘মান্টোর সুলতানা বললেন’ কবিতার এ অংশটি দেখুন—
‘দুনিয়া কী করে জানবে—হৃদয়ের গহিনে কত নদী বহমান
আমাদের দেহ তো মহাসড়ক—মানুষের চলাচল থামেই না
চুপচাপ থাকে, নীরবে দুঃখ সয়ে যায় এবং সতত বলে বেড়ায়—
হৃদয়ের রহস্য জানা সেই যোগী কবে আসবে?’
নাজকির কবিতার বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। কবিতার মাধ্যমে জীবনের নতুন সংস্করণের কাজ করেন তিনি। এই কবিতাগুলো আধুনিকতম উর্দু কবিতার নতুন তাঁবু। যেখানে জীবনের উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে আধুনিক দর্শনের হিরে-মুক্তো-জহরত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। নাজকির কবিতা পৃথিবীকে আলোকিত করা এক আলোর ফোয়ারা।
আরও পড়ুন:

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৫ ঘণ্টা আগে
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
১ দিন আগে
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৫ দিন আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৫ দিন আগেসম্পাদকীয়

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।
পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছ
০১ জুলাই ২০২২
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
১ দিন আগে
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৫ দিন আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৫ দিন আগেসম্পাদকীয়

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।
সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।
সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছ
০১ জুলাই ২০২২
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৫ ঘণ্টা আগে
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৫ দিন আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৫ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।
অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।
‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।
শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।
গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।
এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।
শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।
অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।
‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।
শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।
গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।
এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।
শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছ
০১ জুলাই ২০২২
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৫ ঘণ্টা আগে
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
১ দিন আগে
উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান।
৫ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।
প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা
১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।
হত্যার নেপথ্যে
১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।
আসল খুনি কে?
লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’
অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।
গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।
প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা
১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।
হত্যার নেপথ্যে
১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।
আসল খুনি কে?
লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।
রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’
অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।
গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার
মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

কবিতার কাফনে জড়ানো কম্পিত দেহ, অন্ধকার সড়কে মাথা ঘষতে থাকা সন্ধ্যা, নির্জন-নৈঃশব্দ্যের ভয়কাতর চাঁদ, বিভ্রান্ত উত্তাল নির্বাক শহর কিংবা বৃক্ষে ঝোলানো ক্রুশের ছায়ার সুনির্দিষ্ট একটি সময় আছে। নতুন শহর এবং সমাজের চিত্র শব্দের আঁচড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে সময়ের এই দাগে। যেখানে ভয় আছে, দৃশ্যের বিবরণ আছে, জীবন আছ
০১ জুলাই ২০২২
বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে।
৫ ঘণ্টা আগে
...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।
১ দিন আগে
ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়
৫ দিন আগে