Ajker Patrika

ঝিলমতীরের এক দুরন্ত বালক

ইজাজুল হক
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২২, ১৮: ৫৩
ঝিলমতীরের এক দুরন্ত বালক

এক.
১৯৪০ সাল। কাশ্মীর তখনো তিন টুকরো হয়নি। ভারতবর্ষে বৃটিশরাজ টালমাটাল; পতনোন্মুখ। ব্রিটিশদের আশীর্বাদপুষ্ট মহারাজা হরি সিং অখণ্ড কাশ্মীরের একচ্ছত্র অধিপতি। জম্মু থেকে লাদাখ, কারাকোরাম থেকে গিলগিত-বালতিস্তান কিংবা শ্রীনগর থেকে মুজাফফরাবাদ—সর্বত্রই মহারাজার শাসন। ব্রিটিশরা ১৮৪৬ সালে শিখ রাজাদের পরাজিত করে কাশ্মীর দখল করলেও কখনো সরাসরি কাশ্মীর শাসন করেনি। আনুগত্যের শর্তে হরি সিংয়ের চতুর্থ পুরুষ ডোগরা রাজা গুলাব সিংয়ের কাছে লর্ড হার্ডিঞ্জ মাত্র সাড়ে ৭ লাখ রুপি দিয়ে ভূস্বর্গ কাশ্মীর বেচে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই কাশ্মীরে ডোগরা রাজার শাসন। ৫০০ বছরের মুসলিম-শাসনের সোনালি ইতিহাস থাকলেও এবং কাশ্মীরের দুই তৃতীয়াংশ জনগণ মুসলমান হলেও তত দিনে মুসলমানরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহ নিপীড়িত মুসলমানদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

সেই দিনগুলোতে, সুলতান জাইনুল আবেদিনের প্রধান বিচারপতি মির সৈয়দ আলি বুখারির এক উত্তরপুরুষ—মির গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের বান্ডিপোরায় বাস করতেন। কাশ্মীরের সুফি কবিতার পুনর্জন্মে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া হয়। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি গোলাম রসুল নাজকি বিয়ে করেছিলেন কাশ্মীরের বিখ্যাত ফাজিলি পরিবারের এক শিক্ষিত-বিদূষী নারীকে। সে বছর, ১৯৪০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁদের কোল আলো করে জন্ম নেন এক শিশু—সাইয়েদ মুহাম্মদ ফারুক নাজকি—আজকের কাশ্মীরের সেরা কবি ফারুক নাজকি।

বারামুল্লা জেলার অন্তর্গত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ স্বাদু পানির হ্রদ উলার লেকের উত্তর তীরের এক সবুজ জনপদ বান্ডিপোরা তখনো জেলা হয়নি। সেখানে এক মায়াবী পাহাড় ছিল—নিবু পাহাড়, যার পাদদেশের সারি সারি চিনার-দেবদারুর মাঝে গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম—মাদরাবন; ফারুক নাজকির আশৈশব স্মৃতির জনপদ। মাদরাবনের এক তিনতলা বাড়িতে থাকত ফারুক নাজকির পরিবার। একই ছাদের নিচে যৌথভাবে বসবাস করতেন তাঁর তিন চাচাও—গোলাম মুহাম্মদ, বাহাউদ্দিন ও গোলাম জিলানি। পিঠাপিঠি বড় ভাই রিয়াজুল ইসলামের সঙ্গে খেলেদুলে বড় হতে থাকেন ছোট্ট ফারুক নাজকি। ঘর থেকে বেরোলেই সবুজ ঘাসেভরা উঠোন, উঠোন পেরোলেই নানারঙা ফুলেল মাঠ, মাঠ পেরোলেই কুলকুল বয়ে চলা শীতল নদী, নদী পেরোলেই হলদে পাতাঝরার বন এবং দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়। টিউলিপ, সূর্যমুখী, গোলাপ ও জাফরানের ঘ্রাণ এবং আপেল, আঙুর, চেরি ও নাশপাতির স্বাদ নিতে নিতেই বেড়ে ওঠেন নাজকি। বড়দের সঙ্গে নদী তীরে যান, স্বচ্ছ শীতল জলধারার ছোঁয়ায় মাতেন। দূরে নদীর ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসে শিংঅলা লাল হরিণের দল। ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত সুবোধ হরিণেরা মুখ ডুবিয়ে জল পান করে। শিশু নাজকি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হরিণের মোলায়েম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় তার। কখনো-সখনো দূরের পাহাড়েও যাওয়া হতো নাজকির—বড়দের আঙুল চেপে ধরে। পাহাড়ের ওপর থেকে উপত্যকার যে দৃশ্য দেখা যেত, তা এখনো ভুলতে পারেন না তিনি। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত গাছের শুকনো ডালের মতো বাঁকা শিংঅলা বিপুলদেহ লাল হরিণের দল। এ ধরনের হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলে, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়—বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত।

ফারুক নাকজিফারুক নাজকিদের সেই তিনতলা বাড়িটি সারা দিন মেহমানদের আগমনে গমগম করত। এখানে-ওখানে থরে থরে সাজানো বইপুস্তক, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পত্রিকা-ম্যাগাজিন এবং দেয়ালে-দেয়ালে ঝোলানো দেয়ালচিত্র—মাঝখানের বিশাল হলরুমে বসে গভীর রাত পর্যন্ত চলত কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। বাবা গোলাম রসুল নাজকি কাশ্মীরের উর্দু সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর কাছে নিয়মিত আশীর্বাদ নিতে আসতেন উর্দু ও কাশ্মীরি সাহিত্যের সেরা ব্যক্তিত্বরা। খলিলুর রহমান আজমি, জিএম মির তাউস, জিএইচ আলি বুলবুল, নাজমুদ্দিন ইশরাত, জাবেদ কাশ্মীরি, নিয়াজ কামরাজি, কমরুদ্দিন কমর, তানহা আনসারি, সাওলুরুক শাবানসহ অসংখ্য সাহিত্যসেবী। উর্দু সাহিত্যের কিংবদন্তি পুরুষ জিগর মুরাদাবাদী ও ফিরাক গুরকপুরীও মাঝেমধ্যে আসতেন। এত এত চমৎকার মানুষের রাতজাগা আড্ডা দেখে এবং তাঁদের কোলে-পিঠে চড়ে কবিতার রূপ-রস অজান্তেই প্রবেশ করতে থাকে ফারুক নাজকির রক্তে-মাংসে।

একসময় নাজকির পড়াশোনার বয়স হয়। দাদাবাড়ির এমন কোলাহলে সেই পরিবেশ মোটেও ছিল না। সাহিত্যসাধনায় বুঁদ বাবা গোলাম রসুল নাজকি ছেলেমেয়েদের গামরোর নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেন। নানাবাড়ির পরিবেশ বেশ চমৎকার। পড়াশোনা, গবেষণা ও আভিজাত্যে বান্ডিপোরার অন্যতম সেরা পরিবার। কাশ্মীরের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাসান খুরামি ছিলেন ফারুক নাজকির চাচাতো নানা। সেই পরিবারের বিখ্যাত শিক্ষক আবদুল কাদিফ ফাজিলির কাছেই শুরু হয় তাঁর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা। মামাতো ভাই মনসুর আমহদ তাঁর সহপাঠী ও অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলেও যাওয়া শুরু করেন ফারুক। দু-এক বছরের ব্যবধানে দুটি স্কুল পাল্টাতে হয় তাঁকে। আট বছর বয়সে, ১৯৪৮ সালে তাঁর বান্ডিপোরা অধ্যায়ের ইতি ঘটে এবং পরিবারের সঙ্গে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের বাসিন্দা হয়ে যান। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলোকে তিনি খুব মিস করেন। অনেক বছর পরে এসে লেখা তাঁর ‘শৈশব’ কবিতাটি পড়ুন—

‘হালকা-সরল কথার ফুলে 
তৈরি হতো গানের মালা
ক্ষুদ্র-ছোট শব্দ-শলায়
চিন্তাদ্বীপে জ্বলত আগুন
প্রতিটি মুখ আমার ছিল
আমার ছিল দর্পণও সব
ছিল সকল ঘর আমাদের
উঠোনও সব আমার ছিল। 
ঠোঁটের আগায় আসত কথা
বের হলেও, মন থেকে না
ঢালত কানে অমৃত-শরাব
বইত হাওয়া হৃদয় ছুঁয়ে
সময়টি বেশ প্রিয় ছিল
মধুর ছিল মুহূর্ত সব
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই। 
সেই সময়ের আলোর সড়ক—
শুরু আছে, সমাপ্তি নেই
সময়টি কই হারিয়ে গেল
স্মৃতির ভুবন বর্ণনাতীত।’
(লফ্জ লফ্জ নোহা/ফারুক নাজকি

সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াত আঁকাবাঁকা শিংঅলা লাল হরিণের দল। বিলুপ্তপ্রায় এই হরিণকে স্থানীয় ভাষায় ‘হানগুল’ বলা হয়দুই.
১৯৪৭ সাল। ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির চেহারা পাল্টে যায়। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় ২০০ বছরের ব্রিটিশশাসিত নিখিল ভারত। জন্ম নেয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতজুড়ে শুরু হয় এক নিষ্ঠুর খেলা—সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। লাখে-লাখে মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তান যাচ্ছে; অথবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আসছে। পথে-পথে আগুনের লেলিহান শিখা। মুসলমানেরা হিন্দুদের মারছে, হিন্দুরা কাটছে মুসলমানদের। ফলে পাশের রাষ্ট্র কাশ্মীরেও আছড়ে পড়ে সেই দাঙ্গার প্রমত্ত ঢেউ। কাশ্মীরের অসংখ্য মুসলিম চলে যেতে বাধ্য হয় সদ্যোজাত মুসলিম দেশ পাকিস্তানে। তবে অধিকাংশ কাশ্মীরি মুসলমান একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ এবং পরবর্তীতে রিয়াসত-এ-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কয়েকটি উপজাতীয় বাহিনী। বলা হয়ে থাকে, কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের একটি চুক্তি হয়েছিল। সেই চুক্তির কারণে সরাসরি দখল করতে না পেরে পাকিস্তান কাশ্মীর-সংলগ্ন উপজাতিদের উসকে দেয় এবং বর্তমান আজাদ কাশ্মীর অংশটি দখল করে নেয়। ফলে হরি সিং অনেকটা নিরুপায় হয়ে ভারতের সাহায্য চান এবং নেহেরু-প্যাটেলরা সুকৌশলে অবশিষ্ট কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা বলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। পরে, ১৯৬২ সালে ভারতশাসিত কাশ্মীরের আরেকটি অংশ দখল করে নেয় চীন। ফলে কাশ্মীর তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির সবচেয়ে জটিল ভূখণ্ডে পরিণত হয়।

ভারতের সঙ্গে যুক্ত হলে হরি সিংকে রাজার মর্যাদায় রাখা হলেও কাশ্মীরি মুসলিম নেতা শেখ আবদুল্লাহকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি তখন ‘রেডিও কাশ্মীর জম্মু’ স্টেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। সেই দিনগুলোতে রাজা হরি সিং ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফারুক নাজকির বাবাকেই তা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ফলে আট বছরের শিশু ফারুকসহ পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে তিনি স্থায়ীভাবে শ্রীনগরের রেইনাওয়ারিতে চলে যান। সেখানে এক্সচেঞ্জ রোডে তাদের জন্য একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। বাড়িটি কাশ্মীরের সাবেক শিক্ষা পরিচালক খালিফ আবদুল হাকিমের সরকারি বাসভবন ছিল—দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানে চলে যান।

১৩ জুলাই, ১৯৪৮। শ্রীনগরের পলোগ্রাউন্ডে ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সংবাদপাঠ করে উদ্বোধন করবেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ফারুক নাজকি ভাইবোনদের নিয়ে রেইনাওয়ারির বাড়িটিতে রেডিওর সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কিছুক্ষণ পর কাশ্মীরি ভাষায় তরঙ্গায়িত হলো কাশ্মীরি ভাষার প্রথম রেডিওধ্বনি—‘আদাব, রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর থেকে বলছি…’। ফারুক নাজকিসহ লাখো কাশ্মিরির মনে সেদিন বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। বাবার কণ্ঠ বালক ফারুককে দারুণভাবে আপ্লুত করে। সেদিনের অনুপ্রেরণাই হয়তো পরবর্তীতে কাশ্মীরের কিংবদন্তি মিডিয়া ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে ফারুক নাজকিকে।

ফারুক নাজকির বাবা মির গোলাম রসুল নাজকি ছিলেন কাশ্মীরে সুফি কবিতার পুনর্প্রবর্তকদুই বছর পর, ১৯৫০ সালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ফারুক নাজকির জীবনে। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রাসাদ কাশ্মীরের সৌন্দর্যসুধা পান করতে আসেন। তাঁর সম্মানে শ্রীনগরের ঝিলম নদীতে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য নৌবিহারের। শতরঙা আলপনায় আবৃত সারি সারি বজরা নৌকার মিছিল। নদীর দু-কুলে সাজ-সাজ রব। রেডিওতে এই আয়োজনের ধারাভাষ্য দিচ্ছেন ফারুক নাজকির বাবা গোলাম রসুল নাজকি। ঝিলমের এমন নয়নকাড়া রূপ অনেক কাশ্মিরিদের মতো ফারুকও এর আগে দেখেননি। বহতা ঝিলমের রূপরহস্য যেন প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হয় তাঁর সামনে। সেদিন তাঁর শিশুমনে হয়তো বেজেছিল আনন্দের গান—যেমন বেজেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে ঝিলমের তীরে বসে ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—

‘সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হলো, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার; 
দিনের ভাটার শেষে রাত্রির জোয়ার; 
অন্ধকার গিরিতটতলে
দেওদার-তরু সারে সারে; 
মনে হলো, সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে, 
বলিতে না পারে স্পষ্ট করি—
অব্যক্ত ধ্বনিপুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি।’
(বলাকা/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তিন. 
ফারুক নাজকি যখন বান্ডিপোরার প্রাইমারি স্কুলে পড়তেন, তখনই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন, নিজের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পান। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে স্কুলে এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজা হরি সিং বান্ডিপোরা আসবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁর সম্মানে স্কুলেরই এক শিক্ষার্থীকে পাঠ করতে হবে মানপত্র। সবাইকে পেছনে ফেলে ফারুক নাজকিই নির্বাচিত হন। তবে শেষ মুহূর্তে মহারাজা এলেন না। পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী মেহর চাঁদ মহাজনকে। অনুষ্ঠানে ফারুকের বাবা গোলাম রসুল নাজকি এবং আল্লামা ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিশু ফারুকের মানপত্র পাঠের আভিজাত্য দেখে জাবেদ ইকবাল পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন—‘আখের ব্যাটা কিসকা হ্যায়’। আল্লামা ইকবাল সম্পর্কে ফারুক আগে থেকেই জানতেন। ফলে ইকবালের ছেলে জাবেদ ইকবালের কাছ থেকে এমন মন্তব্য তাঁকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল এবং বুকের পেলব জমিতে আত্মবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।

১৯৪৮ সালে রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর উদ্বোধন করেছিলেন মির গোলাম রসুল নাজকিফারুক নাজকির বাবা বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। কখনো সন্তানদের সরাসরি কোনো কিছু পড়তে বা লিখতে বলতেন না। দূর থেকে টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে ‘সিদকে জাদিদ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থ ‘তাফসিরে মাজেদি’র পর্বগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন। কখনো কোনো সমস্যা হলে সেটির সমাধান বের করার প্রতি জোর দিতেন। ফলে ফারুকের মন নিজের মতো করেই বিকশিত হতে থাকে। ফারুক বিচরণ করতে শুরু করেন সাহিত্যের ডালপালায়। কবিতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই দিল্লির জামিয়া মিলিয়া থেকে প্রকাশিত ড. জাকির হুসাইন সম্পাদিত ‘মেরা পারসা’ ম্যাগাজিনে ফারুকের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে তিনি তৎকালীন কাশ্মীরের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র শ্রী প্রতাপ কলেজে ভর্তি হন। কলেজজীবনে ডেইলি খেদমাত, দেহলি আশিয়ানা, মাস্তানা যোগি ও সাপ্তাহিক চিত্রাসহ বেশ কিছু পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই সচেতনভাবে রচনার প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি বেছে নেন ‘কাশ্মীর ও কাশ্মীরি জাতীয়তাবাদ’।

ফারুকের কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত উর্দু কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাত ধরে। সেই গল্প শুনুন কবি ফারুক নাজকির মুখ থেকেই। তিনি বলেন, একদিন মুরাদাবাদী আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। একটি ডায়েরিতে দুই লাইনের কবিতা লিখে আমাকে বললেন, ‘ফারুক, তুমি যদি এই কবিতার অন্ত্যমিলের সঙ্গে মিল রেখে আরেকটি পঙ্‌ক্তি বলতে পারো, তবে আমি এই ডায়েরি তোমাকে অটোগ্রাফ হিসেবে দিয়ে দেব।’ কবিতার শেষে ‘দিওয়ানা’ শব্দ ছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি ‘পরোয়ানা’ অন্ত্যমিল দিয়ে একটি পঙ্‌ক্তি বলে দিই এবং মুরাদাবাদী বেশ খুশি হন। এর পর থেকে আমি কবিতা লেখায় আগ্রহী হই এবং প্রথম যে লাইনগুলো লিখি তা এ রকম—

‘রাজনীতিকেরা রাজনীতিই বোঝে
ভালোবাসায় রাজনীতি চলে না
তোমাকে দেখে সকলেই ‘বলছে—
এ ছবি নয় খোদা, জাদু, জাদু!’

কবি ফারুক নাজকির শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত ঝিলম নদীনাজকিদের শ্রীনগরের বাড়িটি ছিল কলেজের হোস্টেলের মতো। সহোদর সাত ভাই ছাড়াও সেখানে থেকে পড়াশোনা করত চাচাতো-মামাতো ভাইয়েরাও। ফলে একই ছাদের নিচে রাতদিন আলোচনা চলত জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি, ভেটেরিনারি সায়েন্স, আইন—কী ছিল না তাদের পড়ার বিষয়সূচিতে। জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার মেলা বসত সেখানে। ফলে সেই বাড়ির সকলেই আজ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছেন। আবার অনেকে জীবনের ইতিও টেনেছেন। নাজকি পরিবার থেকেই এসেছেন তিনজন বিখ্যাত কবি। ফারুক নাজকি, ইকবাল নাজকি ও আয়াজ রসুল নাজকি।

ফারুক নাজকি খুব অল্প বয়সে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করেন। তরুণ চঞ্চল দুরন্ত নাজকির স্বপ্ন ছিল অভিনেতা কিংবা শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু এক জীবনে তাঁর এই দুটি স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। বরং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিজের ক্যারিয়ার গড়েন এবং কবি হিসেবে সর্বমহলে বরণীয় হয়ে ওঠেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শুরু করেন সাংবাদিকতা। কাশ্মীরের প্রথিতযশা দুই সাংবাদিক কাজি সানাউল্লাহ বাট ও মুহাম্মদ শফির কাছে হাতে-কলমে শেখেন সাংবাদিকতার পাঠ।

এর পর ১৯৬০ সালে, মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজেই একটি পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নেন এবং কাশ্মিরজুড়ে মোটামুটি হইচই ফেলে দেন। ‘ডেইলি মজদুর’ নামের সেই পত্রিকার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কাশ্মীর উপত্যকার শ্রমিক-মজুর-মেহনতি মানুষের জীবন অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরা। জম্মু-কাশ্মীরে এমন পত্রিকার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ নতুন। ফলে গণমানুষের মাঝে তা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এক বছরের মাথায় সরকারের রোষানলে পড়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।

পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আমাদের অর্জন অনেক

সম্পাদকীয়
আমাদের অর্জন অনেক

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।

এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।

সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এবার অক্সফোর্ডের বর্ষসেরা শব্দ ‘রেজ বেইট’—এর অর্থ কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ০৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।

অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।

‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।

শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।

গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।

এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।

শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রাষ্ট্রীয় সংস্কার করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।

প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা

১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।

হত্যার নেপথ্যে

১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।

আসল খুনি কে?

লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’

অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।

গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত