Ajker Patrika

ভূস্বর্গের কবি ফারুক নাজকি

ইজাজুল হক
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২২, ১৮: ৫৪
ভূস্বর্গের কবি ফারুক নাজকি

মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর একবার কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে খুব বেশি মুগ্ধ করেছিল। তিনি দুই লাইনের একটি ফারসি স্তবক রচনা করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের সৌন্দর্যের বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেছিলেন—‘গর ফেরদৌস বর রুয়ে জমিন আস্ত/হামিন আস্ত ও হামিন আস্ত ও হামিন আস্ত’ অর্থাৎ, ‘পৃথিবীর বুকে বেহেশত যদি থেকেই থাকে/তবে তা এখানেই, এখানেই এবং এখানেই’। শ্রীনগরের বর্ণিল টিউলিপ বাগান, আলপনা-রঙিন হাউসবোট, ডাল লেকের অদূরের তুষারাবৃত পর্বত, কুলকুল বয়ে চলা ঝিলম আমাদের স্বাগত জানায় কাশ্মীর উপত্যকায়। পেহেলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গ, আরু ভ্যালি, তুরতুক ইত্যাদি জায়গার ছবি দেখলেই ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। দেবদারু কিংবা চিনার গাছের হলুদ পাতার বসন্ত কিংবা আঙুর, আপেল ও নাশপাতির উর্বর বাগান পৃথিবীর সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষদের ছুটিয়ে আনে এখানে। গাধার পিঠে চড়ে, পাহাড়ি ঝিরির স্বচ্ছ জলধারা পেরিয়ে, দল বেঁধে চরে বেড়ানো ভেড়াদের সরিয়ে, সবুজ চাদরে মোড়ানো মাঠ ছাড়িয়ে, সবুজের গাউনপরা উঁচু-উঁচু দেবদারু-চিনারঘেরা এই পাহাড়গুলোর কাছে যাওয়া মানুষের আজন্ম সাধ। চারপাশের উঁচু-উঁচু পাহাড়ের মাঝের আসমানি নেয়ামতে ঠাসা এই উপত্যকায় এসে নিঃসন্দেহে স্বর্গের দেখা পায় মানুষ। যেমন দেখা পেয়েছিলেন সুকান্তও। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘কাশ্মীর’ কবিতায় লিখেন—
 
‘সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই
নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি, 
হঠাৎ জেগে উঠেছে-
সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ। 
দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে
মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে, 
ডেকেছে রৌদ্রকে, 
ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে, 
পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর।’ 
 (ছাড়পত্র/সুকান্ত ভট্টাচার্য) 

সুকান্তের সেই ‘নন্দন-কানন’ এখন আর আগের মতো নেই। স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ভূখণ্ডের অধিকারী কাশ্মীর এখন তিন টুকরো। কাশ্মীরের সব সৌন্দর্য গিলে নিয়েছে এশিয়ার তিন অজগর—পাকিস্তান, ভারত ও চীন। স্বর্গীয় কাশ্মীর পরিণত হয়েছে জ্বলন্ত নরকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যেতে থাকে কাশ্মীরি জাতিসত্তা। পাকশাসকরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকার শর্তে স্বায়ত্তশাসনের মুলো ঝুলিয়ে ‘আজাদ-কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান’-কে সেখানকার অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেন। কাশ্মীরি নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাকি কাশ্মীরকে গিলতে শুরু করে ভারত। সেই গলাধঃকরণের ইতিহাস এখনো থামেনি। সুযোগ পেলেই গিলে নিচ্ছে কাশ্মীরি মানুষের অধিকার, যেন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে না দিয়ে থামবে না তারা। এদিকে ১৯৬২ সালে ভারত থেকে কাশ্মীরের কিছু অংশ কেড়ে নিয়ে ভক্ষণ করতে থাকে চীন, সেটির নাম হয়েছে ‘আকসাই চীন’। 

ফারুক নাজকিতিন নেকড়ের কাড়াকাড়ির পরও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতশাসিত কাশ্মীর শুরু থেকেই নিজেদের স্বকীয়তার জন্য লড়াই করে এসেছে। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান প্রণীত হলে তাতে ‘আর্টিকেল-৩৭০’-এর অধীনে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল কাশ্মীর। তবে সেই কাগুজে মর্যাদা কখনোই ভোগ করতে পারেনি কাশ্মীর। শেষপর্যন্ত কয়েক বছর আগে রাতের আঁধারে তাও কেড়ে নেওয়া হয়। ষাটের দশকের গণভোটের দাবি সত্তরের দশকের শেষে এসেই ব্যর্থ আরাধনায় পরিণত হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীদের ‘ঘড়ির কাঁটা পেছনে ফেরানো যায় না’ জাতীয় মনোভাব কাশ্মীরে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেয়; তাতে ঘি ঢালে পাকিস্তান। শুরু হয় ত্রিমুখী সংকট—যা ভূস্বর্গ কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে অনবরত ম্লান করছে ঝিলম নদীর জলে। 

দুই. 
কাশ্মীরের সাত দশকের এই রক্তক্ষয়ী সময়ের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠেন কবি ফারুক নাজকি—‘ঝিলমতীরের এক দুরন্ত বালক’ শিরোনামে যার প্রথমজীবনের কথা আমরা তুলে এনেছি গত পর্বে। এবার আমরা সেই দুরন্ত বালক কীভাবে কাশ্মীরি সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে বিশাল মহিরুহে পরিণত হন, তা দেখার চেষ্টা করব। 

ডেইলি মজদুরের বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কবি ফারুক নাজকি প্রথমবারের মতো কাশ্মীরে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়। তবে রাজনীতিতে আগ্রহ না থাকায় নাজকি অপেক্ষাকৃত মসৃণ ও সুবিধাজনক পথ—সাহিত্য-সংস্কৃতিকেই বেছে নেন। এসপি কলেজে থাকাকালেই তিনি সাহিত্য সংগঠন ‘বজমে আদব’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সাড়াজাগানো ‘ডেইলি মজদুর’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর একক কাজে আগ্রহ খুঁজে পাননি। বাবা গোলাম রসুল নাজকিও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতো বেশি চিন্তিত ছিলেন না, বরং তিনি সন্তানদের যোগ্যতা দিয়ে পথ বের করে নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ফারুক নাজকি চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। একদিন হুট করে হাজির হন কাশ্মীর কালচারাল অ্যাকাডেমিতে। সেকালে চাকরির বাজার এত প্রতিযোগিতাপূর্ণ ছিল না। কালচারাল অ্যাকাডেমির দায়িত্বশীলরা ফারুকের যোগ্যতা নিয়ে মোটেও সন্দিহান ছিলেন না। তারা ফারুককে তৎক্ষণাৎ অ্যাকাডেমির ‘লিটারেরি অ্যাসিন্ট্যান্ট’ পদে নিয়োগ দিয়ে দেন এবং ‘ডিকশনারি ডিপার্টমেন্ট’-এর একটি ডেস্ক দেখিয়ে দেন। সেখানে বেশ কিছুদিন কাজ করেন ফারুক। 

এরপর তিনি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যোগ দেন। ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর তিনি ভারতের একটি মিডিয়া ডেলিগেশনের সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড সফর করার সুযোগ পান। ফারুকের ক্যারিয়ার গঠনে সেই সফর বড় তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা ইংল্যান্ডের প্রতিটি রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশনে হাজির হই এবং তন্ন তন্ন করে দেখি তাদের সিস্টেম।’ 

ডাল লেকের কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে আসে সূর্যএর কিছুদিন পর ফারুক নাজকি সরকারি ব্যবস্থাপনায় জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজমের ফেলোশিপ লাভ করেন। সেখানে নিজের সাংবাদিকতাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার সুযোগ পান তিনি। নাজকির জার্মানির দিনগুলো বড় মধুর ছিল। তিনি বলেন, ‘জার্মানির জীবন বিলাসী ছিল। সবকিছু খুব সস্তায় পাওয়া যেত। পরিবহন ভাড়া ছিল খুব কম। সপ্তাহান্তে জার্মানির বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতাম। দেশে ফেরার আগে-আগে জার্মানির প্রায় সব স্থান আমার দেখা হয়ে যায়। অবশ্য পড়ালেখাও ভালোভাবেই করি, সহপাঠীদের সবার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করার একটি প্রচেষ্টা আমার ছিল।’ 

এরপর ফারুক নাজকি কাশ্মীরে ফিরে আসেন। কাশ্মীরের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বিশ্বমানে উন্নীত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। রেডিও কাশ্মীরে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শুরু করেন কাশ্মীরের প্রথম টেলিভিশন ‘দূরদর্শন কাশ্মীর’-এর কাজও। মূলত ফারুক নাজকির হাত ধরেই কাশ্মীর টেলিভিশনের জগতে প্রবেশ করে—যেমনটি তাঁর বাবার হাত ধরে কাশ্মীর প্রবেশ করেছিল রেডিও-এর যুগে। 

১৯৮২ সালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ মারা যান। পুত্র ফারুক আবদুল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং বাবার হাতেগড়া রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)-এর সভাপতির পদও অলংকৃত করেন। নাজকি পরিবারের সঙ্গে শেখ পরিবারের আগে থেকেই হৃদ্যতার সম্পর্ক, তারওপর ফারুক নাজকি তখন কাশ্মীরের রেডিও-টেলিভিশনের নেতৃত্ব-পর্যায়ের ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ফলে নতুন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ বন্ধুপ্রতিম কবি ফারুক নাজকিকে তাঁর ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ নিয়োগ দেন। ১৯৮৪ সালে শ্যালক গোলাম মুহাম্মদ শাহ-এর কারসাজিতে ফারুক আবদুল্লাহর সরকারের পতন হলে ফারুক নাজকির ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’-এর পদও চলে যায়। 

১৯৮৬ সালে ফারুক নাজকি ‘দূরদর্শন ও রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর ডাইরেক্টর পদে নিয়োগ পান এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য এই সময়ে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন আসে। ১৯৮৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আবার শপথ নেন ফারুক আবদুল্লাহ। পরের দিনগুলোতে কাশ্মীরের রাজনীতি উত্তাল হয়ে পড়ে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ বাড়তে থাকে। রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো দিল্লি থেকে প্রচারিত হতে থাকে। কাশ্মীরজুড়ে ব্যাপক সংঘাত ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ পদত্যাগ করেন। কাশ্মীরে শুরু হয় কেন্দ্রশাসিত রাজ্যপালের শাসন। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে, কাশ্মীরের অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় ‘পণ্ডিত’দের হত্যা ও দেশান্তর করার ঘটনা ঘটে, যা আজকাল হিন্দুত্ববাদীদের কাছে কাশ্মীরি মুসলমানদের অধিকার হরণের বৈধতার বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ তখন কাশ্মীর শাসন করছিলেন হিন্দু রাজ্যপাল জাগমোহন মালহোত্রা। 

নদী, হ্রদ ও পাহাড়ঘেরা শ্রীনগর বড়ই ঐশ্বর্য্যময়১৯৯৬ সালে ফারুক আবদুল্লাহ আবার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ২০০২ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। এই পুরো সময়জুড়ে কবি ফারুক নাজকি ফের তাঁর ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ হিসেবে যোগ দেন। অন্যদিকে ২০০০ সালে কবি ফারুক নাজকি ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে ‘দূরদর্শন ও রেডিও কাশ্মীর’ অধ্যায়ের ইতি টানেন। ২০১০ সালে ফারুক আবদুল্লাহর ছেলে ওমর আবদুল্লাহ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পিতৃতুল্য কবি ফারুক নাজকিকে আবারও ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ পদে নিয়ে আসেন। কাশ্মীরি জাতিসত্তার কবি ফারুক নাজকি সব সময় শেখ পরিবারকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন। 

সম্প্রতি কাশ্মীরের বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দীর্ঘ জীবনের স্মৃতিচারণ করে কবি ফারুক নাজকি বলেন—

‘কাশ্মীরের ইতিহাসের জীবন্ত প্রত্যক্ষদর্শী আমি। কাশ্মীরি ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে থাকার সুবাদে সব ঘটনাবলি সরাসরি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। রাজনীতি কখনো আমার আগ্রহের জায়গা ছিল না। তাই রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও আমি কখনো রাজনীতিতে জড়াইনি। গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে এই দীর্ঘ ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী আমি। আমাদের চোখের সামনে কত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ আবদুল্লাহর চুক্তি কিংবা রাজিব গান্ধী-ফারুক আবদুল্লাহর আলোচনাসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমি কভার করি। কাশ্মিরিদের ভাগ্য পরিবর্তনে কত ইস্যু সামনে এসেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে কাশ্মীর তার স্বকীয়তা হারায়। একসময়ের ‘রেডিও কাশ্মীর’ এখন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ এবং ‘বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন’ কাশ্মীর এখন তার শেষ মর্যাদাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।’ 

তিন. 
কবি ফারুক নাজকির লেখালেখি ও রচনাকর্মকে তিনি দুভাগে ভাগ করতে পছন্দ করেন। প্রবন্ধ, নাটক, গান ইত্যাদি থেকে তিনি তাঁর কবিতাচর্চাকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখেন। তাঁর দাবি মতে—তিনি সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচে কবিতাচর্চায় ব্রতী হয়েছেন। আগেই বলেছি, শৈশবেই কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাতে তাঁর কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তাঁর বাড়ির কবিতাভরা চমৎকার পরিবেশ এবং কাশ্মীরি কবি-সাহিত্যিকদের নিত্য আনাগোনা তাঁর কবিমানস তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। পরে এসপি কলেজ, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়, কাশ্মীর কালচারাল অ্যাকাডেমির অনন্য পরিবেশ তাঁর কবিতাচর্চাকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করে। দীর্ঘ মিডিয়াজীবন ও রাজনীতিঘনিষ্ঠতা এবং দেশ-বিদেশভ্রমণ তাতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। 

ফারুক নাজকি কবিতায় দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। বাবা গোলাম রসুল নাজকি সুফিধারার সংস্কারক কবি ও ফারুকের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হলেও সচেতনভাবেই তাঁর কাব্যধারা এড়িয়ে যান তিনি। নিজের মতো করে তৈরি করতে চেষ্টা করেন নিজস্ব কাব্যধারা। রোমান্টিকতা, ইতিবাচকতা, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিষয়বস্তু বানিয়ে রচনা করেন আধুনিক কাশ্মীরি কবিতা, উর্দু গজল এবং আধুনিক উর্দু কবিতা। এ ছাড়া বিভিন্ন উর্দু-হিন্দি ক্ল্যাসিক্যাল কবিতার কাশ্মীরি রূপ দাঁড় করান যুগের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই। সব ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। কারণ খুব সচেতনভাবেই তিনি কবিতাচর্চায় নিজের যুগকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। তাই কবিতার প্রশ্নে বরবারই বিরলপ্রজ তিনি; খুব কম কবিতাই লিখেন। তিনি বলেন, ‘কবিতার কোয়ান্টিটি কখনোই আমার মুখ্য ছিল না; বরং আমি কোয়ালিটিই চেয়েছি। কোয়ান্টিটির জন্য আমি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় লেখালেখি করেছি। কবিতা আমার কাছে কবিতাই। এর সঙ্গে অন্য কোনো রচনা তুলনীয় নয়।’ 

কাশ্মীরি ভাষায় রচিত ফারুক নাজকির তিন কাব্যগ্রন্থ—‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’, ‘মেহজাবিন’  ও ‘সাতবরণ’-এর প্রচ্ছদফারুক নাজকির কাশ্মীরি ভাষার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ (কাজালভানাসে আগুন), ‘মেহজাবিন’ (চাঁদমুখ) ও ‘সাতবরণ’ (সাতরঙ)। এসব কাব্যগ্রন্থ কাশ্মীরি বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তাঁর সূক্ষ্মদর্শী, মর্মস্পর্শী ও শ্লেষাত্মক কাব্যধাঁচ কাশ্মীরে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। উর্দু কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘আখেরি খোয়াব সে পেহলে’ (শেষ স্বপ্নের আগে) ও ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ (শব্দে শব্দে বিলাপ)। এই কাব্যগুলোকে এ কালের উর্দু সাহিত্যে অবশ্যপাঠ্য গণ্য করছেন অনেক সাহিত্য সমালোচক। তাঁর হিন্দি রচনার মধ্যে ‘গেয়ি রুতিয়োঁ কে সাথি’ (বিগত রাতের সঙ্গী) ও ‘হ্যান্ডিক্রাফট অব কাশ্মীর’ (কাশ্মীরের হস্তশিল্প) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি অসংখ্য নাটক, গান ও টেলিভিশন প্রোগ্রামের স্ক্রিপ্ট লেখেন। 

১৯৯৫ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ এর জন্য কাশ্মীরি ভাষা ক্যাটাগরিতে ভারতের প্রধান সাহিত্যপুরস্কার ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ পান। আবার ‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ ও ‘লফ্জ লফ্জ নোহা-এর জন্য পান ‘স্টেট কালচারাল অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’। কাশ্মীরি ভাষার রচনাবলির জন্য ‘জম্মু-কাশ্মীর অ্যাকাডেমি অব কালচার, আর্ট অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজেজ বেস্টবুক অ্যাওয়ার্ড’ পান। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবস্থাপনায় অনন্য অবদানের জন্য পান ‘জম্মু-কাশ্মীর সরকারের স্বর্ণপদক’। অর্জনের ঝুলিতে ভরেন ‘বেস্ট মিডিয়া কন্ট্রোলার অ্যাওয়ার্ড’ও। 

চার. 
কাশ্মীরের কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পবোদ্ধারা কবি ফারুক নাজকির অবদানকে দারুণভাবে মূল্যায়ন করেন। কাশ্মীরের সাবেক আইনপ্রণেতা ও রাজনীতিবিদ জিএম ভবন বলেন, ‘ফারুক নাজকি কাশ্মীরি ও উর্দু ভাষার কবি। তিনি নিজেকে উর্দু সাহিত্যের প্রথমসারির কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কবি হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও ডেইলি মজদুর-এর সম্পাদক হিসেবে তাঁর অবদান অনেকের অজানা। তিনিই প্রথমবারের মতো কাশ্মীরের শ্রমিকশ্রেণির গুরুত্বে আলো ফেলেন।’ 

শ্রীনগরের জামে মসজিদকাশ্মীরি চিকিৎসক ও সাহিত্য সমালোচক এ ওয়াহিদ বলেন, ‘…ফারুক নাজকি হতাশার গর্ত খুঁড়ে বের করে আনেন ইতিবাচকতা। তিনি এক অনুপম সাহিত্যিক, সমাজবিদ, কবি ও রাজনীতিবিশ্লেষক। তিনি রোমান্টিক, শতরঙা ও আধুনিক; তবে একই সঙ্গে বিশ্বাসীও। ঐতিহ্য ও রহস্যময়তা সাঙ্গ করে বিশ্বাসের পথে হেঁটে তিনি প্রতিটি ঘটনার কারণ খুঁজে ফেরেন। তাঁর কবিতা মোটেও ধারণা-কল্পনার শব্দবাজি নয়; চারপাশের ঘটনাপরম্পরারই প্রতিফলন ঘটে তাঁর লেখায়।’ 

এ ওয়াহিদ আরও বলেন, ‘কাশ্মীরে কয়েক দশকজুড়ে যে হতাশার রাজত্ব এবং মৃত্যুর নৃত্য তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তা তাঁর হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তবুও তিনি ঠোঁটের কোণে ধরে রাখেন এক চিলতে হাসি। তবে ভেতরটা তাঁর দুমড়ে-মুচড়ে যায় যখন দেখেন—এক তরুণ ক্রসফায়ারের শত বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, এক মা তাঁর সদ্য বিবাহিত ছেলের রক্তমাখা শার্ট পরিষ্কার করছেন। তাঁর কবিতা আমাদের এক সময়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সকলেই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নেয়ামত ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। সেই জাতির এমন ভাঙন দেখে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না। আমাদের মাতৃভূমি কাশ্মীরের অনন্য নিদর্শন সহাবস্থান, শান্তি-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য গভীরভাবে আকুল হন। চারপাশের বিরাজমান অন্ধকার সত্ত্বেও তাঁর কবিতা ইতিবাচকতার প্রদীপ জ্বালায়। অনেক কিছু আমরা হারিয়েছি, তবুও ফারুক নাজকি আশা ছাড়েন না; ছাড়তে পারেন না।’ 

অল ইন্ডিয়া রেডিও শ্রীনগরের সাবেক ডাইরেক্টর ও কবি রফিক রাজ বলেন, ‘ফারুক নাজকি সংবেদনশীল কবি, সৃজনশীল ব্রডকাস্টার এবং দক্ষ অনুবাদক। কাশ্মীরি, উর্দু, হিন্দি ও ফারসি ভাষার সাহিত্য রচনায় সিদ্ধহস্ত। দুটি কারণে তাঁর কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে—প্রথমত স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্যে অনন্যতা, দ্বিতীয়ত তাঁর কল্পনার ব্যতিক্রমী আকাশ।’ 

রফিক রাজ আরও যুক্ত করেন, ‘তিনি শৌখিন কবি। সমসাময়িক পরিস্থিতির সঙ্গে অতীতকে দারুণভাবে যুক্ত করেন। তিনি আমাদের অপূর্ণতাগুলো পূর্ণ করেন। তাঁর পঙ্‌ক্তিগুলো যথাযথ এবং সহানুভূতি-জাগানিয়া। আর এটিই তো কবিতার উপাদান।’ 

উর্দু ভাষায় রচিত ফারুক নাজকির কাব্যগ্রন্থ—‘ইয়ে ধোয়াঁ সা কাহাঁ সে উঠতা হ্যায়’, ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ এবং হিন্দি ভাষায় রচিত ‘গেয়ি রুতিয়োঁ কে সাথি’-এর প্রচ্ছদকবি ফারুক নাজকির কবিতা ‘এবং আমি চুপ রইলাম’-এর অনুবাদ দিয়ে এই পর্বের ইতি টানছি—

এবং আমি চুপ রইলাম

আমার হাতে আমার চিতা তৈরি
আমার কাঁধে উঠল আমার লাশ
চোখের পাপড়ি দিয়ে সময়ের খাতায় 
আমারই রক্তে লেখা হলো আমার নাম
এবং আমি চুপ রইলাম। 

আমার বাজার-গলি-ছাদ-দরোজা
সাজানো হলো আমার অনটনে 
আমার চিন্তা আমার শিল্প-সম্বল
আলোকিত হলো আমারই প্রবঞ্চনায়
এবং আমি চুপ রইলাম। 

আমার ভাগ্যের যে স্কেচ আঁকা হয়েছিল
তা লেখা হলো হলদে মৌসুমের পাতায় 
আমার ছবি রাখা হলো আমার আড়ালে
আমাকে দেখা গেলো অদেখা কত স্বপ্নে
এবং আমি চুপ রইলাম। 

মর্ম-কৃপাণ-আঘাতে আমার শব্দ 
দ্বিখণ্ডিত হয়ে গোঙাতে থাকল
ভিখিরির হাতে বণ্টিত আমার গান 
জনপ্রিয়তা পেয়ে গোঙাতে থাকল
এবং আমি চুপ রইলাম। 

হাত থেকে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিনিয়ে নিয়ে
বসন্তবরণ উৎসব করলো হলদে মৌসুম
তুষারপাত হলো আমার কুঁড়েঘরে এসে
রোদ বেরিয়ে ঘরটিকে করল ভীতসন্ত্রস্ত
এবং আমি চুপ রইলাম। 

আমার সবুজ মাঠ বিরান করা হলো
আমার হ্রদে পোষা হলো শত অজগর
মারান পর্বতের পবিত্রতা লুণ্ঠিত হলো
সাজানো হলো অনুভূতিহীনতার কবর
এবং আমি চুপ রইলাম। 

(লফ্জ লফজ নোহা/ফারুক নাজকি

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
রমনা কালীবাড়ি বধ্যভূমি

বর্তমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত রমনা কালী মন্দির ও আনন্দময়ীর আশ্রম। এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল। কথিত আছে, শংকরাচার্যের অনুগামী দর্শনার্থী সম্প্রদায় এ কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। প্রায় ৫০০ বছর আগে বদ্রী নারায়ণের যোশী মঠের সন্ন্যাসী গোপাল গিরি ঢাকায় এসে রমনায় প্রথমে একটি আখড়া স্থাপন করেন। তখন এ আখড়াটি কাঠঘর নামে পরিচিত ছিল।

পরে সম্ভবত ১৭ শতকের প্রথম দিকে এ স্থানেই হরিচরণ গিরি মূল মন্দিরটি নির্মাণ করেন। কালীবাড়ি মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়। তারা মন্দির ও আশ্রমটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মন্দিরের সেবায়েতসহ প্রায় ১০০ সন্ন্যাসী, ভক্ত এবং সেখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষ নিহত হন। যদিও এখন বধ্যভূমির কোনো চিহ্ন নেই। তবে সেটাকে বধ্যভূমি হিসেবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছবি: সংগৃহীত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আমাদের অর্জন অনেক

সম্পাদকীয়
আমাদের অর্জন অনেক

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।

এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।

সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এবার অক্সফোর্ডের বর্ষসেরা শব্দ ‘রেজ বেইট’—এর অর্থ কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ০৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।

অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।

‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।

শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।

গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।

এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।

শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রাষ্ট্রীয় সংস্কার করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।

প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা

১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।

হত্যার নেপথ্যে

১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।

আসল খুনি কে?

লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’

অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।

গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত