Ajker Patrika

২২ শ্রাবণ: শ্রাবণধারায় রচিত এক মহাপুরুষের বিদায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

বাংলা বর্ষার দ্বিতীয় মাস শ্রাবণ। বাতাসে আর্দ্রতা, আকাশে ঘনঘোর মেঘ, আর রিমঝিম শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত। এই শ্রাবণেই, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ তারিখ, আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি, বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই থেকে ২২ শ্রাবণ বাঙালির জন্য শুধু এক প্রাকৃতিক ঋতুর উপলব্ধি নয়—এ এক স্মরণ, এক বিষাদ, এক চিরন্তন অভাবের দিন।

রবীন্দ্রনাথকে শুধুই কবি বললে কম বলা হয়। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রবন্ধকার, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক ও চিত্রশিল্পী। বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের নির্যাস যদি কোথাও নিহিত থাকে, তবে তা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মে। আর এই মহাপুরুষের প্রয়াণ হয়েছিল যে দিনে, সেই দিনটি নিজের একটি আবহাওয়া তৈরি করে নিয়েছে বাংলা সাহিত্যে।

অদ্ভুত বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, নাটকে এবং গদ্যে ‘শ্রাবণ’ নিজেই এক চরিত্র হয়ে উঠেছে। তার সৃষ্টি পড়লে বোঝা যায়, শ্রাবণ তাঁর মনে এক গভীর আবেগের ঋতু। এই ঋতু শুধু প্রকৃতির রূপবদল নয়—এ যেন হৃদয়ের এক অন্তঃসলিলা ধারা।

শ্রাবণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আত্মিক যোগাযোগ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর অন্তত ২৪টি গানে সরাসরি শ্রাবণের নাম আছে। পাশাপাশি অসংখ্য গানে ও কবিতায় বৃষ্টি, মেঘ, বাতাস, বেদনা, বিদায়, অভিমান আর স্মৃতির যে সুর বাজে, সেখানে শ্রাবণের আবহমান ব্যাকুলতা লুকিয়ে থাকে।

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে শ্রাবণ বারবার এসেছে এক গভীর রোমান্টিক রূপ নিয়ে। তবে তা কেবল প্রেমের উচ্ছ্বাস নয়, বরং একধরনের অনাগত বিদায়ের রূঢ় বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন: “ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়া তরীর মাঝি/অশ্রুভরা পূরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি। ” এই পঙ্‌ক্তিতে এক বিষণ্ন যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে। বিদায় এখানে প্রত্যক্ষ না হলেও, বাতাসে যেন সেই বেদনার গন্ধ। পঙ্‌ক্তিগুলোর ভেতর দিয়ে একটি হাহাকার ভেসে আসে—প্রিয়জনের কাছ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার এক অমোঘ আকাঙ্ক্ষা।

আবার অন্য এক গানে লিখেছেন: ‘এই শ্রাবণ বেলা বাদল ঝরা/যূথী বনের গন্ধে ভরা। ‘এখানে শ্রাবণ যেন রোমান্টিকতা ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক স্বপ্নজ অনুভূতি। বাতাসে যূথী ফুলের গন্ধ, শ্রাবণের বৃষ্টিধারা আর প্রেমের প্রগাঢ়তা মিলেমিশে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ কখনোই প্রেমকে নিছক আনন্দ বা উল্লাসে আবদ্ধ রাখেননি। তার প্রেমের গান, বিশেষত শ্রাবণ-ভিত্তিক গানে, বেদনা এক অনিবার্য সুর। ‘শ্রাবণ বরিষন পার হয়ে/কী বাণী আসে ঐ রয়ে রয়ে’—এই গানে শ্রাবণ যেন হয়ে ওঠে অজানা বাণীর বাহক। সে কি প্রেমের পরিণতি, না বিচ্ছেদের সান্ত্বনা? এই দ্বিধা, এই প্রশ্নই রবীন্দ্রনাথের শ্রাবণগানকে করে তোলে রহস্যময় ও বহুস্তরবিশিষ্ট।

শ্রাবণের ধারা রবীন্দ্রনাথের গানে শুধুই প্রকৃতির উপমা নয়। তা হয়ে ওঠে প্রতীক্ষার প্রতীক। ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে/ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। ‘এখানে শ্রাবণ যেন বাহ্যিক প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং মনের দোলাচল, জীবনের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার এক অজানা উদ্দীপনা। এই দ্বিধা, এই চেতনা—প্রকৃতি আর মানুষের এক আশ্চর্য সাযুজ্য, যা কেবল রবীন্দ্রনাথের কলমেই সম্ভব। শ্রাবণ এখানে নেমেছে ‘জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার’ দূত হয়ে। বৃষ্টি যেমন ঝরে আর থেমে যায়, মানুষও তেমনি একসময় সব ছেড়ে চলে যায়। ‘গহন রাতে শ্রাবণ ধারা পড়িছে ঝরে’—এই পঙ্‌ক্তির নির্জনতায় যেন মৃত্যুর ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথ বৃষ্টিকে দেখেছেন রূপের শিল্পী হিসেবে। তাঁর গানে শ্রাবণ মানেই কেবল জলধারা নয়, বরং আলো-আঁধারির খেলা, বিদ্যুৎ চমক, অদ্ভুত কল্পনায় মেঘের নাচন। ‘শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়’—এই পঙ্‌ক্তিতে শ্রাবণ যেন রোমাঞ্চকর এক দৃশ্যপট। আরেক গানে তিনি বলেন: ‘পথিক মেঘের দল জোটে ওই শ্রাবণ গগন অঙ্গনে। ‘মেঘ এখানে শুধু প্রকৃতির উপাদান নয়, বরং এক যাযাবর দলে পরিণত হয়েছে, যাদের কোনো গন্তব্য নেই। যেন মানুষ নিজেই মেঘ হয়ে গেছে, ভেসে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশে।

১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ, ইংরেজি ৭ আগস্ট ১৯৪১—এই দিনটিতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আশ্চর্য এই যে, যাঁর কবিতায়, গানে, গদ্যে শ্রাবণ এসেছে বিচ্ছেদ, প্রত্যাশা, বিষাদ ও আলোড়নের প্রতীক হয়ে—শেষ পর্যন্ত তিনিই যেন নিজেকে সেই শ্রাবণের মাঝেই বিলীন করলেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থতা, দেশ বিভাজনের আশঙ্কা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে চরম বিষাদে নিমজ্জিত ছিলেন। তাঁর শেষ দিককার কবিতাগুলোতে আমরা সেই বিষণ্নতা অনুভব করি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি লিখেছিলেন: ‘মৃত্যুরে করিতে পারি অহো রে জয়/জয়িনী তোরে নয়/মৃত্যুরে আমি করেছি অমৃতস্য সন্তান। ‘এই উক্তির মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস, তা যেন বৃষ্টির মধ্যেও রোদ উঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২২ শ্রাবণ তাই শুধুই অন্তিম নয়, তা আশ্বাসেরও দিন।

প্রতি বছর ২২ শ্রাবণ এলে বাঙালির হৃদয়ে কেবল শোক নয়, একধরনের আধ্যাত্মিক কম্পন জেগে ওঠে। আমরা যেন এই দিনটিতে একটু বেশি রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, তাঁর গান শুনি, কবিতা পড়ি, একটু শান্ত হয়ে যাই। এই দিনে অনেকে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কখনো মরেননি। ‘কথাটি আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক দিক থেকে একেবারে সত্য। তিনি আজও আমাদের গান, নাটক, চিত্রকলা, চিন্তা ও চেতনায় জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে বৃষ্টিকে ভালোবাসতে হয়, কীভাবে বিষাদকে মেনে নিতে হয়, কীভাবে প্রেমকে পূর্ণতার মতো ধরতে হয়, আবার মুক্তির মতো ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর শ্রাবণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবন অনিশ্চিত, তবু তা সুন্দর। বেদনার মধ্যেই থাকে সৌন্দর্যের আলো। আর এই সৌন্দর্য খোঁজার জন্যই আমরা বারবার ফিরে যাই তাঁর গানে, কবিতায়, সাহিত্যে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ‘শ্রাবণ’কে রূপ দিয়েছেন এক জীবন্ত রূপকে। বাংলা সাহিত্যে ‘শ্রাবণ’ এখন কেবল একটি ঋতু বা মাস নয়—এ এক অনুভূতি, এক ভাষা, এক চেতনা। ২২ শ্রাবণ তাই আমাদের জন্য এক দ্বৈততার দিন—বিষাদের এবং ভালোবাসার, অভাবের এবং প্রাপ্তির, মৃত্যুর এবং অমরতার। এই দিনটিতে আমরা কেবল একটি মানুষকে স্মরণ করি না; আমরা স্মরণ করি একটি ভাবধারা, একটি কাব্যিক দর্শন, একটি জাতির আত্মপরিচয়।

এই লেখা শেষ করি রবীন্দ্রনাথের এক শ্রাবণঘন গান দিয়ে: ‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবণ ধারা/অন্ধ বিভাবরী সঙ্গপরশ হারা। ‘কিন্তু আমরা জানি—এই অন্ধকার বিভাবরীতেও রবীন্দ্রনাথ আছেন। তিনি সঙ্গ পরশ হীন হননি। তিনি বরং আমাদের হৃদয়ে শ্রাবণ হয়ে ঝরে পড়ছেন, চিরকাল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আমাদের অর্জন অনেক

সম্পাদকীয়
আমাদের অর্জন অনেক

...এটা অনস্বীকার্য যে আমরা বিজয়ী। আমরা জয়ী আর শোষকেরা পরাজিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন সামনে রেখেই, তাঁদের ত্যাগকে স্বীকার করেই আমরা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলেছিলাম, ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তারা তাদের সরকার নির্ধারণ করবে।

এগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে মনে করি না। কিন্তু বর্তমানে এটা কী হচ্ছে? যদি বলি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তাহলে সেই না এগোনোর কারণটা কী, তা নিয়ে কেন অর্থপূর্ণ আলোচনা হচ্ছে না? আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন আকারেই উত্থাপন করছি। আমাদের অর্জন অনেক। আজ আমাদের গার্মেন্টসশিল্প বিশ্বে তৃতীয়। আমরা খুব দ্রুত দ্বিতীয় বা প্রথমের কাতারে চলে যাব। আমাদের লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। প্রতিবছর কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু এসবের পরেও কী হচ্ছে? বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

... পাকিস্তানিদের কথা আর কী বলব! আক্ষরিক অর্থেই তারা তখন আমাদের পা ধরেছিল। ‘তোমরা এদের ছেড়ে দাও, আমরা নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচার করব।’ ১৯৫ জনকে আমরা চিহ্নিত করি তখন। বঙ্গবন্ধু তখন রাশিয়াতে ছিলেন, তারা সেখানে বঙ্গবন্ধুর কাছে লোক পাঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেছে, ‘আপনারা যদি এ বিচার করেন তাহলে ভুট্টোর কল্লা থাকবে না। আমাদের কাছে ফেরত দিন, আমরা এদের বিচার করব।’ এটা সে সময় ‘লন্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। একেবারে তারা আন্ডারটেকিং দিয়েছে, ‘ছেড়ে দিন, আমরা বিচার করব। আর কোনো সাক্ষী লাগলে তোমাদের ডেকে পাঠানো হবে।’ শিল্পকলা একাডেমির যে বিল্ডিং ভেঙে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়েছে, ওই বিল্ডিংয়ে ভর্তি ছিল স্টেটমেন্টগুলো। এগুলো কী হয়েছে, কে গুম করেছে, আমি জানি না। এর মধ্যে অনেক সরকার এসেছে, গেছে। তবে আমরা খুব পরিশ্রম করেই এগুলো সংগ্রহ করেছিলাম।

সূত্র: শারমিনুর নাহার কর্তৃক ড. কামাল হোসেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ; ‘সময় সমাজ ও রাজনীতির ভাষ্য’, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এবার অক্সফোর্ডের বর্ষসেরা শব্দ ‘রেজ বেইট’—এর অর্থ কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ০৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ইন্টারনেটে স্ক্রল করতে করতে এমন কিছু কনটেন্ট হঠাৎই চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয়—ইচ্ছে করেই আপনাকে রাগীয়ে তুলতে চাইছে! এই ধরনের প্ররোচনামূলক উপাদানকেই বলা হয় ‘রেজ বেইট’। অনলাইন দুনিয়ায় এর ব্যাপক বিস্তার ও প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০২৫ সালের ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে এই শব্দটিকেই বেছে নিয়েছে।

অক্সফোর্ড জানিয়েছে, চলতি বছর ‘রেজ বেইট’ শব্দের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, মানুষ এখন আগের চেয়ে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম প্রভাবিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ও মুহূর্তের মধ্যে রাগ, ক্ষোভ ও বিভাজন তৈরি করছে—যা মূলত এনগেজমেন্ট বাড়ানোর কৌশল।

‘রেজ বেইট’ সব সময় যে বিপজ্জনক হবে, এমন নয়। কখনো এটি হতে পারে অদ্ভুত কোনো রেসিপি বা এমন ভিডিও যেখানে কেউ নিজের পোষা প্রাণী বা পরিবারের সদস্যকে মজার ছলে বিরক্ত করছে। তবে রাজনীতি ও জনপরিসরেও এখন এটি শক্তিশালী হাতিয়ার। কারণ প্ররোচিত ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ার ঢেউ অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রচারণাকে আরও উসকে দেয়।

শুধু অক্সফোর্ড নয়, প্রায় সব বড় অভিধানই এবার ইন্টারনেট-সম্পর্কিত শব্দকেই ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। এবার কলিন্স ডিকশনারির বেছে নেওয়া শব্দটি হলো ‘ভয়েস কোডিং’। যেখানে এআই ব্যবহার করে মানুষের ভাষাকে কম্পিউটার কোডে রূপান্তর করা হয়। অন্যদিকে ক্যামব্রিজ ডিকশনারি বেছে নিয়েছে ‘প্যারাসোশ্যাল’ শব্দটি, যা অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে গড়ে ওঠা একতরফা সম্পর্ককে নির্দেশ করে।

গত বছর (২০২৪) অক্সফোর্ড বেছে নিয়েছিল ‘ব্রেইন রট’ শব্দটি, যা ছিল মূলত অবিরাম স্ক্রলিংয়ে মানসিক ক্লান্তির রূপকার্থ। অক্সফোর্ড ল্যাংগুয়েজেসের প্রেসিডেন্ট ক্যাসপার গ্র্যাথওহলের মতে, ‘রেজ বেইট’ এবং ‘ব্রেন রট’—দুটি শব্দই দেখায় কীভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আমাদের চিন্তা ও আচরণকে বদলে দিচ্ছে। একটি প্ররোচিত রাগ বাড়ায়, অন্যটি সেই রাগের মধ্যেই মানুষকে আবিষ্ট রাখে।

এ বছর অক্সফোর্ড সাধারণ মানুষের ভোটে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচন করেছে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল আরও দুটি শব্দ—‘অরা ফার্মিং’ ও ‘বায়োহ্যাক’। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তৈরি করার কৌশলকে বোঝাতে ‘অরা ফার্মিং’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বাড়াতে জীবনযাপনে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘বায়োহ্যাক’।

শেষ পর্যন্ত ‘রেজ বেইট’ শব্দটিই জিতেছে—যে শব্দের মধ্য দিয়ে আজকের অনলাইন জীবনের রাগ, প্রতিক্রিয়া এবং ক্লান্তির বাস্তবতা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

রাষ্ট্রীয় সংস্কার করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেমস গারফিল্ড। ছবি: ব্রিটানিকা

উনিশ শতকের শেষভাগে মার্কিন ইতিহাসে এক ট্র্যাজিক অধ্যায় রচনা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জেমস এ. গারফিল্ড। ১৮৮১ সালের মার্চ মাসে শপথ গ্রহণের মাত্র চার মাসের মাথায় তিনি আততায়ীর গুলিতে আহত হন। পরবর্তীকালে চিকিৎসকের চরম অবহেলা ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে সেপসিসে (সংক্রমণ) ভুগে মারা যান। সেই মর্মান্তিক ঘটনা, গারফিল্ডের জীবন ও তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে এবার নেটফ্লিক্স-এ আসছে চার পর্বের ড্রামা সিরিজ, ‘ডেথ বাই লাইটনিং’।

প্রেসিডেন্টের উত্থান ও প্রগতিশীল এজেন্ডা

১৮৮০ সালে আমেরিকা এক কঠিন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য দাসপ্রথা বিলুপ্তির পর আফ্রিকান-আমেরিকানরা কি নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার পাবেন? নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সরকারি চাকরি বণ্টনের সেই দীর্ঘদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত ‘পচে যাওয়ার ব্যবস্থা’ অব্যাহত থাকবে? রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে ওহাইও-এর জনপ্রিয় কংগ্রেসম্যান জেমস গারফিল্ড এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আহ্বান জানান। দারিদ্র্য থেকে উঠে আসা, গৃহযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব দেখানো এই কমান্ডার নভেম্বরে দেশের ২০ তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে গারফিল্ড উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নিয়ে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল: মার্কিন নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ, লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানো এবং বিশেষত নাগরিক অধিকারের পক্ষে জোরালো সওয়াল করা। তিনি সাবেক ক্রীতদাস ফ্রেডরিক ডগলাসকে ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়ার রেকর্ডার অব ডিডস পদে নিযুক্ত করেন। একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের জন্য প্রথম সারির একটি কেন্দ্রীয় পদ পাওয়ার বিরল ঘটনা ছিল এটি।

হত্যার নেপথ্যে

১৮৮১ সালের ২ জুলাই ওয়াশিংটন ডিসি-র রেলওয়ে স্টেশনে চার্লস এল. গুইটো নামক এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি গারফিল্ডকে গুলি করে। গুইটো তার জীবনকাল ধরে একজন ব্যর্থ আইনজীবী, সাংবাদিক, ধর্মপ্রচারক এবং ফ্রি লাভ কমিউনের সদস্য হিসেবে এক ব্যর্থ অ্যাকটিভিস্ট ছিলেন। তা সত্ত্বেও, তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর তাকে মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য সৃষ্টি করেছেন। গারফিল্ডের মনোনয়নের পর তিনি তাঁর সমর্থনের বিনিময়ে প্যারিসে গুরুত্বপূর্ণ কনস্যুলার পদ দাবি করে হোয়াইট হাউসে ধরনা করতেন। প্রেসিডেন্ট ‘প্যাট্রোনেজ সিস্টেম’-এর ঘোর বিরোধী হওয়ায় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরই গুইটো সিদ্ধান্ত নেন—গারফিল্ডকে হত্যা করে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থারকে ক্ষমতায় আনার ‘ঈশ্বর প্রদত্ত নির্দেশ’ তাঁর ওপর বর্তেছে।

আসল খুনি কে?

লেখক ক্যান্ডিস মিলার্ড তাঁর বেস্ট সেলিং বই ডেসটিনি অব দ্য রিপাবলিক-এ তুলে ধরেছেন, গারফিল্ডের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল চিকিৎসার চরম অব্যবস্থা। ড. উইলফ্রেড ব্লিস নামক দাম্ভিক চিকিৎসক গারফিল্ডের চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টার কর্তৃক প্রবর্তিত আধুনিক অ্যান্টিসেপটিক পদ্ধতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন। ব্লিস জীবাণুমুক্ত নয় এমন যন্ত্র এবং খালি হাত ব্যবহার করে প্রেসিডেন্টের মেরুদণ্ডের কাছে থাকা গুলিটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। এর ফলে সংক্রমণ (সেপসিস) ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, গুলি খুঁজতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত প্রারম্ভিক মেটাল ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু ব্লিসের অসহযোগিতার কারণে সেটিও ব্যর্থ হয়। শট নেওয়ার প্রায় আশি দিন পর প্রেসিডেন্ট মারা যান এবং এই মৃত্যুর সম্পূর্ণ দায় ড. ব্লিসের ওপর বর্তায়।

রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরও গারফিল্ডকে নিউইয়র্কের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটর রোসকো কনকলিং-এর বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কনকলিং প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক ছিলেন এবং গারফিল্ডের প্রগতিশীল ভাবধারা পছন্দ করতেন না। মাকোভস্কি বিবিসিকে জানান, এই সিরিজের মূল আকর্ষণ হলো ইতিহাসের সেই ‘যদি’ প্রশ্নটি—যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি হয়তো আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন। মাকোভস্কির মতে, ‘গারফিল্ডের অসাধারণ মেধা ছিল। তাঁকে যে আজ ইতিহাসে একটি অস্পষ্ট পাদটীকা হিসেবে স্থান দেওয়া হয়, তা এক ট্র্যাজেডি।’

অভিনেতা মাইকেল শ্যানন গারফিল্ডের ‘ঐশ্বর্য ও মর্যাদা, বিশেষ করে তাঁর শালীনতা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন বলে মন্তব্য করেছেন লেখক মিলার্ড।

গারফিল্ডের উত্তরাধিকার ও আইন সংস্কার

মাত্র ৪৯ বছর বয়সে গারফিল্ডের মৃত্যু পুরো জাতিকে নাড়িয়ে দেয় এবং দেশজুড়ে সরকারি চাকরি সংস্কারের দাবি জোরালো হয়। জনগণের ক্ষোভের কারণেই ভাইস প্রেসিডেন্ট চেস্টার এ. আর্থার, যিনি একসময় প্যাট্রোনেজ সিস্টেমের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনিই ১৮৮৩ সালে ‘পেন্ডলটন অ্যাক্ট’-এ স্বাক্ষর করেন। এই আইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে ‘যোগ্যতা-ভিত্তিক’ নিয়োগের নীতি শুরু হয়, যা মার্কিন সরকারি আমলাতন্ত্রের পেশাদারি নিশ্চিত করার পথ দেখায়। এইভাবে, এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড আমেরিকার শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে এক স্থায়ী প্রগতিশীল পরিবর্তন এনে দেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জল্লাদখানা বধ্যভূমি

সম্পাদকীয়
জল্লাদখানা বধ্যভূমি

ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লকের বধ্যভূমিটি ‘জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, রাজাকার, আলবদর ও বিহারিরা এখানে বাঙালিদের ধরে এনে হত্যা করত। মিরপুর খালের পাশে এক নির্জন এলাকায় দুটি পয়োনিষ্কাশন ট্যাংকের ওপর ছিল একটি পরিত্যক্ত পাম্পহাউস। ঘাতকেরা এ জায়গাকে বেছে নিয়েছিল বধ্যভূমি হিসেবে।

স্বাধীনতার পরপরই এই বধ্যভূমির সন্ধান যখন পাওয়া যায়, তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে অসংখ্য বাঙালির কঙ্কাল দেখতে পান। স্থানীয় জনগণ জল্লাদখানার পাশে সে কঙ্কালগুলো দাফন করেন। এ পাম্পহাউসের ভেতরে উঁচু এক বেদিতে লেখা ছিল ‘জল্লাদখানা’। এখানে অনেক বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিল।

তথ্য: সংগ্রামের নোটবুক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত