Ajker Patrika

সম্রাট শাহজাহান কি তাজমহলের কারিগরদের হাত কেটে দিয়েছিলেন

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫: ০৩
সম্রাট শাহজাহান কি তাজমহলের কারিগরদের হাত কেটে দিয়েছিলেন

মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল। তাঁর নির্দেশেই প্রয়াত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতিতে এই সৌধ নির্মিত হয়। দীর্ঘ ২২ বছরে ২০ হাজার শ্রমিক ও কারিগর মিলে ১৬৫৩ সালে তাজমহল নির্মাণকাজ শেষ করেন। এটাকে অতুলনীয় রাখতে অর্থাৎ একই ধরনের সৌধ নির্মাণ যাতে হয়, সে জন্য ওই কারিগরদের হাত বা হাতের আঙুল কেটে দেওয়া হয়—এমন একটি দাবি বহুল প্রচারিত।

ভারতীয় গণমাধ্যম তো বটেই, ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানেও তাজমহলের কারিগরদের হাত বা হাতের আঙুল কেটে দেওয়ার জনশ্রুতির উল্লেখ আছে। ২০০৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তাজমহলের ৩৫০ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়।

২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাশী বিশ্বনাথ মন্দির উদ্বোধন করতে গিয়ে একই অনুষ্ঠানে মন্দিরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় নিয়োজিত কর্মীদের গায়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে সম্মান জানান। অনুষ্ঠানটি প্রচারের সময়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটটিনের উপস্থাপক আমিশ দেবগন বলেন, ‘মন্দিরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দিয়েছেন মোদি, আর শাহজাহান তাজমহল নির্মাতাদের হাত কেটে দিয়েছিলেন।’

আসলেই কি সম্রাট শাহজাহান তাজমহল শ্রমিক ও কারিগরদের হাতের আঙুল কেটে দিয়েছিলেন? এ দাবির পক্ষে ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণ আছে? 

সম্রাট শাহজাহানের তাজমহল শ্রমিকদের আঙুল কেটে ফেলার দাবির সত্যতা কি১৯৭১ সালে ভারতের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত জার্নাল অব হিস্ট্রিকাল রিসার্চের ১৪তম সংস্করণে ‘তাজমহল শ্রমিক ও কারিগরদের হাতের আঙুল কেটে ফেলার’ দাবিটিকে ‘শহুরে কিংবদন্তি বা রূপকথা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাজমহলের ভ্রমণবিষয়ক ওয়েবসাইট ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়াতে তিনটি যুক্তির ওপর দাবিটিকে প্রচলিত ভুল হিসেবে প্রমাণ করা হয়। 

প্রথমত, এত বিশালসংখ্যক মানুষের আঙুল কেটে ফেলা হলে তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থাকত। কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত, তাজমহল নির্মাণের সমসাময়িক কোনো বই বা সে সময়ে ভারতে ভ্রমণ করা বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকেও এমন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তৃতীয়ত, সম্রাট শাহজাহানের সময়কালকে মুঘল নির্মাণশৈলীর ‘সুবর্ণ সময়’ বলা হয়। তাঁর শাসনামলেই একের পর এক নির্মাণকাজ হয়েছে। তিনি কেবল তাজমহলই নয়, আগ্রায় মতি মসজিদ, দিল্লিতে লাল কেল্লা ও জামে মসজিদও নির্মাণ করেন; শাহজাহানাবাদ নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। আঙুল বা হাত কাটার মতো নৃশংসতা হলে একই ধরনের নির্মাণশৈলীর আরও স্থাপনার জন্য শ্রমিক পাওয়া কঠিন হতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং এসব শ্রমিকের জন্য তাজমহলের কাছে (যা এখন তাজগঞ্জ নামে পরিচিত) বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান।

দাবিটির সূত্রপাত তাহলে কোথায়? এ নিয়ে ওয়েবসাইটটি জানায়, বাস্তবে সম্রাট শাহজাহান তাজমহল শ্রমিক ও কারিগরদের সঙ্গে একটি নৈতিক চুক্তি করেছিলেন। এর আওতায় শ্রমিকেরা অন্য কোনো সম্রাটের অধীনে কাজ করার সুযোগ হারান। সেখান থেকেই ‘শ্রমিকদের হাত কেটে ফেলার’ প্রবাদ জনশ্রুত হয়। 

ঐতিহাসিকভাবে তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে খুদ্দাম ই রোজা কমিটি। এ কমিটির চেয়ারম্যান হাজি তাহের উদ্দিন তাহারের বক্তব্যের সঙ্গেও এ তথ্যের মিল পাওয়া যায়।  

২০১৭ সালে ভারতের এক সংবাদমাধ্যম পত্রিকাকে তিনি বলেন, সম্রাট শাহজাহানের হাত কেটে ফেলার দাবিটি পুরোপুরি মিথ্যা। আসলে শ্রমিকদের সঙ্গে শাহজাহানের একটা চুক্তি হয়েছিল। এই চুক্তির অধীনে তিনি শ্রমিকদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, তাঁরা আর কোথাও তাজমহল নির্মাণ করবেন না। এরপর যখনই কেউ ওই শ্রমিকদের তাজমহল তৈরির কথা জিজ্ঞেস করতেন, তাঁরা বলতেন যে ‘আমাদের হাত কেটে ফেলা হয়েছে’। তার পর থেকে এটি সত্য দাবি করে প্রচলিত হয়ে গেছে। চুক্তিটি ‘অ্যাগ্রিমেন্ট হ্যান্ডকাট’ নামে পরিচিত।

তিনি বলেন, প্রায় পৌনে ৪০০ বছরের ইতিহাসে ওই শ্রমিকদের কারও হাত কাটা হয়েছে—এমন কোনো দাবি প্রজন্মান্তরের কোনো পর্যায়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন কিছু হলে বংশ পরম্পরায় কারও না কারও কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যেত। শাহজাহানামা, আকবরনামা এবং দ্য গ্রেট মুঘল বইগুলোতে অ্যাগ্রিমেন্ট হ্যান্ডকাট সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। 

তাজমহলের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও এ দাবির পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

শ্রমিকদের হাত কেটে ফেলার বিষয়ে ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান অল্ট নিউজকে বলেন, ‘এটি বিখ্যাত শহুরে কিংবদন্তি। এ দাবি সমর্থন করার পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই বা কোনো বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসবিদ এই দাবি করেননি। প্রসঙ্গত বলতে পারি, এই শহুরে কিংবদন্তির জন্ম সেই ষাটের দশকে। লোকমুখে এ কাহিনি শুনেছিলাম আমি।’

মুঘল সম্রাট আকবরের জীবনের ওপর লেখা ‘আল্লাহু আকবর: আউটস্ট্যান্ডিং দ্য গ্রেট মুঘল ইন টুডেস ইন্ডিয়া’র লেখক ও সাংবাদিক মনিমুগ্ধ এস শর্মা ২০১৭ সালে ভারতের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ‘বাস্টিং দ্য তাজ ফেক নিউজ’ শিরোনামে প্রতিবেদন লেখেন। 

সেখানে তিনি বলেন, তাজমহল নিয়ে আগ্রার স্থানীয় গাইড, অনেক ডানপন্থী ওয়েবসাইটে জনপ্রিয় গল্পের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাতে দাবি করা হয়, তাজমহল নির্মাণ শেষে নেতৃস্থানীয় রাজমিস্ত্রিদের হাত কেটে নিতে সৈন্যদের নির্দেশ দেন শাহজাহান। যেন তাঁরা পরে কখনোই এই অবকাঠামো নকল করতে না পারেন। 

এ দাবিকে বিদ্যমান তথ্য-প্রমাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে তুলে ধরে করে তিনি বলেন, ‘তাজগঞ্জ নামে বিশাল বসতিটির অস্তিত্ব আজও আছে। রাজ্যের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাজমহল নির্মাণে অংশ নেওয়া হাজারো রাজমিস্ত্রি, কারিগর ও অন্য শ্রমিকদের জন্য সম্রাট শাহজাহানই বসতিটি গড়ে তুলেছিলেন। ওই শ্রমিকদের বংশধররা আজও সেখানে বাস করেন এবং তাঁদের পূর্বপুরুষদের শিখিয়ে যাওয়া কাজ করছেন। 

আরও একটি বিষয় হলো তাজমহল নির্মাণের পরপরই শাহজাহানের জন্য দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নামে নতুন সাম্রাজ্য শহর নির্মাণ করেন এই শ্রমিকেরা। তা নাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক রাজমিস্ত্রি ও কারিগরের দল খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব।

সম্রাট শাহজাহানের শ্রমিকদের হাত কেটে ফেলার প্রচলিত দাবিটির ওপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালে আমেরিকান নাট্যকার রাজিব জোসেফ গার্ডস অ্যাট দ্য তাজ নামে মঞ্চনাটক নির্মাণ করেন। 

এ নাটকের পর্যালোচনা করে পাকিস্তানের কলাম লেখক ইরফান হোসাইন ডন পত্রিকায় সে সময় একটি কলাম লেখেন। সেখানে পুরো বিষয়টিকে জনপ্রিয় রূপকথা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্রাট শাহজাহান বা তাজমহল নির্মাণের সমসাময়িককালের কেউ এ দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেনি। 

সিদ্ধান্ত 
তাজমহল সতেরো শতকে সম্রাট শাহজাহানের তৈরি অনন্য সৃষ্টি। এই তাজমহল ঘিরে প্রচলিত অনেক বিশ্বাসের মধ্যে অন্যতম হলো—তাজমহলের মতো দ্বিতীয় আর কোনো স্থাপনা শ্রমিক-কারিগরেরা যাতে নির্মাণ করতে না পারেন, সে জন্য তাঁদের হাত কেটে দিয়েছিলেন সম্রাট। তবে প্রচলিত এ বিশ্বাসের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই; কেবল লোকমুখেই প্রচার হয়ে আসছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আজকের পত্রিকার নামে ছড়িয়ে পড়া এই ফটোকার্ডটি ভুয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৯: ২১
আজকের পত্রিকার নামে ছড়িয়ে পড়া এই ফটোকার্ডটি ভুয়া

সম্প্রতি আজকের পত্রিকার নাম ও ফটোকার্ড ব্যবহার করে ‘হরেকৃষ্ণ হরিবোল, দাঁড়িপাল্লা টেনে তোলঃ পরওয়ার’ শিরোনামে একটি ভুয়া ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুয়া ফটোকার্ড।

আজকের পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করছে, এই ধরনের কোনো খবর আজকের পত্রিকাতে কখনোই প্রকাশিত হয়নি। ফটোকার্ডটিতে আজকের পত্রিকার লোগো ব্যবহার করা হলেও এর ভেতরের খবর ও শিরোনাম সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।

আজকের পত্রিকা সর্বদা সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

বর্তমান সময়ে এ ধরনের ভুয়া ফটোকার্ড ও খবর নিয়ে পাঠকদের সচেতনতা জরুরি। যেকোনো সন্দেহজনক খবর যাচাই করার জন্য অনুরোধ রইল।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মধ্যরাতে মাঝরাস্তায় বাঘকে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে মাতাল—ভাইরাল ভিডিওটি ফেক

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ৫৪
মধ্যরাতে মাঝরাস্তায় বাঘকে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে মাতাল—ভাইরাল ভিডিওটি ফেক

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি ভাইরাল একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রাতে রাস্তার মাঝখানে এক মধ্যবয়সী ব্যক্তি এক হাতে একটি স্বচ্ছ বোতল, অপর হাতে বাঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি বাঘটির মুখে বোতল গুঁজে দিতেও দেখা যায় তাঁকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এই ভিডিও শেয়ার করে দাবি করছেন, একটি সিসিটিভি ফুটেজ। ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ঘটনাটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ এলাকার। ওই ব্যক্তি দেশীয় মদ পান করে মাতাল হয়ে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। তিনি এতটা মাতাল ছিলেন যে বাঘকেও মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। বাঘ অবশ্য তাঁর হাতে মদ্যপানে রাজি হয়নি! পরে ওই বাঘটিকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। বাঘটি ওই ব্যক্তির কোনো ক্ষতি করেনি।

বাঘকে বোতল থেকে মদ খাওয়ার দাবি করা ভিডিওর ক্যাপশন, যেখান থেকেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: সংগৃহীত
বাঘকে বোতল থেকে মদ খাওয়ার দাবি করা ভিডিওর ক্যাপশন, যেখান থেকেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: সংগৃহীত

ভিডিওটি দেখে অনেকেই বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন—কেউ বিশ্বাস করেছেন, এটি বাস্তব কোনো ঘটনা; কেউ আবার মনে করছেন, এটি নিছকই কৃত্রিম ভিডিও। কিন্তু সত্যিটা কী? দ্য কুইন্টের সাংবাদিক অভিষেক আনন্দ ও ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা বুম বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করেছে।

বুম ভিডিওটি নিয়ে বিভিন্ন কিওয়ার্ড দিয়ে এ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন অনুসন্ধান করেছে, কিন্তু কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে এমন ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এরপর তারা সরাসরি মধ্যপ্রদেশের সেওনি জেলার পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করে। দ্য কুইন্ট ও বুমকে সেওনি জেলার পুলিশ সুপারের দপ্তর থেকে স্পষ্ট জানানো হয়—তাদের জানামতে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।

পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের উপপরিচালক রাজনীশ সিংহের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি যাচাই করা হয়। তিনি বলেন, ভিডিওটির সঙ্গে পেঞ্চ এলাকার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরও ব্যাখ্যা দেন, বনের বাঘের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠভাবে মানুষের যোগাযোগ সম্ভব নয়, যদি না বাঘটিকে বন্দী করে দীর্ঘদিন ধরে পোষ মানানো হয়। তাঁর ভাষায়, ‘বনের বাঘ কখনো এমন আচরণ করে না, এটা বাস্তবে সম্ভব নয়।’

ভিডিওর সন্দেহজনক দিক বা ভিজ্যুয়াল অসংগতি

বুম ভিডিওটির একটি উচ্চমানের সংস্করণ সংগ্রহ করে তাতে কিছু অস্বাভাবিক দিক লক্ষ করে। দেখা যায়, ভিডিওটির পটভূমির দৃশ্যে কিছু অস্পষ্ট বস্তু নড়াচড়া করছে, যা বাস্তব ভিডিওর মতো স্বাভাবিক নয়।

বাঘের মাথায় হাত রাখা ব্যক্তির আঙুলগুলো বিকৃতভাবে বাঁকানো, যেন সফটওয়্যারে তৈরি কৃত্রিম ছায়া। এমনকি হাতে থাকা বোতলের মুখ কখনো দেখা যায়, আবার মিলিয়ে যায়—এই ভিজ্যুয়াল অসংগতিগুলো ইঙ্গিত দেয়, এটি ধারণকৃত কোনো ফুটেজ নয়। সব মিলিয়ে ভিডিওটির একাধিক ফ্রেমে গ্রাফিক বিকৃতি স্পষ্ট।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর বিশ্লেষণ

এরপর ভিডিওটি পরীক্ষা করা হয় ডিপফেক-ও-মিটার নামের একটি উন্নত টুলে। এটি তৈরি করেছে ইউনিভার্সিটি অব বাফেলোর মিডিয়া ফরেনসিকস ল্যাব। এই টুল ভিডিওটির বিভিন্ন অংশ বিশ্লেষণ করে দেখায়, এতে ‘উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নির্মাণের চিহ্ন’ রয়েছে।

এআই টুল দিয়ে ভিডিওটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি হওয়ার প্রমাণ পরীক্ষার ফলাফল। ছবি: সংগৃহীত
এআই টুল দিয়ে ভিডিওটির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি হওয়ার প্রমাণ পরীক্ষার ফলাফল। ছবি: সংগৃহীত

এরপর বুম তাদের অংশীদার ডিপফেক অ্যানালাইসিস ইউনিটের সাহায্য নেয়। তারা ভিডিওটি পরীক্ষা করে ‘Is It AI’ এবং ‘AI Or Not’—নামক দুটি আলাদা টুলে। উভয় টুলের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিডিওটি এআই দিয়ে নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৬৯ শতাংশ।

এই ফলাফল অনুযায়ী বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভিডিওর মানুষের সঙ্গে প্রাণীর মিথস্ক্রিয়া এবং আলো-ছায়ার ত্রুটি স্পষ্ট করে দিচ্ছে এটি আসল নয়, বরং জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বানানো একটি দৃশ্য।

ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর বহু ব্যবহারকারী এটিকে সত্যি বলে বিশ্বাস করেছেন। কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ভিডিওর ওই ব্যক্তির নাম রাজু পাতিল। ৫২ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি একজন দিনমজুর। তিনি নেশাগ্রস্ত অবস্থায় রাস্তায় বাঘটিকে আদর করছিলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছেন।

একাধিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্তকরণ টুলের ফলাফল এবং প্রশাসনিক যাচাই মিলিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায়—ভিডিওটি বাস্তব নয়, বরং এআই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি একটি কৃত্রিম দৃশ্য। পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের উপপরিচালক রাজনীশ সিংহও সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই ভিডিওর কোনো অংশই পেঞ্চের নয়। এটি সম্পূর্ণ ভুয়া।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাকিস্তানি জেনারেলকে ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলযুক্ত বাংলাদেশের পতাকা উপহারে’র দাবি নিয়ে যা বলল সিএ ফ্যাক্ট চেক

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৭: ০৩
ছবি : সিএ ফ্যাক্ট চেকিং
ছবি : সিএ ফ্যাক্ট চেকিং

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানের যৌথবাহিনীর চেয়ারম্যানকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল যুক্ত বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত পতাকা উপহার দিয়েছেন বলে ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের দাবি সম্পূর্ণ অসত্য ও কল্পনাপ্রসূত বলে জানিয়েছে সিএ (প্রধান উপদেষ্টা) ফ্যাক্ট চেক।

ভারতের সংবাদমাধ্যমটি গতকাল এক প্রতিবেদনে দাবি করে, পাকিস্তানের যৌথবাহিনীর চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জাকে এমন একটি পতাকা উপহার দিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস, যেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের মানচিত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

সিএ ফ্যাক্ট চেক জানায়, প্রকৃতপক্ষে অধ্যাপক ইউনূস উপহার দিয়েছেন ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ নামে একটি চিত্রসংকলন—যেখানে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের আঁকা রঙিন গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র সংকলিত হয়েছে।

‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন প্রকাশিত একটি সচিত্র দলিল, যেখানে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগে অর্জিত বিপ্লবের ইতিহাস ফুটে উঠেছে।

গ্রাফিতি সংকলনের প্রচ্ছদে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আবু সাইদের পিছনে রক্তরাঙ্গা বাংলাদেশের মানচিত্র প্রদর্শিত হয়েছে।

প্রচ্ছদে দৃশ্যমান মানচিত্রটি গ্রাফিতি হিসেবে অঙ্কিত হওয়ায় বাংলাদেশের মূল মানচিত্রের পরিমাপের কিছুটা হেরফের হয়েছে বলে কারো কাছে মনে হতে পারে। কিন্তু ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের কোনো অংশ গ্রাফিতি মানচিত্রটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে দাবি করাটা সম্পূর্ণ অসত্য এবং কল্পনাপ্রসূত। বাংলাদেশের মানচিত্রের সাথে উল্লেখিত গ্রাফিতিতে দৃশ্যমান মানচিত্রের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, অঙ্কিত মানচিত্রটিতে বাংলাদেশের প্রকৃত মানচিত্র প্রায় হুবহুভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা এর আগেও একই গ্রাফিতি সংকলন ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ জাতিসংঘের মহাসচিব, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোসহ বিশ্ব নেতাদের উপহার দিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অরকার আক্রমণে তরুণী প্রশিক্ষকের মৃত্যু, ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে যা জানা গেল

ফ্যাক্টচেক  ডেস্ক
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ৫৮
ভাইরাল ভিডিওটির দৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট
ভাইরাল ভিডিওটির দৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট

একটি মেরিন পার্কে এক নারী প্রশিক্ষককে চুবিয়ে হত্যা করেছে অরকা বা কিলার তিমি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। মর্মান্তিক ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দাবি করা হয়, প্যাসিফিক ব্লু মেরিন পার্কে ‘জেসিকা র‍্যাডক্লিফ’ নামে একজন প্রশিক্ষককে একটি অরকা আক্রমণ করে হত্যা করেছে।

ভিডিওটি টিকটক, ফেসবুক এবং এক্সে ভাইরাল হয়েছে। তবে, একাধিক ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা নিশ্চিত করেছে যে, এই ভিডিওটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

ভিডিওতে যা দেখানো হয়েছে

ভাইরাল হওয়া ক্লিপটিতে দেখা যায়, একজন তরুণী একটি অরকার পিঠে দাঁড়িয়ে নাচছেন। দর্শকেরা তখন উল্লাস করছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর হঠাৎ অরকাটি ওই তরুণীকে আক্রমণ করে পানির নিচে টেনে নিয়ে যায়। ভিডিওটি শেয়ার করা অনেক ব্যবহারকারী দাবি করেছেন, পানির নিচে নিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওই তরুণীর মৃত্যু হয়।

ঘটনা বা প্রশিক্ষকের কোনো প্রমাণ নেই

ভিডিওটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হওয়া সত্ত্বেও, জেসিকা র‍্যাডক্লিফ নামে একজন প্রশিক্ষক অরকার আক্রমণে মারা গেছেন—এই দাবির পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কর্তৃপক্ষ, মেরিন পার্ক এবং প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমগুলো জেসিকা র‍্যাডক্লিফের অস্তিত্ব বা এমন কোনো ঘটনার রেকর্ড খুঁজে পায়নি। দ্য স্টার পত্রিকার মতে, ভিডিওটি কাল্পনিক; এমনকি ভিডিওতে থাকা কণ্ঠস্বরগুলোও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্যান্য প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এমন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সাধারণত যে ধরনের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়, এই ঘটনায় তার কোনোটিই পাওয়া যায়নি। ফরেনসিক বিশ্লেষণ অনুসারে, ভিডিওর মধ্যে পানির অস্বাভাবিক গতিবিধি এবং অদ্ভুত বিরতিও নিশ্চিত করে যে এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এমনকি ভিডিওতে যে পার্কের নাম বলা হয়েছে, সেটিও ভুয়া।

এক্স-এ ছড়িয়ে পড়া ভিডিও। ছবি: স্ক্রিনশট
এক্স-এ ছড়িয়ে পড়া ভিডিও। ছবি: স্ক্রিনশট

সম্পূর্ণভাবে এআই-নির্মিত

ফোর্বস ম্যাগাজিন ক্লিপটিকে ‘একটি প্রতারণা’ বলে চিহ্নিত করেছে। তারা উল্লেখ করেছে, এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা যদি সত্যিই ঘটতো, তাহলে তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হতো। ভিডিওর দৃশ্য এবং শব্দ সম্ভবত চাঞ্চল্যকর প্রভাব তৈরির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। দ্য ইকোনমিক টাইমস উল্লেখ করেছে, এই গল্পের চরিত্র এবং নাম কোনো যাচাইযোগ্য রেকর্ডের সঙ্গে মেলে না। ফলে বলা যেতে পারে যে, পুরো গল্পটি বানোয়াট।

সত্যিকারের দুর্ঘটনার সঙ্গে মিল

এই ধরনের প্রতারণামূলক ভিডিওগুলোতে কিছুটা সত্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করা হয়। ভিডিওটি ২০১০ সালে সি ওয়ার্ল্ডে ডন ব্রাঞ্চেউ এবং ২০০৯ সালে অ্যালেক্সিস মার্টিনেজ-এর বাস্তব জীবনের মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়। উভয় প্রশিক্ষকই অরকার আক্রমণে মারা যান। কিন্তু এই ঘটনাগুলো জেসিকা র‍্যাডক্লিফের গল্পের মতো নয়, কারণ সেগুলো নথিভুক্ত এবং কর্তৃপক্ষের তরফে নিশ্চিত করা হয়েছে।

কেন এই ধরনের প্রতারণা ভাইরাল হয়

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি ভিডিওর আবেগপূর্ণ তীব্রতা এবং বাস্তবসম্মত উৎপাদন কৌশল এটি ভাইরাল হতে সাহায্য করে। এই ধরনের ক্লিপগুলো বুদ্ধিমান সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বন্দী করে রাখার নৈতিকতা নিয়ে মানুষের গভীর উদ্বেগগুলোকে কাজে লাগায়। একই সঙ্গে, এগুলো চাঞ্চল্যকর বিষয়বস্তু ব্যবহার করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ফ্যাক্টচেকিং হলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়।

কথিত জেসিকা র‍্যাডক্লিফকে নিয়ে অরকার আক্রমণের ভিডিওটি একটি সম্পূর্ণ বানোয়াট। এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এই নামে কোনো প্রশিক্ষকের অস্তিত্বেরও কোনো প্রমাণ নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত