রোববার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সামনে চায়ের দোকান ঘিরে আড্ডা যখন জমে উঠেছে, তখন আমাদের পরিচিত একটি মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।মেয়েটার জীবনসঙ্গীকে জিজ্ঞেস করায় যে উত্তর পাওয়া গেল, তা হলো, এই গরমে টিকতে না পেরে এক্সপেরিমেন্টাল হলের সামনে থাকা বিশ্রামকক্ষে চলে গেছে সে। সেখানে নিশ্চয় মিলবে এসির বাতাস।
আড্ডায় নাট্যজন মাসুম রেজাকে পাওয়া গেল প্রাণবন্ত। কামালউদ্দিন কবির থাকলেন অনেকক্ষণ। ‘রিমান্ড’ নামে যে নাটকটি দেখতে এসেছি আমরা, তার মঞ্চসজ্জা করেছেন তিনি, একটি দৃশ্যে অভিনয়ও করেছেন। কিন্তু তাঁর অভিনয়পর্ব নাটকের দ্বিতীয় ভাগে বলে এখন এই আড্ডায় তিনি আয়েশি শরিক।
এরই মধ্যে নজরুল কবীর, জুলহাস, অনিকেত রাজেশ, মাহবুব আশরাফ, তৃষ্ণা সরকারসহ অনেক পরিচিত মুখের সন্ধান পাওয়া গেল। নাটক শুরু হতে যখন দুই মিনিট বাকি, তখন আসর ভাঙল।
সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল হলে পৌঁছানোর পর সেই হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার দেখা মিলল। গরমে সেদ্ধ হতেই শুধু বাকি আছে তার। এই বিশাল ঘরটার একটা এসিও সচল নয়। গুমোট গরমে সেটা যেন কাকতালীয়ভাবে এক রিমান্ড ঘরে পরিণত হয়েছে। একটু পর যে নাটকটির জন্য বেল বাজবে, তারই মহড়ায় যেন আমরা এখন! আমরাই রিমান্ডে! এ জায়গাটি যে তাদেরই অধীনে, সে কথা শিল্পকলা একাডেমি ভুলে গেছে বুঝি!
‘রিমান্ড’ নাটকের মূল দুটি চরিত্রে অভিনয় করছেন আসাদুজ্জামান নূর আর জ্যোতি সিনহা। রচয়িতা ও নির্দেশক শুভাশিস সিনহা মেসেঞ্জারে জানতে চেয়েছিলেন, নাটকটি দেখব কি না। সানন্দে রাজি হয়েছি। বিকাশে টিকিট কাটার পুরো ব্যবস্থা করে দিয়েছেন পাভেল রহমান। ফলে বেশ আনন্দ নিয়েই ঢোকা গেল এক্সপেরিমেন্টাল হলে। সামনেই ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ ছবির পরিচালক মোহাম্মদ কাইয়ুম, পাশে বাকার বকুল, যাঁর ‘আদম সুরত’ নাটকটিও এই মঞ্চেই পরিবেশিত হবে খুব শিগগির।
এক্সপেরিমেন্টাল হলটিতে সমীহ করার মতো দর্শক সমাগম হয়েছিল। বাতি নিবে গেলে এবং বেল বাজলে মঞ্চের সঙ্গে একাত্ম হলো মন। তখনই রিমান্ড ঘরে দেখা গেল একজন লেখককে। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেন তিনি। প্রেমকে অস্বীকার করেন। যিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ অন্য প্রাণী থেকে আলাদা, সেটা শুধু এই কারণে যে শুধু মানুষেরই আছে মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা!
না, এখানে কাহিনি বলে দিয়ে নাটক দেখার আগ্রহ নষ্ট করার চেষ্টা করব না। শুধু বলব, সত্তরোর্ধ্ব আসাদুজ্জামান নূরকে দেখে ভাবতে হলো, তাঁর অভিনয় এতটাই পরিণত, এতটাই নাটকীয়তাহীন, এতটাই সাবলীল! হুমায়ুন ফরীদির ৬০ বছর পূর্তির পর যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, তিনি বলেছিলেন, মঞ্চে ওঠার মতো শক্তি এখন আর শরীরে অবশিষ্ট নেই। আসাদুজ্জামান নূর বোঝালেন, সেই শক্তি তাঁর মধ্যে আছে। নাটকে শেক্সপিয়ার, হেমিংওয়ে, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দসহ সাহিত্যজগতের লোকেরা আসেন তাঁদের মতো করেই। কিন্তু পুলিশ অফিসার জ্যোতি সিনহার কাছে এসব মুখ্য নয়। তিনি জানতে চান, কেন এই লেখকের সংস্পর্শে এলেই মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে কিংবা হয়ে যায় পলাতক।
কেন মেয়েটি লেখককে খুঁড়ে খুঁড়ে সত্য জানতে চায়, তার মীমাংসা হয় নাটকের একেবারে শেষে। সে কথা থাক। শুভাশিসকে তারিফ করার পাশাপাশি বলার যা আছে, তা হলো, মঞ্চনাটক এখনো টিকে আছে তার অপার সম্ভাবনা নিয়েই। কিন্তু সেই সত্তর-আশির দশকের মতো তারুণ্য কি আবার জাগবে, যারা থিয়েটার হলের শূন্য আসনগুলো পূর্ণ করে দেবে?
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে