রোববার, ০৪ জুন ২০২৩

সেকশন

 

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান

কাকুল সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণ লাভের সময় থেকেই আতিকুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রসঙ্গে সচেতন হয়ে ওঠেন। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আতিকুর রহমান সিরাজী ১৯৭০ সালের ২১ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন।

আপডেট : ২৩ মার্চ ২০২৩, ১৩:৫৩

শহীদ হওয়ার সময় লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান সিরাজীর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। ছবি: সংগৃহীত ৩০ মার্চ, ১৯৭১ সাল। বেলা সাড়ে তিনটা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৫৩তম পদাতিক ব্রিগেডের সদর দপ্তরে একটি প্রায় অন্ধকার, অপরিসর কক্ষের মেঝেতে আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সঙ্গে বসে আছেন ষষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের তরুণ বাঙালি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান সিরাজী। মার্চের বিকেলের রোদ সব উজ্জ্বলতাসহকারে বাইরের মাঠে উপস্থিত। কিন্তু সেদিকে লেফটেন্যান্ট আতিকের কোনো মনোযোগ নেই।

২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর সকাল থেকেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের সব বাঙালি কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক নজরদারিতে ছিলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যেও কোনো ধরনের যোগাযোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। নিরাপত্তার আশায় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান তাঁর নিকটাত্মীয় মেজর আনোয়ারুল ইসলামের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকেই ২৯ মার্চ বিকেলে আর্টিলারি রেজিমেন্টের একদল সৈনিক তাঁকে বন্দী করে ৫৩তম পদাতিক ব্রিগেডের সদর দপ্তরে নিয়ে আসে। ২৯ মার্চ বিকেল থেকে সেখানে তিনটি কক্ষে বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার বন্দী অবস্থায় ছিলেন। সেনাবাহিনীর একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিজের সম্ভাব্য পরিণতি প্রসঙ্গে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকের অন্তত অর্ধ স্পষ্ট একটি ধারণা ছিল। তাঁর সব আশঙ্কার পরিসমাপ্তি টেনে তাঁদের কক্ষের দরজা সশব্দে খুলে গেল। পাঞ্জাবি মেজর মো. ইয়ামিন খোকা বাইরে উদ্যত স্টেনগান হাতে দণ্ডায়মান। ‘বাহার নিকাল,... বাঙালি’, মেজর ইয়ামিন খোকা গর্জন করে উঠলেন। কক্ষের বাইরে আসা আর্টিলারির মাত্র একজন সৈনিক লেফটেন্যান্ট আতিকের হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। তিনি বুঝতে পারলেন সম্ভবত কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর ২০ বছর স্থায়ী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। ব্রিগেড সদর দপ্তর থেকে বাইরে বেরোনোর সময় স্নেহশীল বড় বোনের কথা তাঁর মনে পড়ল, যাঁর ছায়ায় তিনি বড় হয়েছেন।

সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকের শৈশব-কৈশোরের দিকে ফিরে তাকালে তাঁর ওই ধরনের পরিণতি প্রায় অকল্পনীয় মনে হয়। লেফটেন্যান্ট আতিক ১৫ জানুয়ারি, ১৯৫১ সালে ঢাকার নারিন্দায় এক মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রকৌশলী পিতা সিরাজুল হকের ১২ সন্তানের মধ্যে আতিক ছিলেন পঞ্চম। শৈশব থেকেই আতিক বিদেশি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে। পরে তিনি তাঁর পিতৃভূমি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার রসুলপুর গ্রামের নিকটবর্তী ধলা হাইস্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৮ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে তিনি একই কলেজে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হন। এর কাছাকাছি সময়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে যোগদানের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন।

আতিকুর রহমান সিরাজী কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ১৯৬৯ সালের ২৪ অক্টোবর ২৩তম বিশেষ কোর্সে যোগ দেন। সেই কোর্সের ১৩৭ জন ক্যাডেটের মধ্যে ৩৫ জনই ছিলেন বাঙালি।

কাকুল সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণ লাভের সময় থেকেই আতিকুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রসঙ্গে সচেতন হয়ে ওঠেন। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আতিকুর রহমান সিরাজী ১৯৭০ সালের ২১ জুন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন। তাঁকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ষষ্ঠ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নে পদায়ন করা হয়।

স্বল্পকাল পরে ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইমাম উজ জামান (পরে বীর বিক্রম, মেজর জেনারেল) কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ৫৩তম ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে যোগদান করলে ওই দুই তরুণ কর্মকর্তার মধ্যে দ্রুত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দুই তরুণ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে দক্ষিণবঙ্গের উপকূল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত হওয়ার পরে ত্রাণ কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। পরে তাঁরা ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রে বাঙালি প্রভাবান্বিত সরকার গঠনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু ওই দুই তরুণ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা অতিদ্রুত উপলব্ধি করেন যে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁদের একটি সন্দেহের দেয়াল তৈরি হচ্ছে। স্পষ্টত পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা কোনোক্রমেই কেন্দ্রে একটি বাঙালি প্রভাবান্বিত সরকারের সঙ্গে সহাবস্থানের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা প্রকাশ্যেই যেকোনো পদ্ধতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রসঙ্গে আস্ফালন করা শুরু করেন। ইতিমধ্যে মার্চ মাসের প্রথমার্ধেই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং একটি কোম্পানিকে শমশেরনগরে পাঠানো হয়। পরে ২৭ মার্চ চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করলে পাকিস্তানিরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাঙালি সব সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেন আর্টিলারি রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সিও লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক এবং ৫৩তম পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর সুলতান। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান সিরাজীসহ ২৪ জন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঙালি বেসামরিক কর্মচারীকে ২৯ মার্চ বিকেলে ব্রিগেড সদর দপ্তরের তিনটি কক্ষে বন্দী করা হয়। পরে ৩০ মার্চ বিকেল আনুমানিক ৪টায় বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও বেসামরিক কর্মচারীদের ব্রিগেড সদর দপ্তরের পেছনের মাঠে হত্যার পরে মাটিচাপা দেওয়া হয়। তবে তৎকালীন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইমাম উজ জামান অলৌকিকভাবে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আহত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। তিনি পরবর্তীকালে সক্রিয়ভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ বিজয় অর্জিত হওয়ার পরে শাহাদাতবরণকারী ২৪ জন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার মরদেহ যথাযথ সম্মানসহকারে সমাধিস্থ করা হয়। আতিকুর রহমান সিরাজীর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। তাঁর জীবন যথাযথ পরিণতি লাভ না করলেও তাঁর এবং তাঁর মতো অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ পরিণতির পথে এগিয়ে চলেছে। সব শহীদের আত্মা চির শান্তি লাভ করুক।

ফয়সাল শাহরিয়ার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    বিদ্যুৎ সরবরাহ কম, বিল আসছে বাড়তি

    মন্ত্রণালয়ে গেড়ে বসেছেন তাঁরা

    এক দফায় এক হলেও মতভেদ রাষ্ট্র সংস্কারে

    নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা

    চা দিবস বনাম চা-শ্রমিক দিবস

    জীবন অগাধ

    বুদ্ধদেবের পঞ্চাশ হাজার

    দিনাজপুরে ৬৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড 

    নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে অস্পষ্টতা নেই: আইনমন্ত্রী

    উত্তরা ও কাফরুল থেকে প্রতারণা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত চার আসামি গ্রেপ্তার 

    পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি মিলছে সোমবার

    নীলফামারীতে বিদ্যুতায়িত হয়ে দুই শিশুর মৃত্যু

    ব্যবসায়ী অপহরণে সিআইডি ও র‍্যাব সদস্য, থানায় মামলা