আওয়ামী লীগের ক্ষমার রাজনীতির প্রশংসা করবেন বহিষ্কৃতরা, কিন্তু দলের সব নেতা-কর্মী কি এতে সমান খুশি হবেন? এর ফলে কি আগামী নির্বাচনের আগে দলের শক্তি বাড়বে, নাকি ভেতরে-ভেতরে ক্ষোভ-অসন্তোষই জিইয়ে থাকবে? রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রতি আওয়ামী লীগ ক্ষমা ঘোষণা করেনি। ক্ষমা করা হয়েছে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে যাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাঁদের। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছানো ও প্রশাসন সাজানোর যে কাজ চলছে, তার অংশ হিসেবেই দল থেকে বহিষ্কৃতদের দলে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গত ১৭ ডিসেম্বর দলের জাতীয় কমিটির সভায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া দলীয় নেতাদের সাধারণ ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৭ ডিসেম্বরের দলীয় সিদ্ধান্তের পরও যাঁরা আবেদন করবেন, তাঁদেরও ক্ষমা করা হবে। ইতিমধ্যে আলোচিত কয়েকজন বহিষ্কৃত নেতা ক্ষমা পেয়ে যাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, কেউ আর ক্ষমার আওতার বাইরে থাকবেন না।
দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা বা অব্যাহতি পাওয়া নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনা আওয়ামী লীগের জন্য নতুন কিছু নয়। দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষা, আদর্শিক অবস্থান মজবুত রাখার স্বার্থে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে থাকলেও তা মেনে চলার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা নীতি অনুসরণ করাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। আমাদের রাজনীতি গ্রহণে যতটা তৎপর, বর্জনে তা নয়। আবর্জনা সাফ না করে তা আড়াল করার চেষ্টাই দেখা যায়। তাই বড় ধরনের কোনো অন্যায় না করলে বা দলকে বড় ক্ষতির মুখে ঠেলে না দিলে সাধারণত কাউকে দল থেকে বহিষ্কার করতে দেখা যায় না। অনেক সময় কোনো কোনো নেতা দলে থেকেও কৌশলে দলের নীতি-আদর্শ বা কৌশলের বিরোধিতা করা সত্ত্বেও তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো শাস্তি আরোপ করা হয় না। আওয়ামী লীগে এমন বড় মাপের ঘরের শত্রু বিভীষণ ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তাঁকে সময়মতো শাসন করলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির পর রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁর কুক্ষিগত হতো না।
যা হোক, অতীতের কাসুন্দি না ঘেঁটে আমরা আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি গত কয়েক বছরের মধ্যে। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা কিংবা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কাউকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার কথা মনে করতে পারছি না।
কিন্তু পবিত্র হজসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে ২০১৪ সালে প্রথমে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন টাঙ্গাইলের আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তখন তাঁকে দলের সভাপতিমণ্ডলী ও সাধারণ সদস্য পদ থেকেও বাদ দেওয়া হয়। দলীয় চাপে তিনি সংসদ সদস্য পদ ত্যাগ করেন। সে সময় লতিফ সিদ্দিকী দলের সাধারণ সদস্য পদটি বহাল রাখার অনুরোধ করলে তা প্রত্যাখ্যান করে দল। তার পর থেকে তিনি রাজনীতি থেকে আড়ালেই আছেন। অথচ তিনি তো একজন দাপুটে নেতা ও মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর ছোট ভাই বঙ্গবীর বলে পরিচিত কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগেরই নেতা ছিলেন। আবার একসময় তিনি আওয়ামী-বিরোধিতায় সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার সব উদ্যোগেই তাঁকে যুক্ত হতে দেখা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি মনে হচ্ছে, তিনিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা পেয়েছেন। সপরিবারে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার সঙ্গে সাক্ষাৎ, ফটোসেশন করে এসেছেন। বাজারে কথা চালু হয়েছে, তিনি ভবিষ্যতে আর ‘বোন হাসিনা’র অবাধ্য হবেন না। কাদের সিদ্দিকী মার্জনা পেলেও লতিফ সিদ্দিকীকে ক্ষমার বিষয়টি আওয়ামী লীগের বিবেচনায় নেই। কারণ, তিনি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। সব অপরাধের ক্ষমা হলেও ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করলে কারও রেহাই নেই। তাই লতিফ সিদ্দিকীর আর দলে ফেরার সম্ভাবনা দেখছেন না কেউ।
গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কমিটি থেকে যাঁদের বহিষ্কার কিংবা অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, এর প্রায় ৯৯ শতাংশ কিংবা তারও বেশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন।
তবে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান, কাটাখালীর বহিষ্কৃত মেয়র আব্বাস আলী ও সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন কারণে। ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও গাজীপুর জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কারের কিছুদিন পরই অশালীন ও নারীর প্রতি অবমাননাকর কথা বলে মন্ত্রিত্ব ও দলের পদ হারান তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। অবশ্য জাহাঙ্গীর আলমের আগে রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতা করে দেওয়া বক্তব্য গোপনে ধারণ করে ছেড়ে দেওয়ার পর। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারেও পাঠানো হয়। মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। এখন তিনি জামিনে মুক্ত। দলের অভ্যন্তরে কোন্দলের কারণে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার হয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ নম্বর ধারায় ‘প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা’ শিরোনামে একটি ধারা আছে। এর ১১টি উপধারায় অপরাধের শাস্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া, শাস্তির কথা বলা রয়েছে। একই সঙ্গে শাস্তির ব্যাপারে আপিল ও ক্ষমা করার বিষয় উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ৪৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে—কোনো সদস্য আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, গঠনতন্ত্র ও নিয়মাবলি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করলে তাঁর বিরুদ্ধে যেকোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কাউন্সিল, কার্যনির্বাহী সংসদ, সংসদীয় বোর্ড বা সংসদীয় পার্টির বিরুদ্ধে কোনো কাজ করলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগেও দল ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ ছাড়া ৪৭ (১১) ধারায় বলা আছে—জাতীয় সংসদ কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তদন্ত করে বহিষ্কার করা হবে। এ ছাড়া সব অপরাধ বা বহিষ্কার থেকে মুক্তি দেওয়ার এখতিয়ার দলের জাতীয় কমিটির বলে ৪৭ (২) ধারায় উল্লেখ আছে গঠনতন্ত্রে।
শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আওয়ামী লীগ থেকে সাময়িক বহিষ্কারের পর দলে ফিরিয়ে নেওয়ার অনেক নজির গত ১৪ বছরের শাসনামলে বহুবার স্থাপন করা হয়েছে। এবার ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে দলের জাতীয় সম্মেলনের আগে আগে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের আগে এক জাতীয় কমিটির বৈঠকে একইভাবে বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল। সেবার প্রথম ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় নিহত হন ১১৬ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন ৭১ জন। তাঁদের বেশির ভাগই মারা গেছেন দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে মারামারিতে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ এক মূল্যায়নে দেখা গেছে, ইউপি ভোটে প্রতি তিনজন দলীয় প্রার্থীর বিপরীতে দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। বিদ্রোহীদের কারণেই এসব হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে দলটির ভেতরে আলোচনা ছিল। এর পরও সে সময় সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এতে বিপুল সংখ্যায় বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন। গঠনতন্ত্র মোতাবেক সবাই সাময়িক বহিষ্কার হন। এমন বহিষ্কৃত নেতার সংখ্যা কয়েক শ বলে আলোচনা আছে। একটা হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীসহ নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৩০৪ জন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়ী হন ১৩৬ জন, তাঁরা মূলত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ৪৫ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা বা সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ ছিল। অর্থাৎ, ১৩৬ জন নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। এই তথ্যগুলো মনে রাখা ভালো।
এই যে দলের সিদ্ধান্ত না মানার প্রবণতা, এটা কি দলের জন্য স্বাস্থ্যকর? এখন বলা হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখেই বহিষ্কৃত ব্যক্তিদের ক্ষমা করা হয়েছে। কারণ, যাঁদের বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাঁদের প্রায় সবাই দলের বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী নেতা ছিলেন। এত বিপুলসংখ্যক জনপ্রতিনিধি ও নেতাকে বাদ দিয়ে নির্বাচন কিংবা বিরোধীদের আন্দোলন মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রশ্ন হলো, আগামী নির্বাচনে কেন্দ্র থেকে যাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হবে, তা সবাই মেনে নেবেন, বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবেন না—এটা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? তৃণমূলের নেতাদের অনেকেরই এখন টাকাপয়সা হয়েছে, তাঁদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও কারও কারও লাইনঘাট হয়েছে। কে কাকে ঘায়েল করার জন্য গোপনে কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন, তা বিস্তারিত জানা আছে তো? ক্ষমা নিশ্চয়ই বড় গুণ। কিন্তু ক্ষমা পেয়ে কেউ যদি ‘ক্ষমিতে পারিলাম না যে’ বলে উল্টো পথেই হাঁটে?
বিভুরঞ্জন সরকার,জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে