Ajker Patrika

এককালের নরমাংস ভোজী গাছবাসী মানুষেরা

ইশতিয়াক হাসান
এককালের নরমাংস ভোজী গাছবাসী মানুষেরা

করোওয়াইদের কথা প্রথম পড়েছিলাম যদ্দুর মনে পড়ে রিডার্স ডাইজেস্টে। সভ্যতার স্পর্শ পায়নি এমন মানুষদের কথা ভাবতে গেলে আমাজনের জঙ্গলের কিংবা আফ্রিকার কিছু অঞ্চলের আদিবাসীদের কথাই মাথায় চলে আসত। তবে এই ধারণা বদলে দেয় করোওয়াইরা। আরও মজার ব্যাপার হলো, তাঁদের বাস এশিয়া মহাদেশেই, দক্ষিণ-পূর্ব ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া অঞ্চলের গহিন অরণ্যে। আজ বলব করোওয়াইদের গল্প।

বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না এই আদিবাসীদের। নিজেরদের এই গভীর বনানীর জগৎ ছাড়া আর কোনো পৃথিবী আছে এটা ভাবতেও পারত না ওরা, তেমনি করোওয়াইদের কথা জানত তা গোটা দুনিয়ার মানুষও। এরপরই ১৯৭৪ সালে ডাচ মিশনারিরা খুঁজে বের করেন তাঁদের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বুনো জন্তু শিকার ও জংলি ফল-মূল, লতা-পাতা সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করছে এই আদিবাসীরা। আরাফুরা সাগর থেকে মোটামুটি ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে করোওয়াইদের বসতি। 

করোওয়াইদের খুঁজে পাওয়ার পর তাঁদের সম্পর্কে আজব এক তথ্য বেরিয়ে আসে। করোওয়াইরা নরমাংস ভোজন করে? পিলে চমকানো খবরটা এতটাই তোলপাড় তোলে যে আরেকটু হলে এর আড়ালে ঢাকা পড়তে বসেছিল এই অরণ্যচারী আদিবাসীদের আশ্চর্য আরেক বৈশিষ্ট্য। সেটি হলো, তাঁদের বৃক্ষচর স্বভাব। উঁচু উঁচু গাছে বাস তাঁদের, তাও অসাধারণ স্থাপত্যকর্মের দৃষ্টিনন্দন সব ঘর। আমার করোওয়াইতে মজে যাওয়ার কারণ তাঁদের এই গাছের জীবনই। 

পর্যটক টানতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রিসোর্টে এখন গাছে রাত কাটানোর চমৎকার ব্যবস্থাও হয়েছে। কিন্তু দেখুন, শত শত বছর ধরে প্রয়োজনের তাগিদেই এমন আশ্চর্য গাছ-বাড়িতে বাস করে আসছে এই আদিবাসীরা। 

মনে নিশ্চয়ই এখন একটা প্রশ্ন জেগেছে, করোওয়াইদের এই গাছবাড়িগুলো কতটা উঁচুতে? সাধারণত ২০ থেকে ৪০ ফুট উচ্চতায় দেখা পাবেন এমন বাড়িগুলোর। তবে কোনো কোনোটা ছাড়িয়ে যায় এক শ ফুটের সীমাও। ১১৪ ফুট উঁচুতে এমন বাড়ি বানানোর রেকর্ডও আছে। 

একটি গাছেই তৈরি হয় ঘরটি, কখনো কখনো কয়েকটি জীবন্ত গাছের ওপর থাকে ভিতটা, বাড়তি সাপোর্ট হিসেবে থাকে কাঠের খুঁটি। এই গাছবাড়িতে বাসের অনেক সুবিধা। এটা বাসিন্দাদের যে শুধু নিচে গিজগিজ করতে থাকে অগণিত রক্তলোভী মশার কবল থেকে বাঁচায় তা নয়, বাঁচায় প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রতিবেশী কিংবা বন্যপ্রাণীদের থেকেও। অবশ্য করোওয়াইরা এ ধরনের গাছ-বাড়িতে বাসের আরেকটি কারণ আছে। অশুভ আত্মায় প্রবল বিশ্বাস তাঁদের। তাঁরা মনে করেন, এভাবে উঁচু সব বৃক্ষে বাড়ি বানালে অশুভ আত্মাদের কবল থেকেও রেহাই মিলবে। 

সাধারণত ২০ থেকে ৪০ ফুট উচ্চতায় দেখা পাবেন এমন বাড়িগুলোর। তবে কোনো কোনোটা ছাড়িয়ে যায় এক শ ফুটের সীমাওএমন একটি বৃক্ষবাড়ি বানাবার জন্য প্রধান খুঁটি হিসেবে একটি শক্তপোক্ত গাছ বাছাই করা হয়। গাছের ওপরের অংশটা কেটে ফেলা হয়। এরপর চারপাশে ছোট ছোট খুঁটি বসানোর কাজ চলে। গাছের ডাল-পালা দিয়ে মেঝের কাঠামোটা দাঁড় করানোর পর ঢেকে দেওয়া হয় সাগো পামের শক্ত পাতা দিয়ে। দেয়াল এবং ছাদ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় ওই সাগো পামই। ডালপালাগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা আটকানোর উপাদান বেতজাতীয় রত্তন গাছ। 

বাড়ির মেঝেটা মজবুত হওয়া চাই। কারণ অনেক সময় এক একটা বাড়িতে ডজনখানেক মানুষ বাস করে। তাদের ওজনতো বহন করতে হবে। 
নারী-পুরুষ-শিশুর সঙ্গে পোষাপ্রাণী এবং গবাদিপশুরও ঠাঁই হয়। খাঁজকাটা একটা গাছের গুঁড়ি উঠানামার জন্য মই হিসেবে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বড় বাড়িগুলোতে নারী-পুরুষের থাকার আলাদা জায়গা, এমনকি আগুন জ্বালানোর কামরা থাকে। 

আগুনে পুড়ে যাওয়াই এই সবুজ আস্তানার একটি বড় সমস্যা। তবে এমনিতেও এ ধরনের এক একটা বাড়ি পাঁচ বছরের বেশি টেকে না। নতুন করে গাছ-বাড়ি তৈরি করতে হয় তখন। 

করোওয়াইদের পোষাপ্রাণীর মধ্যে আছে কুকুর আর শূকর। কুকুর ব্যবহার করা হয় শিকারের কাজে। তীর, ধনুকসহ হাতে বানানো নানা অস্ত্র ব্যবহার করেন শিকারে। তাঁদের খাদ্যতালিকায় আছে সাপ, হরিণ, বুনো শূকরের মাংস। গুবরে পোকার লার্ভাও খাবার হিসেবে পছন্দের তলিকায় ওপরের দিকে। 

ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া অঞ্চলে করোওয়াইদের বাসকরোওয়াইদের একটি বিখ্যাত রীতি হলো সাগো পার্টি। কারও জন্ম, বিয়ে আর মৃত্যুর সময় এ আচার পালন করা হয়। এই রীতিগুলো যেসব পুরোহিত সম্পন্ন করেন তাঁদের নানা ধরনের উপহার দেওয়া হয়। 

শয়তান, পাপিষ্ঠ আত্মা, বান বা তুকতাক, মৃত্যু এসব নিয়ে অন্ধবিশ্বাস‌‌ই নরমাংস ভোজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে করোওয়াইদের। কোনো অপরাধ বা জাদুটোনার জন্য কারও প্রাণদণ্ড হলে তাঁর মাংস খাওয়ার রীতির চল ছিল কালো জাদুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের। ২০০৬ সালে প্রচারিত হয় করোওয়াইদের নিয়ে অস্ট্রেলীয় টিভি অনুষ্ঠান ‘সিক্সটি মিনিটস’–এর তথ্যচিত্র ‘লাস্ট ক্যানিবালস’। প্রচারের পর দারুণ জনপ্রিয়তাও পায় তথ্যচিত্রটি। 

তবে নৃ-বিজ্ঞানী ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য বলছে, শোরগোল তোলার উদ্দেশ্যেই এভাবে নরমাংস ভোজনের ব্যাপারটা প্রচার করা হয়েছে। তাঁদের মত, তথ্যচিত্রটি তৈরির অন্তত দুই যুগ আগ থেকেই পূর্বপুরুষদের ওই বর্বর অভ্যাস থেকে সরে এসেছে করোওয়াইরা। 

গহিন অরণ্যে অনেক উঁচুতে এক গাছ-বাড়িসভ্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়াটা হয়তো অশনিসংকেতই দিচ্ছে। তরুণেরা এখন অরণ্যবাস ছেড়ে শহরমুখী হচ্ছে। মোটের ওপর মাত্র ৩-৪ হাজার করোওয়াই টিকে আছে ইন্দোনেশিয়ার পাপুয়া অঞ্চলের গভীর অরণ্যে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই তাঁদের সর্বশেষ স্বকীয়তাগুলো হারিয়ে যাবে। লেখক ও অ্যাডভেঞ্চারার উইল মিলার কয়েকবারই ঘুরে এসেছেন আদিবাসীদের জঙ্গলের আস্তানা। তাঁর অভিজ্ঞতাও সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
 
বিবিসি মিলারের অভিজ্ঞতা নিয়ে বানিয়েছে তথ্যচিত্র। মিলার মারফতই জানা যায় হতাশাজনক এক তথ্য। সিংহভাগ করোওয়াই এখন ঐতিহ্যবাহী গাছবাড়িতে বাস করেন না। বরং পর্যটক আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করেন তাঁদের বৃক্ষনিবাসসহ ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গ! 

তবে কি আদিম জীবন যাপনের ধারাবাহিকতা নিয়ে টিকে থাকা শেষ আদিবাসী গোত্রগুলোর একটি, করোওয়াইও অচিরেই পুরোপুরি হারাতে বসেছে তাদের অনন্য ঐতিহ্য!

সূত্র: দ্য সান, অথেন্টিক ইন্দোনেশিয়া ডট কম, অ্যামিউজিং প্ল্যানেট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জরায়ুর বাইরে বেড়ে উঠল শিশু, অলৌকিক জন্ম দেখল ক্যালিফোর্নিয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১: ১১
২০২৫ সালের আগস্টে লস অ্যাঞ্জেলেসের সিডারস-সিনাই হাসপাতালে সুজ লোপেজের মেয়ে কাইলা সুজ, তাঁর কোলে রিউ ও অ্যান্ড্রু লোপেজ (ছবিতে বাম দিক থেকে)। ছবি: এপির সৌজন্যে
২০২৫ সালের আগস্টে লস অ্যাঞ্জেলেসের সিডারস-সিনাই হাসপাতালে সুজ লোপেজের মেয়ে কাইলা সুজ, তাঁর কোলে রিউ ও অ্যান্ড্রু লোপেজ (ছবিতে বাম দিক থেকে)। ছবি: এপির সৌজন্যে

ক্যালিফোর্নিয়ার সুজ লোপেজ যখন তাঁর ছোট ছেলে রিউকে কোলে নিয়ে বসেন, তখন এক অলৌকিক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান। কারণ, ছোট্ট রিউ তাঁর মায়ের জরায়ুর ভেতরে নয়, বেড়ে উঠেছিল পেটের ভেতরে একটি বিশাল আকৃতির ওভারিয়ান সিস্টের আড়ালে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিরল এই ঘটনাকে ‘মিরাকল’ বা অলৌকিক বলছেন চিকিৎসকেরা।

লস অ্যাঞ্জেলেসের সিডারস-সিনাই মেডিকেল সেন্টারের প্রসূতি ও প্রসব বিভাগের মেডিকেল ডিরেক্টর ড. জন ওজিমেক এপিকে বলেন, ‘প্রতি ৩০ হাজার গর্ভাবস্থার মধ্যে মাত্র একটি জরায়ুর বাইরে পেটের ভেতরে (Abdominal Pregnancy) ঘটে। আর পূর্ণ মেয়াদে সুস্থ শিশু জন্ম দেওয়ার ঘটনা ১ কোটিতে একজনের ক্ষেত্রেও দেখা যায় না। এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য।’

৪১ বছর বয়সী সুজ লোপেজ পেশায় একজন নার্স। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সন্তান জন্ম দেওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগ পর্যন্ত তিনি জানতেনই না যে তিনি অন্তঃসত্ত্বা।

সুজ দীর্ঘদিন ধরে ওভারিয়ান সিস্টের সমস্যায় ভুগছিলেন। যখন তাঁর পেট বড় হতে শুরু করে, তিনি ভেবেছিলেন, এটি ২১ পাউন্ড ওজনের সেই সিস্টেরই বৃদ্ধি।

সাধারণ গর্ভাবস্থার কোনো লক্ষণ; যেমন সকালবেলায় অসুস্থতা বোধ করা (Morning Sickness) বা শিশুর নড়াচড়া—কিছুই তিনি অনুভব করেননি। অনিয়মিত পিরিয়ডের কারণে ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়াকেও তিনি স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলেন।

অবশেষে পেটে অসহ্য ব্যথা শুরু হলে তিনি সিস্ট অপসারণের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। সেখানে সিটি স্ক্যান করার আগে বাধ্যতামূলক গর্ভাবস্থা পরীক্ষায় ফল ‘পজিটিভ’ আসে।

হাসপাতালে আলট্রাসাউন্ড এবং এমআরআই স্ক্যানে দেখা যায়, সুজের জরায়ু সম্পূর্ণ খালি। অথচ একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রূণ তাঁর লিভারের কাছে পেটের এক কোণে অ্যামনিওটিক থ্যাকের ভেতরে বেড়ে উঠছে। ড. ওজিমেক জানান, ভ্রূণটি লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে সরাসরি আক্রান্ত করেনি, বরং পেলভিসের পাশের দেয়ালে গেঁথে ছিল। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক হলেও লিভারের তুলনায় কিছুটা নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল।

গত ১৮ আগস্ট এক জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৮ পাউন্ড (৩.৬ কেজি) ওজনের রিউকে পৃথিবীতে আনা হয়। অস্ত্রোপচারের সময় সুজের সেই বিশাল সিস্টটিও অপসারণ করা হয়। অত্যধিক রক্তক্ষরণ হলেও চিকিৎসকদের দক্ষতায় সুজ এবং তাঁর সন্তান দুজনেই সুস্থভাবে ফিরে আসেন।

সুজের স্বামী অ্যান্ড্রু লোপেজ বলেন, ‘বাইরে শান্ত থাকলেও আমি ভেতরে-ভেতরে প্রার্থনা করছিলাম। যেকোনো মুহূর্তে স্ত্রী বা সন্তানকে হারানোর ভয় আমাকে তাড়া করছিল।’

বর্তমানে রিউ সম্পূর্ণ সুস্থ এবং প্রাণচঞ্চল। নিজের ১৮ বছর বয়সী বড় বোন কাইলার সঙ্গে তার খুনসুটি লেগেই থাকে। সামনেই রিউয়ের প্রথম বড়দিন। সুজ লোপেজ আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘আমি এখন অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাস করি। ঈশ্বর আমাদের জীবনের সেরা উপহারটি দিয়েছেন।’

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই কেস এতই বিরল যে তাঁরা এটি একটি মেডিকেল জার্নালে প্রকাশের পরিকল্পনা করছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অন্য নারীর ছবিতে লাইক দেওয়া বৈবাহিক বিশ্বাসভঙ্গের শামিল: তুরস্কের আদালত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৭
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

তুরস্কের একটি আদালত এক চাঞ্চল্যকর রায়ে জানিয়েছেন, স্ত্রী ছাড়া অন্য নারীদের অনলাইন পোস্টে স্বামীর বারবার ‘লাইক’ দেওয়া বৈবাহিক বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে এবং তা বিবাহবিচ্ছেদের ভিত্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে। মধ্যতুরস্কের কায়সেরি শহরের একটি মামলায় এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত এসেছে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম হাবারলারের বরাত দিয়ে হংকং থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইচবি নামে এক নারী তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মৌখিক অপমান এবং আর্থিক ভরণপোষণ না দেওয়ার অভিযোগ আনেন। ওই নারী আরও উল্লেখ করেন, তাঁর স্বামী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর সময় কাটাতেন এবং সেখানে নিয়মিত অন্য নারীদের ছবিতে, এমনকি প্রলুব্ধকর ছবিতেও ‘লাইক’ দিতেন। মাঝেমধ্যে তিনি ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যও করতেন।

এইচবি যুক্তি দেন, এই আচরণ তাঁর স্বামীর দাম্পত্য আনুগত্যের পরিপন্থী। তিনি বিবাহবিচ্ছেদের পাশাপাশি খোরপোশ ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেন। স্বামী এসবি অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনিও পাল্টা বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন এবং দাবি করেন, তাঁর স্ত্রী তাঁর বাবাকে অপমান করেছেন এবং অতিরিক্ত ঈর্ষাপরায়ণ। স্ত্রীর এসব অভিযোগ তাঁর সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

আদালত এই মামলায় স্বামীকেই বেশি দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন। তাঁকে প্রতি মাসে ৭৫০ লিরা বা ২০ মার্কিন ডলার খোরপোশ এবং ৮০ হাজার লিরা ২ হাজার মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এসবি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দাবি করেন, এই পরিমাণ অনেক বেশি। কিন্তু আদালত তাঁর সেই আবেদন নাকচ করে দেন।

বিচারকেরা জানান, অন্য নারীদের ছবিতে ওই ব্যক্তির ‘লাইক’ দেওয়ার বিষয়টি বৈবাহিক বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। তাঁরা মন্তব্য করেন, ‘অনলাইনে এই আপাত নিরীহ মিথস্ক্রিয়াগুলো মূলত মানসিক নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।’

তুর্কি আইনজীবী ইমামোগ্লু স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, এই রায় একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল যে অনলাইন কর্মকাণ্ড এখন বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে। তিনি বলেন, ‘এখন থেকে স্ক্রিনশট, মেসেজ এবং সব ধরনের ডিজিটাল কার্যক্রম উভয় পক্ষের দোষ নির্ধারণে বিবেচনায় নেওয়া হবে। নাগরিকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময় বিষয়টি মাথায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছি।’

এই মামলা অনলাইনে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এক নেটিজেন লিখেছেন, ‘যদি একটি লাইক আপনার সম্পর্ক ধ্বংস করতে পারে, তবে আপনাদের বিয়ে কখনোই মজবুত ছিল না।’ অন্য একজন মন্তব্য করেছেন, ‘এখন পরিচয় লুকিয়ে লাইক দেওয়ার ফিচার চালু করার সময় এসেছে।’ তবে তৃতীয় একজন ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘যদি অনলাইনে প্রতিটি লাইক বা ভিউকে অবিশ্বস্ততা হিসেবে দেখা হয়, তবে মানুষ সারাক্ষণ ভয়ে থাকবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হওয়া উচিত মতপ্রকাশের মুক্ত জায়গা।’

তুরস্কের আদালতে অদ্ভুত কারণে বিবাহবিচ্ছেদের রায় দেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে এক ব্যক্তিকে তাঁর সাবেক স্ত্রীকে ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে ‘মোটু’ নামে সেভ করার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যা অসম্মানজনক হিসেবে বিবেচিত হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বাগ্দত্তা ‘বেশি খায়’, বিয়ে ভেঙে দিয়ে ক্ষতিপূরণ চাইলেন প্রেমিক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩৫
প্রতীকী ছবি। ছবি: ফ্রিপিক
প্রতীকী ছবি। ছবি: ফ্রিপিক

এক চীনা ব্যক্তি তাঁর প্রাক্তন বাগ্দত্তার বিরুদ্ধে মামলা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ওই ব্যক্তির দাবি, তাঁর বাগ্‌দত্তা ‘খুব বেশি খাবার খেতেন।’ তাই সম্পর্কের পেছনে ব্যয় করা সব টাকা তাঁকে ফেরত দিতে হবে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জংলান নিউজের বরাত দিয়ে হংকং থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ৯ ডিসেম্বর এই যুগলকে নিয়ে আদালতের একটি শুনানি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। হে পদবির ওই ব্যক্তি তাঁর বান্ধবী ওয়াংয়ের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। মামলায় হে দাবি করেন, তাঁর পরিবার কনেপক্ষকে অগ্রিম যৌতুক (ব্রাইড প্রাইস) হিসেবে যে ২০ হাজার ইউয়ান বা ২ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার দিয়েছিল, তা তিনি ফেরত পেতে চান।

শুধু তা-ই নয়, সম্পর্কের সময় ওয়াংয়ের পেছনে খরচ হওয়া আরও ৩০ হাজার ইউয়ানও (৪ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার) দাবি করেন হে। এই খরচের তালিকায় তাঁর কেনা কালো টাইটস এবং অন্তর্বাসও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

উত্তর-পূর্ব চীনের হেইলংজিয়াং প্রদেশের একই গ্রামের বাসিন্দা হে এবং ওয়াং। এক ঘটকের মাধ্যমে তাদের পরিচয় এবং পরে বাগ্‌দান সম্পন্ন হয়। বাগ্‌দানের পর তাঁরা উত্তর চীনের হেবেই প্রদেশে হের পরিবারের মালিকানাধীন একটি রেস্তোরাঁ চালাতে যান।

উল্লেখ্য, মালাতাং চীনের একটি জনপ্রিয় স্ট্রিট ফুড, যা মাংস, সবজি ও নুডলসের ঝাল ঝোলে তৈরি করা হয়। ওয়াং সেখানে ছয় মাস কাজ করেন। তবে হের অভিযোগ, ওয়াং ‘সহজ কাজগুলো’ করতেন। হেইলংজিয়াং টিভিকে হে বলেন, ‘সে প্রতিদিন আমাদের মালাতাং খেত। আমাদের বিক্রির জন্য যা থাকত, তা-ও তার খাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না।’ তিনি আরও যোগ করেন, তাঁর পরিবারও ওয়াংয়ের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। কারণ, তাদের মনে হয়েছে মেয়েটি বদলে গেছে।

আদালতে হে সেসব জিনিসের তালিকা পেশ করেন, যা তিনি ওয়াংয়ের জন্য কিনেছিলেন। জবাবে ওয়াং বলেন, ‘ও বড্ড বেশি হিসাবি। আমি তো ওর বান্ধবী ছিলাম।’ আদালতে তিনি হেকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি আমাকে যে টাইটস আর অন্তর্বাস কিনে দিয়েছিলে, সেগুলো কি তুমি নিজেও উপভোগ করনি?’

আদালত ৩০ হাজার ইউয়ান ফেরত দেওয়ার দাবিটি খারিজ করে দেন। বিচারক জানান, এগুলো ব্যক্তিগত জিনিস, যা উভয় পক্ষকেই আবেগীয় তৃপ্তি দিয়েছে। তবে অগ্রিম দেওয়া ২০ হাজার ইউয়ান যৌতুকের অর্ধেক টাকা ওয়াংকে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতের এই রায়ে উভয় পক্ষই সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

চীনে যৌতুক বা ‘ব্রাইড প্রাইস’ একটি প্রাচীন প্রথা। বিয়ের সময় বরের পরিবার কনের পরিবারকে উপহার হিসেবে এই টাকা দেয়, যা মূলত মেয়েটিকে পরিবারে স্বাগত জানানোর একটি আন্তরিক প্রথা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রথা নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ একে সেকেলে এবং নারীকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করার নামান্তর মনে করেন। আবার অনেকে একে বিয়ের পর নারীর ত্যাগের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেখেন।

২০২১ সালে কার্যকর হওয়া চীনের সিভিল কোড অনুযায়ী, যদি বিয়ে সম্পন্ন না হয় কিংবা বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী একত্রে বসবাস না করেন, তবে যৌতুকের টাকা ফেরত দেওয়ার দাবি আদালত সমর্থন করতে পারেন।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ইন্টারনেটে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। একজন মন্তব্য করেছেন, ‘ও যদি এতই হিসাবি হয়, তবে কেন মেয়েটিকে বেতন দিল না?’ অন্য একজন লিখেছেন, ‘ওর বউ নয়, একজন আয়া দরকার ছিল।’ তৃতীয় আরেকজন লিখেছেন, ‘মেয়েটিকে অভিনন্দন যে সে এমন এক সংকীর্ণমনা মানুষের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মদের দোকানে তাণ্ডব, বাথরুমে পাওয়া গেল মাতাল র‍্যাকুন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ১৯
মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল একটি র‍্যাকুন। ছবি: সংগৃহীত
মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল একটি র‍্যাকুন। ছবি: সংগৃহীত

সকালে দোকানের শাটার খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার অ্যাশল্যান্ডের একটি সরকারি মদের দোকানের কর্মীদের। দোকানের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শত শত ভাঙা কাচের টুকরা। মেঝে ভেসে গেছে দামি বিলেতি মদে! প্রাথমিকভাবে সবাই বড় কোনো চুরির আশঙ্কা করলেও কোনো দামি জিনিস খোয়া যায়নি; বরং দোকানের বাথরুমের কমোড আর ডাস্টবিনের চিপায় উদ্ধার হলো আসল ‘অপরাধী’। সেখানে অঘোরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল এক বুনো র‍্যাকুন!

ঘটনার সূত্রপাত হয় থ্যাংকসগিভিংয়ের ছুটিতে। দোকান বন্ধ থাকার সুযোগে এই ‘মুখোশধারী ডাকাত’ সিলিংয়ের টাইলস ভেঙে দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে। পশুপালন দপ্তরের কর্মকর্তা সামান্থা মার্টিন গণমাধ্যমকে জানান, ভেতরে ঢুকেই র‍্যাকুনটি পুরোদস্তুর তাণ্ডব শুরু করে। তবে তার প্রধান আকর্ষণ ছিল নিচের দিকের তাকগুলোতে সাজিয়ে রাখা স্কচ হুইস্কির বোতলগুলো। বেশ কয়েকটি বোতল ভেঙে, প্রচুর পরিমাণে স্কচ সাবাড় করে র‍্যাকুনটি মাতাল হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে নেশার ঘোরে সে বাথরুমে আশ্রয় নেয় এবং সেখানেই জ্ঞান হারায়।

খবর পেয়ে সামান্থা মার্টিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে র‍্যাকুনটিকে উদ্ধার করেন। তিনি কৌতুক করে বলেন, ‘পশু সুরক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার জীবনে এটা আর দশটা দিনের মতোই একটি সাধারণ দিন!’

পুরো মদের দোকান তছনছ করেছিল বুনো র‍্যাকুন। ছবি: সংগৃহীত
পুরো মদের দোকান তছনছ করেছিল বুনো র‍্যাকুন। ছবি: সংগৃহীত

র‍্যাকুনটি এতটাই নেশাগ্রস্ত ছিল যে সেটিকে ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ হ্যানোভার কাউন্টি অ্যানিমেল প্রটেকশন শেল্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে পুলিশি কাস্টডিতে নয়, বরং তার নেশা কাটানোর জন্যই এই ব্যবস্থা।

বেশ কয়েক ঘণ্টা একটানা ঘুমের পর যখন র‍্যাকুনটি হ্যাংওভার কাটে। শারীরিক কোনো চোট পাওয়া যায়নি। এটি নিশ্চিত হয়েই তাকে সসম্মানে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়।

দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে এক রহস্যময় ছায়ামূর্তির তাণ্ডব দেখা গেলেও র‍্যাকুনটি ঠিক কতটা স্কচ হজম করেছিল, তা অজানাই রয়ে গেছে। দোকানের পক্ষ থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি মজার পোস্ট দিয়ে জানানো হয়, র‍্যাকুনটিকে নিরাপদে ‘সোবার রাইড’, অর্থাৎ নেশামুক্ত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা প্রশাসনের কাছে কৃতজ্ঞ!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত