Ajker Patrika

সৃজনশীলতা ও জ্ঞানের দেবী সরস্বতী

বিভুরঞ্জন সরকার 
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বিদ্যার দেবী সরস্বতীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের এক বিশেষ দিন সরস্বতী পূজা। এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং জ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পকলার প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রতিফলন। প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘বসন্ত পঞ্চমী’ নামেও পরিচিত। বসন্তের আগমনী বার্তা নিয়ে এই পূজা জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হিসেবে মানুষের মনকে উদ্ভাসিত করে তোলে।

সরস্বতী দেবী হিন্দু পুরাণে জ্ঞান, সংগীত ও সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হন। সাধারণত তাঁকে শুভ্র বসনে, হাতে বীণা, পুস্তক এবং অক্ষরজ্ঞান দানকারী মুদ্রাসহ চিত্রিত করা হয়। এসব প্রতীক বিদ্যার মহিমা ও পবিত্রতা তুলে ধরে। বীণা সংগীতের প্রতীক, পুস্তক জ্ঞানের, মালা ধ্যান ও মননশীলতার এবং জলপাত্র পবিত্রতার প্রতীক। সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতার প্রতীক, যা আমাদের জীবনে সত্যের পথ বেছে নেওয়ার বার্তা দেয়। কখনো কখনো তাঁকে ময়ূরের ওপর আসীন দেখানো হয়, যা অহংকার বর্জনের প্রতীক। ময়ূর রূপের মোহে আচ্ছন্ন থাকে, আর সরস্বতী আমাদের শেখান—বিদ্যা বিনয় প্রদান করে।

দেবী সরস্বতীকে প্রথমে আমরা এক নদীরূপে কল্পনা করেছিলাম; পরে বিদ্যা, সংগীত ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পূজা করতে শুরু করি। তিনি কেবল বিদ্যার দেবী নন, সংগীত, সাহিত্য, শিল্পকলারও রক্ষক। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতসহ নানান সাহিত্যকর্মে দেবী সরস্বতীর বিভিন্ন কাহিনি ও রূপের বিবরণ পাওয়া যায়।

পুরাণ থেকে জানা যায়, সরস্বতী একসময় এক বিশাল ও পবিত্র নদী ছিলেন, যার সঙ্গে নারী জাতির শুচিতার গভীর সম্পর্ক ছিল। দেবলোকের অপ্সরাদের মধ্যেও সরস্বতীর প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট।

রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের কাহিনিতে সরস্বতীর ভূমিকা এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিশ্বামিত্র ব্রহ্মর্ষি হতে ব্যর্থ হয়ে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের প্রতি ক্রুদ্ধ হন এবং সরস্বতী নদীকে আদেশ দেন বশিষ্ঠ মুনির আশ্রম ভাসিয়ে দিতে। সরস্বতী এই আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানালে বিশ্বামিত্রের অভিশাপে তিনি রক্তরূপী নদীতে পরিণত হন। মহাদেব এই অবস্থা মেনে নিতে না পেরে বর প্রদান করেন, যাতে সরস্বতী তাঁর আগের রূপ ফিরে পান এবং নারীশ্রেষ্ঠার মর্যাদায় ভূষিত হন।

এ ঘটনার পর বিশ্বামিত্র আরও কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত হয়ে অপ্সরাদের মাধ্যমে তাঁর ধ্যানভঙ্গের পরিকল্পনা করেন। উর্বশী ও রম্ভা ব্যর্থ হলে মেনকাকে পাঠানো হয়। মেনকা সরস্বতী নদীতে স্নান করে পবিত্র হয়ে বিশ্বামিত্রের মন ভঙ্গ করতে সক্ষম হন। এরপর বিশ্বামিত্র ব্রহ্মর্ষি হওয়া কিংবা স্বর্গের অধিপতি হওয়ার পরিবর্তে এক নতুন পথে এগিয়ে যান এবং ইতিহাস এক নতুন ধারায় প্রবাহিত হয়।

সরস্বতী মূলত বৈদিক দেবী। ‘সরস’ শব্দের অর্থ জল, ফলে ‘সরস্বতী’ অর্থ ‘জলবতী’ বা নদী। পরবর্তীকালে তিনি জ্ঞান ও বিদ্যার প্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনি বিদ্যাদেবী, বীণাপাণি, কুলপ্রিয়া, পলাশপ্রিয়া নামেও পরিচিত। দেবীর চার হাতের মধ্যে একটিতে বীণা, একটিতে পুস্তক, একটিতে মালা এবং অন্যটিতে জলপাত্র থাকে। অনেক জায়গায় তিনি দুই হাতে বীণা ধারণ করেও চিত্রিত হন।

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সরস্বতী পূজা বিশেষভাবে উদ্‌যাপিত হয়। শিক্ষার্থীরা, শিল্পীরা ও বিদ্যানুরাগীরা এই দিনে দেবীর আশীর্বাদ কামনা করেন। বিশেষ করে বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পূজার আয়োজন করে। প্রতিমা স্থাপন, সাজসজ্জা, প্রসাদ বিতরণ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।

একটি উল্লেখযোগ্য প্রথা হলো ‘হাতে খড়ি’, যেখানে শিশুদের প্রথমবারের মতো লেখার শিক্ষা দেওয়া হয়। এটি বিদ্যার সূচনা হিসেবে ধরা হয় এবং অভিভাবকেরাও এই বিশেষ দিনে সন্তানদের নতুন খাতা-কলম দেবীর চরণে অর্পণ করেন। অনেক শিক্ষার্থী তাদের বই-খাতা ও কলম দেবীর সামনে রেখে শুভাশীর্বাদ কামনা করে।

সরস্বতী পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এর অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক। সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক—এসব মিলিয়ে এটি এক অনন্য সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূজা উদ্‌যাপনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীরা একত্রিত হয়, যা সৌহার্দ্যের বন্ধন গড়ে তোলে।

সরস্বতী পূজা জ্ঞান ও সৃজনশীলতার এক অনন্য উৎসব, যা শিক্ষার গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং বিদ্যা ও শিল্পের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে জাগ্রত করে। আজকের দিনে যখন প্রযুক্তি ও তথ্যের যুগে আমরা বসবাস করছি, তখন সরস্বতী পূজার তাৎপর্য আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা উচিত। জ্ঞানের এই আলোকবর্তিকা আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাক—এই কামনা।

‘বিদ্যার আলোয় আলোকিত হোক সকল প্রাণ, সরস্বতীর আশীর্বাদে জ্ঞান হোক মহান!’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিবিসি বাংলার সমালোচনার পর দুঃখপ্রকাশ করলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব

ছুটি না দেওয়ায় চার সহকর্মীকে ছুরিকাঘাত করে সদর্পে হাঁটা দিলেন সরকারি কর্মকর্তা

ভারতকে যুদ্ধের হুমকি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের

হাসিনার বক্তব্যে ‘ভারতের দায় নেই’, বাংলাদেশের দূতকে পাল্টা তলব

বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে সব পুলিশ সদস্য ক্ষুব্ধ: পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত