Ajker Patrika

বাস্তবতার ধারাবাহিকতা

শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের সমস্যা, সেটির সমাধান তো হয়ইনি, উল্টো ধনবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে যে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আগের শাসকদের মতোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাই অব্যাহত রেখেছেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাস্তবতার ধারাবাহিকতা

একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনার ভেতরই প্রোথিত ছিল। সিরাজুল আলম খানের নিজের ব্যাপারটা মূলত ছিল ব্যক্তিগত; ক্ষমতার উত্তরাধিকার তাঁরই প্রাপ্য—এটা ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস; কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শেখ মুজিবের ভগিনীপুত্র শেখ ফজলুল হক মনি। সিরাজুল আলম খান তাঁর নিজের শক্তির প্রমাণ দেখাতে চেয়েছিলেন এবং সেটা প্রধান কারণ। এ জন্য তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। প্রকৃত সমাজতন্ত্রীরা তখন মাঠে দৃশ্যমান নন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ‘উগ্রপন্থী’ বলে চিহ্নিত, তাঁরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে গোপন তৎপরতায় ছিলেন। এরাই আবার কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, নয়তো রয়েছেন কারাগারে বন্দী অবস্থায়। কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন। তার আগেই এ দেশে রুশ-চীন বিভাজন ঘটে। এই বিভাজন বাম আন্দোলনে বড় ক্ষতি করে।

স্বাধীনতার পরে রুশপন্থীরাই ছিলেন দৃশ্যমান।

তাঁরা ‘উগ্রপন্থা’ তো শুরুতেই পরিহার করেছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী শাসকেরা যে পূর্ববঙ্গকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেটা অনুধাবনেও তাঁদের বিস্তর বিলম্ব ঘটে। ফলে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর দ্বন্দ্বটাই যে তখন প্রধান ছিল, এটা না বুঝে তাঁরা ‘সারা’ পাকিস্তানেই শ্রেণিসংগ্রাম অব্যাহত রেখে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পরে উঠতি বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যে শাসনক্ষমতা পেয়ে গেছেন, এটা তাঁরা দেখেও দেখতে চাইলেন না। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই শাসকদের সহায়তাতেই অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজটি সমাপ্ত করার। উগ্রপন্থা পরিহারের জন্য মস্কো থেকে তখন তাঁরা পরামর্শও পেয়েছিলেন বৈকি। পরিস্থিতিটা এ রকম দাঁড়িয়েছিল যে রুশপন্থীরা সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, চীনপন্থীরা মাঠে নেই, সমাজতন্ত্রের আওয়াজটা সমর্থক পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে এবং আওয়াজটা জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। হিটলার-মুসোলিনির নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিজমকে রুখে দেওয়ার জন্য ইউরোপে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতন্ত্রীরাও তেমন পন্থা ধরেই এগোতে থাকলেন। ‘মুজিব-বিরোধী’ জাতীয়তাবাদীরা খাড়া করলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আসলে উভয় দলই ছিল যথার্থ সমাজতন্ত্রের বিরোধী, যদিও উভয় দলই সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলে দাবি করত।

বামপন্থীদের দমনে সরকার তো তৎপর ছিলই, জাসদও তাতে যুক্ত হলো, যদিও প্রচ্ছন্নভাবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের গলা-ফাটানো আওয়াজ তুলে সামাজিক বিপ্লবের জন্য অধীর হয়ে পড়েছিল যে তরুণেরা, তাদের একাংশকে তারা নিজেদের দলে টেনে নিয়ে বিপ্লব-বিরোধিতার অন্ধগলিতে ঠেলে দিল। একই সঙ্গে আবার সম্ভাব্য সমাজবিপ্লবীদের উন্মোচন করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সহায়ক হলো। লাল পতাকা তুলে লাল পতাকার বিরোধিতা করার আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশেই সংঘটিত হলো বৈকি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে, তখন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, জাতীয়তাবাদের কথা তাঁর বক্তৃতায় শোনা যায়নি। এর কারণ এই যে যুদ্ধটা যেহেতু চলছিল জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই এবং এর অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষাটা যেহেতু ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্র থেকে কেবল যে আয়তনে নয়, চরিত্রেও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাই জাতীয়তাবাদের কথা বলা ছিল অপ্রয়োজনীয়।

জাতীয়তাবাদের কথা না-বলার পেছনে অবশ্য আরও একটি কারণ ছিল, সেটা হলো ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনাগ্রহ। ইন্দিরা গান্ধীর শঙ্কা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম না আবার দুই বাংলার মানুষদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ সৃষ্টি করে। তেমন আবেগ প্রবল হলে বাংলাদেশের বামপন্থীদের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনবিরোধী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের একটি মিলনের সূত্রপাত ঘটে যেতে পারে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের দৃষ্টান্ত তো চোখের সামনেই ছিল; জাতীয় মুক্তির ওই লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে, দুই বাংলার কমিউনিস্টরা ওই রকম কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, এমন শঙ্কা ভারতীয় শাসকদের কাছে অমূলক ঠেকেনি। ইন্দিরা গান্ধী তখন নকশালবাড়ী আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তিনি তাই চাননি যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থী তরুণেরা যোগ দিক। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ও ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিন্ন।

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বিশেষভাবেই বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন নেতা। ভারতে তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে যাননি, গিয়েছিলেন যোদ্ধা হিসেবে। যুদ্ধের ব্যাপারে সহায়তা চাইবার জন্য দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত পতাকার একটি নমুনা সঙ্গে রেখেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পতাকার ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্রের অবস্থান দেখিয়ে এই বলে আশ্বস্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যে বাংলাদেশ বলতে তাঁরা শুধু পূর্ববঙ্গকেই বোঝেন, তার বাইরের বাংলাভাষী অঞ্চলকে নয়। ‘জয় বাংলা’র অর্থ গোটা বাংলার জয় নয়, পূর্ববঙ্গের জয় হোক, এটাই তাঁরা চান; তার বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হোক, এটা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীদের দল আওয়ামী লীগ যেমন চায়নি, সেটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না ভারতের জাতীয়তাবাদীদেরও; বহির্বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর তো বটেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকেও দ্রুত যুদ্ধাবসান কাঙ্ক্ষিত ছিল। কারণ ওই একই—নতুন একটি ভিয়েতনামের অভ্যুদয়ের শঙ্কা।

নানা দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের আওয়াজই যথেষ্ট ছিল, জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তোলা ছিল অনাবশ্যক। কিন্তু শেখ মুজিব যখন পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে এলেন, জাতীয়তাবাদের আওয়াজটা তারপর থেকেই উঠতে থাকল। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের দাবিকে দুর্বল করার জাতীয়তাবাদী যে চিন্তা মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ধারণ করতেন, যুদ্ধ শেষে সেটিকেই ফেরত আনতে তিনি উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সঙ্গেই কেবল নয়, একেবারে প্রথমেই জাতীয়তাবাদকে স্থান দেওয়া হলো। আর এই সংযোজনের তাৎপর্য প্রকাশ পেল বাঙালি ছাড়াও যেসব স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষ বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে, সংবিধানে তাদের অস্তিত্বই অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। এমনকি তাদেরকে বাঙালি হয়ে যেতেও বলা হয়েছিল; অনেকটা সেভাবেই, একদা যেভাবে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের বলা হয়েছিল পাকিস্তানি বনে যেতে। বিদগ্ধজনদের মুখে এবং তাঁদের লেখাতেও বলা শুরু হলো যে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র। এটি যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, সে ধরনের প্রত্যাশা তাঁদের খেয়ালে রইল না।

পরাধীন ভারতবর্ষে মূল সমস্যাটি ছিল শ্রেণির; এবং সেটিকে সামনে আনার জন্যই জাতি সমস্যার সমাধান অত্যাবশ্যক ছিল। সাতচল্লিশের পরে পাকিস্তানের ব্যাপারেও ছিল ওই একই কথা। জাতি সমস্যার সমাধানের সেখানেও প্রয়োজন ছিল শ্রেণি সমস্যা সমাধানে হাত দেওয়ার জন্য। একাত্তরে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হলো, জাতি সমস্যার পুরোপুরি না হলেও একরকমের সমাধান মিলল। স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগুলোকে সাংবিধানিকভাবে অবশ্য এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তবু তারা যে আছে, সেটা মেনে নেওয়া হয়েছে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিদানের পর থেকে বাংলাদেশে অন্তত সরকারিভাবে বাংলা ভাষা ছাড়াও অন্য মাতৃভাষাগুলো রক্ষা করার এবং স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষদের জন্য প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তাটা স্বীকৃতি পেয়েছে।

কিন্তু মূল যে সমস্যা—শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের সমস্যা, সেটির সমাধান তো হয়ইনি, উল্টো ধনবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে যে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আগের শাসকদের মতোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাই অব্যাহত রেখেছেন। আর পুঁজিবাদী উন্নয়ন যে ধনবৈষম্য বাড়াতে বাধ্য, সেটা তো সর্বজনবিদিত।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার বন্ধ ঘোষণা

হাদির অবস্থা আশঙ্কাজনক, মস্তিষ্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত, ফুসফুসেও আঘাত: মেডিকেল বোর্ড

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২ অবিলম্বে চালু হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

সুদানে সন্ত্রাসী হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ শান্তিরক্ষী নিহত, যুদ্ধ চলমান: আইএসপিআর

মেসিকে কলকাতায় আনার মূল উদ্যোক্তা আটক

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ