Ajker Patrika

ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা ফুল বেঁচে থাক

রাজিউল হাসান
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’—শিশুর জন্য পৃথিবীর জঞ্জাল সরাতে চেয়েছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। মাঝেমধ্যেই আমরা নানা আয়োজনে, নানা কারণে তাঁর ‘ছাড়পত্র’ কবিতার এই পঙ্‌ক্তিগুলো আওড়াই। দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দিই, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা বিশ্বটাকে আরও বাসযোগ্য করব। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কতটা রাখতে পারছি? জঞ্জাল তো সরছেই না, বরং এই আধুনিক যুগেও পৃথিবীর বুকে শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই কিছু নবজাতকের ঠাঁই হয় আবর্জনার স্তূপে, অকারণে-নিঃশব্দে ঝরে যায় তাদের প্রাণ।

পৃথিবীটা সুন্দর। জীবন আরও সুন্দর। কিন্তু এত এত সুন্দরের মাঝে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা সম্ভবত ডাস্টবিনে নবজাতকের ঠাঁই হওয়া। আবর্জনার স্তূপ কেন কিছু নবজাতকের ঠিকানা হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রতিটা প্রাণই গুরুত্বপূর্ণ। সেই প্রেক্ষাপট থেকে জীবন বাঁচানোর দিকে মনোযোগ আকর্ষণই এ লেখার উদ্দেশ্য। কারও জীবনে সেই নবজাতক সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই নিজের কিংবা সঙ্গীর নাড়ি ছেঁড়া ধনকে এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। সভ্য জগতে এমনটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

মানবাধিকার সংগঠন সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্যের বরাত দিয়ে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকায় গত ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালে সারা দেশে মোট ৯৪টি নবজাতক উদ্ধার হয়েছে। তার মধ্যে ৬৪টিই মৃত।

১২ এপ্রিল ‘বিশ্ব পথশিশু দিবস’ সামনে রেখে গত ১০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘ডা. মুজিব নিউবর্ন ফাউন্ডেশন’। এই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নবজাতকসহ বিভিন্ন বয়সী শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ হাজার পথশিশু ও নবজাতকের সন্ধান মিলেছে। তাদের মধ্যে ৮০০ ছিল নবজাতক। ২০২৪ সালে উদ্ধার হওয়া নবজাতকদের ৬৮ শতাংশই উদ্ধার হয়েছে মৃত অবস্থায়। অথচ পৃথিবীর নতুন এই অতিথিদের জীবন এভাবে চোখ মেলার আগেই শেষ হওয়ার কথা ছিল না। তাদের থাকার কথা ছিল মায়ের কোলে, পরিবারের আলো হয়ে। কিন্তু তা না হয়ে তাদের ঠিকানা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে।

অথচ এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে আমাদের সমাজে। একটা সন্তানের জন্য অনেক দম্পতির জীবন অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা সেই নবজাতকের সঙ্গে যদি কোনোভাবে ওই সব দম্পতির যোগসূত্র ঘটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলেই কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একটু সচেতন আর উদ্যোগী হলে এই যোগসূত্র ঘটানো সম্ভব, ঠেকানো সম্ভব নতুন প্রাণগুলোর ঝরে পড়া।

একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তার প্রতি যেমন মা-বাবার দায়িত্ব থাকে, একইভাবে দায়িত্ব থাকে রাষ্ট্রেরও। উন্নত বিশ্বে শিশুর দায়দায়িত্ব পালনে মা-বাবা ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র রীতিমতো হস্তক্ষেপ করে বসে। বলিউডে এ নিয়ে একটি ছবিও আছে—‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’। ছবিটিতে যদিও কোল থেকে সন্তান কেড়ে নেওয়ার পর একজন মায়ের আকুতি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে বড় একটি বার্তাও আছে। নরওয়ে, ফিনল্যান্ডসহ উন্নত রাষ্ট্রগুলো মনে করে, আজকের শিশু আগামী দিনের সম্পদ। কাজেই তার সুরক্ষা, তাকে বড় করে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। মা-বাবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা যদি কোনোভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে রাষ্ট্র নিজেই সে দায়িত্ব নিয়ে নেবে।

এমন ব্যবস্থার কারণেই উন্নত বিশ্বে ডাস্টবিন কখনো কোনো নবজাতকের ঠিকানা হয় না। এমন ঘটনা কেবল ঘটে আমাদের দেশের মতো উন্নত হওয়ার চেষ্টায় থাকা দেশগুলোয়। কারণ, এখানে এখনো আজকের শিশুকে আগামীর সম্পদ বলে মনে করা হয় না।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঠেকানোর উপায় কী? আমাদের দেশে অবশ্য একটি সমাধান আছে। সেটা হলো সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘ছোটমনি নিবাস’। সারা দেশে ছয়টি বিভাগে পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন ০-৭ বছর বয়সী উদ্ধারকৃত শিশুদের এখানে লালনপালন করা হয়। কিন্তু ডাস্টবিনে পড়ে থাকা শিশুকে উদ্ধার করে সেই নিবাস পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়। এর পাশাপাশি যদি হাসপাতালগুলোয় ‘নবজাতক ব্যাংক’ থাকত, তাহলে হয়তো ডাস্টবিনে নবজাতকের ঠাঁইই হতো না। তারপরও যদি কোনো নবজাতককে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা হয়, তার জীবন অন্তত সেই আবর্জনার স্তূপেই শেষ হতো না। এই ব্যবস্থা এমনভাবে করা যেতে পারে যেখানে কেউ চাইলে তাঁর ‘অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানকে’ ডাস্টবিনে ছুড়ে না ফেলে নবজাতক ব্যাংকে রেখে যাবেন। সেখানে তাঁর পরিচয় গোপন থাকবে। আগ্রহী দম্পতিরা হাসপাতালে যোগাযোগ করে সেই ব্যাংক থেকে সন্তান দত্তক নিতে পারবেন। এতে সন্তানহীন দম্পতিরা যেমন মা-বাবা হওয়ার স্বাদ পাবেন, একইভাবে মা-বাবাহীন নবজাতকগুলোও পরিবার খুঁজে পাবে।

কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, দেশজুড়ে থাকা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের এতিমখানা, সমাজসেবা অধিদপ্তরের ‘ছোটমনি নিবাস’ থেকেই তো দত্তক নেওয়া যায়। হাসপাতালে আবার ‘নবজাতক ব্যাংক’ খোলার ঝক্কি নিতে হবে কেন? ওপরে যে তথ্যগুলো আমি উল্লেখ করেছি, তাতেই এই প্রশ্নের জবাব রয়েছে। একটি তথ্য আবার উল্লেখ করছি—২০২৪ সালে উদ্ধার হওয়া নবজাতকদের ৬৮ শতাংশই উদ্ধার হয়েছে মৃত অবস্থায়।

একটি শিশুর জন্মের পর তার কিছু সেবার প্রয়োজন হয়। সেই সেবাটা না পেলে তার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যায়। কাজেই একটি নবজাতককে ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করে ‘ছোটমনি নিবাস’ কিংবা এতিমখানায় নেওয়ার চেয়ে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া জরুরি। হাসপাতালে যদি ‘নবজাতক ব্যাংক’ থাকে, তাহলে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা শিশুগুলোর জন্য সেই সেবা পাওয়া সহজ হবে। ফলে শিশুদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে না, অকালে ঝরবে না তাদের প্রাণ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ