জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রুশ বাহিনী ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনে। এটা এখন আর নতুন খবর নয়। যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেবে, তা নিয়েও চলবে বিচার-বিশ্লেষণ। কিন্তু কী করে রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্ক এই নাজুক পর্যায়ে পৌঁছাল, সে বিষয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক। ছাড়া-ছাড়াভাবে তা বলা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু একসঙ্গে পুরো ঘটনাটা দেখতে গেলে আমাদের যেতে হবে একেবারে ১৯৯২ সালে। এই পথটুকু পিছিয়ে না গেলে আজকের ২০২২ সালের সংকটটি বুঝতে পারা যাবে না।
আমরা তো ইতিমধ্যে জেনে গেছি, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘কিয়েভ রুস’-এর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। যখন এখনকার রাশিয়া ও ইউক্রেন দুটো দেশই ছিল কিয়েভ রুশের অংশ। বেলারুসকেও এর বাইরে রাখা যাবে না।
তবে রুশ প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণে এ কথাও বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মানুষ সব সময় একরকম করে ভাবেনি। তাই তাদের চলার পথও সব সময় একদিকে হয়েছে এমনও নয়। ফলে তৈরি হয়েছে দুটো ভাষা, দুটো সংস্কৃতি। দুই জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি দুই ধরনের বটে, কিন্তু তারা একই পরিবারভুক্ত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর।
বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সময়কে ভাগ করলে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বোঝা সহজ হবে।

প্রথম ধাপ: ১৯৯২-২০০৩
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বেলারুসের এক খামারবাড়িতে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুসের তিন প্রেসিডেন্ট এক বৈঠক করেন। প্রাসাদোপম সেই বাড়িতে ছিল বিলাসের সব আয়োজন। সেখানে বসেই এই তিন নেতা (রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক ও বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তালিস্লাভ শুশকিয়েভিচ) সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার বিষয়ে কথা বলেন। মনে রাখতে হবে, তত দিনে বার্লিন দেওয়াল ভেঙে গেছে ঠিকই, কিন্তু টিকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তখনো মিখাইল সের্গিয়েভিচ গরবাচেভ।
এই তিন প্রেসিডেন্ট নিজেদের মধ্যে একটি হালকা সম্পর্ক বজায় রেখে আলাদা হয়ে যাওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর একটি কমনওয়েলথ তৈরি করা হলো আলমাআতা চুক্তির মাধ্যমে, যেখানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১১টি দেশ স্বাক্ষর করল। প্রি-বাল্টিকের তিনটি দেশ আগেই বের হয়ে গিয়েছিল। এই চুক্তিতে জর্জিয়া স্বাক্ষর করেনি।
চুক্তি সাক্ষর হওয়ার পর গর্বাচেভ হয়ে গেলেন নিধিরাম সর্দার। তাঁর হাতে আর কোনো ক্ষমতা রইল না।
ইউক্রেন তখন থেকেই পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে ছিল। ক্রেমলিন, অর্থাৎ রুশদের জন্য তা ছিল বিড়ম্বনার। মনে রাখতে হবে, সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার হিসেবে ইউক্রেনে ১০ লাখ সোভিয়েত সেনা ছিল, ছিল পরমাণু অস্ত্রের একটি বড় অংশ। মিসাইলগুলো ইউক্রেন আর নিজের দখলে রাখেনি। তারা তা রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে নিজেদের জন্য চেয়েছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। কিন্তু এখানে বলতে হবে, পারমাণবিক অস্ত্র না রাখলেও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। যে কারণে ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে সেই স্থাপনাগুলোয় আবার পারমাণবিক অস্ত্র রাখা যাবে, সেই আশঙ্কা আছে। সেটা রাশিয়ার মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে।
যত দিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের বিষয়ে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, তত দিন পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সে সময় দুই দেশের মধ্যে কোনো সংঘর্ষও হয়নি। তবে এ জায়গায় একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হবে। ১৯৯২ সালে যখন চেরনোমোরস্কি ফ্লোতের (ফ্লিট) একটি জাহাজে ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং সেই যুদ্ধজাহাজ সেভাস্তাপোল থেকে ওদেসায় চলে যায়। সে সময় গোলাগুলির কিছু ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু বর্তমান সংকটের তুলনায় তা ছিল মামুলি।
মনে রাখতে হবে, সে সময় রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ছিল খুব দুর্বল একটি দেশ। চেচেন যুদ্ধ তাদের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চেরনোমোরস্কি ফ্লোত (ফ্লিট) ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় রাশিয়া মেনে নিল ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তরেখা। তখন ক্রিমিয়া ছিল ইউক্রেনের অংশ।
এখানে আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি খুবই নির্দয় হয়ে উঠেছিল। অকারণ জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা ইউক্রেনের স্কুলগুলো থেকে রুশ ভাষা উঠিয়ে দিয়েছিল। এটা খুব ভালো কাজ হয়নি। ইউক্রেনে স্বাভাবিক কারণেই রুশ জাতির মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনে। তাদের জন্য এ ছিল এক বড় ধরনের অপমান। সে কথা ইউক্রেনের সরকারগুলো কখনোই আমলে নেয়নি। ফলে পরবর্তীকালে ইউক্রেনের যে শহর বা অঞ্চলগুলোয় রুশ জাতির মানুষ বেশি, সেসব অঞ্চলে ইউক্রেন থেকে বিযুক্ত হওয়ার আন্দোলন সুদৃঢ় হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপ: সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ের বন্ধুত্বে ছেদরেখা
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে প্রথম বড় ধরনের সংকট শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভ্লাদিমির পুতিনই তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের তুজলা দ্বীপের কেরচেন প্রণালিতে একটা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এটা ইউক্রেনের সীমান্তের অভ্যন্তরের এলাকা। রুশ এলাকা নয়। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট বৈঠক করার পর এই সংকটের নিরসন হয়। বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ করে রাশিয়া। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের চিড় ধরে।
২০০৪ সালে ইউক্রেনের নির্বাচনে রাশিয়া তাদের অনুসারী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সে সময় ইউক্রেনের ‘কমলা বিপ্লব’ ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পশ্চিমের দিকে হেলে থাকা ভিক্তর ইউশেঙ্কো। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নেয়। ইউশেঙ্কোর শাসনামলে রাশিয়া ২০০৬ ও ২০০৯ সালে দুবার তেলের পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বিঘ্নিত হয়।
রাশিয়া এখন সমুদ্রের অভ্যন্তর দিয়ে আরেকটি পাইপলাইন তৈরি করছে, যা ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাবে না। এটা তৈরি হলে ইউরোপে তেল রপ্তানির সময় রাশিয়াকে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে তেল প্রবাহিত করতে হবে না। এটা ইউক্রেনের জন্য মাথাব্যথার কারণ। এই খাতে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সমাগম ঘটে।
বর্তমান সংকটকে বুঝতে হলে ২০০৮ সালে ঘটা একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সে বছর ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। পুতিন এই পরিকল্পনার কড়া প্রতিবাদ করেছিলেন। মস্কো তখন বলেছিল, ইউক্রেনকে পূর্ণ স্বাধীন দেশ হিসেবে তারা স্বীকার করে না। এরপর ফ্রান্স ও জার্মানি জর্জ বুশের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হবে—এ কথা বলা হয় ঠিকই, তবে সেটা কবে দেওয়া হবে, তা উল্লেখ করা হয় না।
ন্যাটোতে যোগ দেওয়া হলো না বলে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার প্রয়াস নিয়েছিল ২০১৩ সালে। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেয়। রপ্তানির পথ বন্ধ হয়ে যায় ইউক্রেনের। ফলে ইউক্রেন ব্রাসেলস চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। রাশিয়ার চাপে পড়েই তারা চুক্তি সই করছে না, তা জানিয়ে দেয়। ২০১০ সালে ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনিই এই কাজ করেন। তাতে ইউক্রেনজুড়ে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভের তোড়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান।
পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়া এ কথাই প্রচার করে। কিন্তু তারা একবারও বলে না, ইউক্রেনে ‘বিপ্লব’ আমদানি করার জন্য, তথা ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র কত টাকা খরচ করেছে। মার্কিনরাই এখন সে কথা বলছে। ইন্টারনেট ঘাটলে সে তথ্য হাজির হবে আপনার সামনে।

তৃতীয় ধাপ: ২০১৪-২০২১
এই সময়টিকে বলতে হবে ক্রিমিয়া ও দোনবাসের সময়। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের অংশ করে নেয়। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ করে দেন। তার আগে এটা ছিল রাশিয়ার অংশ। এ সময় রাশিয়া আবার ক্রিমিয়ার দখল নিয়ে নিল।
একই সঙ্গে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে দোনবাসে (দানিয়েৎস্ক অঞ্চলে) বিচ্ছিন্নতাবাদে মদদও দিয়েছে রাশিয়া। ফলে ‘লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র’ ও ‘দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র’ নামে দুটো প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কিয়েভ তার প্রতিক্রিয়া দেখায় খুব ধীরলয়ে। প্রথমে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ নাম দিয়ে এসব এলাকায় সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। তারা যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ইউক্রেনের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা তাতে প্রচণ্ড আঘাত পায়। তারা নিজেদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। ইউক্রেন সরকার যে নিজ দেশের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ব্যাপারে উদাসীন, সেটা অনুভব করে তারা।
২০১৪ সালে নরম্যান্ডি চুক্তির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট পিওতর পারাশেঙ্কোর। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছিলেন ফ্রান্স ও জার্মানির নেতারা। সেখানে রুশ ও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট একটা সমঝোতা চুক্তি করেন। তবে এর পর শুরু হয় মজার ব্যাপার। ইউক্রেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনঠাসা করে ফেলে। তারা প্রবল বিক্রমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধ চূর্ণ করে দিতে থাকে। কিন্তু আগস্ট মাসে রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। ইউক্রেন হেরে যায় ইলোভাইস্কির যুদ্ধে। এখানেই সংকট ঘণীভূত হয়। সেপ্টেম্বরে মিনস্কে দু দেশ শান্তি চুক্তি করে। কিন্তু শান্তির দেখা আর মেলেনি।
২০১৫ সাল থেকে অবস্থানগত যুদ্ধ শুরু হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যুদ্ধে নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে ছদ্মবেশী রুশ সেনা সদস্যরা রয়েছে। রাশিয়া তা অস্বীকার করে। দেবালৎসেভা শহরের কাছে ইউক্রেনীয় বাহিনী পরাজিত হয়। তখন ফ্রান্স ও জার্মানির সহায়তায় ‘মিনস্ক-২’ নামে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
২০১৯ সালে শেষবার একটি অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। গ্রীষ্ম এবং শরৎকালে দুই দেশই সম্মত হয়ে বেশ কয়েকটি এলাকায় নিজেদের বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু প্যারিসে নরম্যান্ডি ফরম্যাটের শীর্ষ সম্মেলনের পর আর কোনো বৈঠক হয়নি। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে অস্বীকার করেছিল। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ‘মিনস্ক-২’ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার অভিযোগ আনে। ২০২১ সালে, রাশিয়ান ফেডারেশন দুবার ইউক্রেনের সীমানায় সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল; বসন্ত এবং শরতের শেষের দিকে।
একই বছরের ডিসেম্বরে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথমবারের মতো ইউক্রেন এবং অন্যান্য সোভিয়েত-পরবর্তী দেশগুলোকে জোটে গ্রহণ না করার এবং তাদের সামরিক সহায়তা না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে একটি আল্টিমেটাম জারি করেন। জোট সে আলটিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে। ন্যাটো জোট আরও পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল। এটা রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি। কিন্তু ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তা আমলে নেয়নি।
অতঃপর ২০২২: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র ও লুগানস্ক প্রজাতন্ত্রকে এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই দুই প্রজাতন্ত্রই রাশিয়া-লাগোয়া এবং ইউক্রেনের অংশ। রুশ প্রেসিডেন্টের এ স্বীকৃতি ইতিমধ্যেই রুশ আইনসভায় অনুমোদন পেয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় রুশ নেতা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, রুশ ফেডারেশন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এই হামলা শুধু লুগানস্ক ও দানিয়েৎস্কেই চালানো হচ্ছে না, রুশ সেনারা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বোমা হামলা শুরু করেছে।
এই যুদ্ধ কোনদিকে যাবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আসছে। কিন্তু রাশিয়া এরই মধ্যে নিজেদের রিজার্ভ নিয়ে গেছে শক্ত অবস্থানে। তবে যুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে রাশিয়া সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে ন্যাটো শুধু বৈঠক করে যাবে, নাকি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অস্ত্র হাতে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়াবে, সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যুদ্ধের কয়েকদিনের মধ্যেই। আপাতত তেমন কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রথমে ন্যাটোর আচরণে আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এখন শান্তির কথা বলছেন। রাশিয়া এখনো থামেনি। তাই এখনো যতি চিহ্ন টানা যাচ্ছে না।
আর একটা কথা না বললেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমছে, রাশিয়ায় পুতিনও চলছেন একনায়কত্বে বলীয়ান হয়ে, জনসমর্থনের ধার না ধেরে। তাঁরা দুজনই নতুন করে জনপ্রিয়তা বাড়াতে চান। তাঁদের এই জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বলি হলো কিনা ইউক্রেন, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে!

যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। রুশ বাহিনী ঢুকে পড়েছে ইউক্রেনে। এটা এখন আর নতুন খবর নয়। যুদ্ধ কোনদিকে মোড় নেবে, তা নিয়েও চলবে বিচার-বিশ্লেষণ। কিন্তু কী করে রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্ক এই নাজুক পর্যায়ে পৌঁছাল, সে বিষয়ে একটু জেনে নেওয়া যাক। ছাড়া-ছাড়াভাবে তা বলা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু একসঙ্গে পুরো ঘটনাটা দেখতে গেলে আমাদের যেতে হবে একেবারে ১৯৯২ সালে। এই পথটুকু পিছিয়ে না গেলে আজকের ২০২২ সালের সংকটটি বুঝতে পারা যাবে না।
আমরা তো ইতিমধ্যে জেনে গেছি, ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘কিয়েভ রুস’-এর প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। যখন এখনকার রাশিয়া ও ইউক্রেন দুটো দেশই ছিল কিয়েভ রুশের অংশ। বেলারুসকেও এর বাইরে রাখা যাবে না।
তবে রুশ প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণে এ কথাও বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মানুষ সব সময় একরকম করে ভাবেনি। তাই তাদের চলার পথও সব সময় একদিকে হয়েছে এমনও নয়। ফলে তৈরি হয়েছে দুটো ভাষা, দুটো সংস্কৃতি। দুই জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি দুই ধরনের বটে, কিন্তু তারা একই পরিবারভুক্ত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর।
বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সময়কে ভাগ করলে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বোঝা সহজ হবে।

প্রথম ধাপ: ১৯৯২-২০০৩
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে বেলারুসের এক খামারবাড়িতে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুসের তিন প্রেসিডেন্ট এক বৈঠক করেন। প্রাসাদোপম সেই বাড়িতে ছিল বিলাসের সব আয়োজন। সেখানে বসেই এই তিন নেতা (রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক ও বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তালিস্লাভ শুশকিয়েভিচ) সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার বিষয়ে কথা বলেন। মনে রাখতে হবে, তত দিনে বার্লিন দেওয়াল ভেঙে গেছে ঠিকই, কিন্তু টিকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তখনো মিখাইল সের্গিয়েভিচ গরবাচেভ।
এই তিন প্রেসিডেন্ট নিজেদের মধ্যে একটি হালকা সম্পর্ক বজায় রেখে আলাদা হয়ে যাওয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর একটি কমনওয়েলথ তৈরি করা হলো আলমাআতা চুক্তির মাধ্যমে, যেখানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ১১টি দেশ স্বাক্ষর করল। প্রি-বাল্টিকের তিনটি দেশ আগেই বের হয়ে গিয়েছিল। এই চুক্তিতে জর্জিয়া স্বাক্ষর করেনি।
চুক্তি সাক্ষর হওয়ার পর গর্বাচেভ হয়ে গেলেন নিধিরাম সর্দার। তাঁর হাতে আর কোনো ক্ষমতা রইল না।
ইউক্রেন তখন থেকেই পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে ছিল। ক্রেমলিন, অর্থাৎ রুশদের জন্য তা ছিল বিড়ম্বনার। মনে রাখতে হবে, সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার হিসেবে ইউক্রেনে ১০ লাখ সোভিয়েত সেনা ছিল, ছিল পরমাণু অস্ত্রের একটি বড় অংশ। মিসাইলগুলো ইউক্রেন আর নিজের দখলে রাখেনি। তারা তা রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে নিজেদের জন্য চেয়েছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা। কিন্তু এখানে বলতে হবে, পারমাণবিক অস্ত্র না রাখলেও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো কিন্তু রয়ে গেছে। যে কারণে ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হলে সেই স্থাপনাগুলোয় আবার পারমাণবিক অস্ত্র রাখা যাবে, সেই আশঙ্কা আছে। সেটা রাশিয়ার মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে।
যত দিন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের বিষয়ে সরাসরি কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, তত দিন পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সে সময় দুই দেশের মধ্যে কোনো সংঘর্ষও হয়নি। তবে এ জায়গায় একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হবে। ১৯৯২ সালে যখন চেরনোমোরস্কি ফ্লোতের (ফ্লিট) একটি জাহাজে ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং সেই যুদ্ধজাহাজ সেভাস্তাপোল থেকে ওদেসায় চলে যায়। সে সময় গোলাগুলির কিছু ঘটনা ঘটেছিল, কিন্তু বর্তমান সংকটের তুলনায় তা ছিল মামুলি।
মনে রাখতে হবে, সে সময় রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে ছিল খুব দুর্বল একটি দেশ। চেচেন যুদ্ধ তাদের অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে চেরনোমোরস্কি ফ্লোত (ফ্লিট) ভাগাভাগি করে নেওয়ার সময় রাশিয়া মেনে নিল ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তরেখা। তখন ক্রিমিয়া ছিল ইউক্রেনের অংশ।
এখানে আরেকটি ব্যাপার না বললেই নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন রুশ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি খুবই নির্দয় হয়ে উঠেছিল। অকারণ জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে তারা ইউক্রেনের স্কুলগুলো থেকে রুশ ভাষা উঠিয়ে দিয়েছিল। এটা খুব ভালো কাজ হয়নি। ইউক্রেনে স্বাভাবিক কারণেই রুশ জাতির মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনে। তাদের জন্য এ ছিল এক বড় ধরনের অপমান। সে কথা ইউক্রেনের সরকারগুলো কখনোই আমলে নেয়নি। ফলে পরবর্তীকালে ইউক্রেনের যে শহর বা অঞ্চলগুলোয় রুশ জাতির মানুষ বেশি, সেসব অঞ্চলে ইউক্রেন থেকে বিযুক্ত হওয়ার আন্দোলন সুদৃঢ় হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপ: সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ের বন্ধুত্বে ছেদরেখা
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে প্রথম বড় ধরনের সংকট শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। ভ্লাদিমির পুতিনই তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের তুজলা দ্বীপের কেরচেন প্রণালিতে একটা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এটা ইউক্রেনের সীমান্তের অভ্যন্তরের এলাকা। রুশ এলাকা নয়। দুই দেশের প্রেসিডেন্ট বৈঠক করার পর এই সংকটের নিরসন হয়। বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ করে রাশিয়া। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে প্রথমবারের মতো বড় ধরনের চিড় ধরে।
২০০৪ সালে ইউক্রেনের নির্বাচনে রাশিয়া তাদের অনুসারী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে সমর্থন দেয়। কিন্তু সে সময় ইউক্রেনের ‘কমলা বিপ্লব’ ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পশ্চিমের দিকে হেলে থাকা ভিক্তর ইউশেঙ্কো। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্ক নতুন দিকে মোড় নেয়। ইউশেঙ্কোর শাসনামলে রাশিয়া ২০০৬ ও ২০০৯ সালে দুবার তেলের পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়। ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি বিঘ্নিত হয়।
রাশিয়া এখন সমুদ্রের অভ্যন্তর দিয়ে আরেকটি পাইপলাইন তৈরি করছে, যা ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাবে না। এটা তৈরি হলে ইউরোপে তেল রপ্তানির সময় রাশিয়াকে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে তেল প্রবাহিত করতে হবে না। এটা ইউক্রেনের জন্য মাথাব্যথার কারণ। এই খাতে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সমাগম ঘটে।
বর্তমান সংকটকে বুঝতে হলে ২০০৮ সালে ঘটা একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। সে বছর ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। পুতিন এই পরিকল্পনার কড়া প্রতিবাদ করেছিলেন। মস্কো তখন বলেছিল, ইউক্রেনকে পূর্ণ স্বাধীন দেশ হিসেবে তারা স্বীকার করে না। এরপর ফ্রান্স ও জার্মানি জর্জ বুশের এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হবে—এ কথা বলা হয় ঠিকই, তবে সেটা কবে দেওয়া হবে, তা উল্লেখ করা হয় না।
ন্যাটোতে যোগ দেওয়া হলো না বলে ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করার প্রয়াস নিয়েছিল ২০১৩ সালে। রাশিয়া তখন ইউক্রেনের সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেয়। রপ্তানির পথ বন্ধ হয়ে যায় ইউক্রেনের। ফলে ইউক্রেন ব্রাসেলস চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। রাশিয়ার চাপে পড়েই তারা চুক্তি সই করছে না, তা জানিয়ে দেয়। ২০১০ সালে ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনিই এই কাজ করেন। তাতে ইউক্রেনজুড়ে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভের তোড়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান।
পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়া এ কথাই প্রচার করে। কিন্তু তারা একবারও বলে না, ইউক্রেনে ‘বিপ্লব’ আমদানি করার জন্য, তথা ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র কত টাকা খরচ করেছে। মার্কিনরাই এখন সে কথা বলছে। ইন্টারনেট ঘাটলে সে তথ্য হাজির হবে আপনার সামনে।

তৃতীয় ধাপ: ২০১৪-২০২১
এই সময়টিকে বলতে হবে ক্রিমিয়া ও দোনবাসের সময়। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের অংশ করে নেয়। সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের অংশ করে দেন। তার আগে এটা ছিল রাশিয়ার অংশ। এ সময় রাশিয়া আবার ক্রিমিয়ার দখল নিয়ে নিল।
একই সঙ্গে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে দোনবাসে (দানিয়েৎস্ক অঞ্চলে) বিচ্ছিন্নতাবাদে মদদও দিয়েছে রাশিয়া। ফলে ‘লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র’ ও ‘দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র’ নামে দুটো প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কিয়েভ তার প্রতিক্রিয়া দেখায় খুব ধীরলয়ে। প্রথমে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ নাম দিয়ে এসব এলাকায় সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। তারা যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ইউক্রেনের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকেরা তাতে প্রচণ্ড আঘাত পায়। তারা নিজেদের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। ইউক্রেন সরকার যে নিজ দেশের রুশ বংশোদ্ভূত নাগরিকদের ব্যাপারে উদাসীন, সেটা অনুভব করে তারা।
২০১৪ সালে নরম্যান্ডি চুক্তির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট পিওতর পারাশেঙ্কোর। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ছিলেন ফ্রান্স ও জার্মানির নেতারা। সেখানে রুশ ও ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট একটা সমঝোতা চুক্তি করেন। তবে এর পর শুরু হয় মজার ব্যাপার। ইউক্রেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কোনঠাসা করে ফেলে। তারা প্রবল বিক্রমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতিরোধ চূর্ণ করে দিতে থাকে। কিন্তু আগস্ট মাসে রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। ইউক্রেন হেরে যায় ইলোভাইস্কির যুদ্ধে। এখানেই সংকট ঘণীভূত হয়। সেপ্টেম্বরে মিনস্কে দু দেশ শান্তি চুক্তি করে। কিন্তু শান্তির দেখা আর মেলেনি।
২০১৫ সাল থেকে অবস্থানগত যুদ্ধ শুরু হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যুদ্ধে নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে। ইউক্রেন অভিযোগ করে, এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে ছদ্মবেশী রুশ সেনা সদস্যরা রয়েছে। রাশিয়া তা অস্বীকার করে। দেবালৎসেভা শহরের কাছে ইউক্রেনীয় বাহিনী পরাজিত হয়। তখন ফ্রান্স ও জার্মানির সহায়তায় ‘মিনস্ক-২’ নামে আরেকটি চুক্তি সম্পাদন করে রাশিয়া ও ইউক্রেন।
২০১৯ সালে শেষবার একটি অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। গ্রীষ্ম এবং শরৎকালে দুই দেশই সম্মত হয়ে বেশ কয়েকটি এলাকায় নিজেদের বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি বাস্তবায়ন করেছিল। কিন্তু প্যারিসে নরম্যান্ডি ফরম্যাটের শীর্ষ সম্মেলনের পর আর কোনো বৈঠক হয়নি। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে অস্বীকার করেছিল। রাশিয়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ‘মিনস্ক-২’ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার অভিযোগ আনে। ২০২১ সালে, রাশিয়ান ফেডারেশন দুবার ইউক্রেনের সীমানায় সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছিল; বসন্ত এবং শরতের শেষের দিকে।
একই বছরের ডিসেম্বরে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রথমবারের মতো ইউক্রেন এবং অন্যান্য সোভিয়েত-পরবর্তী দেশগুলোকে জোটে গ্রহণ না করার এবং তাদের সামরিক সহায়তা না দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে একটি আল্টিমেটাম জারি করেন। জোট সে আলটিমেটাম প্রত্যাখ্যান করে। ন্যাটো জোট আরও পূর্বদিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল। এটা রাশিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি। কিন্তু ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তা আমলে নেয়নি।
অতঃপর ২০২২: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
দানিয়েৎস্ক প্রজাতন্ত্র ও লুগানস্ক প্রজাতন্ত্রকে এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি দিয়েছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই দুই প্রজাতন্ত্রই রাশিয়া-লাগোয়া এবং ইউক্রেনের অংশ। রুশ প্রেসিডেন্টের এ স্বীকৃতি ইতিমধ্যেই রুশ আইনসভায় অনুমোদন পেয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোর বেলায় রুশ নেতা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, রুশ ফেডারেশন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এই হামলা শুধু লুগানস্ক ও দানিয়েৎস্কেই চালানো হচ্ছে না, রুশ সেনারা ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বোমা হামলা শুরু করেছে।
এই যুদ্ধ কোনদিকে যাবে, তা এখনই বলে দেওয়া যাবে না। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আসছে। কিন্তু রাশিয়া এরই মধ্যে নিজেদের রিজার্ভ নিয়ে গেছে শক্ত অবস্থানে। তবে যুদ্ধ যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তাহলে রাশিয়া সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে ন্যাটো শুধু বৈঠক করে যাবে, নাকি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো অস্ত্র হাতে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়াবে, সেটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে যুদ্ধের কয়েকদিনের মধ্যেই। আপাতত তেমন কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি প্রথমে ন্যাটোর আচরণে আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং এখন শান্তির কথা বলছেন। রাশিয়া এখনো থামেনি। তাই এখনো যতি চিহ্ন টানা যাচ্ছে না।
আর একটা কথা না বললেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা কমছে, রাশিয়ায় পুতিনও চলছেন একনায়কত্বে বলীয়ান হয়ে, জনসমর্থনের ধার না ধেরে। তাঁরা দুজনই নতুন করে জনপ্রিয়তা বাড়াতে চান। তাঁদের এই জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বলি হলো কিনা ইউক্রেন, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে!

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রহমান। ঘটনার শিকার ছাত্রী ৫ অক্টোবর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর মামুন স্যারের নির্দেশে বিকেল সাড়ে ৪টায় থিসিসের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য তাঁর কাছে যাই। সেখানে স্যারের পক্ষ থেকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিক আচরণের সম্মুখীন হই। আমাকে হুমকি দেন, বিভাগের কোর্সগুলোতে তিনি পরীক্ষক হিসেবে আছেন। সুতরাং অনেক কিছু করতে পারেন।’ ২০২৩ সাল থেকে ওই শিক্ষক তাঁকে বিরক্ত করছেন। এ জন্য তিনি মানসিক ট্রমায় আছেন। এদিকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অপূর্ব রায়কে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি মুখ খুলতে বারণ করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয়, বরং তা বিবেক ও নীতি-নৈতিকতা অর্জনের জায়গা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করানোর নামে একজন ছাত্রীকে যে ধরনের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তা লজ্জাজনক তো বটেই, উচ্চশিক্ষার নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানও। আশঙ্কার বিষয় হলো, ওই ছাত্রী আড়াই মাস আগে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিভাগের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষক তাঁকে একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হুমকিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন নিজের পদমর্যাদাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ‘পরীক্ষক’ হওয়ার ভয় দেখান, তখন তা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার। দুই বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক ট্রমার মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে এবং বিভাগ তা আড়ালের চেষ্টা করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করবেন কোথায়?
আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোরভাবে সেটি পালন করতে হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে হবে, যাতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর একাডেমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের। কিন্তু সেই সম্পর্কের আড়ালে লালসা ও হুমকির সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সেই বিদ্যাপীঠ তার গৌরব হারায়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রহমান। ঘটনার শিকার ছাত্রী ৫ অক্টোবর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর মামুন স্যারের নির্দেশে বিকেল সাড়ে ৪টায় থিসিসের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য তাঁর কাছে যাই। সেখানে স্যারের পক্ষ থেকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিক আচরণের সম্মুখীন হই। আমাকে হুমকি দেন, বিভাগের কোর্সগুলোতে তিনি পরীক্ষক হিসেবে আছেন। সুতরাং অনেক কিছু করতে পারেন।’ ২০২৩ সাল থেকে ওই শিক্ষক তাঁকে বিরক্ত করছেন। এ জন্য তিনি মানসিক ট্রমায় আছেন। এদিকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অপূর্ব রায়কে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি মুখ খুলতে বারণ করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয়, বরং তা বিবেক ও নীতি-নৈতিকতা অর্জনের জায়গা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করানোর নামে একজন ছাত্রীকে যে ধরনের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তা লজ্জাজনক তো বটেই, উচ্চশিক্ষার নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানও। আশঙ্কার বিষয় হলো, ওই ছাত্রী আড়াই মাস আগে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিভাগের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষক তাঁকে একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হুমকিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন নিজের পদমর্যাদাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ‘পরীক্ষক’ হওয়ার ভয় দেখান, তখন তা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার। দুই বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক ট্রমার মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে এবং বিভাগ তা আড়ালের চেষ্টা করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করবেন কোথায়?
আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোরভাবে সেটি পালন করতে হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে হবে, যাতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর একাডেমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের। কিন্তু সেই সম্পর্কের আড়ালে লালসা ও হুমকির সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সেই বিদ্যাপীঠ তার গৌরব হারায়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর। বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সম
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির সেই সহযোদ্ধারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শত্রুতাও দেখা দিয়েছে পারস্পরিক।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের ছিল অতুলনীয় সাহসী এক বিদ্রোহ। আর দেশবাসীর একটি অত্যন্ত সংকটময় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয় যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই কিন্তু দেখা গেল, খালেদ মোশাররফ শিকার হয়েছেন অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের।
আবুল মঞ্জুর, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। তবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যুদ্ধের যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, যাঁর বিরুদ্ধে উল্টো গুঞ্জন ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার। মঞ্জুর হত্যা নিয়ে মামলা একটা হয়েছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।
যুদ্ধ করবেন বলে পাকিস্তান থেকে ছুটে এলেন আবু তাহের; যুদ্ধ করলেনও, যুদ্ধে একটি পা হারালেন। যুদ্ধশেষে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবী কর্মে; পরিণামে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হলো সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাঁদের পরিজনদের হত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে।
এম এ জলিল যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকেই; যুদ্ধের পরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্যের লুণ্ঠন তৎপরতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। জিয়াউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নীতি সঠিক নয় বলে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সর্বহারা পার্টিতে।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এসব ঘটনায় বোঝাই যাচ্ছিল, রাষ্ট্র স্থিতিশীলতা পায়নি। যুদ্ধের সময় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন আসবে। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। একবার নয়, কয়েকবার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য কোনো সামরিক বাহিনী থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, তা নিয়েই। থাকলেও সেটা কেমন ধরনের এবং কোন মাত্রার হবে, সেটা নিয়েও। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়নি। নতুন শাসকদের উদ্বেগ ছিল পুরোনো ব্যবস্থাকে আপৎকালীন বন্দোবস্ত হিসেবে হলেও চালু রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে পুরোনো আইনকানুন, আদালত, আমলাতন্ত্র—সবই চালু থাকল।
সামরিক বাহিনীও আগের ধরনেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়া—এই দুই ভাগের ভেতর নীরব ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হলো। গঠিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর একটি দ্বন্দ্বও দেখা দিল। সংবিধান প্রণীত হলো, কিন্তু দেখা গেল, তাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বের কথা ভুলে তাকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হলো। অনেকটা পাকিস্তানি কায়দাতেই।
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল, যুদ্ধের পরে সেটা প্রকট হলো এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব, পরে মন্ত্রিত্ব থেকেই অপসারিত হলেন। অব্যবস্থাপনার দরুন দেশে দুর্ভিক্ষের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। তাতে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়; আর বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড, পরীক্ষায় নকল, সম্পদ লুণ্ঠন—এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এমন আশা ছিল সর্বজনীন। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। অল্প পরে ১৯৭৫-এর শুরুতে এল একদলীয় শাসন। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটল না। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, আর সেটা ছিল সরকারের জন্য বিরাট এক মূলধন। কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকল, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ততই বাড়তে থাকল।
সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ঘটল, সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে এটা ঘটল। সরাসরি না হলেও ঘটনার পেছনে যে আমেরিকার সমর্থন ছিল, এই ধারণা অন্যায্য নয়। ক্ষমতায় এলেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ; তিনি যে মার্কিনপন্থী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমর্থন করেনি, তবে মেনে নিয়েছিল এবং চেষ্টা করেছিল নিজের প্রভাববলয়ের ভেতরে তাকে দ্রুত নিয়ে আসতে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় মোশতাকের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে আমেরিকার জন্য সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মোশতাক সরকারের চারিত্রিক ঝোঁকটা কোন দিকে, তা বোঝা গিয়েছিল ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা যখন ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে এল, বাংলাদেশ বেতারের নাম দিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে, তখনই।
মোশতাকের সেই ‘বিপ্লব’ অবশ্য টেকসই প্রমাণিত হয়নি, তিন মাস হতে না হতেই তিনি এবং তাঁর ‘সূর্য-সন্তানেরা’ উৎখাত হয়েছেন। তবে ব্যাপার সুবিধার নয় দেখে জেলখানায় লোক পাঠিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বন্দী চার শীর্ষ নেতাকে হত্যা করিয়েছেন। তারপরে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটেছে।
তারপরে এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পরে ‘গণতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে ছদ্মবেশী সেনাশাসন। এরপরে ভোটারবিহীন নির্বাচন। সবকিছুই হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে। অধরাই থাকল ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। আজও তাই বিজয়ের চুয়ান্ন বছরে সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃত স্বাধীনতাকেই খোঁজে।

একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির সেই সহযোদ্ধারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শত্রুতাও দেখা দিয়েছে পারস্পরিক।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের ছিল অতুলনীয় সাহসী এক বিদ্রোহ। আর দেশবাসীর একটি অত্যন্ত সংকটময় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয় যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই কিন্তু দেখা গেল, খালেদ মোশাররফ শিকার হয়েছেন অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের।
আবুল মঞ্জুর, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। তবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যুদ্ধের যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, যাঁর বিরুদ্ধে উল্টো গুঞ্জন ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার। মঞ্জুর হত্যা নিয়ে মামলা একটা হয়েছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।
যুদ্ধ করবেন বলে পাকিস্তান থেকে ছুটে এলেন আবু তাহের; যুদ্ধ করলেনও, যুদ্ধে একটি পা হারালেন। যুদ্ধশেষে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবী কর্মে; পরিণামে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হলো সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাঁদের পরিজনদের হত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে।
এম এ জলিল যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকেই; যুদ্ধের পরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্যের লুণ্ঠন তৎপরতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। জিয়াউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নীতি সঠিক নয় বলে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সর্বহারা পার্টিতে।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এসব ঘটনায় বোঝাই যাচ্ছিল, রাষ্ট্র স্থিতিশীলতা পায়নি। যুদ্ধের সময় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন আসবে। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। একবার নয়, কয়েকবার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য কোনো সামরিক বাহিনী থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, তা নিয়েই। থাকলেও সেটা কেমন ধরনের এবং কোন মাত্রার হবে, সেটা নিয়েও। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়নি। নতুন শাসকদের উদ্বেগ ছিল পুরোনো ব্যবস্থাকে আপৎকালীন বন্দোবস্ত হিসেবে হলেও চালু রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে পুরোনো আইনকানুন, আদালত, আমলাতন্ত্র—সবই চালু থাকল।
সামরিক বাহিনীও আগের ধরনেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়া—এই দুই ভাগের ভেতর নীরব ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হলো। গঠিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর একটি দ্বন্দ্বও দেখা দিল। সংবিধান প্রণীত হলো, কিন্তু দেখা গেল, তাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বের কথা ভুলে তাকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হলো। অনেকটা পাকিস্তানি কায়দাতেই।
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল, যুদ্ধের পরে সেটা প্রকট হলো এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব, পরে মন্ত্রিত্ব থেকেই অপসারিত হলেন। অব্যবস্থাপনার দরুন দেশে দুর্ভিক্ষের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। তাতে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়; আর বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড, পরীক্ষায় নকল, সম্পদ লুণ্ঠন—এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এমন আশা ছিল সর্বজনীন। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। অল্প পরে ১৯৭৫-এর শুরুতে এল একদলীয় শাসন। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটল না। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, আর সেটা ছিল সরকারের জন্য বিরাট এক মূলধন। কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকল, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ততই বাড়তে থাকল।
সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ঘটল, সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে এটা ঘটল। সরাসরি না হলেও ঘটনার পেছনে যে আমেরিকার সমর্থন ছিল, এই ধারণা অন্যায্য নয়। ক্ষমতায় এলেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ; তিনি যে মার্কিনপন্থী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমর্থন করেনি, তবে মেনে নিয়েছিল এবং চেষ্টা করেছিল নিজের প্রভাববলয়ের ভেতরে তাকে দ্রুত নিয়ে আসতে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় মোশতাকের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে আমেরিকার জন্য সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মোশতাক সরকারের চারিত্রিক ঝোঁকটা কোন দিকে, তা বোঝা গিয়েছিল ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা যখন ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে এল, বাংলাদেশ বেতারের নাম দিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে, তখনই।
মোশতাকের সেই ‘বিপ্লব’ অবশ্য টেকসই প্রমাণিত হয়নি, তিন মাস হতে না হতেই তিনি এবং তাঁর ‘সূর্য-সন্তানেরা’ উৎখাত হয়েছেন। তবে ব্যাপার সুবিধার নয় দেখে জেলখানায় লোক পাঠিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বন্দী চার শীর্ষ নেতাকে হত্যা করিয়েছেন। তারপরে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটেছে।
তারপরে এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পরে ‘গণতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে ছদ্মবেশী সেনাশাসন। এরপরে ভোটারবিহীন নির্বাচন। সবকিছুই হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে। অধরাই থাকল ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। আজও তাই বিজয়ের চুয়ান্ন বছরে সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃত স্বাধীনতাকেই খোঁজে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর। বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সম
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেআসিফ

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ। সংবাদপত্রের ভাষায় এটি একটি ‘কালো অধ্যায়’, যা জাতিকেই স্তব্ধ ও মর্মাহত করে দিয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিশাল আর্কাইভ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দগ্ধ হয়েছে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ও উদীচী।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ইমারত নয়, এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ছায়ানটের প্রাচীন বই, সংগীতচর্চার দলিল, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ—সবই ছাই হয়ে গেছে। উদীচীর সংগ্রহে থাকা গণসংগীত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দলিল, নাট্যচর্চার নথি ও আর্কাইভও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংরক্ষিত ফাইলগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এসব নথির অনেকগুলোই হয়তো কখনো ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়নি। ফলে যে ক্ষতির মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তা শুধু বস্তুগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় ক্ষতি।
এই ঘটনাকে যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের স্মৃতি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল হারানো জ্ঞানের প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে কয়েক লাখ পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলা হয়। গ্রিক, মিসরীয়, ভারতীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা—বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান সেখানে একত্র হয়েছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানবসভ্যতা কয়েক হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসা—অসংখ্য ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার টিকে থাকত, তবে মানবসভ্যতা হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী আগে আধুনিকতায় পৌঁছাত। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার মাত্রাগত হেরফের থাকতে পারে, তবে স্বরূপ সেই একই—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত।
এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভান্ডার শুধু কাগজে বা বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তা বিপদের মুখে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মুহূর্তে সেই ভান্ডারকে ধ্বংস করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরও কতগুলো গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের নথি শুধু সংবাদপত্রের ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দলিল। এগুলোতে রয়েছে মানুষের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাহিত্য ও শিল্পের খবর। ছায়ানটের বই ও নথি আমাদের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করত। উদীচী; যা গণসংগীত, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক, তার নথিপত্র হারানো মানে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক বড় অংশ মুছে যাওয়া।
উদীচীর আর্কাইভে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংগীতের দলিল, গণ-আন্দোলনের গান, নাট্যচর্চার স্ক্রিপ্ট এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গণসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ক্ষতি। ছায়ানট যেমন রবীন্দ্রসংগীতের ধারক, উদীচী তেমনি গণসংগীত ও নাট্যচর্চার ধারক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নথি ধ্বংস হওয়া মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া।
এই ক্ষতি শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তারা হয়তো আর জানতে পারবে না, কীভাবে একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রজন্মরা আর জানতে পারেনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পূর্ণ জ্ঞান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি হারানো মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের শূন্যতা তৈরি হওয়া। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি আমাদের সেই সুরক্ষা দিতে পারে, যা আলেক্সান্দ্রিয়ার সময়ে অসম্ভব ছিল। আজকের পৃথিবীতে ‘তথ্য’ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই তাকে ঝুঁকির মুখে রাখা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা এই ধরনের মানবসৃষ্ট নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর (ডিজিটাইজেশন)। যেমন—
ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটাবেইস: প্রতিটি বই, সংবাদপত্র ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাল স্ক্যান করে ক্লাউড সার্ভারে রাখা জরুরি।
আন্তর্জাতিক সংযোগ: আমাদের আর্কাইভগুলোকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত করলে তা সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে যেমন পৌঁছাবে, তেমনি ভৌগোলিকভাবে কোনো এক জায়গায় ধ্বংস হলেও তার প্রতিলিপি অন্য কোথাও নিরাপদ থাকবে।
বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাগজে নির্ভরশীল। ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির উদ্যোগ সীমিত। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় আমরা অমূল্য সম্পদ হারাই। এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই এখনই আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত ডিজিটাল সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র—সবাইকে এতে যুক্ত করতে হবে।
আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস আমাদের শেখায়, জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলা মানে সভ্যতার পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডও একই সতর্কবার্তা বহন করছে। যদি আমরা এখনই ডিজিটাল সংরক্ষণে মনোযোগ না দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মতোই ইতিহাসের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জানবে না আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগীতচর্চা, সংবাদপত্রের সংগ্রাম—সবই কেমন ছিল।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর নথি হারানো শুধু একটি অশুভ শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের নথিপত্র শুধু কিছু কাগজের স্তূপ নয়; এতে ধরা আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। ছায়ানট ও উদীচীর আর্কাইভ শুধু গানের সংকলন নয়; তা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি। এই নথিগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করা। যেমনটা আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের পর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো জানবে না কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুরের সাধনায় একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তুলেছিল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি শুধু নথি এবং গ্রন্থ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না। এভাবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডার উপহার দিতে পারব।

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ। সংবাদপত্রের ভাষায় এটি একটি ‘কালো অধ্যায়’, যা জাতিকেই স্তব্ধ ও মর্মাহত করে দিয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিশাল আর্কাইভ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দগ্ধ হয়েছে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ও উদীচী।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ইমারত নয়, এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ছায়ানটের প্রাচীন বই, সংগীতচর্চার দলিল, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ—সবই ছাই হয়ে গেছে। উদীচীর সংগ্রহে থাকা গণসংগীত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দলিল, নাট্যচর্চার নথি ও আর্কাইভও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংরক্ষিত ফাইলগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এসব নথির অনেকগুলোই হয়তো কখনো ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়নি। ফলে যে ক্ষতির মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তা শুধু বস্তুগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় ক্ষতি।
এই ঘটনাকে যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের স্মৃতি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল হারানো জ্ঞানের প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে কয়েক লাখ পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলা হয়। গ্রিক, মিসরীয়, ভারতীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা—বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান সেখানে একত্র হয়েছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানবসভ্যতা কয়েক হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসা—অসংখ্য ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার টিকে থাকত, তবে মানবসভ্যতা হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী আগে আধুনিকতায় পৌঁছাত। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার মাত্রাগত হেরফের থাকতে পারে, তবে স্বরূপ সেই একই—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত।
এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভান্ডার শুধু কাগজে বা বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তা বিপদের মুখে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মুহূর্তে সেই ভান্ডারকে ধ্বংস করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরও কতগুলো গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের নথি শুধু সংবাদপত্রের ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দলিল। এগুলোতে রয়েছে মানুষের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাহিত্য ও শিল্পের খবর। ছায়ানটের বই ও নথি আমাদের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করত। উদীচী; যা গণসংগীত, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক, তার নথিপত্র হারানো মানে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক বড় অংশ মুছে যাওয়া।
উদীচীর আর্কাইভে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংগীতের দলিল, গণ-আন্দোলনের গান, নাট্যচর্চার স্ক্রিপ্ট এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গণসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ক্ষতি। ছায়ানট যেমন রবীন্দ্রসংগীতের ধারক, উদীচী তেমনি গণসংগীত ও নাট্যচর্চার ধারক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নথি ধ্বংস হওয়া মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া।
এই ক্ষতি শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তারা হয়তো আর জানতে পারবে না, কীভাবে একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রজন্মরা আর জানতে পারেনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পূর্ণ জ্ঞান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি হারানো মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের শূন্যতা তৈরি হওয়া। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি আমাদের সেই সুরক্ষা দিতে পারে, যা আলেক্সান্দ্রিয়ার সময়ে অসম্ভব ছিল। আজকের পৃথিবীতে ‘তথ্য’ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই তাকে ঝুঁকির মুখে রাখা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা এই ধরনের মানবসৃষ্ট নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর (ডিজিটাইজেশন)। যেমন—
ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটাবেইস: প্রতিটি বই, সংবাদপত্র ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাল স্ক্যান করে ক্লাউড সার্ভারে রাখা জরুরি।
আন্তর্জাতিক সংযোগ: আমাদের আর্কাইভগুলোকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত করলে তা সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে যেমন পৌঁছাবে, তেমনি ভৌগোলিকভাবে কোনো এক জায়গায় ধ্বংস হলেও তার প্রতিলিপি অন্য কোথাও নিরাপদ থাকবে।
বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাগজে নির্ভরশীল। ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির উদ্যোগ সীমিত। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় আমরা অমূল্য সম্পদ হারাই। এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই এখনই আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত ডিজিটাল সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র—সবাইকে এতে যুক্ত করতে হবে।
আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস আমাদের শেখায়, জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলা মানে সভ্যতার পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডও একই সতর্কবার্তা বহন করছে। যদি আমরা এখনই ডিজিটাল সংরক্ষণে মনোযোগ না দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মতোই ইতিহাসের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জানবে না আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগীতচর্চা, সংবাদপত্রের সংগ্রাম—সবই কেমন ছিল।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর নথি হারানো শুধু একটি অশুভ শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের নথিপত্র শুধু কিছু কাগজের স্তূপ নয়; এতে ধরা আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। ছায়ানট ও উদীচীর আর্কাইভ শুধু গানের সংকলন নয়; তা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি। এই নথিগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করা। যেমনটা আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের পর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো জানবে না কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুরের সাধনায় একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তুলেছিল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি শুধু নথি এবং গ্রন্থ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না। এভাবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডার উপহার দিতে পারব।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর। বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সম
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেদীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য।
আবু তাহের খান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর যখন রাশিয়া ও ইউক্রেন—এই দুই দেশের জন্ম হলো, তখন রাজনৈতিকভাবে দুই দেশের মধ্যে একটি পার্থক্য গড়ে উঠল। কিয়েভ এবার হাঁটতে চাইল পশ্চিম ইউরোপের দেখানো পথে। মস্কোকে এড়িয়ে কিয়েভের এই পথচলা ভালো লাগেনি মস্কোর। বর্তমান যুদ্ধ আসলে বিগত ৩০ বছরের রাজনীতির সরাসরি ফল। তিনটি ধাপে এই সম
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৮ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
৮ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
৮ ঘণ্টা আগে