ভারতের মিডিয়াযুদ্ধ ও বিজেপির রাজনীতি

মাসুদ কামাল
আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮: ১১
Thumbnail image

ভারতের মিডিয়াগুলো এর মধ্যে দেখেছেন? অনলাইনে আজকাল সহজেই দেশ-বিদেশের মিডিয়া দেখা যায়। প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া চাইলেই দেখা যায়। আর সোশ্যাল মিডিয়া তো আপনার মোবাইলেই উঁকিঝুঁকি মারে। কাজেই না দেখে উপায় থাকে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—এসব মিডিয়ার দিকে তাকালে বিভ্রান্ত হতে হয়, আতঙ্কিত হতে হয়। ক্ষণিকের জন্য হলেও আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে—আসলেই কি বাংলাদেশে বর্তমানে নির্বিচার সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে?

ভারতের মিডিয়াগুলো ইদানীং বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব কথা প্রচার করছে, তার সঙ্গে সত্যতার সম্পর্ক কতটুকু? সামান্য উদাহরণ দিই। এই লেখা যখন লিখছি, ৫ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায়, পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি টেলিভিশন ‘টিভি ৯ বাংলা’র ইউটিউব চ্যানেলে যে কয়টা নিউজ প্রচারিত হচ্ছিল তার মধ্যে একটা ছাড়া বাকি সব কটিই বাংলাদেশ সম্পর্কিত। কয়েকটা শিরোনাম দিই—বাংলাদেশি টাকা থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’র ছবি সরাচ্ছে ইউনূস সরকার, ‘উরি বাবা ওপারে যা হচ্ছে...’ ওপার বাংলা থেকে ঘুরে ভয়ংকর তথ্য দিলেন এপারের সুনীতি মৃধা, উত্তপ্ত বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার সঙ্গে পাকিস্তান থেকে দেখা করতে কে এলেন দেখুন, সাতসকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আপডেট, বাংলাদেশ নিয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিল ভারত, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের ড্রোন ক্যামেরায় কী ধরা পড়ল, কোণঠাসা বাংলাদেশ-ভারত ছাড়া অন্যান্য দেশ যা করবে, বাংলাদেশে ছড়ি ঘোরাচ্ছে দুই কট্টর সংগঠন, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ, পদ্মাপাড়ে হিন্দু নিপীড়ন-মেনে নিল খোদ ইউনূস প্রশাসন, বাংলাদেশে মহিলাদের বাজারে যাওয়া বন্ধ করার হুঁশিয়ারি কট্টরপন্থীদের। আর যদি আপনি ‘রিপাবলিক টিভি বাংলা’তে যান তাহলে আরও ভয়ংকর টাইপের অসংখ্য শিরোনাম দেখতে পাবেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলেই কি বাংলাদেশে কিংবা বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এ রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে? আমাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? আমরা কি এ ধরনের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা দেখছি? কদিন আগে আসামের একটা বেসরকারি টেলিভিশন ‘আসম লাইভ ২৪’-এ একটা নিউজ শুনলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘ঢাকা শহর ভরে গেছে হিন্দু মৃতদেহে!’ আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঢাকা শহর বলতে তারা আসলে কোন জায়গাকে বোঝাচ্ছে? আমি তো ঢাকা শহরেই থাকি! কোথায় হিন্দু মৃতদেহ? আপনারা কি তেমন কিছু দেখেছেন? তাহলে এ ধরনের শিরোনাম আর আজগুবি প্রচারণা তারা কেন চালাচ্ছে? যাঁরা এই দেশে আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এমন ভিডিও, আলোচনা বা শিরোনাম দেখে কিছুই বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে হিন্দু যাঁরা আছেন, যাঁদের আত্মীয়-স্বজন বাংলাদেশে বসবাস করছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আতঙ্কিত হবেন। উদ্বিগ্ন হবেন তাঁদের নিকটজনদের জীবন ও নিরাপত্তা নিয়ে। রক্তের আত্মীয় না হলেও যাঁরা ধর্মীয় আত্মীয়তায় বিশ্বাস করেন, তাঁরাও উদ্বিগ্ন হবেন, সহমর্মিতা অনুভব করবেন। এই বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে সীমান্তের ওপারের হিন্দুদের মধ্যে উদ্বেগ—আমার ধারণা এই রাজনীতিটাই এখন করতে চাইছে ভারতের ক্ষমতাসীন দল।

রাজনীতির বিষয়টি একটু বরং ডিটেইলে বলি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে এখন বিজেপি। টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকলেও এবার তারা আগের দুইবারের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। বরং অন্য দুটি আঞ্চলিক দলের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। আগামী নির্বাচনে ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। বিজেপির আরেকটি চিন্তা পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে। এদের সঙ্গে তারা পেরেই উঠছে না। লোকসভা কিংবা বিধানসভা—দুই নির্বাচনেই তারা তৃণমূলের কাছে পাত্তা পায়নি। এই পাত্তা না পাওয়ার পেছনে ভোটের একটা সহজ সমীকরণ কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটার ২৭ শতাংশের মতো। এই ভোটগুলো ঐক্যবদ্ধ। এরা যখন ভোট দেয়, একটি দলকেই দেয়। আগে এরা বামফ্রন্টকে ভোট দিত, এখন দেয় তৃণমূলকে। এই ২৭ শতাংশের মধ্যে বিজেপি হাত ঢোকাতে পারে না। বাকি ৭২ শতাংশের মতো হিন্দু ভোটার আছে, তার পুরোটাও কিন্তু বিজেপির নয়। সেটা চার ভাগ হয়ে যায়। বড় ভাগটা হয়তো বিজেপি পায়, কিন্তু তৃণমূল, বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসও কম পায় না। বিজেপির হিসাব হচ্ছে, ৭২ শতাংশ হিন্দু ভোট থেকে দুই-তৃতীয়াংশ যদি তারা সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে তাদের একটা চান্স থাকে পশ্চিমবঙ্গে জেতার। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই তাদের অনুগত ‘গদি মিডিয়া’গুলো চালাচ্ছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ‘নির্যাতন’-এর নানামুখী প্রচারণা।

হিসাবটা তাদের সহজ। বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় সিংহভাগই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। আবার দুই পারের হিন্দুদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কও কয়েক প্রজন্মের। কাজেই এখানকার সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হলে সেই ব্যথার অনেকটাই ওখানকার সংখ্যাগুরুদের গায়ে লাগে। ‘বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে’—এমন প্রচারণা পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মাথায় একবার ঢুকিয়ে দিতে পারলে সেটা বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অনুকূলে চলে যাবে। সেই আলোচিত ৭২ শতাংশ হিন্দু ভোট থেকে আরও অতিরিক্ত কিছু ভোট তখন বিজেপির ব্যাগে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। এই হিসাবটা যে তৃণমূল কংগ্রেস বুঝতে পারছে না, তা নয়। তারা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছে, আর সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিচ্ছে। কদিন আগে বিধানসভা অধিবেশনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে আচমকাই বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান জানালেন, সেটা কিন্তু সেই উপলব্ধিরই প্রতিক্রিয়া। মমতা বা তৃণমূল এখন যেন বিজেপির সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তারা পশ্চিমবঙ্গের আবেগপ্রবণ হিন্দুদের বোঝাতে চাইছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য তাদের দলের কী নিদারুণ চিন্তা! পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন সামনেই, ২০২৬ সালের প্রথম দিকে। তাই রাজনীতির গণিত অনুযায়ী সামনের বছরখানেক সময় তারা এই হিন্দু সহানুভূতির লড়াইয়ে বেশ তৎপর থাকবে।

ভারতের বিষয়টা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু কথা হচ্ছে—আমাদের দিক থেকেও কি কিছু ভুল হয়নি? আমি মনে করি হয়েছে। আচ্ছা, হিন্দু ধর্মগুরু চিন্ময় কৃষ্ণকে আপনারা আগে কতজন চিনতেন? তিনি কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ? একটা হালকা মামলায় গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে আমাদের সরকার বা প্রশাসন কি তাঁকে হঠাৎ করেই গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে দেয়নি? গ্রেপ্তারের পর জামিন নিয়ে আরও যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হলো, সেগুলো কি আগুনে কেরোসিন ঢালার মতো নয়? যে মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটার কথা একবার ভাবুন। চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ে আগে থেকে উড়তে থাকা জাতীয় পতাকাকে ইসকনের গেরুয়া পতাকা দিয়ে মুড়ে দেওয়ার অভিযোগে যে মামলা হয়েছে, সেটাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো মামলা বলা যায় না। প্রথমত, এটা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধের মধ্যে কি না, তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, মামলাটির যিনি বাদী, তিনি ছিলেন স্থানীয় বিএনপির একজন নেতা। তাঁর দল বিএনপি বিষয়টি পছন্দ করেনি, এমন মামলা করার কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কারও করেছে। মামলায় চিন্ময়সহ ১৯ জন আসামি রয়েছেন। অন্যদের নিয়ে কোনো কিছু, কোনো আলোচনা কি শুনেছেন? তাই চিন্ময়ের গ্রেপ্তারটা এই মুহূর্তে জরুরি ছিল কি না, এই প্রশ্নটিও তোলা জরুরি বলে আমি মনে করি। বিষয়টিকে আমার নাজুক এই সময়ে বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানানোর মতো মনে হয়েছে।

সরকার এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সামনের সময়গুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে—এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: মাসুদ কামাল

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত