আলতাফ পারভেজ

বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ করোনা সেবা উদ্যোগ নিয়ে সেই সময় লেখার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেন অনেকের কাছে অপছন্দের। তিনি ওষুধ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীতে কী করতে চেয়েছিলেন? গতকাল রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আজ পুরোনো বিতর্কটাকে সামনে এনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে চাই। বিষয়টি পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সে জন্যই আলাদা করে এই আলাপের উদ্যোগ। এখানে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পুরোনো লেখা থেকে নেওয়া।
করোনার বিরুদ্ধে সেই সময় দীর্ঘযুদ্ধে বেঁচে-মরে শেষপর্যন্ত যে কয়জন জয়ী হয়েছিলেন এদেশে, তাঁদের অবশ্যই ওষুধ ও স্বাস্থ্য প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে অতীতের সংগ্রামের কথাটা আসা স্বাভাবিক বিষয়। অসমাপ্ত সেই সংগ্রামের শিক্ষা এ সময়ে কাজে লাগতে পারে। এটা কেবল একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একার ব্যাপার না।
গণস্বাস্থ্য ফার্মা এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল দুবার ভাঙচুরের শিকার হয়। প্রথমবার এটিতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয় ১৯৮৪ সালের আগস্টে; দ্বিতীয়বার ১৯৯০ এর অক্টোবরে। গণস্বাস্থ্য ও ডা. জাফরুল্লাহ প্রথমবার আক্রান্ত হয় ওষুধনীতি নিয়ে, দ্বিতীয়বার স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে। দুটো ঘটনায় প্রবল যোগসূত্র আছে। আমরা ওষুধনীতির অধ্যায় থেকে শুরু করতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতেও সম্প্রসারণ করতে তৎপর ছিল।
সে সময় আমাদের দেশটিতে স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা করুণ ছিল। প্রতি একহাজার নবজাতকের ২৬০ জন ৫ বছরের মধ্যে মারা যেত। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। দামও ছিল অযৌক্তিকভাবে বেশি। ওষুধের ব্যবসার প্রধান সুবিধাভোগী ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সরকার সেই সময় টিসিবির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ থেকে ওষুধ আমদানি শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ অনেকে অসন্তুষ্ট ছিল। তাতে সেটাও কমাতে হয়। ফলে ওষুধ খাতে বহুজাতিকদের একচেটিয়াত্ব বাড়তেই থাকে।
১৯৭৮ সালে দেশে একটা ওষুধ নীতির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ড. এম এম হক। খসড়া অবস্থাতেই ওই ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ‘ওষুধ শিল্প সমিতি’। তাদের প্রতিবাদে ওটা খসড়াতেই থেমে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ হারান। এ কাজে তখনকার একজন মন্ত্রীরও ইন্ধন ছিল।
বাংলাদেশে অনেকেই বলেন ওষুধ নীতি জেনারেল এরশাদের অবদান তা কিন্তু ঠিক নয়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই জের।
১৯৮২ সালে এসে ২৮ এপ্রিল ওষুধনীতি তৈরি করতে ৮ সদস্যের একটা কমিটি হয়। এই কমিটিতে কোন আমলা ছিল না। সবাই ছিল চিকিৎসাবিদ্যার লোক। যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন পিজির অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন মাত্র। এই কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিএমএ’র সদস্যও ছিলেন।
এই কমিটি অনেকগুলো বৈঠক শেষে ১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে দেশের ওষুধ খাত নিয়ে তদন্তে নামে। দেশে সে সময় ওষুধ তৈরির জন্য ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছিল। পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি ওষুধ আমদানি হতো। কমিটি প্রায় ৪ হাজার ধরনের ওষুধের সন্ধান পায়। দেখা যায়, এতো বিভিন্ন নামের ওষুধ আসলে ১৫০টি উপাদানে তৈরি ওষুধেরই রকমারি কোম্পানি নাম মাত্র।
১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে এসব ওষুধ পরীক্ষা শেষে নূরুল ইসলাম কমিটি ১ হাজার ৭৪২টি ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় বা অকার্যকর ওষুধ শনাক্ত করে। এর মাঝে প্রায় ৯০০ ওষুধ তারা বাজার থেকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তুলে নেয়ার সুপারিশ করে। পাশাপাশি ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধে’র একটা তালিকা করা হয়। এই কমিটির বড় অবদান ছিল--
১. ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করার সুপারিশ;
২. বাংলাদেশে কারখানা না করে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ;
৩. দেশে থাকলে বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে প্রতিযোগিতামূলক করা;
৪. আয়ুর্বেদি ও ইউনানী ওষুধকে আইনের আওতায় আনা;
৫. ৪৫টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধকে পর্যায়ক্রমে জিনেরিক নামে বাজারজাত করা। আগে একই এমপিসিলিন ৪৮টি কোম্পানি ৪৮ নামে বাজারজাত করতো। আলাদা ব্র্যান্ড নাম হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা অনেক ব্র্যান্ডে দামের ক্ষেত্রে প্রতারিত হতো।
১৯৮২ সালের ২৯ মে মন্ত্রিসভা এসব সুপারিশ অনুমোদন করে। ১২ জুন সেটা ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ নামে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়।
তৃতীয় বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের জন্য এটা ছিল এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত। বহুজাতিকরা এতদিন নিজেদের চ্যালেঞ্জ অযোগ্য ভাবতো। সেখানে এই প্রথম একটা ঘা লাগে।
পাল্টা ঝড় উঠতেও দেরি হলো না। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওষুধকে ঘিরে দেশ-বিদেশে রাজনীতির পুরো চেহারাটি আস্তে আস্তে সে সময় বাংলাদেশে উদোম হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জার্মানি, ডাচ ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতও সরকারের উপর সম্মিলিত চাপ দেন ওষুধ নীতি বদলাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিসেস কুনকে সে সময় বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করতে দেখা যায়। ঢাকার টিকাটুলি থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী একটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি দৈনিক সে সময় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। জুনেই জেনারেল এরশাদকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যদিও এটা আইনে পরিণত করেই ওয়াশিংটন গেলেন--কিন্তু সেখানে গিয়ে কথা দিয়ে এলেন যে আইনটি রিভিউ করা হবে।
ওষুধনীতি বাস্তবায়ন হলে বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাবে এবং বহু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা প্রচারণা চলতে থাকে তুমুল বেগে সে সময়।
বিদেশি এই চাপ প্রয়োগের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের এই ওষুধ নীতি সফল হয়ে গেলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে একই রকম নীতির জন্য রাজনৈতিক রূপান্তরবাদীরা চাপ প্রয়োগ শুরু করবে।
বাংলাদেশের ওষুধ বিষয় কীভাবে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে এ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট হয় ১৯৮২ সালের ১৯ আগস্ট। শিরোনাম ছিল: ‘ইউএস ইজ এইডিং ড্রাগ কোম্পানিজ ইন বাংলাদেশ’।
ক্রমাগত চাপ ও তদবিরে মাধ্যমে মূল ড্রাগ পলিসি এরপর অনেকখানি পাল্টে যায়। প্রথম ‘রিভিউ’ হয় ১৯৮২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ আরো সংশোধিত হয়।
ওষুধ নীতি নিয়ে বিতর্ককালের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল কোম্পানিগুলোর পাল্টা প্রচারণা এবং তাতে দেশের চিকিৎসক সমাজের সংহতিতে ঢাকার মধ্যবিত্তরা সাধারণভাবে ওষুধ নীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল।
এখানকার মধ্যবিত্তরা যেকোন বড় ধরনের রূপান্তর উদ্যোগে যে কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে পারে তার একটা মহড়া হয়ে যায় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানে। একই ঘটনা দেখা যায় কয়েক বছর পর স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানেও।
বলাবাহুল্য, জেনারেল এরশাদের সরকার দেশ-বিদেশের এসব মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো সরকার ছিল না। ফলে দ্রুতই ওষুধ নীতিতে সংশোধন ঘটতে থাকে। পরবর্তীকালের এ রকম নির্বাহী আদেশের ফল হিসেবে খুব কম সংখ্যক ওষুধই আর মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকে। তারপরও ওষুধনীতির এমন কিছু সুফল অবশিষ্ট ছিল যার মাধ্যমে দেশের ওষুধশিল্প অনেক বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। কিন্তু এসব বিকাশ থেকে ভোক্তা হিসেবে রোগীরা প্রত্যাশিত মাত্রায় সুবিধা পায়নি।
ওষুধ নীতির এই ইতিহাসের মাঝেই ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দেশের চিকিৎসা পেশার নেতৃত্বস্থানীয় ৬৩ জন ব্যক্তি বিএমএকে অনুরোধ করে প্রফেসর নূরুল ইসলাম ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
সেই সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিশেষ রাগ ছিল কয়েকটি কারণে। যেসব চিকিৎসক স্বাধীনতা-যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তনের জন্য লড়ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় একজন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধের কাঁচামাল এবং ওষুধের দাম সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত, বহুজাতিকদের ব্যবসায়িক চাতুরি সম্পর্কিত তথ্যাদি গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন তিনি। সরকারকেও তিনি এসব তথ্য এনে দিতেন। তৃতীয়ত জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিদেশে যারা কাজ করছে এমন একটিভিস্টদেরও তিনি বাংলাদেশের ওষুধনীতির লড়াইয়ে কাজে লাগাচ্ছিলেন।
তাঁর কাছে এটা ছিল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক কাজ। বাংলাদেশের ‘র্যাডিক্যাল’দের তরফ থেকে তিনি সেসময় ভালো সংহতি পাননি। বরং তখন এমনও প্রচার চালানো হয়, ‘জাফরুল্লাহ খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা মুসলমান দেশের ওষুধ শিল্প ধ্বংসে নেমেছেন। এতে বাংলাদেশ ভারতীয় ওষুধের বাজারে পরিণত হবে।’ তাঁর বিচার চেয়ে অজ্ঞাত উৎস থেকে পোস্টার লাগানো হয় দেয়ালে দেয়ালে।
ওষুধনীতির বিরুদ্ধে এ রকম অবিশ্বাস্য মাত্রার প্রচার-প্রচারণা রুখতে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতেই এক সময় ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ওষুধ তৈরিকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের যে চাপ ও কার্যকারিতা আজও বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে এবং ভোক্তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে আছে তাতে স্বাস্থ্য খাতে ভোক্তা-বান্ধব পুনর্গঠন প্রকৃতই কঠিন। এ খাতে ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো চরিত্রকেও এখন আর বিশেষ দেখা যায় না।
ওষুধ নীতির পর দ্বিতীয়বার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্রান্ত হন স্বাস্থ্যনীতি তৈরির সময়। ১৯৮৭ সালের মার্চে স্বাস্থ্যনীতির তৈরির জন্য চার সদস্যের যে কমিটি হয় তাতে ছিলেন তিনি। এই কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল স্বাস্থ্য খাতের বিকেন্দ্রীকরণ। বিশেষ করে চিকিৎসকদের গ্রামে নেয়ার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে একত্রিত করা, স্বাস্থ্য কাঠামোতে জনপ্রতিনিধিদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতা বাড়াতে অডিট শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রীয় মেডিক্যাল কলেজসমূহের শিক্ষকদের প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করা এবং তার বদলে তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে এই স্বাস্থ্যনীতি বিল আকারে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন ওঠে। এই দিনই ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ ‘জনস্বার্থ বিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে’ ৭২ ঘন্টার ধর্মঘটের ডাক দেয়। পাশাপাশি তারা ডা. জাফরুল্লাহসহ আরো দুই জনের সদস্যপদ খারিজ করে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে যুক্ত থাকায়। ২৭ অক্টোবর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার ব্যাপকভাবে ভাঙ্গচুর হয়। অংশ বিশেষে আগুন দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সেই সময় জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতেও দেশে আন্দোলন চলছিল। তারই ফল হিসেবে নব্বুয়ের ডিসেম্বরে এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএমএ’র সভাপতি ডা. এম এ মাজেদ। সরকারের প্রথম দিনই সংসদে প্রস্তাব আকারে থাকা স্বাস্থ্যনীতি-বিলটি বাতিল হয়। তবে ডা. জাফরুল্লাহ’র বিরুদ্ধে অনেকেরই রাগ-ক্ষোভ তখনও থামেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকাকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। সে সময় বিএমএ’র নানান দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় ওষুধ শিল্প সমিতিকে।
ওষুধ মালিকদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সেই বন্ধন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এদেশে কেবল শক্তিশালীই হয়েছে। বিপরীতে জনকল্যাণমূলক একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিকল্প চেষ্টাগুলো খুব বেশি দাঁড়াতে পারেনি।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক

বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ করোনা সেবা উদ্যোগ নিয়ে সেই সময় লেখার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেন অনেকের কাছে অপছন্দের। তিনি ওষুধ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীতে কী করতে চেয়েছিলেন? গতকাল রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আজ পুরোনো বিতর্কটাকে সামনে এনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে চাই। বিষয়টি পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সে জন্যই আলাদা করে এই আলাপের উদ্যোগ। এখানে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পুরোনো লেখা থেকে নেওয়া।
করোনার বিরুদ্ধে সেই সময় দীর্ঘযুদ্ধে বেঁচে-মরে শেষপর্যন্ত যে কয়জন জয়ী হয়েছিলেন এদেশে, তাঁদের অবশ্যই ওষুধ ও স্বাস্থ্য প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে অতীতের সংগ্রামের কথাটা আসা স্বাভাবিক বিষয়। অসমাপ্ত সেই সংগ্রামের শিক্ষা এ সময়ে কাজে লাগতে পারে। এটা কেবল একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একার ব্যাপার না।
গণস্বাস্থ্য ফার্মা এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল দুবার ভাঙচুরের শিকার হয়। প্রথমবার এটিতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয় ১৯৮৪ সালের আগস্টে; দ্বিতীয়বার ১৯৯০ এর অক্টোবরে। গণস্বাস্থ্য ও ডা. জাফরুল্লাহ প্রথমবার আক্রান্ত হয় ওষুধনীতি নিয়ে, দ্বিতীয়বার স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে। দুটো ঘটনায় প্রবল যোগসূত্র আছে। আমরা ওষুধনীতির অধ্যায় থেকে শুরু করতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতেও সম্প্রসারণ করতে তৎপর ছিল।
সে সময় আমাদের দেশটিতে স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা করুণ ছিল। প্রতি একহাজার নবজাতকের ২৬০ জন ৫ বছরের মধ্যে মারা যেত। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। দামও ছিল অযৌক্তিকভাবে বেশি। ওষুধের ব্যবসার প্রধান সুবিধাভোগী ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সরকার সেই সময় টিসিবির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ থেকে ওষুধ আমদানি শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ অনেকে অসন্তুষ্ট ছিল। তাতে সেটাও কমাতে হয়। ফলে ওষুধ খাতে বহুজাতিকদের একচেটিয়াত্ব বাড়তেই থাকে।
১৯৭৮ সালে দেশে একটা ওষুধ নীতির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ড. এম এম হক। খসড়া অবস্থাতেই ওই ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ‘ওষুধ শিল্প সমিতি’। তাদের প্রতিবাদে ওটা খসড়াতেই থেমে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ হারান। এ কাজে তখনকার একজন মন্ত্রীরও ইন্ধন ছিল।
বাংলাদেশে অনেকেই বলেন ওষুধ নীতি জেনারেল এরশাদের অবদান তা কিন্তু ঠিক নয়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই জের।
১৯৮২ সালে এসে ২৮ এপ্রিল ওষুধনীতি তৈরি করতে ৮ সদস্যের একটা কমিটি হয়। এই কমিটিতে কোন আমলা ছিল না। সবাই ছিল চিকিৎসাবিদ্যার লোক। যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন পিজির অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন মাত্র। এই কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিএমএ’র সদস্যও ছিলেন।
এই কমিটি অনেকগুলো বৈঠক শেষে ১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে দেশের ওষুধ খাত নিয়ে তদন্তে নামে। দেশে সে সময় ওষুধ তৈরির জন্য ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছিল। পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি ওষুধ আমদানি হতো। কমিটি প্রায় ৪ হাজার ধরনের ওষুধের সন্ধান পায়। দেখা যায়, এতো বিভিন্ন নামের ওষুধ আসলে ১৫০টি উপাদানে তৈরি ওষুধেরই রকমারি কোম্পানি নাম মাত্র।
১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে এসব ওষুধ পরীক্ষা শেষে নূরুল ইসলাম কমিটি ১ হাজার ৭৪২টি ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় বা অকার্যকর ওষুধ শনাক্ত করে। এর মাঝে প্রায় ৯০০ ওষুধ তারা বাজার থেকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তুলে নেয়ার সুপারিশ করে। পাশাপাশি ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধে’র একটা তালিকা করা হয়। এই কমিটির বড় অবদান ছিল--
১. ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করার সুপারিশ;
২. বাংলাদেশে কারখানা না করে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ;
৩. দেশে থাকলে বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে প্রতিযোগিতামূলক করা;
৪. আয়ুর্বেদি ও ইউনানী ওষুধকে আইনের আওতায় আনা;
৫. ৪৫টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধকে পর্যায়ক্রমে জিনেরিক নামে বাজারজাত করা। আগে একই এমপিসিলিন ৪৮টি কোম্পানি ৪৮ নামে বাজারজাত করতো। আলাদা ব্র্যান্ড নাম হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা অনেক ব্র্যান্ডে দামের ক্ষেত্রে প্রতারিত হতো।
১৯৮২ সালের ২৯ মে মন্ত্রিসভা এসব সুপারিশ অনুমোদন করে। ১২ জুন সেটা ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ নামে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়।
তৃতীয় বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের জন্য এটা ছিল এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত। বহুজাতিকরা এতদিন নিজেদের চ্যালেঞ্জ অযোগ্য ভাবতো। সেখানে এই প্রথম একটা ঘা লাগে।
পাল্টা ঝড় উঠতেও দেরি হলো না। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওষুধকে ঘিরে দেশ-বিদেশে রাজনীতির পুরো চেহারাটি আস্তে আস্তে সে সময় বাংলাদেশে উদোম হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জার্মানি, ডাচ ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতও সরকারের উপর সম্মিলিত চাপ দেন ওষুধ নীতি বদলাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিসেস কুনকে সে সময় বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করতে দেখা যায়। ঢাকার টিকাটুলি থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী একটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি দৈনিক সে সময় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। জুনেই জেনারেল এরশাদকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যদিও এটা আইনে পরিণত করেই ওয়াশিংটন গেলেন--কিন্তু সেখানে গিয়ে কথা দিয়ে এলেন যে আইনটি রিভিউ করা হবে।
ওষুধনীতি বাস্তবায়ন হলে বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাবে এবং বহু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা প্রচারণা চলতে থাকে তুমুল বেগে সে সময়।
বিদেশি এই চাপ প্রয়োগের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের এই ওষুধ নীতি সফল হয়ে গেলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে একই রকম নীতির জন্য রাজনৈতিক রূপান্তরবাদীরা চাপ প্রয়োগ শুরু করবে।
বাংলাদেশের ওষুধ বিষয় কীভাবে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে এ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট হয় ১৯৮২ সালের ১৯ আগস্ট। শিরোনাম ছিল: ‘ইউএস ইজ এইডিং ড্রাগ কোম্পানিজ ইন বাংলাদেশ’।
ক্রমাগত চাপ ও তদবিরে মাধ্যমে মূল ড্রাগ পলিসি এরপর অনেকখানি পাল্টে যায়। প্রথম ‘রিভিউ’ হয় ১৯৮২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ আরো সংশোধিত হয়।
ওষুধ নীতি নিয়ে বিতর্ককালের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল কোম্পানিগুলোর পাল্টা প্রচারণা এবং তাতে দেশের চিকিৎসক সমাজের সংহতিতে ঢাকার মধ্যবিত্তরা সাধারণভাবে ওষুধ নীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল।
এখানকার মধ্যবিত্তরা যেকোন বড় ধরনের রূপান্তর উদ্যোগে যে কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে পারে তার একটা মহড়া হয়ে যায় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানে। একই ঘটনা দেখা যায় কয়েক বছর পর স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানেও।
বলাবাহুল্য, জেনারেল এরশাদের সরকার দেশ-বিদেশের এসব মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো সরকার ছিল না। ফলে দ্রুতই ওষুধ নীতিতে সংশোধন ঘটতে থাকে। পরবর্তীকালের এ রকম নির্বাহী আদেশের ফল হিসেবে খুব কম সংখ্যক ওষুধই আর মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকে। তারপরও ওষুধনীতির এমন কিছু সুফল অবশিষ্ট ছিল যার মাধ্যমে দেশের ওষুধশিল্প অনেক বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। কিন্তু এসব বিকাশ থেকে ভোক্তা হিসেবে রোগীরা প্রত্যাশিত মাত্রায় সুবিধা পায়নি।
ওষুধ নীতির এই ইতিহাসের মাঝেই ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দেশের চিকিৎসা পেশার নেতৃত্বস্থানীয় ৬৩ জন ব্যক্তি বিএমএকে অনুরোধ করে প্রফেসর নূরুল ইসলাম ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
সেই সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিশেষ রাগ ছিল কয়েকটি কারণে। যেসব চিকিৎসক স্বাধীনতা-যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তনের জন্য লড়ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় একজন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধের কাঁচামাল এবং ওষুধের দাম সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত, বহুজাতিকদের ব্যবসায়িক চাতুরি সম্পর্কিত তথ্যাদি গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন তিনি। সরকারকেও তিনি এসব তথ্য এনে দিতেন। তৃতীয়ত জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিদেশে যারা কাজ করছে এমন একটিভিস্টদেরও তিনি বাংলাদেশের ওষুধনীতির লড়াইয়ে কাজে লাগাচ্ছিলেন।
তাঁর কাছে এটা ছিল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক কাজ। বাংলাদেশের ‘র্যাডিক্যাল’দের তরফ থেকে তিনি সেসময় ভালো সংহতি পাননি। বরং তখন এমনও প্রচার চালানো হয়, ‘জাফরুল্লাহ খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা মুসলমান দেশের ওষুধ শিল্প ধ্বংসে নেমেছেন। এতে বাংলাদেশ ভারতীয় ওষুধের বাজারে পরিণত হবে।’ তাঁর বিচার চেয়ে অজ্ঞাত উৎস থেকে পোস্টার লাগানো হয় দেয়ালে দেয়ালে।
ওষুধনীতির বিরুদ্ধে এ রকম অবিশ্বাস্য মাত্রার প্রচার-প্রচারণা রুখতে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতেই এক সময় ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ওষুধ তৈরিকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের যে চাপ ও কার্যকারিতা আজও বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে এবং ভোক্তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে আছে তাতে স্বাস্থ্য খাতে ভোক্তা-বান্ধব পুনর্গঠন প্রকৃতই কঠিন। এ খাতে ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো চরিত্রকেও এখন আর বিশেষ দেখা যায় না।
ওষুধ নীতির পর দ্বিতীয়বার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্রান্ত হন স্বাস্থ্যনীতি তৈরির সময়। ১৯৮৭ সালের মার্চে স্বাস্থ্যনীতির তৈরির জন্য চার সদস্যের যে কমিটি হয় তাতে ছিলেন তিনি। এই কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল স্বাস্থ্য খাতের বিকেন্দ্রীকরণ। বিশেষ করে চিকিৎসকদের গ্রামে নেয়ার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে একত্রিত করা, স্বাস্থ্য কাঠামোতে জনপ্রতিনিধিদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতা বাড়াতে অডিট শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রীয় মেডিক্যাল কলেজসমূহের শিক্ষকদের প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করা এবং তার বদলে তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে এই স্বাস্থ্যনীতি বিল আকারে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন ওঠে। এই দিনই ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ ‘জনস্বার্থ বিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে’ ৭২ ঘন্টার ধর্মঘটের ডাক দেয়। পাশাপাশি তারা ডা. জাফরুল্লাহসহ আরো দুই জনের সদস্যপদ খারিজ করে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে যুক্ত থাকায়। ২৭ অক্টোবর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার ব্যাপকভাবে ভাঙ্গচুর হয়। অংশ বিশেষে আগুন দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সেই সময় জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতেও দেশে আন্দোলন চলছিল। তারই ফল হিসেবে নব্বুয়ের ডিসেম্বরে এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএমএ’র সভাপতি ডা. এম এ মাজেদ। সরকারের প্রথম দিনই সংসদে প্রস্তাব আকারে থাকা স্বাস্থ্যনীতি-বিলটি বাতিল হয়। তবে ডা. জাফরুল্লাহ’র বিরুদ্ধে অনেকেরই রাগ-ক্ষোভ তখনও থামেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকাকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। সে সময় বিএমএ’র নানান দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় ওষুধ শিল্প সমিতিকে।
ওষুধ মালিকদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সেই বন্ধন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এদেশে কেবল শক্তিশালীই হয়েছে। বিপরীতে জনকল্যাণমূলক একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিকল্প চেষ্টাগুলো খুব বেশি দাঁড়াতে পারেনি।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক
আলতাফ পারভেজ

বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ করোনা সেবা উদ্যোগ নিয়ে সেই সময় লেখার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেন অনেকের কাছে অপছন্দের। তিনি ওষুধ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীতে কী করতে চেয়েছিলেন? গতকাল রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আজ পুরোনো বিতর্কটাকে সামনে এনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে চাই। বিষয়টি পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সে জন্যই আলাদা করে এই আলাপের উদ্যোগ। এখানে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পুরোনো লেখা থেকে নেওয়া।
করোনার বিরুদ্ধে সেই সময় দীর্ঘযুদ্ধে বেঁচে-মরে শেষপর্যন্ত যে কয়জন জয়ী হয়েছিলেন এদেশে, তাঁদের অবশ্যই ওষুধ ও স্বাস্থ্য প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে অতীতের সংগ্রামের কথাটা আসা স্বাভাবিক বিষয়। অসমাপ্ত সেই সংগ্রামের শিক্ষা এ সময়ে কাজে লাগতে পারে। এটা কেবল একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একার ব্যাপার না।
গণস্বাস্থ্য ফার্মা এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল দুবার ভাঙচুরের শিকার হয়। প্রথমবার এটিতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয় ১৯৮৪ সালের আগস্টে; দ্বিতীয়বার ১৯৯০ এর অক্টোবরে। গণস্বাস্থ্য ও ডা. জাফরুল্লাহ প্রথমবার আক্রান্ত হয় ওষুধনীতি নিয়ে, দ্বিতীয়বার স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে। দুটো ঘটনায় প্রবল যোগসূত্র আছে। আমরা ওষুধনীতির অধ্যায় থেকে শুরু করতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতেও সম্প্রসারণ করতে তৎপর ছিল।
সে সময় আমাদের দেশটিতে স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা করুণ ছিল। প্রতি একহাজার নবজাতকের ২৬০ জন ৫ বছরের মধ্যে মারা যেত। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। দামও ছিল অযৌক্তিকভাবে বেশি। ওষুধের ব্যবসার প্রধান সুবিধাভোগী ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সরকার সেই সময় টিসিবির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ থেকে ওষুধ আমদানি শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ অনেকে অসন্তুষ্ট ছিল। তাতে সেটাও কমাতে হয়। ফলে ওষুধ খাতে বহুজাতিকদের একচেটিয়াত্ব বাড়তেই থাকে।
১৯৭৮ সালে দেশে একটা ওষুধ নীতির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ড. এম এম হক। খসড়া অবস্থাতেই ওই ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ‘ওষুধ শিল্প সমিতি’। তাদের প্রতিবাদে ওটা খসড়াতেই থেমে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ হারান। এ কাজে তখনকার একজন মন্ত্রীরও ইন্ধন ছিল।
বাংলাদেশে অনেকেই বলেন ওষুধ নীতি জেনারেল এরশাদের অবদান তা কিন্তু ঠিক নয়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই জের।
১৯৮২ সালে এসে ২৮ এপ্রিল ওষুধনীতি তৈরি করতে ৮ সদস্যের একটা কমিটি হয়। এই কমিটিতে কোন আমলা ছিল না। সবাই ছিল চিকিৎসাবিদ্যার লোক। যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন পিজির অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন মাত্র। এই কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিএমএ’র সদস্যও ছিলেন।
এই কমিটি অনেকগুলো বৈঠক শেষে ১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে দেশের ওষুধ খাত নিয়ে তদন্তে নামে। দেশে সে সময় ওষুধ তৈরির জন্য ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছিল। পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি ওষুধ আমদানি হতো। কমিটি প্রায় ৪ হাজার ধরনের ওষুধের সন্ধান পায়। দেখা যায়, এতো বিভিন্ন নামের ওষুধ আসলে ১৫০টি উপাদানে তৈরি ওষুধেরই রকমারি কোম্পানি নাম মাত্র।
১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে এসব ওষুধ পরীক্ষা শেষে নূরুল ইসলাম কমিটি ১ হাজার ৭৪২টি ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় বা অকার্যকর ওষুধ শনাক্ত করে। এর মাঝে প্রায় ৯০০ ওষুধ তারা বাজার থেকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তুলে নেয়ার সুপারিশ করে। পাশাপাশি ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধে’র একটা তালিকা করা হয়। এই কমিটির বড় অবদান ছিল--
১. ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করার সুপারিশ;
২. বাংলাদেশে কারখানা না করে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ;
৩. দেশে থাকলে বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে প্রতিযোগিতামূলক করা;
৪. আয়ুর্বেদি ও ইউনানী ওষুধকে আইনের আওতায় আনা;
৫. ৪৫টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধকে পর্যায়ক্রমে জিনেরিক নামে বাজারজাত করা। আগে একই এমপিসিলিন ৪৮টি কোম্পানি ৪৮ নামে বাজারজাত করতো। আলাদা ব্র্যান্ড নাম হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা অনেক ব্র্যান্ডে দামের ক্ষেত্রে প্রতারিত হতো।
১৯৮২ সালের ২৯ মে মন্ত্রিসভা এসব সুপারিশ অনুমোদন করে। ১২ জুন সেটা ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ নামে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়।
তৃতীয় বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের জন্য এটা ছিল এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত। বহুজাতিকরা এতদিন নিজেদের চ্যালেঞ্জ অযোগ্য ভাবতো। সেখানে এই প্রথম একটা ঘা লাগে।
পাল্টা ঝড় উঠতেও দেরি হলো না। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওষুধকে ঘিরে দেশ-বিদেশে রাজনীতির পুরো চেহারাটি আস্তে আস্তে সে সময় বাংলাদেশে উদোম হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জার্মানি, ডাচ ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতও সরকারের উপর সম্মিলিত চাপ দেন ওষুধ নীতি বদলাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিসেস কুনকে সে সময় বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করতে দেখা যায়। ঢাকার টিকাটুলি থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী একটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি দৈনিক সে সময় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। জুনেই জেনারেল এরশাদকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যদিও এটা আইনে পরিণত করেই ওয়াশিংটন গেলেন--কিন্তু সেখানে গিয়ে কথা দিয়ে এলেন যে আইনটি রিভিউ করা হবে।
ওষুধনীতি বাস্তবায়ন হলে বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাবে এবং বহু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা প্রচারণা চলতে থাকে তুমুল বেগে সে সময়।
বিদেশি এই চাপ প্রয়োগের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের এই ওষুধ নীতি সফল হয়ে গেলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে একই রকম নীতির জন্য রাজনৈতিক রূপান্তরবাদীরা চাপ প্রয়োগ শুরু করবে।
বাংলাদেশের ওষুধ বিষয় কীভাবে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে এ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট হয় ১৯৮২ সালের ১৯ আগস্ট। শিরোনাম ছিল: ‘ইউএস ইজ এইডিং ড্রাগ কোম্পানিজ ইন বাংলাদেশ’।
ক্রমাগত চাপ ও তদবিরে মাধ্যমে মূল ড্রাগ পলিসি এরপর অনেকখানি পাল্টে যায়। প্রথম ‘রিভিউ’ হয় ১৯৮২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ আরো সংশোধিত হয়।
ওষুধ নীতি নিয়ে বিতর্ককালের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল কোম্পানিগুলোর পাল্টা প্রচারণা এবং তাতে দেশের চিকিৎসক সমাজের সংহতিতে ঢাকার মধ্যবিত্তরা সাধারণভাবে ওষুধ নীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল।
এখানকার মধ্যবিত্তরা যেকোন বড় ধরনের রূপান্তর উদ্যোগে যে কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে পারে তার একটা মহড়া হয়ে যায় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানে। একই ঘটনা দেখা যায় কয়েক বছর পর স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানেও।
বলাবাহুল্য, জেনারেল এরশাদের সরকার দেশ-বিদেশের এসব মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো সরকার ছিল না। ফলে দ্রুতই ওষুধ নীতিতে সংশোধন ঘটতে থাকে। পরবর্তীকালের এ রকম নির্বাহী আদেশের ফল হিসেবে খুব কম সংখ্যক ওষুধই আর মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকে। তারপরও ওষুধনীতির এমন কিছু সুফল অবশিষ্ট ছিল যার মাধ্যমে দেশের ওষুধশিল্প অনেক বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। কিন্তু এসব বিকাশ থেকে ভোক্তা হিসেবে রোগীরা প্রত্যাশিত মাত্রায় সুবিধা পায়নি।
ওষুধ নীতির এই ইতিহাসের মাঝেই ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দেশের চিকিৎসা পেশার নেতৃত্বস্থানীয় ৬৩ জন ব্যক্তি বিএমএকে অনুরোধ করে প্রফেসর নূরুল ইসলাম ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
সেই সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিশেষ রাগ ছিল কয়েকটি কারণে। যেসব চিকিৎসক স্বাধীনতা-যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তনের জন্য লড়ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় একজন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধের কাঁচামাল এবং ওষুধের দাম সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত, বহুজাতিকদের ব্যবসায়িক চাতুরি সম্পর্কিত তথ্যাদি গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন তিনি। সরকারকেও তিনি এসব তথ্য এনে দিতেন। তৃতীয়ত জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিদেশে যারা কাজ করছে এমন একটিভিস্টদেরও তিনি বাংলাদেশের ওষুধনীতির লড়াইয়ে কাজে লাগাচ্ছিলেন।
তাঁর কাছে এটা ছিল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক কাজ। বাংলাদেশের ‘র্যাডিক্যাল’দের তরফ থেকে তিনি সেসময় ভালো সংহতি পাননি। বরং তখন এমনও প্রচার চালানো হয়, ‘জাফরুল্লাহ খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা মুসলমান দেশের ওষুধ শিল্প ধ্বংসে নেমেছেন। এতে বাংলাদেশ ভারতীয় ওষুধের বাজারে পরিণত হবে।’ তাঁর বিচার চেয়ে অজ্ঞাত উৎস থেকে পোস্টার লাগানো হয় দেয়ালে দেয়ালে।
ওষুধনীতির বিরুদ্ধে এ রকম অবিশ্বাস্য মাত্রার প্রচার-প্রচারণা রুখতে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতেই এক সময় ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ওষুধ তৈরিকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের যে চাপ ও কার্যকারিতা আজও বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে এবং ভোক্তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে আছে তাতে স্বাস্থ্য খাতে ভোক্তা-বান্ধব পুনর্গঠন প্রকৃতই কঠিন। এ খাতে ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো চরিত্রকেও এখন আর বিশেষ দেখা যায় না।
ওষুধ নীতির পর দ্বিতীয়বার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্রান্ত হন স্বাস্থ্যনীতি তৈরির সময়। ১৯৮৭ সালের মার্চে স্বাস্থ্যনীতির তৈরির জন্য চার সদস্যের যে কমিটি হয় তাতে ছিলেন তিনি। এই কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল স্বাস্থ্য খাতের বিকেন্দ্রীকরণ। বিশেষ করে চিকিৎসকদের গ্রামে নেয়ার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে একত্রিত করা, স্বাস্থ্য কাঠামোতে জনপ্রতিনিধিদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতা বাড়াতে অডিট শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রীয় মেডিক্যাল কলেজসমূহের শিক্ষকদের প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করা এবং তার বদলে তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে এই স্বাস্থ্যনীতি বিল আকারে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন ওঠে। এই দিনই ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ ‘জনস্বার্থ বিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে’ ৭২ ঘন্টার ধর্মঘটের ডাক দেয়। পাশাপাশি তারা ডা. জাফরুল্লাহসহ আরো দুই জনের সদস্যপদ খারিজ করে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে যুক্ত থাকায়। ২৭ অক্টোবর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার ব্যাপকভাবে ভাঙ্গচুর হয়। অংশ বিশেষে আগুন দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সেই সময় জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতেও দেশে আন্দোলন চলছিল। তারই ফল হিসেবে নব্বুয়ের ডিসেম্বরে এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএমএ’র সভাপতি ডা. এম এ মাজেদ। সরকারের প্রথম দিনই সংসদে প্রস্তাব আকারে থাকা স্বাস্থ্যনীতি-বিলটি বাতিল হয়। তবে ডা. জাফরুল্লাহ’র বিরুদ্ধে অনেকেরই রাগ-ক্ষোভ তখনও থামেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকাকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। সে সময় বিএমএ’র নানান দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় ওষুধ শিল্প সমিতিকে।
ওষুধ মালিকদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সেই বন্ধন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এদেশে কেবল শক্তিশালীই হয়েছে। বিপরীতে জনকল্যাণমূলক একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিকল্প চেষ্টাগুলো খুব বেশি দাঁড়াতে পারেনি।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক

বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময় গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ করোনা সেবা উদ্যোগ নিয়ে সেই সময় লেখার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কেন অনেকের কাছে অপছন্দের। তিনি ওষুধ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে অতীতে কী করতে চেয়েছিলেন? গতকাল রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর আজ পুরোনো বিতর্কটাকে সামনে এনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে চাই। বিষয়টি পৃথকভাবে আলোচনার দাবি রাখে। সে জন্যই আলাদা করে এই আলাপের উদ্যোগ। এখানে যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পুরোনো লেখা থেকে নেওয়া।
করোনার বিরুদ্ধে সেই সময় দীর্ঘযুদ্ধে বেঁচে-মরে শেষপর্যন্ত যে কয়জন জয়ী হয়েছিলেন এদেশে, তাঁদের অবশ্যই ওষুধ ও স্বাস্থ্য প্রশ্নে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন-কর্ম নিয়ে অতীতের সংগ্রামের কথাটা আসা স্বাভাবিক বিষয়। অসমাপ্ত সেই সংগ্রামের শিক্ষা এ সময়ে কাজে লাগতে পারে। এটা কেবল একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীর একার ব্যাপার না।
গণস্বাস্থ্য ফার্মা এবং গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল দুবার ভাঙচুরের শিকার হয়। প্রথমবার এটিতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা হয় ১৯৮৪ সালের আগস্টে; দ্বিতীয়বার ১৯৯০ এর অক্টোবরে। গণস্বাস্থ্য ও ডা. জাফরুল্লাহ প্রথমবার আক্রান্ত হয় ওষুধনীতি নিয়ে, দ্বিতীয়বার স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে। দুটো ঘটনায় প্রবল যোগসূত্র আছে। আমরা ওষুধনীতির অধ্যায় থেকে শুরু করতে পারি।
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি খাতেও সম্প্রসারণ করতে তৎপর ছিল।
সে সময় আমাদের দেশটিতে স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা করুণ ছিল। প্রতি একহাজার নবজাতকের ২৬০ জন ৫ বছরের মধ্যে মারা যেত। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। দামও ছিল অযৌক্তিকভাবে বেশি। ওষুধের ব্যবসার প্রধান সুবিধাভোগী ছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। সরকার সেই সময় টিসিবির মাধ্যমে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ থেকে ওষুধ আমদানি শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ অনেকে অসন্তুষ্ট ছিল। তাতে সেটাও কমাতে হয়। ফলে ওষুধ খাতে বহুজাতিকদের একচেটিয়াত্ব বাড়তেই থাকে।
১৯৭৮ সালে দেশে একটা ওষুধ নীতির খসড়া তৈরির কাজ শুরু হয়। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন ড. এম এম হক। খসড়া অবস্থাতেই ওই ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ‘ওষুধ শিল্প সমিতি’। তাদের প্রতিবাদে ওটা খসড়াতেই থেমে যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ হারান। এ কাজে তখনকার একজন মন্ত্রীরও ইন্ধন ছিল।
বাংলাদেশে অনেকেই বলেন ওষুধ নীতি জেনারেল এরশাদের অবদান তা কিন্তু ঠিক নয়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটা ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই জের।
১৯৮২ সালে এসে ২৮ এপ্রিল ওষুধনীতি তৈরি করতে ৮ সদস্যের একটা কমিটি হয়। এই কমিটিতে কোন আমলা ছিল না। সবাই ছিল চিকিৎসাবিদ্যার লোক। যার প্রধান ছিলেন তৎকালীন পিজির অধ্যাপক নূরুল ইসলাম। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন মাত্র। এই কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিএমএ’র সদস্যও ছিলেন।
এই কমিটি অনেকগুলো বৈঠক শেষে ১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে দেশের ওষুধ খাত নিয়ে তদন্তে নামে। দেশে সে সময় ওষুধ তৈরির জন্য ১৭৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ছিল। পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি ওষুধ আমদানি হতো। কমিটি প্রায় ৪ হাজার ধরনের ওষুধের সন্ধান পায়। দেখা যায়, এতো বিভিন্ন নামের ওষুধ আসলে ১৫০টি উপাদানে তৈরি ওষুধেরই রকমারি কোম্পানি নাম মাত্র।
১৬টি মানদন্ডের ভিত্তিতে এসব ওষুধ পরীক্ষা শেষে নূরুল ইসলাম কমিটি ১ হাজার ৭৪২টি ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় বা অকার্যকর ওষুধ শনাক্ত করে। এর মাঝে প্রায় ৯০০ ওষুধ তারা বাজার থেকে বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তুলে নেয়ার সুপারিশ করে। পাশাপাশি ‘অত্যাবশ্যকীয় ওষুধে’র একটা তালিকা করা হয়। এই কমিটির বড় অবদান ছিল--
১. ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী করার সুপারিশ;
২. বাংলাদেশে কারখানা না করে থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি কোম্পানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ;
৩. দেশে থাকলে বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি নিরুৎসাহিত করা এবং বিদেশ থেকে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিকে প্রতিযোগিতামূলক করা;
৪. আয়ুর্বেদি ও ইউনানী ওষুধকে আইনের আওতায় আনা;
৫. ৪৫টি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধকে পর্যায়ক্রমে জিনেরিক নামে বাজারজাত করা। আগে একই এমপিসিলিন ৪৮টি কোম্পানি ৪৮ নামে বাজারজাত করতো। আলাদা ব্র্যান্ড নাম হওয়ায় সাধারণ ক্রেতা অনেক ব্র্যান্ডে দামের ক্ষেত্রে প্রতারিত হতো।
১৯৮২ সালের ২৯ মে মন্ত্রিসভা এসব সুপারিশ অনুমোদন করে। ১২ জুন সেটা ‘ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ’ নামে প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়।
তৃতীয় বিশ্বের স্বাস্থ্যখাতের জন্য এটা ছিল এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত। বহুজাতিকরা এতদিন নিজেদের চ্যালেঞ্জ অযোগ্য ভাবতো। সেখানে এই প্রথম একটা ঘা লাগে।
পাল্টা ঝড় উঠতেও দেরি হলো না। ১ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। ওষুধকে ঘিরে দেশ-বিদেশে রাজনীতির পুরো চেহারাটি আস্তে আস্তে সে সময় বাংলাদেশে উদোম হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জার্মানি, ডাচ ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতও সরকারের উপর সম্মিলিত চাপ দেন ওষুধ নীতি বদলাতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মিসেস কুনকে সে সময় বাংলাদেশের প্রভাবশালী দৈনিকের সম্পাদক এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করতে দেখা যায়। ঢাকার টিকাটুলি থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী একটা বাংলা এবং একটা ইংরেজি দৈনিক সে সময় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। জুনেই জেনারেল এরশাদকে যুক্তরাষ্ট্র সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যদিও এটা আইনে পরিণত করেই ওয়াশিংটন গেলেন--কিন্তু সেখানে গিয়ে কথা দিয়ে এলেন যে আইনটি রিভিউ করা হবে।
ওষুধনীতি বাস্তবায়ন হলে বিদেশি বিনিয়োগ চলে যাবে এবং বহু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা প্রচারণা চলতে থাকে তুমুল বেগে সে সময়।
বিদেশি এই চাপ প্রয়োগের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশের এই ওষুধ নীতি সফল হয়ে গেলে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে একই রকম নীতির জন্য রাজনৈতিক রূপান্তরবাদীরা চাপ প্রয়োগ শুরু করবে।
বাংলাদেশের ওষুধ বিষয় কীভাবে আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যথার কারণ হয়েছে এ নিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টে রিপোর্ট হয় ১৯৮২ সালের ১৯ আগস্ট। শিরোনাম ছিল: ‘ইউএস ইজ এইডিং ড্রাগ কোম্পানিজ ইন বাংলাদেশ’।
ক্রমাগত চাপ ও তদবিরে মাধ্যমে মূল ড্রাগ পলিসি এরপর অনেকখানি পাল্টে যায়। প্রথম ‘রিভিউ’ হয় ১৯৮২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বরে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ আরো সংশোধিত হয়।
ওষুধ নীতি নিয়ে বিতর্ককালের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল কোম্পানিগুলোর পাল্টা প্রচারণা এবং তাতে দেশের চিকিৎসক সমাজের সংহতিতে ঢাকার মধ্যবিত্তরা সাধারণভাবে ওষুধ নীতির বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল।
এখানকার মধ্যবিত্তরা যেকোন বড় ধরনের রূপান্তর উদ্যোগে যে কীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখতে পারে তার একটা মহড়া হয়ে যায় ওষুধ নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানে। একই ঘটনা দেখা যায় কয়েক বছর পর স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানেও।
বলাবাহুল্য, জেনারেল এরশাদের সরকার দেশ-বিদেশের এসব মহলের বিরুদ্ধে দীর্ঘযুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো সরকার ছিল না। ফলে দ্রুতই ওষুধ নীতিতে সংশোধন ঘটতে থাকে। পরবর্তীকালের এ রকম নির্বাহী আদেশের ফল হিসেবে খুব কম সংখ্যক ওষুধই আর মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকে। তারপরও ওষুধনীতির এমন কিছু সুফল অবশিষ্ট ছিল যার মাধ্যমে দেশের ওষুধশিল্প অনেক বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়। কিন্তু এসব বিকাশ থেকে ভোক্তা হিসেবে রোগীরা প্রত্যাশিত মাত্রায় সুবিধা পায়নি।
ওষুধ নীতির এই ইতিহাসের মাঝেই ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দেশের চিকিৎসা পেশার নেতৃত্বস্থানীয় ৬৩ জন ব্যক্তি বিএমএকে অনুরোধ করে প্রফেসর নূরুল ইসলাম ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
সেই সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিশেষ রাগ ছিল কয়েকটি কারণে। যেসব চিকিৎসক স্বাধীনতা-যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে আমূল পরিবর্তনের জন্য লড়ছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সক্রিয় একজন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে ওষুধের কাঁচামাল এবং ওষুধের দাম সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত, বহুজাতিকদের ব্যবসায়িক চাতুরি সম্পর্কিত তথ্যাদি গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেন তিনি। সরকারকেও তিনি এসব তথ্য এনে দিতেন। তৃতীয়ত জনস্বাস্থ্য নিয়ে বিদেশে যারা কাজ করছে এমন একটিভিস্টদেরও তিনি বাংলাদেশের ওষুধনীতির লড়াইয়ে কাজে লাগাচ্ছিলেন।
তাঁর কাছে এটা ছিল বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা রাজনৈতিক কাজ। বাংলাদেশের ‘র্যাডিক্যাল’দের তরফ থেকে তিনি সেসময় ভালো সংহতি পাননি। বরং তখন এমনও প্রচার চালানো হয়, ‘জাফরুল্লাহ খ্রিস্টানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটা মুসলমান দেশের ওষুধ শিল্প ধ্বংসে নেমেছেন। এতে বাংলাদেশ ভারতীয় ওষুধের বাজারে পরিণত হবে।’ তাঁর বিচার চেয়ে অজ্ঞাত উৎস থেকে পোস্টার লাগানো হয় দেয়ালে দেয়ালে।
ওষুধনীতির বিরুদ্ধে এ রকম অবিশ্বাস্য মাত্রার প্রচার-প্রচারণা রুখতে এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতেই এক সময় ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে একটা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ওষুধ তৈরিকারী কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপনের যে চাপ ও কার্যকারিতা আজও বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমে এবং ভোক্তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে আছে তাতে স্বাস্থ্য খাতে ভোক্তা-বান্ধব পুনর্গঠন প্রকৃতই কঠিন। এ খাতে ডা. জাফরুল্লাহ’র মতো চরিত্রকেও এখন আর বিশেষ দেখা যায় না।
ওষুধ নীতির পর দ্বিতীয়বার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্রান্ত হন স্বাস্থ্যনীতি তৈরির সময়। ১৯৮৭ সালের মার্চে স্বাস্থ্যনীতির তৈরির জন্য চার সদস্যের যে কমিটি হয় তাতে ছিলেন তিনি। এই কমিটির প্রধান সুপারিশ ছিল স্বাস্থ্য খাতের বিকেন্দ্রীকরণ। বিশেষ করে চিকিৎসকদের গ্রামে নেয়ার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে একত্রিত করা, স্বাস্থ্য কাঠামোতে জনপ্রতিনিধিদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জবাবদিহিতা বাড়াতে অডিট শক্তিশালী করা, রাষ্ট্রীয় মেডিক্যাল কলেজসমূহের শিক্ষকদের প্রাইভেট প্রাকটিস বন্ধ করা এবং তার বদলে তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ইত্যাদি।
১৯৯০ সালের অক্টোবরে এই স্বাস্থ্যনীতি বিল আকারে জাতীয় সংসদে আলোচনার জন ওঠে। এই দিনই ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ ‘জনস্বার্থ বিরোধী স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে’ ৭২ ঘন্টার ধর্মঘটের ডাক দেয়। পাশাপাশি তারা ডা. জাফরুল্লাহসহ আরো দুই জনের সদস্যপদ খারিজ করে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে যুক্ত থাকায়। ২৭ অক্টোবর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার ব্যাপকভাবে ভাঙ্গচুর হয়। অংশ বিশেষে আগুন দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে এই আন্দোলনের পাশাপাশি সেই সময় জেনারেল এরশাদের পদত্যাগের দাবিতেও দেশে আন্দোলন চলছিল। তারই ফল হিসেবে নব্বুয়ের ডিসেম্বরে এরশাদ পদত্যাগ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারে অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন বিএমএ’র সভাপতি ডা. এম এ মাজেদ। সরকারের প্রথম দিনই সংসদে প্রস্তাব আকারে থাকা স্বাস্থ্যনীতি-বিলটি বাতিল হয়। তবে ডা. জাফরুল্লাহ’র বিরুদ্ধে অনেকেরই রাগ-ক্ষোভ তখনও থামেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকাকে দিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়। সে সময় বিএমএ’র নানান দাবির সমর্থনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় ওষুধ শিল্প সমিতিকে।
ওষুধ মালিকদের সঙ্গে চিকিৎসকদের সেই বন্ধন ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এদেশে কেবল শক্তিশালীই হয়েছে। বিপরীতে জনকল্যাণমূলক একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিকল্প চেষ্টাগুলো খুব বেশি দাঁড়াতে পারেনি।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
১০ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
১১ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
১১ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
১১ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
১১ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
১১ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
১১ ঘণ্টা আগেজাহীদ রেজা নূর

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
১০ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
১১ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
১১ ঘণ্টা আগেস্বপ্না রেজা

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
১০ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
১১ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
১১ ঘণ্টা আগেসানজিদা সামরিন

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যখাত এবং ওষুধ নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছিল। বিশাল গ্রামবাংলায় কীভাবে স্বাস্থ্যসেবাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সেটা যুদ্ধোত্তর সমাজেরই একটা আকাঙ্খা ছিল। বিশেষ করে সেই সব চিকিৎসক এটা তীব্রভাবে ভাবতেন, যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ‘মুক্তি’ বিষয়টিকে এরা স্বাস্থ্য
১৩ এপ্রিল ২০২৩
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
১০ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
১১ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
১১ ঘণ্টা আগে