Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশকে হজম করে ফেলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র

আনু মুহাম্মদ।

আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশের একজন অন্যতম গণবুদ্ধিজীবী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সংগঠক, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্যসচিব। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম নেতা এবং ‘সর্বজন কথা’ পত্রিকার সম্পাদক। মার্কিন শুল্ক ও সরকারের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট বা গোপনীয়তা রক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করেছে—এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

যুক্তরাষ্ট্র তো ট্রাম্পের নেতৃত্বে সারা বিশ্বে একটা উন্মাদনা শুরু করেছে। শুল্ক বৃদ্ধির একচেটিয়া সিদ্ধান্ত যেসব যুক্তিতে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, এসবের কোনো যুক্তি নেই। ট্রাম্পের যুক্তি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি আছে এবং তাঁর দেশ থেকে আমাদের দেশে অনেক পণ্য আনা হয় না। এই যে আনা হয় না বা তাঁর দেশ থেকে পাঠানো হয় না, এসব তো অর্থনৈতিক কারণে হয়।

আমাদের বিশ্ববাজারে যে জায়গা থেকে আমদানি করা সুবিধাজনক, আমরা তো সেখান থেকেই আমদানি করব। অর্থনৈতিক যুক্তিতে তা-ই হওয়ার কথা। বাজার অর্থনীতির কথা হলো, যেখানে দাম কম পাওয়া যায়, সেখান থেকে আমদানি করা। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করার আসলে আমাদের তেমন কিছু নেই। সে কারণে সেখানে ঘাটতি থাকে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা আছে আমাদের পোশাকের। সে কারণে সেখানে আমাদের পোশাক যায়। বাজার অর্থনীতির মধ্যে তো জোরজবরদস্তির ব্যাপার থাকার কথা না।

যুক্তরাষ্ট্র বাজার অর্থনীতির কথা বলে। তারাই আবার বাজার অর্থনীতির নিয়মকানুন, বিধি-ব্যবস্থার সবকিছুকে ভেঙেচুরে তছনছ করে দিয়ে এখানে পুরো একটা দানবীয় সংঘাতসুলভ ব্যবহার করে নানা দেশে ইচ্ছেমতো শুল্ক আরোপ করছে। এটা আসলে অর্থনীতির শক্তির জোরে করছে না, সেটা করছে সামরিক শক্তির জোরে। যুক্তরাষ্ট্রের আসলে এখন আর অর্থনীতির কোনো শক্তি নেই।

এটা তারা করতে পারছে অন্যান্য দেশের অনৈক্যের কারণে। তারা এ কারণে সম্রাটসুলভ ঔদ্ধত্য দেখাতে পারছে। ট্রাম্পের মতলবটা ছিল বিভিন্ন দেশের ওপর ৩০ থেকে ৮০ বা তার বেশি শুল্ক আরোপ করা। কমানোর উদ্দেশ্য মাথায় রেখে তিনি এ রকম বড় অঙ্কের শুল্ক বসিয়েছেন। তারপর বিভিন্ন ধরনের শর্ত চাপিয়ে এখন আবার দর-কষাকষি করছেন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। বিভিন্ন ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের নির্দেশ দিচ্ছেন।

বাংলাদেশে যেটা ২০ শতাংশ দাঁড়াল, সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। আগে আমাদের শুল্কের পরিমাণ ছিল ১৬ শতাংশ; তখন ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরবের চেয়ে আমাদের শুল্কহার বেশি ছিল। তার ওপর এখন ২০ শতাংশ বসল। সে হিসাবে ওই সব দেশের কাছাকাছি আছে। এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ট্রাম্পের এ ধরনের অপতৎপরতায় শুধু বিশ্বের নানা দেশ না, স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেখানকার ভোক্তাদের বেশি দামে জিনিস কিনতে হবে। এতে করে সব দেশ থেকে যত ধরনের জিনিস যাবে, সবকিছুর দাম বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে একটা সংকট তৈরি হবে। ফলে সেখানে বেকারত্ব বাড়বে।

ট্রাম্প যত ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁর নাগরিকদের, তার কিছুই পূরণ করতে পারছেন না। তাই ট্রাম্প শুধু বিশ্বের মানুষের জন্য না, নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

তাঁর এসব উদ্যোগের কারণে কিছু কোম্পানির লাভ হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকের প্রত্যেকেরই প্রকৃত আয় কমে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির গতি এমনিতেই সংকটের মধ্যে আছে, আরও সংকটের মধ্যে পড়বে। আর সেখানে যদি মন্দা হয়, তার প্রভাব সারা বিশ্বে দেখা দেবে শুধু ট্রাম্পের কারণে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে সমঝোতা হয়েছে, তাতে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট বা গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এটাকে কেন গোপন করা হলো?

বাংলাদেশকে ট্রাম্পের ধমক দেওয়া এবং জোরজবরদস্তি করে শুল্ক চাপানোর সঙ্গে নানা ধরনের শর্ত দেওয়ার সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ আসলে ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে, তার পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে ট্রাম্পের নির্দেশ। মানে ট্রাম্পের সঙ্গে কী কী ব্যবসা করতে হবে, তাঁর কাছ থেকে কীভাবে আমদানি বাড়াতে হবে, অন্য দেশের সঙ্গে কীভাবে আমদানি বাড়াতে হবে এবং অন্য দেশের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক রাখতে হবে—এই সবকিছু হলো ট্রাম্পের নির্দেশ। মানে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ট্রাম্পের কথামতো হতে হবে। সেই রকম একটা নির্দেশমালা তারা বাংলাদেশকে পাঠিয়েছে। পাঠানোর পরে সেটা নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই সরকার কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন শুরু করে দিয়েছে জুনের প্রথম থেকে। এটার প্রতিফলন পাওয়া যায় বাজেটে। আমি বাজেট আলোচনার সময় বলেছিলাম, এবার বাজেটে ট্রাম্প এবং আইএমএফের ছায়া আছে। ট্রাম্পের শর্ত বাস্তবায়নের কারণে শতাধিক মার্কিন পণ্যের শুল্কমুক্ত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে বাজেটে। জাতীয় স্বার্থের কোনো আলোচনা ছাড়াই এসব শুরু হয়েছে জুন থেকেই।

কেনাকাটার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। এলএনজি আমদানি করতে হবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যদি অন্য কোথাও কম টাকায় কেনা যায়, সেটা কেনা যাবে না। এই আমদানি চুক্তি তো কয়েক মাস আগে করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বিদেশে গিয়ে সেই চুক্তি করেছেন। এরপর ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাজেটের মধ্যে অস্ত্র আমদানির কথা বলা হয়েছে, মাছ-মাংস ইত্যাদি শুল্কমুক্তে আমদানি করতে হবে।

এর মধ্যে শুল্ক আলোচনার সর্বশেষ পর্যায়ে যাওয়ার আগে সরকার একটা ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট বা গোপনীয়তা রক্ষা’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। মানে, এই চুক্তির কোনো কিছুই প্রকাশ করা যাবে না। সরকার ১৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর জন্য কী কী বিষয় নিয়ে চুক্তি করেছে, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে, কয়েক মাস ধরে এই সরকারের মধ্যে বেশ কিছু ব্যক্তি আছেন, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই সেসব বাস্তবায়নের জন্য একধাপ এগিয়ে আছেন। এতে করে তাঁরা কোনো ঝামেলার মধ্যে না পড়লেও, পুরো দেশকে একটা ফাঁদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। এই চুক্তিগুলো করার জন্য সরকারের মধ্যকার কিছু লোককে বেশি উৎসাহী দেখা যাচ্ছে। সেটাই হলো উদ্বেগের বিষয়।

গম আমরা কম দামে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে কিনতে পারতাম, কিন্তু চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনতে হবে। চীন বা অন্য দেশ থেকে কম দামে তুলা আনা সম্ভব হলেও তা আনা যাবে না। আমাদের মাছ, মাংস যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করার দরকার না হলেও তা করতে হবে। ২৫টা বোয়িং বিমান কেনার দরকার না থাকলেও সেটা তাদের কাছ থেকেই কিনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যা ইরান ও রাশিয়ার। আমরাও এ দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারব না। এতে করে বাংলাদেশের স্বাধীন কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।

এখন সরকার ১৫ শতাংশ শুল্ক কমানোকে বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখাতে চাইছে। কিন্তু এই ১৫ শতাংশ কমানোটা এমনিতেই সম্ভব ছিল, সেটা অন্যান্য দেশের কমানো দেখে বোঝা যাচ্ছে। এখন বাণিজ্য উপদেষ্টা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি চায়, তাহলে আমরা সেটা প্রকাশ করতে পারব। প্রকাশ করা আর না করার মধ্যে এখন আর কোনো পার্থক্য নেই। কারণ, চুক্তি তো স্বাক্ষর করা হয়ে গেছে। এতে বাংলাদেশ একটা বড় বিপদের মধ্যে পড়বে। যেসব পণ্য আমদানি করব, সেগুলো বেশি দামে কিনতে হবে। সেসবের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। এগুলো হলো আর্থিক ক্ষতির দিক।

আমাদের যে বৈশ্বিকভাবে সামরিক ব্যাপারে পোলারাইজেশনের উদ্বেগ, সেসবের ফাঁদের মধ্যে পড়ে যাব। আমাদের এ বিষয়ে পুরো নিয়ন্ত্রণটা যুক্তরাষ্ট্র নিতে চাইছে। এখানে তো চীনেরও বড় বিনিয়োগ আছে।

চীন থেকে অস্ত্র আনা যাবে না। সেখান থেকে পণ্য আমদানি কমাতে হবে। মানে, সরাসরি চীনের নাম করে তাদের অনেক ধরনের শর্ত আছে। চীনের সঙ্গে আমাদের এখনকার যে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, সেটা বড় আকারের। কারণ, চীনের পণ্য আমদানি আমাদের জন্য সুবিধাজনক। দামের দিক থেকে, দূরত্বের দিক থেকে এবং প্রয়োজনের দিক থেকে সবচেয়ে সহজ। আর চীন থেকে আমরা কোনো অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করি না। শিল্পের জন্য কাঁচামাল আসে, যন্ত্রাংশ আসে। আর আসে কনজ্যুমার আইটেম। চীন থেকে আসা পণ্যগুলোর দাম সুলভ হয়।

আর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও সবচেয়ে বেশি চীনের পণ্য রপ্তানি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর এবং বেশি পরিমাণে পণ্য আমদানি করা হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এখন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতির রীতিনীতি এবং বাজার অর্থনীতির টেক্সটবুকের কথা তারাই বেশি করে বলে থাকে, সেটাকে তারা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি কোনো বৈশ্বিক নিয়ম বা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নয়, বরং রাজনৈতিক ও কৌশলগত অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তৈরি। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত ও দুর্বল অর্থনীতির ওপর এ ধরনের বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ন্যায্য ও সমান সুযোগভিত্তিক’ বাণিজ্যনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন নয় কি?

এটা আগে থেকেই হচ্ছিল। আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের আইন অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে গেছে। আগে থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইসরায়েল যে ফিলিস্তিনে প্রতিদিন মানুষ (শিশু ও নারী) হত্যা করছে, এর বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোটাই কার্যকর হয়নি। আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থা, আইনকানুন—কোনো কিছুই কাজ করছে না।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে ব্যাপক উৎসাহ দেখিয়েছে। এটা বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের মতো না। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সদস্য হতে হয় চাঁদার ওপর নির্ভর করে। একটি দেশের চাঁদার পরিমাণ বেশি হলে তার ভোটের সংখ্যা বেশি হয়। চাঁদার পরিমাণ কম হলে ভোটও কম হয়।

কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা হলো জাতিসংঘের একটি দেশের জন্য একটি ভোট। সে কারণে অন্য দেশের জন্যও একধরনের সুবিধা আছে। ফলে এই সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে। তার ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে ‘ব্রিকসের’ মতো সংস্থার জন্ম হয়েছে। ফলে বড় দেশের সঙ্গে ছোট দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সমঝোতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে ব্রিকসের জন্ম যুক্তরাষ্ট্র পছন্দ করে না। এরপর একটা পর্যায়ে দেখা গেল, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সেভাবে আর কার্যকর নেই।

ট্রাম্পের এই শুল্ক চাপানোটা আন্তর্জাতিক বাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। এভাবে একটা দেশ শুল্ক আরোপ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাধারণ নিয়ম হলো, কোনো দেশ শুল্ক আরোপ করলে সেখানে অন্য দেশ যেতে পারে, আবার না-ও যেতে পারে। সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য এখন ট্রাম্প জোরজবরদস্তির আশ্রয় নিচ্ছেন। এখানে তিনি সামরিক শক্তি দেখাচ্ছেন। সমস্ত কিছু যুক্তরাষ্ট্র ঠিক করে দেবে। মানে, বাংলাদেশকে হজম করে ফেলতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। শুধু বাংলাদেশ কেন, সারা বিশ্বের ক্ষেত্রে তারা সেই চেষ্টাই করছে।

একটা অনির্বাচিত সরকার কি এ ধরনের ঝুঁকি নিতে পারে?

অন্তর্বর্তী সরকার একটা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাদের দায়িত্ব আরও বেশি ছিল এগুলো প্রতিরোধ করার জন্য। তারা তো কোনো স্থায়ী সরকার না। নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত এ ধরনের চুক্তিতে না যাওয়াই তাদের উচিত ছিল। কিন্তু দেখা গেল, তারা আগ্রহী হয়ে এ ধরনের শর্ত মেনে নিয়ে চুক্তিটা করল। যাঁরা চুক্তিটা করেছেন, তাঁদের তো একসময় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার প্রবাসী, তাঁরা বাংলাদেশে থাকবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির শিকার হতে হবে। সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো, রাজনৈতিক, সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক পোলারাইজেশন সামনে তৈরি হবে; সেগুলোর একটা ভিকটিম হতে পারে বাংলাদেশ এ চুক্তির কারণে।

বাণিজ্য চুক্তি কাজে লাগাতে হলে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আমরা কি সক্ষমতার জায়গায় আদৌ পৌঁছাতে পারব?

সক্ষমতা হলো আত্মসম্মানের ব্যাপার। একটা দেশ যদি সক্ষমতা বাড়াতে চায়, তাহলে প্রথমে আত্মসম্মান বোধের দরকার হয়। কোনো আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন সরকার এ ধরনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে না জনগণকে না জানিয়ে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে জিনিসটা আমরা অন্য কোনো দেশ থেকে কম টাকায় পাব, সেটা আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়াটা তো কোনো সক্ষমতার মধ্যে পড়ে না। সক্ষমতা তো বলবে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আনার দরকার নেই। অ্যাডাম স্মিথ, রিকার্ডোদের তত্ত্বই বলে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এ ধরনের জিনিস আমদানি করার দরকার নেই। কারণ, সেখানে দাম বেশি পড়ে। তার মানে, এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করাই হলো সক্ষমতা। এই চুক্তি করার মধ্য দিয়ে সক্ষমতার সব সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করা হয়েছে এবং বাংলাদেশকে বড় ধরনের বিপদের মধ্যে ফেলা হয়েছে।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তারেকের প্রত্যাবর্তন: অভিমত

রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান
ড. কামরুল আহসান।
ড. কামরুল আহসান।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে, আজ থেকে ছয় দশক আগে। বাবা দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সফল রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। মা বিএনপির চেয়ারপারসন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাই জন্মসূত্রে তারেক বিরল ভাগ্যের অধিকারী। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছেন, সেদিন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কীভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন। বহু প্রতিভার অধিকারী বাবা জিয়াউর রহমান কীভাবে চড়াই-উতরাই মোকাবিলা করে দেশকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়েছেন, তাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। মা খালেদা জিয়া হলেন তাঁর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই স্বৈরাচারী এরশাদ প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তখন বিএনপির খুব দুঃসময়। হাল ধরলেন খালেদা জিয়া। তারেক রহমান প্রত্যক্ষ করেছেন, নবাগত তাঁর মা কীভাবে ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সুসংগঠিত করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনবার দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে তারেক রহমানের রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে। তৃণমূল সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হন, যা ছিল তাঁর জন্য মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা তাঁর পরিবার থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করার কাজে সেই অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন। অতঃপর এই অঙ্গনে তাঁর কর্মকাণ্ড ছিল নিরন্তর প্রবহমান। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী প্রচার-কার্যক্রম পরিচালনার পাঠ গ্রহণ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আধুনিক ও কার্যকর প্রচারের কৌশল প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং বিএনপির অমিত সম্ভাবনাময় নেতা হিসেবে তাঁর অভ্যুদয় ঘটে। ২০০১ সালে নির্বাচিত হন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে। ২০০৯ সালে দলের কাউন্সিলের মাধ্যমে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক গণসংযোগ ও যুবসমাজকে রাজনীতির প্রশিক্ষণ দিয়ে নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ দেশবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে দলের ভেতরে ও দেশবাসীর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় জুলুমের শিকার কারাবন্দী দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার স্থলে ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। কখনো সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখে, আবার কখনো-বা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নেতাকে অপশক্তির রোষানলে পড়তে হয়। কৈশোরের অনুরূপ তারেক রহমানের রাজনৈতিক অঙ্গনে পথ চলাও নিয়ত সরলরৈখিক হয়নি। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে যে সেনা সরকার এসেছিল, তা জরুরি অবস্থা জারি করে বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

বিশেষ করে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনী এবং টাস্কফোর্সের নামে হামলা-মামলা, জুলুম ও নির্যাতন চালায়। দেশনেত্রীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই নির্যাতন ও জুলুমের শিকার নেতা-কর্মীদের মধ্যে তারেক রহমানের ওপর নেমে আসা নির্যাতনের মাত্রা ও ধরন ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। ৭ মার্চ ২০০৭ তারিখে গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর নেমে আসে পৈশাচিক নির্যাতন। এই আক্রমণ তাঁর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্যই করা হয়েছিল। তিনি ভাগ্যক্রমে এবং দেশবাসীর দোয়ায় বেঁচে যান। ৭ মার্চ ২০০৭ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান। এটি তাঁর জন্য একদিক থেকে যেমন নির্বাসনের যন্ত্রণা ভোগের শামিল, অন্যদিক থেকে দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে তাঁর নিজের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরও দৃঢ় করার একটি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া। রাজনৈতিক জীবনের এই আঁকাবাঁকা পথ চলায় তিনি যে জীবনমুখী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা তাঁর বর্তমান পথ চলার ক্ষেত্রে পাথেয় হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে দেশের দায়িত্ব পালন করার সময় তাঁর এই অভিজ্ঞতার সুবাদে সূচিত হতে পারে বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির গতিধারা। পৃথিবীর স্বনামধন্য রাজনীতিকগণের জীবন ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, তাঁদের অনেকেরই রাষ্ট্র পরিচালনায় সফল হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতা ও চড়াই-উতরাই পার হওয়ার করুণ কাহিনি। সুখ-দুঃখের এই মিশ্র অভিজ্ঞতাগুলো তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে আরও জোরালো করেছে। তারেক রহমানের রয়েছে নির্যাতনের দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করার অভিজ্ঞতা। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সফলতম রাষ্ট্রনায়ক পিতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবরণের করুণ কাহিনি প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা। আরও রয়েছে মা খালেদা জিয়ার ৪০ বছর যাবৎ বসবাস করা নিজ বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হওয়ার করুণ অভিজ্ঞতা। প্রতিনিয়ত নেতা-কর্মীদের ওপর ঘটে যাওয়া অসংখ্য নিপীড়ন-নির্যাতনের কাহিনি তো রয়েছেই। এই অভিজ্ঞতাগুলো তারেক রহমানকে করে তুলেছে এক সর্বংসহা রাজনীতিক হিসেবে। তাঁর মধ্যে এমন এক বোধ তৈরি হয়েছে, যা তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে।

সুতরাং বলা যায়, যে অভিজ্ঞতাগুলো একজন মানুষকে ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ উপলব্ধিতে সাহায্য করে, তারেক রহমান সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রায় অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতির পঙ্কিল পথে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার-আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণে এর চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে কি? বোধ করি নেই।

এখন প্রয়োজন হলো, এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে সচেষ্ট হওয়া, যার স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিল এবং যার সূচনা করেছিলেন তাঁরই পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ও পরবর্তী সময়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মাধ্যমে।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিন ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, সেদিন থেকেই এই স্বপ্ন পূরণের বাস্তব এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। প্রতিশোধের অগণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে তারেক রহমান জাতির উদ্দেশ্যে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত থাকবে, সেটাই জাতির প্রত্যাশা। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন শুধু একজন ব্যক্তির ফিরে আসা নয় বরং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের এক সুবর্ণ সুযোগ।

অন্তর্বর্তী সরকার তারেক রহমানসহ সকল রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে এই সুযোগের বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা উচিত। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বজায় থাকলে প্রতিহিংসার বিপরীতে গণতান্ত্রিক ইতিবাচক প্রতিযোগিতার বিজয় অনিবার্য।

লেখক: অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বড়দিনের শুভেচ্ছা

সম্পাদকীয়
বড়দিনের শুভেচ্ছা

দেখতে দেখতেই যেন বছরটা শেষ হয়ে আসছে। ২০২৫ সালের হতাশা-প্রত্যাশার হিসাব কষতে কষতে বড়দিন কড়া নেড়ে দিল দরজায়। সব হতাশা ভুলে প্রত্যাশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে প্রতিবছর ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের আগমন হয়, ভালোবাসা ও একতার বাণী ছড়িয়ে। এ দিনে পৃথিবীতে যিশুখ্রিষ্টের আগমন, শান্তি আর সৎপথের বার্তা নিয়ে। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাই দিনটি বিশেষ।

আজ বড়দিন। যিশুর অনুসারী তথা খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় উৎসব। পবিত্র এ দিনটি আজ বিশ্বজুড়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে। বহুবিধ সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশেও ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই মিলে উদ্‌যাপন করছে যিশুর জন্মদিন। গির্জা কিংবা ঘরোয়া পার্বণ—সবখানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হচ্ছে সেই যিশুকে, যিনি বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে জন্মেছিলেন। স্মরণ করা হচ্ছে তাঁর জন্মের পবিত্র লগ্নকে।

আজ যিশুর বন্দনা গাওয়ার দিন। কারণ, এই দিনে ধরণিতে তাঁর আবির্ভাব হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে—ত্রাতা হিসেবে। তিনি অন্যকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন পাপ-পঙ্কিলতা বর্জন করে করুণা, পবিত্রতা ও সুন্দর পথে কীভাবে জীবন পরিচালনা করা যায়। ঈশ্বরের প্রতি আস্থা এনে মুক্তির পথ খুঁজতে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

বড়দিনে যিশুখ্রিষ্টের জন্মের কাহিনি পাঠ ও ধ্যান করা হয়। সেই কাহিনি অবলম্বনে গির্জায় এবং বাড়িতে বাড়িতে গোশালা নির্মাণ করে ফুলপাতা দিয়ে সাজানো হয়। এ দিনে চলে গানবাজনা, নামসংকীর্তন, ভোজন, আনন্দ-উল্লাস। এসব উৎসব-আয়োজনের চেয়েও বড় ব্যাপার হয়ে ওঠে নিজেদের হৃদয়-মন ও অন্তরাত্মাকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করার প্রয়াস। তাই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা বড়দিনের পূর্ববর্তী চার সপ্তাহব্যাপী ধ্যান-অনুধ্যান, মন পরীক্ষা, ব্যক্তিগত পাপ স্বীকার, সমবেত পুনর্মিলন বা ক্ষমা-অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষে-মানুষে সুসম্পর্ক গড়তে সচেষ্ট হন।

ঈশ্বরের মহান বার্তাবাহক যিশুকে অনুসরণ করলে কতই না সুন্দর একটি সমাজ গঠন করা যায়! অথচ পাপাচারের পৃথিবীতে সেই সমাজ থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে বাস করি। মানবজাতির জন্য এ এক দুর্ভাগ্য! এ রকম সংকটের মুহূর্তেই যিশুর বাণী, বড়দিনের বার্তা যেন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—মানুষে-মানুষে ভালোবাসা ও একতার বীজ বুনতে হবে; ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে সবার প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। কোনো জাতি, ধর্ম বা তার অনুসারীর প্রতিই বিরুদ্ধাচরণ কাম্য নয়।

বড়দিন উপলক্ষে প্রতিবছর বাংলাদেশে সরকারি ছুটি থাকে। শান্তিপূর্ণভাবে উদ্‌যাপনের পাশাপাশি দিনটিতে প্রিয় স্বদেশের মঙ্গল কামনার জন্য খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনা করতে ভোলেন না। এই প্রার্থনা আর শান্তিরাজ যিশুর দেখানো পথে চলার প্রয়াসই কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে পারে। বড়দিন সবাইকে বারবার সুযোগ দেয় দুর্নীতি, অনাচার, পাপাচার বর্জন করে সৎপথে চলার। সেই সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না। বরং কাজে লাগিয়ে গড়তে হবে একতার বাংলাদেশ; যে বাংলাদেশে ধর্মকে পুঁজি করে মিথ্যা অপবাদে কাউকে হত্যা করা হবে না—সে যে কেউ হোক।

সবার জীবনে বড়দিন শান্তি বয়ে আনুক। সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বিশ্বজুড়েই কেন গণমাধ্যম আক্রান্ত

রাজিউল হাসান
১২ মাসে নিহত সাংবাদিকদের প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। ছবি: এএফপি
১২ মাসে নিহত সাংবাদিকদের প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। ছবি: এএফপি

গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। এই দর্পণে চোখ রাখলে সমাজ তার অন্ধকার দিকগুলো আবিষ্কার করতে পারে, ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগ পায়। এ কারণেই যুগে যুগে সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া ব্যক্তিরা গণমাধ্যমকে ‘শত্রু’ মনে করে এসেছে। অর্থশক্তি, পেশিশক্তি দিয়ে তারা সমাজের এই দর্পণের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে। সেই ধারাবাহিকতা ২০২৫ সালেও ছিল। এ বছরেও গণমাধ্যম আক্রান্ত হয়েছে, সাংবাদিকদের প্রাণ গেছে।

সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডাসের তথ্য বলছে, বিদ্বেষ ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির কারণে ২০২৫ সালেও সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। এ বছর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিক শুধু প্রাণই দেননি, তাঁরা হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্যবস্তুও হয়েছেন।

সংগঠনটির তথ্য বলছে, বিগত ১২ মাসে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকসহ ৬৭ জন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই প্রাণ দিয়েছেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিংবা অপরাধী চক্রের লক্ষ্যবস্তু হয়ে। এই ৬৭ জনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকেরই প্রাণ গেছে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধেও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে সাংবাদিকদের। আফ্রিকার দেশ সুদান সাংবাদিকদের জন্য হয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র। মেক্সিকোয় অপরাধী চক্রের হাতে প্রাণ গেছে ৯ সাংবাদিকের। উত্তর আমেরিকার এই দেশটিকে বলা হয় সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের দ্বিতীয় বিপজ্জনক রাষ্ট্র।

সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শুধু প্রাণই দিচ্ছেন না, তাঁরা আটক-গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অন্তত ৫০৩ জন সাংবাদিক কারান্তরীণ হয়ে আছেন।

কেবল অপরাধ চক্রের উৎপাতে অতিষ্ঠ দেশ কিংবা যুদ্ধকবলিত দেশই নয়, গণতন্ত্রের চর্চার দাবি করা দেশেও সাংবাদিকেরা দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকের ওপর সহিংসতা বেড়ে গেছে। ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন নামের অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যত সাংবাদিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তা গত তিন বছরের মোট সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনার সংখ্যার বেশি।

ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে নিপীড়নের শিকার সাংবাদিকদের বেশির ভাগই আক্রান্ত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সাংবাদিক কেন আক্রান্ত হন? বিশ্বজুড়েই দেখা যায়, যখন কোথাও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়, সাংবাদিক সেখানে যান পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে তথ্য সংগ্রহ করতে। তিনি কারও পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কাজ করেন না। শুধু জনসাধারণকে সঠিক তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টায় কোনো না কোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ হয় সেই পক্ষের উদ্দেশ্য প্রকাশ হওয়ার ভয়ে।

আবার অপরাধী চক্র সাংবাদিককে আক্রমণ করে তাদের গোমর ফাঁসের ভয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেশি থাকে। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে মানবাধিকারের বালাই থাকে না। মাঠের পরিস্থিতি যেন বিশ্বমানবতা জানতে না পারে, সে চেষ্টার অংশ হিসেবে আক্রমণ করা হয় সাংবাদিককে।

কখনো কখনো শুধু রোষের বশেও সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করা হয়। শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী না, কখনো কখনো রাষ্ট্রও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরে। সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, এর উদাহরণ বিশ্বজুড়েই রয়েছে। নতুন করে আর কোনো দেশের নামোল্লেখ করতে চাই না।

কিন্তু গণমাধ্যম সরকার ও সমাজের বন্ধু হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল সমাজের নানা ত্রুটি তুলে ধরে গণমাধ্যম রাষ্ট্র গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। গণমাধ্যম সে প্রচেষ্টা করেও যাচ্ছে। গণমাধ্যমের শাসক কিংবা কোনো গোষ্ঠীর ‘দাসে’ পরিণত হওয়ার রেকর্ড যদিও আছে, কিন্তু সেটা হাতে গোনা বলা চলে। বাকি গণমাধ্যমগুলো সমাজকে সঠিক পথ দেখাতেই নিরন্তর কাজ করে চলেছে। উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ভূমিকা রেখেছিল, তা যুগ যুগ ধরে আলোচনা হবে। কিংবা হাল আমলে যুক্তরাজ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের করোনাকালীন ভূমিকা বিবিসি, গার্ডিয়ানসহ সে দেশের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে প্রকাশ করেছিল, সেটাও বড় উদাহরণ।

একটি জাতি গঠন কিংবা সমাজ গঠন—যে গঠনের কথাই বলা হোক না কেন, গণমাধ্যমের ভূমিকা কিছুতেই খাটো করে দেখা যাবে না। সমাজের ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরাই সাংবাদিকের কাজ। এমনকি শাসক দল যখন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়, তখন গণমাধ্যমই তাদের কথা সবার সামনে তুলে ধরে। অথচ এমনও দেখা গেছে, সেই বিরোধী দল যখন সরকারে যায়, তারাও গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করেছে। এভাবেই যুগে যুগে সংবাদমাধ্যমকে বাকরুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

আমরা যদি একটু গভীরে ভাবি, তাহলে দেখব, সাংবাদিক যে পারিশ্রমিক পান, সে তুলনায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যে ঝুঁকি নেন, তা অনেক অনেক বেশি। কার এমন দায় পড়েছে নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তিনি জীবনের ঝুঁকি নেবেন। তারপরও তিনি ঝুঁকি নেন দায়িত্বের জায়গা থেকে, তিনি ঝুঁকি নেন জনসাধারণকে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়ার নেশা থেকে। এই নেশাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া উচিত, দমন করা উচিত নয়। গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ মানে একটি সমাজের মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়া। সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

একবার ভাবুন, একটি দেশের গণমাধ্যমের কণ্ঠ যদি পুরোদমে রোধ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের অবস্থা কী হবে। কেবল ‘বাতাবি লেবুর রেকর্ড ফলনেরই’ গান শুনতে হবে পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়। কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে কেউ থাকবে না কথা বলার।

কাজেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সবার জন্যই জরুরি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে গণমাধ্যমের সেই স্বাধীনতার সুযোগে সে দূর করতে পারে সমাজের পঙ্কিলতা। বিরোধীরা চাইলে সেই স্বাধীনতার সুযোগে সরকারের অন্ধকার দিকগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারবে। এভাবে পুরো সমাজ-রাষ্ট্রে নিশ্চিত হতে পারে জবাবদিহি।

কিন্তু বিশ্বে গণমাধ্যম নিয়ে এমন নীতি খুব কমই দেখা যায়। বরং উল্টো ঘটনাই বেশি ঘটছে। তারপরও গণমাধ্যম তার কাজ করে চলেছে, যাবে। কারণ, গণমাধ্যম হলো ফিনিক্স পাখির মতো। সে আক্রান্ত হবে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে, তারপর সেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে। গণমাধ্যম এমন একটি শিল্প, এমন একটি দায়বদ্ধতা, যা কখনো কোনো দিন কোনো হামলা, হুমকি, ত্রাসের কাছে মাথা নত করবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি: বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
২০ জন সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ইউরোপীয় তদন্ত কর্মকর্তারা। ছবি: সংগৃহীত
২০ জন সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ইউরোপীয় তদন্ত কর্মকর্তারা। ছবি: সংগৃহীত

একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় যুদ্ধের ধারণা আমূল বদলে গেছে। রাষ্ট্রের সীমান্ত, সেনাবাহিনী কিংবা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র আর একমাত্র ক্ষমতার মানদণ্ড নয়; বরং অদৃশ্য, নীরব ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাইবার স্পেস। আজ তথ্যই শক্তি, ডেটাই অস্ত্র এবং নেটওয়ার্কই নতুন ফ্রন্টলাইন। রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা, কূটনীতি, এমনকি নাগরিকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে উঠছে ডিজিটাল অবকাঠামোর ওপর।

সাইবার যুদ্ধ এখন আর কল্পবিজ্ঞান নয়; এটি বাস্তব, চলমান এবং ক্রমাগত বিস্তৃত এক বৈশ্বিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা অচল করা, ব্যাংকিং সিস্টেমে অনুপ্রবেশ, নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, ভুয়া তথ্য ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ—সবকিছুই আজ সাইবার আক্রমণের আওতায় পড়ে। এসব আক্রমণ কোনো যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই, কোনো গুলির শব্দ ছাড়াই একটি রাষ্ট্রকে কার্যত অচল করে দিতে পারে। ফলে সামরিক শক্তির পাশাপাশি সাইবার সক্ষমতা এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এরই সঙ্গে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে নজরদারি প্রযুক্তি। জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে রাষ্ট্রগুলো নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ, যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ডেটা বিশ্লেষণের দিকে ঝুঁকছে। ক্যামেরা, বায়োমেট্রিক ডেটা, মেটাডেটা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবকিছুই নজরদারির আওতায় চলে আসছে। এতে একদিকে সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধ দমনের সম্ভাবনা তৈরি হলেও, অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, গোপনীয়তা ও মানবাধিকারের প্রশ্নও তীব্র হয়ে উঠছে।

এই প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কোন পথে যাচ্ছে—সে প্রশ্ন ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সাইবার অস্ত্র প্রতিযোগিতা, ডিজিটাল সার্বভৌমত্ব, তথ্যনির্ভর আধিপত্য এবং প্রযুক্তিগত অসমতা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি করছে। শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যেখানে প্রযুক্তিকে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, সেখানে উন্নয়নশীল ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলো পড়ছে নতুন ধরনের ঝুঁকির মুখে।

এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির উদ্ভব, রাষ্ট্রীয় কৌশলে এর প্রভাব এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকাঠামোর ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিফলন বিশ্লেষণ করা হবে। একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা হবে—নিরাপত্তার নামে কতটা নজরদারি গ্রহণযোগ্য এবং এই অদৃশ্য যুদ্ধের যুগে মানবিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক নৈতিকতা আদৌ টিকে থাকবে কি না।

আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও অ-রাষ্ট্রীয় সংস্থার কৌশলগত আচরণে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে এই অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে তথ্য, ডেটা এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণই হয়ে উঠেছে প্রভাব বিস্তারের প্রধান হাতিয়ার। রাষ্ট্রের পাশাপাশি বহুজাতিক করপোরেশন, হ্যাকার গোষ্ঠী, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এবং রাষ্ট্র-সমর্থিত সাইবার ইউনিটগুলোও সাইবার স্পেসকে ব্যবহার করছে কৌশলগত সুবিধা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে।

এই প্রেক্ষাপটে সাইবার হামলা, ডিজিটাল স্পাইয়িং, তথ্য চুরি, গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্কে ব্যাঘাত সৃষ্টি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রোপাগান্ডা আধুনিক সংঘাতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। কোনো একটি দেশের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, আর্থিক খাত, সামরিক যোগাযোগ বা নির্বাচনব্যবস্থায় সামান্য ডিজিটাল হস্তক্ষেপও তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই ধরনের আক্রমণ প্রায়ই অজ্ঞাতনামা, সীমান্তহীন এবং যুদ্ধ ঘোষণার বাইরে সংঘটিত হয়, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ও নিরাপত্তাকাঠামোকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

ফলস্বরূপ, সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আজ আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত সক্ষমতা, প্রতিরক্ষা নীতি এবং নিরাপত্তা পরিকল্পনার একটি কেন্দ্রীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলো শুধু আক্রমণ প্রতিরোধেই নয়, বরং আগাম হুমকি শনাক্তকরণ, প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বিশ্লেষণ এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই প্রযুক্তির ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভর করছে। এর পাশাপাশি, সাইবার সক্ষমতা এখন আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব, সামরিক জোট এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

তবে এই বাস্তবতা শুধু প্রযুক্তিগত বা সামরিক সক্ষমতার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বিস্তার জিওপলিটিকসের সামগ্রিক কাঠামো, রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। ক্ষমতার ভারসাম্য, সার্বভৌমত্বের ধারণা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা—সবকিছুই নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এই ডিজিটাল যুগে।

এই প্রেক্ষাপটে আধুনিক সাইবার ক্ষেত্রের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব রাষ্ট্রগুলোর জন্য কৌশলগত সতর্কতা, নীতি সমন্বয় এবং বহুপক্ষীয় নিরাপত্তা অংশীদারত্বের প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই কলামে সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তির বহুমাত্রিক প্রভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।

সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি আধুনিক জিওপলিটিকসের কেন্দ্রে অবস্থান করছে। এটি আর শুধু প্রতিরক্ষা বা আক্রমণের হাতিয়ার নয়; বরং রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত প্রভাব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তা স্থিতিশীলতার মূল নির্ধারণকারী। প্রতিটি ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, তথ্যপ্রবাহ এবং নজরদারি সক্ষমতা আজ রাষ্ট্রকে শক্তিশালী বা দুর্বল করতে পারে—এটি শুধু প্রযুক্তির নয়, ক্ষমতারও খেলা।

এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রগুলোর জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কৌশলগত সতর্কতা, তথ্যভিত্তিক নীতিনির্ধারণ এবং বহুপক্ষীয় অংশীদারত্বের মাধ্যমে বৈশ্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ন্যায্য এবং নিয়ন্ত্রিত সাইবার ক্ষমতার ব্যবহার আজ শুধু প্রতিরক্ষা নয়; এটি রাষ্ট্রের কূটনীতি, শক্তি ভারসাম্য এবং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচে পরিণত হয়েছে।

ফলস্বরূপ আধুনিক জিওপলিটিকসে সাইবার যুদ্ধ এবং নজরদারি প্রযুক্তি শুধু এক হাতিয়ার নয়; এটি রাষ্ট্রগুলোর ভবিষ্যৎ, বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তি রক্ষার এক অদৃশ্য, কিন্তু শক্তিশালী ভিত্তি। প্রযুক্তির অদৃশ্য স্রোতগুলোর মধ্যে আজ রাষ্ট্রের ক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং প্রভাবের মান নির্ধারিত হচ্ছে—এটি আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা, যা দীর্ঘদিন আমাদের স্মৃতিতে এবং নীতিতে টেকসই রেশ রেখে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত