Ajker Patrika

প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা: অদূরদর্শী প্রশাসন

মামুনুর রশীদ
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা: অদূরদর্শী প্রশাসন

বিসিএসসহ সব পরীক্ষা পদ্ধতিতে একটা বড় ধরনের সংকট দেখা দিচ্ছে। ব্যাংক, অডিটসহ সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় লাখ লাখ প্রার্থী অংশগ্রহণ করে থাকেন এবং একটি এমসিকিউর নিয়মে এই পরীক্ষাগুলো হয়ে থাকে। প্রাথমিক যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষাগুলোর একটি সহজ উপায় বের করা হয়েছে। কিন্তু এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গেলে লাগে প্রবল মুখস্থনির্ভর স্মরণশক্তি। দেশে হাজার হাজার কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। এই কোচিং সেন্টারগুলো অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। কোভিডের কারণে ইতিমধ্যে যেহেতু ক্লাস করা সম্ভব হয়নি, তাই অনলাইনে কোচিং মাস্টাররা অনর্গল বক্তৃতা ঝেড়ে থাকেন এবং ছাত্রছাত্রীরা যথাসাধ্য গলাধঃকরণ করে।

শেখার মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হয় এবং এঁদের মধ্যে যাঁরা না বুঝে মুখস্থবিদ্যায় পটু, তাঁরা পাস করে যান। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার—অঙ্কও নাকি মুখস্থ করে নেন। একই কায়দায় পরবর্তীকালে লিখিত পরীক্ষায়ও এঁরা পাস করে যান। শেষ পর্যন্ত মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে এঁদের কেউ কেউ কৃতকার্য হয়ে সরকারি, আধা সরকারি এবং ব্যাংকের পরীক্ষায় পাস করে নিয়োগ পেয়ে যান। এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, বছরের পর বছর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যরা এবং অন্য নিয়োগকর্তারা ভেবে দেখেননি। যে সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষাগুলো হয়ে থাকে, তা-ও খুব অবাস্তব। উচ্চতর গণিত, উচ্চতর ইংরেজি চাকরিজীবনের কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগবে, তা-ও তাঁরা কখনো ভেবে দেখেননি।

পাকিস্তান আমলে এ ধরনের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র বিবেচনা করলে দেখা যাবে, সীমিত ও প্রয়োজনীয় সিলেবাসের মধ্যেই পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন হতো এবং যোগ্য ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়ে প্রশাসনে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতেন। বাংলাদেশেও ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। যার ফলে অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকে পরবর্তীকালে পাওয়া গেছে। এখন সমস্যা হচ্ছে, এই বিশাল সিলেবাস হজম করতে গিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেরই মনোবৈকল্য দেখা দেয়। একটি চাকরির কারণে প্রার্থীরা অমানবিক হয়ে পড়েন এবং এই রকম একটি মানসিকতা নিয়ে পরবর্তীকালে কেউ কেউ চাকরিজীবনে প্রবেশ করেন। সাম্প্রতিককালে দেখা গেছে, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা প্রবল দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন। তাঁদের বিবেকহীন এবং অমানবিক আচরণে প্রশাসন দুর্নাম কুড়াচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মুখস্থবিদ্যায় কোনো শিক্ষা হয় না। শিক্ষার প্রক্রিয়াটিই হচ্ছে বিষয়টিকে বোঝা এবং সেই ক্ষেত্রে যতবার বোঝা না যায় ততবারই চেষ্টা করে যাওয়া। আর অঙ্কের বিষয় তো বুঝতেই হবে। অঙ্কের মূল সূত্র হচ্ছে—যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ। এই চারটি সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে কোনো অঙ্কই মিলবে না। প্রাথমিক শিক্ষায় এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা খুব একটা নজর দেন না। এ থেকেই মুখস্থবিদ্যার সূচনা। এটাও অসম্ভব মনে হয়, অনেক ছাত্রই নাকি অঙ্কে মুখস্থবিদ্যা প্রয়োগ করে এসএসসি পরীক্ষা পাস করে যায়, এমনকি ইংরেজিও।

প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকে প্রচুর পরিমাণে দক্ষ ইংরেজি শিক্ষক নেই। প্রচুর পরিমাণে বলা ভুল হবে। খুবই নগণ্যসংখ্যক শিক্ষক দক্ষ হয়ে ছাত্রদের পড়াতে পারেন। সেখানেও মুখস্থবিদ্যার প্রয়োগ। বাক্যগঠন এবং বানানের সূত্রগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান না থাকলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইংরেজিতে ভুল হওয়া স্বাভাবিক। বাংলা মাতৃভাষা; কিন্তু প্রমিত বাংলায় একটি বাক্যগঠন অত সহজ নয়। বাংলায় দেখা গেছে, কলেজ তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পর্যন্ত সঠিক বাংলা বাক্য রচনা করতে পারেন না। বানানবিভ্রাট থেকে যায় এবং সেই সঙ্গে বাক্যগঠনের এক জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। মুখস্থনির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে তাঁরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। তাঁদের স্মৃতিশক্তির ওপর যে প্রবল চাপ পড়ছে, তাতে কেউ কেউ হয়তো কৃতকার্য হতে পারেন; কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার মধ্য থেকে যে মেধা বাছাই করার বিষয়, তা একেবারেই অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে। আশির দশকের পর থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একটা অংশ অমানবিক, দুর্নীতিপরায়ণ এবং অদক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে কেউ কেউ সাজা ভোগ করছেন আবার কেউ কেউ ভাগ্যগুণে বেঁচে যাচ্ছেন। এ কথা প্রায় সবাই বলে থাকেন, এমনকি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বলে থাকেন, নিয়োগের ত্রুটির এবং শিক্ষাব্যবস্থার কারণে প্রশাসনিক দক্ষতা কমে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত এসব দেখভাল করার জন্য সরকার তার বিবেচনায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনে অত্যন্ত মেধাবী কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। সেই নিয়োগগুলোও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। জানা গেছে, অতীতে এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল।

সেই বিবেচনার কারণে পরীক্ষায়ও দুর্নীতি হয়েছে। দলীয় স্বার্থ বিবেচনায় ভ্রান্তপথে নিয়োগ কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে আছে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। নিয়োগ-বাণিজ্য একটি নির্মম সত্যে পরিণত হয়েছে। কোভিডের কারণে অনেক দিন নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ ছিল। কিন্তু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগ-বাণিজ্যের দালালেরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এমনই সক্রিয় যে, পদ অনুযায়ী ঘুষের পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে যায় এবং ওই টাকা দিলে পরীক্ষায় শুধু অবতীর্ণ হতে হবে; কিন্তু লেখা যাবে না। লেখার কাজটা ওই দালালের লোকজনই করে ফেলবেন। এই দালালেরা খুবই সততার সঙ্গে চাকরিগুলোর ব্যবস্থা করে থাকেন। বছরের পর বছর তাই এসব দালাল তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে চলেছেন। পুলিশ, প্রাথমিক শিক্ষক, ব্যাংক কর্মচারী-কর্মকর্তা, বিভিন্ন অফিস-আদালতে ড্রাইভার, পিয়ন, নিরাপত্তাকর্মীসহ সব জায়গার জন্যই একটা অর্থমূল্য প্রচলিত হয়ে আছে। অনেক প্রার্থী বাড়িঘর, জমিজমা বিক্রি করে, ধারদেনা করে এই অর্থের সংস্থান করে থাকেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা কৃতকার্য হন। তবে এর মধ্যে একটা অংশ যে দুর্ভাগ্যে পতিত হয় না, তা নয়। আদর্শ ব্যাপারীর হাতে নিঃস্ব হয়ে তাঁরা পথে পথে ঘুরতে থাকেন। শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া একটা ঐতিহ্যে দাঁড়িয়ে গেছে।

সরকার এ বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য একটি সাজাও ঘোষণা করেছে। সাজার ঘোষণা এ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নয়। এর চেয়েও গুরুতর ব্যবস্থার কথা ভাবা প্রয়োজন। কারণ, আইনের সঙ্গে সঙ্গে আইনের ফাঁকও থাকে প্রচুর। যাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গর্হিত কাজ করতে পারেন, তাঁদের পক্ষে আইনের ফাঁক বের করা কঠিন কোনো কাজ নয়। 
যাঁরা নিয়োগ-বাণিজ্যের বদৌলতে চাকরি পান, তাঁদের পক্ষে যেকোনো অনৈতিক কাজ করার অধিকার জন্মে যায়। কারণ, অর্থের বিনিময়ে তিনি চাকরিটি পেয়েছেন এবং চাকরিদাতাদের নৈতিকতা সম্পর্কে প্রথমেই তাঁর একটা ধারণা জন্মে যায়। সেই ধারণা তাঁকে উচ্চতর দুর্নীতি করার সাহস জোগায়। এখানে ওই মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ী। জীবনের শুরু থেকে তিনি কোনো প্রকৃত শিক্ষা পাননি। যে শিক্ষক নিয়োগ-বাণিজ্যের ফলে চাকরি পেয়েছেন, সেই অর্থ তাঁকে যেকোনোভাবেই হোক তুলতে হবে। এখানে কোনো নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। বিষয়টি যেকোনো অর্থে রাজনৈতিক। কারণ, ভ্রান্ত রাজনীতিই এসব লোককে যুক্ত করে থাকে। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, সাংসদদের মনোনয়ন নিতে প্রকারভেদে লাখ থেকে কোটি টাকা লাগে শোনা যায় এবং হয়তো সত্য। কোটি কোটি টাকা দিয়ে যেহেতু তাঁকে মনোনয়ন নিতে হয়, ক্ষমতায় বসার পর তিনি যেকোনো অনৈতিক কাজের অধিকার পেয়ে যান। নিয়োগ-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একই। বর্তমান রাজনীতি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কোনো কাজ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। বিষয়টি ঠিক না হলে একটি পঙ্গু প্রশাসনেরই জন্ম হতে থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শান্তি এখন খুব প্রয়োজন

সম্পাদকীয়
শান্তি এখন খুব প্রয়োজন

নৈরাজ্যে লাভ কার? এতে লাভ হয় অন্ধকার শক্তির। যেকোনো ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে তারা ফায়দা লুটতে তৎপর হয়ে ওঠে। নৈরাজ্যকারীরা তখনই নিরস্ত হয়, যখন সরকারের পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্সের বার্তা দেওয়া হয়। যেকোনো নৈরাজ্য ঠেকিয়ে দিয়ে সরকার জানাতে পারে, গণতান্ত্রিক দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কোনো স্থান নেই।

এই বার্তা দেওয়া না হলে দেশ পড়ে যায় বিপদে। এরই মধ্যে বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র। দুটি পত্রিকা অফিস এবং ছায়ানট ও উদীচীতে উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে দলটি। এনসিপিসহ আরও কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে এই নৈরাজ্যের নিন্দা জানানো হয়েছে। মুশকিল হলো, নিন্দা জানালে জনগণ সংকটগুলো বুঝতে পারে বটে, কিন্তু শৈশবে বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে দেওয়া একটি বাক্যের কথা তখন তাদের মনে পড়ে যায়। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মরিয়া গেল’—এই বাক্যের ইংরেজি অনুবাদ করেননি, এমন পড়ুয়া খুব কম আছেন।

এবারও দেখা গেল, শাহবাগ থেকে কিছু মানুষ এসে প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভাঙচুর চালাচ্ছে। সংখ্যায় এরা বেশি নয়, কিন্তু যে রকম মারমুখী, তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মূলত এই আক্রমণ ঠেকানোর দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পত্রিকা অফিস কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর যখন হামলে পড়ল কিছু মানুষ, তখন তাদের থামানোর মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত সদস্য সেখানে মোতায়েন ছিল না। ভাঙচুর শেষে আগুন দেওয়ার পর এসে হাজির হয়। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার পর হাজির হয় ফায়ার সার্ভিস।

রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ভাঙচুরের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, নিন্দা জানানো হয়েছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকা অরাজক বাহিনী যে সুযোগ নিয়েছে, তা বন্ধ করার জন্য সরকার কী কী ব্যবস্থা নেয়, সেটা এখন দেখার বিষয়। যেকোনো বিষয়কে ইস্যু করে যে কেউ অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারাকে স্বাধীনতা বলে না, তাকে বলা হয় অরাজকতা। এই কথা সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বুঝতে হবে। উত্তেজিত জনতা যুক্তি বোঝে না।

তাদের উত্তেজিত করছে কে, সেটাই আসলে খুঁজে বের করা দরকার।

জাতীয় নির্বাচনের কাছাকাছি সময় এসে গেছে। এ সময় নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হলে তা শক্ত হাতে দমন করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারি মহল থেকে যে ধরনের কথা শোনা যায়, তাতে মনে হয়, যেকোনো মূল্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে সরকার। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই এখন সবার চাওয়া। সে রকম পরিবেশ তৈরির করার জন্য নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে সরকারকে। যারা ঝোপ বুঝে কোপ মারে, তাদের ব্যাপারে সতর্ক না হলে বিপদ বাড়তেই থাকবে।

দেশে বহুমত, বাক্‌স্বাধীনতা, সংস্কৃতির প্রবহমানতার ওপর আঘাত এলে তা রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। দেশের মানুষের শান্তি এখন খুব প্রয়োজন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শান্ত হোন

সম্পাদকীয়
শান্ত হোন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। ইতিহাস বলে, উত্তেজনার মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। এ ধরনের নৃশংস ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন নাগরিকের প্রাণহানি মানেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত। এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য।

তবে এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের পাশাপাশি যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে দুটি গণমাধ্যম ও একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান—যা-ই থাকুক না কেন, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজের শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার পরিসরকে আঘাত করা। এসব কর্মকাণ্ড কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। কেন তাঁকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করা হলো, তা বোধগম্য নয়।

এই পরিস্থিতিতে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাই ছাড়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। এই সময়ে দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় হলো—সংযত ভাষা ব্যবহার করা, তথ্য যাচাই করা এবং উসকানিমূলক পোস্ট বা মন্তব্য থেকে বিরত থাকা।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জন করাও জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে—উসকানি নয়, সংলাপ ও সহনশীলতার পথ বেছে নিতে হবে।

দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। এ সময় প্রতিটি দলকেই ধৈর্য ধরতে হবে। শান্ত থাকতে হবে। শান্ত রাখতে হবে দলের কর্মীদের। নেতারা যদি এ সময় দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে দেশের পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহু কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে প্রতিটি রাজনৈতিক দল যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অরাজকতার মোকাবিলা করতে পারে, তাহলেই কেবল সামনে আশার আলো দেখা যাবে। বিশেষ করে তরুণসমাজকে মনে রাখতে হবে—দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই পথেই দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয়। বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শঙ্কা যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না

অরুণ কর্মকার
শঙ্কা যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে গণভোটের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ততই যেন জটিলতর হয়ে উঠছে। সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড চলেছে অব্যাহতভাবে। ফলে জনমনে প্রতিদিনই নতুন নতুন শঙ্কা, সংশয় দানা বাঁধছে। এই শঙ্কা ও সংশয় শুধু শহর-নগরবাসী মানুষের মধ্যে নয়, গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যেও সমানভাবে বিরাজ করছে। গত সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কয়েকটি জেলা-উপজেলা শহর ও বেশ কিছু গ্রামাঞ্চলে গিয়েছি। পরিচিত-অপরিচিত অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে কোনো মানুষ স্বস্তিতে নেই।

মফস্বল শহর এবং গ্রামগঞ্জের মানুষের এই অস্বস্তি যে কেবল রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে, তা নয়। আয়-উপার্জনে গভীর মন্দা থেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তার বিষয়ও এই অস্বস্তির কারণ। শত্রুতা করে মামলায় ফাঁসানো, ব্যক্তিগত শত্রুতাকে রাজনৈতিক রং দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া—এগুলো বন্ধ হয়নি। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে আছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তার মধ্যে আছে নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা, যা আমাদের দেশের যেকোনো নির্বাচনকালীন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে। এবারও পরিস্থিতি অন্য রকম হওয়ার কোনো লক্ষণ সাধারণ মানুষ দেখছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অতীতকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার মানুষকে অব্যাহতভাবে আশ্বস্ত করে যাচ্ছে।

ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান নগরকেন্দ্রিক এবং রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকেন্দ্রিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেও ভিন্ন কোনো চিত্র দেখা যায় না। সম্প্রতি জাতীয় পার্টি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে আগামী নির্বাচনটি একটি ‘পাতানো’ নির্বাচন হতে পারে। দলটির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারি অনেক রকম আশঙ্কার কথা বলেছেন। যেমন ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে। ভোটের নির্ধারিত সময়ের পরে ভোট হতে পারে। মিডিয়া ভোট হতে পারে। কোনো আশঙ্কাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ যদিও তাঁরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন দলের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন বলেও বলে রেখেছেন। এর চেয়েও ভয়ানক এবং স্পর্শকাতর যে বিষয়টি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন তা হলো, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, গ্রহণযোগ্য না হয়, ক্রেডিবল না হয়, রিফ্লেকটিভ না হয় তাহলে ভবিষ্যতে দেশে গৃহযুদ্ধ হতে পারে।

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির এসব বক্তব্য হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনায় বিবেচিত হবে। কারণ, তাদের ওপর স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ লাগানো রয়েছে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের একেবারে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে যাদের অবস্থান, তারাও তো স্বস্তিতে নেই! তাদের মধ্যেও তো কেউ কেউ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যেমন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে দলের প্রার্থী ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ গত বুধবার নির্বাচন কমিশনে উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ করে বলেছেন, পুলিশ তাঁকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে না।

আরেকজন, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী রেহা কবির সিগমাও নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন ওই বুধবারই। তিনি নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলেছেন, ‘আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পক্ষপাতমুক্ত, সুষ্ঠু ও সবার জন্য নির্বিঘ্ন করা অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়। কিন্তু এসব প্রশ্নবিদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে অবিলম্বে জড়িত ও দায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার আবেদন করছি।’ পরে সাংবাদিকদের রেহা কবির বলেন, ‘পুলিশ ভীতি সৃষ্টি করছে। আমার কর্মী ও আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই ইসি ও প্রশাসনের কাছে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছি।’

দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচন কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর হামলা, হত্যাকাণ্ড চলছে। নির্বাচনের আগে আগে এসব ঘটনা জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সরকার অবশ্য এসব ঘটনার জন্য কার্যক্রম নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছে। কিন্তু তাদের এসব কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার কার্যকর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে বলে মনে হয় না। যদি তা-ই হয় এবং আওয়ামী লীগ এ রকম কর্মকাণ্ড চালাতেই থাকে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে হয়তো স্বাভাবিক—সে ক্ষেত্রে সরকার নির্বাচনটা কীভাবে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, সেই প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আরেকটি বিষয় বোধ হয় সরকারের ভেবে দেখা দরকার। তা হলো কোনো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী পর্দার অন্তরালে থেকে সরকারের নাকের ডগায় বসে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কোনো অপচেষ্টা চালাচ্ছে কি না। ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর এই প্রশ্নটি আরও গভীরভাবে সামনে এসেছে। কোনো পেশাদার শুটার কাউকে হত্যা করার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে সেই ব্যক্তির আশপাশে থেকে নিজের চেহারা দেখাবে কি না, প্রশ্ন সেটি। অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এমনটা সাধারণত হয় না। কারণ সে ক্ষেত্রে শুটার নিজেই নিজেকে চিহ্নিত করার কাজটি সহজ করে দেয়। কিন্তু ওসমান হাদির ক্ষেত্রে সেই ঘটনাটাই ঘটেছে।

তা ছাড়া, ওসমান হাদির ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর (অবশ্য তার আগেও বেশ কয়েকবার) দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য ভারতের জন্য স্পর্শকাতরতা সৃষ্টি করেছে। ফলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সৃষ্ট তীব্র টানাপোড়েন আমরা কয়েক দিন ধরে দেখেছি। নির্বাচনপূর্ব সময়ে দুই দেশের মধ্যে আন্তসীমান্ত উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে, কূটনৈতিক টানাপোড়েন বৃদ্ধি পেলে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে জনমনের অস্বস্তি বাড়াবে কি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়। কেননা, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান।

অবশ্য যেকোনো অজুহাতে নির্বাচন বিঘ্নিত করার কোনো প্রয়াস যে নেই, তা-ও মানুষ বিশ্বাস করে না। কারণ, মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করার মতো নানা কর্মকাণ্ডও দেখতে পাচ্ছে। তবে সবার জানা এবং বোঝা দরকার যে আগামী নির্বাচন বিঘ্নিত হলে দেশ অনেক বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই সংযত আচরণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমাদের বড় কোনো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই পরিস্থিতি বোধ হয় আমাদের কারও জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। দেশের জন্য তো নয়ই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদি হত্যা এবং আগামী নির্বাচন

এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫১
ওসমান হাদি। ছবি: সংগৃহীত
ওসমান হাদি। ছবি: সংগৃহীত

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে। বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকেই তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হলেও তিনি তাতে ভীত হননি। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘ভয় পেয়ে ৫০ বছর বেঁচে থেকে লাভ নেই, যদি এই বেঁচে থাকা সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে না পারে।’

অবশেষে ওসমান হাদি সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা গেছেন। হাদিকে এভাবে হত্যা করে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র দেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য একটি রেড অ্যালার্ট। তবে রাষ্ট্র ও সরকার জুলাই যোদ্ধা ও অকুতোভয় কণ্ঠস্বরগুলোকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে দেশটা গভীর সংকটে নিপতিত হতে বাধ্য।

বহু জল্পনা-কল্পনা-আলোচনার পর দেশ যখন নির্বাচনমুখী ট্রেনে, ঠিক তখন নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীকে আততায়ীরা নিশানা করল কেন? যার ফলে উত্তপ্ত পুরো দেশ। প্রশ্নের মুখে পড়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সন্দেহ নেই, উদ্ভূত পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে এটি আসন্ন নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচন ইস্যুতে বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতি জটিল করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে হাদির ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আরও শক্তিশালীরূপে ফিরে এসেছে জুলাই আন্দোলনের পর লুণ্ঠিত অস্ত্রের বিষয়টি। সে সময়ে এই অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা গেলে এখনকার উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি নাও হতে পারত বলে অনেকের ধারণা।

এখন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর অনেকের মনে প্রশ্ন তুলেছে, নির্বাচন কি আদৌ হবে? নাকি নির্বাচন বানচালের অপতৎপরতা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে?

এ ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রার্থীদের আতঙ্কিত করে তুলছে। এই আতঙ্কের কারণেই বিজয় দিবসের দিন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী নিজেকে নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। ভয়ের ছায়া তাঁদের গ্রাস করছে। এরই মধ্যে হাদির ওপর আততায়ীর হামলার ঘটনা জনপ্রতিনিধি তো বটেই; জনমনেও একধরনের শঙ্কা তৈরি করেছে, যা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তরায়। ফলে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে এ পরিস্থিতির উন্নতি একমাত্র পথ।

শুধুই কি নির্বাচন বানচাল করা, নাকি এর পেছনে আরও বড় কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? নির্বাচন বানচাল হলে কার লাভ আর কার ক্ষতি? নির্বাচন বানচাল হলে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেলে যাদের লাভ, হাদির ওপর হামলায় তাদের কোনো ইন্ধন রয়েছে কি না বা রাজনৈতিক বিভক্তির সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ এই ঘটনা ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে কি না? বা দেশি-বিদেশি কোনো শক্তি চরম অস্থিরতা তৈরি করে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়?

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা বিরাজ করছে, তার সমাধান কী? কোনো কোনো মহল ভাবছে নির্বাচন ঘিরে দেশে সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতার আশঙ্কাও আছে। তবে সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে পুলিশের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রাজধানীতে ৩৫২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। শুধু রাজধানীতেই নয়, ঢাকা বিভাগেও গড় হিসাব করলে গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি খুন হয়েছে। এই খুনের হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপের অভাব।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচনটি বানচাল হয়ে গেলে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেলে দেশ এখন যে সংকটে আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সংকট ঘনীভূত হবে। সুতরাং রাজনৈতিক আদর্শ, দর্শন ও কর্মসূচি ভিন্ন হলেও এই মুহূর্তে ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বারবার জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, সেই ঐক্যে যে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে, তা নানা ঘটনায় স্পষ্ট। কিন্তু এখন অন্তত হাদির এই ঘটনার পরে সেই ফাটল দূর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যাশা, যথাযথ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অচিরেই উন্নতি ঘটবে। দূর হবে আস্থার সংকট। দেশ এগিয়ে যাবে একটি সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচনের দিকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত