Ajker Patrika

ভবিষ্যতের কী হবে

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব 
বিভিন্ন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ উদ্বেগজনক। ছবি: আজকের পত্রিকা
বিভিন্ন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ উদ্বেগজনক। ছবি: আজকের পত্রিকা

বেশ কিছুদিন যাবৎ বিভিন্ন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ রীতিমতো উদ্বেগজনক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। অনেক জায়গায়ই মাঝে মাঝে সংঘর্ষ হচ্ছে, সেসব টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি, খবরের কাগজে পড়েছি এবং নানা প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু ৯ ফেব্রুয়ারি আমি নিজেই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বেশ শঙ্কিত হয়েছি। ধানমন্ডি ২ নম্বর রোড ধরে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে যাচ্ছিলাম, সিটি কলেজের একটু আগে থেকেই উত্তেজিত ছাত্রদের মারমুখী চেহারা দেখলাম। ওই এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও মেডিকেল কলেজের অবস্থান। নানা রকম রোগী, তাদের আত্মীয়স্বজন, অ্যাম্বুলেন্স—এসবের যাতায়াতে সর্বক্ষণই এলাকাটি কর্মব্যস্ততায় নিপতিত। সেখানে হঠাৎ করেই সব যানবাহন আটকে গেল।

আমাদের সামনে কিছু পুলিশের লোক, তাঁরা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না! দুই পক্ষের মধ্যে বহুল প্রচলিত পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছে। অসহায় পুলিশ বলছে, ‘কিছু করার নেই, আপনারা গাড়ি ঘোরান।’ একমুখী পথে গাড়ি ঘোরানোর কোনো উপায় নেই। হতবিহ্বল গাড়ির চালক গাড়ি ঘোরাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু রিকশার জটের মধ্যে গাড়ি ঘোরানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। এর মধ্যে শুরু হলো দুই পক্ষের ইটের টুকরা ছোড়াছুড়ি। যাই হোক, আমার গাড়িচালকের কৃতিত্বে এবং উপস্থিত জনগণ ও পুলিশের সাহায্যে গাড়ি ঘোরানো সম্ভব হলো।

তারপর ১০ মিনিটের গন্তব্যে পৌঁছাতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লেগে গেল। সৌভাগ্য এইটুকু যে, গাড়ি ও আমরা যাত্রীরা অক্ষত থাকলাম। তবে হৃদয় অক্ষত থাকল না। উৎকণ্ঠা বাড়ল। কারণ, দুই বিবদমান পক্ষেই আমাদের সন্তানেরা রয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ আহত হলো কি না, তার জন্য একটা দুশ্চিন্তা রয়েই গেল। মাত্র ছয় মাস আগে এই কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে মিলে তুমুল আন্দোলন করেছে। একসঙ্গে আন্দোলন করলে একটা ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে এবং সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ষাটের দশকে এমনই আন্দোলনগুলোতে আমরা ছিলাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও ছিলাম। পরবর্তীকালে আশির দশকে দীর্ঘ সময় আন্দোলনের মাঠে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। এক কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে আরেক কলেজের ছাত্রদের এই ধরনের সহিংস বিবাদ দেখিনি। আর কারণগুলোও এত বড় বিবাদের মতো ঘটনা ঘটার মতো নয়।

কলেজগুলোর ব্যবস্থাপনা বহু বছর ধরেই ভেঙে পড়েছে। ছাত্ররা শিক্ষকদের কথা প্রায়ই মানে না। মনে পড়ে, একবার বাসে করে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলাম, টাঙ্গাইলের পথেই ঐতিহ্যবাহী জামুরকী হাইস্কুল। এই হাইস্কুলের ছাত্ররা একদা খুবই মেধাবী ছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় তারা শীর্ষস্থানে থাকত। শিক্ষকেরাও ছিলেন সর্বজনমান্য। সেইখানে ছাত্ররা অবরোধ করেছে, দুই দিকেই কয়েক মাইলের গাড়ির স্থিত অবস্থা। আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম এবং সেখানে উদ্বিগ্ন ছাত্রদের সামনে গিয়ে বললাম, স্কুলের শিক্ষকদের ডাকা হোক। তখন স্থানীয় একজন এসে বললেন, শুধু একজন শিক্ষক আছেন, যাঁর কথা সবাই শোনে। আমি অনুরোধ করলাম, তাঁকে একটু অনুগ্রহ করে আসতে বলেন। তিনি এলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম ঘটনা কী ঘটেছে। তখন জানা গেল একজন ছাত্র হাফ টিকিটের ভাড়া দিয়েছিল বলে তাকে বাসের কন্ডাক্টর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। ছাত্রটি কাছেই ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ওই কন্ডাক্টরকে চিনতে পারবে? সে জানাল পারবে। কিন্তু সেই কন্ডাক্টর ও ড্রাইভার পালিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে টাঙ্গাইল থেকে পরিবহন মালিকদের নেতারাও এসে গেছেন। কিন্তু তাঁরা ভয়ে সামনে আসছেন না। তখন ছাত্রদের বললাম, তোমরা টাঙ্গাইল চলো। যে গাড়ির কন্ডাক্টর এই ঘটনা ঘটিয়েছে তার মালিক এবং ড্রাইভারসহ ক্ষমা চাইবে, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার হলে দেবে। শিক্ষক বললেন, ড্রাইভার-কন্ডাক্টর নিশ্চয়ই আশপাশে আছেন, তাঁদের ডাকা হোক, সর্বসমক্ষে তাঁদের ক্ষমা চাইতে হবে। ওই শিক্ষক আর আমি পরিবহন নেতাদের অভয় দিলাম আসার জন্য। দু-একজন করে পরিবহন নেতারা সামনে এলেন এবং ছাত্রদের বললাম, তোমরা আর কী চাও? ওরা তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবে, ক্ষতিপূরণ দেবে। ছাত্ররা চুপ করে রইল। এরপর পরিবহন নেতাদের বললাম, ওই ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরকে হাজির করুন। কেউ তাঁদের কিছু করবে না। ওরা এল। ওদের বললাম, সবার কাছে ক্ষমা চাও। ততক্ষণে ছাত্রদের সামনে যাত্রীদের দুর্ভোগের চিত্রটি বারবার তুলে ধরছিলাম। ওই শিক্ষকও আমার প্রতিটি কথায় সায় দিচ্ছিলেন। ছাত্ররা আর কিছু চাইল না। ক্ষতিপূরণও নিল না, রাস্তাটি ছেড়ে দিল। একটা বিশাল ভোগান্তির অবসান করা গেল।

এখন সমস্যা হচ্ছে, ওই ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম আর ছাত্ররা নানা কারণেই শিক্ষকদের মধ্যস্থতা মানছে না। কারণ, শিক্ষকেরাও দলীয় রাজনীতির মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেলেছেন। সর্বোপরি আছে পড়ালেখার চাপ। সেই সঙ্গে কোচিং-বাণিজ্য। কিন্তু ভয়াবহতা হচ্ছে লাখ লাখ ছাত্র, সহস্রাধিক স্কুল-কলেজ, শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কার নির্দেশনায় উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখবে? সদ্য একটি আন্দোলন থেকে ছাত্ররা স্কুল-কলেজে ফিরেছে, সমাজে তাদের একটি শ্রদ্ধার জায়গায় থাকার কথা। কিন্তু যদি এখনই আবার নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মানুষের সহানুভূতি থেকে ক্রমেই তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

৯ তারিখ যখন আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আসছিলাম, জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছিল, তখন নানা শ্রেণির নানান লোকেরা বিভিন্ন মন্তব্য করছিলেন। এইসব মন্তব্য মোটেই ছাত্রদের জন্য স্বস্তিকর নয়। এমনিতেই স্কুল-কলেজে পড়ালেখার পরিবেশ অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সাতটি কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে এখনো মীমাংসা হয়নি। স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টাকে নানা ধরনের উদ্বেগজনক মন্তব্য করতে শুনেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী নই, ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার পক্ষেও নই। কারণ, ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সব আন্দোলনের মূলে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু কালে কালে ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের ক্যাডার কিংবা বাহক হিসেবে কাজ করেছে, শিক্ষকদের দলাদলিতেও তারা অংশ নিয়েছে। অনেক ছাত্রনেতার মুখে শিক্ষকদের প্রতি অশ্রদ্ধাপূর্ণ বক্তব্যও শুনেছি। সবটা মিলিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা অশনিসংকেত দেখা যাচ্ছে।

উচ্চবিত্তরা বর্তমানে নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য এ দেশটাকে অনুপযোগী ভাবছেন। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এই মুহূর্তে বিদেশে পড়ালেখার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করছে। অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে সম্মতি আছে। তাঁরা পারলে এক্ষুনি তাঁদের সন্তানদের নিয়ে এই দেশ ত্যাগ করবেন। ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা অন্যায় নয়। কিন্তু জাতির শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণে দেশত্যাগ করা একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এ কথাও সত্যি, দেশে যে বিপুল পরিমাণ কাজের সৃষ্টি হচ্ছে, সেটাও নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস করা ছাত্রদের বেকারত্ব বর্তমানে একটা চরম আকার ধারণ করেছে। এই বেকারত্ব চরম হতাশার জন্ম দেয়। হতাশার ফলাফল কখনো নতুন পথের সন্ধান দেয় না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবন সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হওয়াও স্বাভাবিক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অনেক কলেজে মাস্টার্স ডিগ্রির সুযোগ আছে। সেখানে শিক্ষার ব্যবস্থাটা কতটা মানসম্মত, সেটাও ভেবে দেখার অবকাশ আছে।

বর্তমানে কোনো কোনো কলেজে ছাত্রসংখ্যা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার। শিক্ষকের সংখ্যা সব জায়গাতেই অপ্রতুল। অনেক ছাত্রই ক্লাস না করে শুধু পরীক্ষা দেয়। এই ছাত্ররা স্বভাবতই শ্রেণিকক্ষের শৃঙ্খলা ও সংস্কৃতির বাইরে। কিন্তু তারা সার্টিফিকেটের মূল্যের দিক থেকে সমান। নিয়ম করা হয়েছিল জনপ্রতিনিধিরা কলেজের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকবেন। দেখা গেছে, এই জনপ্রতিনিধিরা নিজস্ব স্বার্থেই ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। শিক্ষার মান উন্নয়ন, শৃঙ্খলা এবং শিক্ষকদের তদারকির কাজ তাঁরা সামান্যই করতে পেরেছেন। ফলে শিক্ষার কোনো উপকার হয়নি। বরং দলীয় রাজনীতির প্রসার ঘটেছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখে থাকে, শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দিয়ে থাকে এবং তারা ভেবেই নিয়েছেন জাতির সব ধরনের উন্নতির জন্য শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদের শৃঙ্খলা এবং জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি তাদের আনুগত্য এবং আগ্রহ এ বিষয়টিকে একটা বড় ধরনের নজরদারির মধ্যে রাখা উচিত। আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই এসব ক্ষেত্রে অবহেলা, অযত্ন, উদাসীনতা এবং একধরনের দায়িত্বহীন আচরণ ছাত্রদের মধ্যে আদর্শবোধ তৈরির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

এতসব কথার অবতারণা করলাম একটিই কারণে—ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, রাজনীতিবিদ—সবার মধ্যে একটা শুভবুদ্ধির উদয় হউক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ মার্কিন ফেডারেল সংস্থার

চীনের আগে ভারত সফরে যেতে চেয়েছিলেন ড. ইউনূস: দ্য হিন্দুকে প্রেস সচিব

কালো টাকা সাদা করেছেন সাবেক প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ

ভারত নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রিকশাচালকের সঙ্গে তর্ক, বাংলাদেশিকে ফেরত

চেয়ার দখল করে চাকরি হারালেন বিএমডিএ প্রকৌশলী

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত