Ajker Patrika

সেতুর ভূগোল, সেতুর মনোভূমি

সৌমিত জয়দ্বীপ
আপডেট : ৩০ জুন ২০২২, ১৭: ১২
সেতুর ভূগোল, সেতুর মনোভূমি

পদ্মা, প্রমত্তা পদ্মা! তার ওপরে সেতু। একটা বিশ্বকাপ জয়ের চেয়েও এ অর্জন মহীয়ান! জাতীয়তাবাদী যে মন জাদুটোনার মিথ ও ট্যাবুতে অভ্যস্ত, তার জন্য প্রকৃত ও বাস্তবিক জাতীয়তাবাদী হওয়ার এটাই উৎকৃষ্ট সময়!

কিন্তু জাতীয়তাবাদী হওয়ার প্রকৃত সংকট হলো বয়ানের অতিরঞ্জন। এবং সেই অসততারই জয় হয় জাতীয়তাবাদী চেতনার গা-জোরিতে। জাতীয়তাবাদের ক্ষমতা না হলেও চলে, সংখ্যা আর অনুভূতিই তার ক্ষমতা। উদাহরণ খুঁজে পাবেন ভূরিভূরি। 
২.
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আরও একবার হাতে নিন। দেখবেন লেখা আছে, দেশভাগের আগে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসেছিলেন মাত্র দু-একবার (পৃ.৮৩)। ১৯৪৭ সালের আগে তাঁর পুরোটা রাজনৈতিক অর্জনের কোলজুড়ে আছে কলকাতা।

অবিভক্ত বঙ্গ তথা ভারতের সবচেয়ে বড় বাঙালি জননায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঢাকায় এসেছিলেন পাঁচবার, ১৯২৪ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে। প্রতিবারই নানাভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৫ বছরে মাত্র পাঁচবার আসতে পেরেছিলেন বাংলার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহরে, এ সংখ্যাটা কমই বৈকি! 
সুভাষ ও মুজিব—উভয়েই দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। কলকাতা ছিল তাঁদের রাজনীতির প্রাণভ্রমর। ফলে, ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের হাইনেটওয়ার্ক তখন খুব অত্যাবশ্যক ছিল না। সেই দাবিও সামনে হাজির ছিল না।

কলকাতার অবস্থানটাও ভৌগোলিকভাবে চমকপ্রদ। একদিকে সে গঙ্গার তীরে (হুগলি নদী) জন্মেছে। আরেক দিকে এই গঙ্গাই যখন পদ্মা হয়েছে পূর্ববঙ্গে ঢুকে, তখন দেখা যাচ্ছে কলকাতা আসলে দক্ষিণবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ‘রিভারলক’ হওয়ার কারণে। তখনকার বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা থেকে শুরু করে বরিশাল-খুলনা-যশোর হয়ে কলকাতা ছিল দক্ষিণবঙ্গের মানুষের ‘হরিহর’ মহানগর।

এই যে ফরিদপুরের মানুষ তখন এত কাছে থাকার পরও ঢাকামুখী না হয়ে কলকাতামুখী হয়েছিলেন, তার বড় কারণ ছিল প্রমত্তা পদ্মা। দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের প্রধান অন্তরায় ছিল এই পদ্মা, বহু বহু বছর। তার মানে একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার কোনো সড়ক বা রেল যোগাযোগ ছিল না। এটা প্রণিধানযোগ্য বিষয়। 
ফাইল ছবি৩. 
অন্যদিকে সমগ্র ভারতবর্ষের সাপেক্ষে কলকাতার দশাও ছিল ঢাকারই মতো। গঙ্গা কলকাতার বুকে নাম নিয়েছে হুগলি। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে কলকাতা, পশ্চিম তীরে কলকাতার টুইন সিস্টার হাওড়া। এই হাওড়ার সঙ্গে সমগ্র ভারতবর্ষের রেল-সংযোগ সেই ১৮৫৪ সাল থেকে। হাওড়া রেলওয়ে জংশন ভারতবর্ষের একটা ‘মিথিক্যাল সুপারপাওয়ার’-এর মতো। সবচেয়ে প্রাচীন, সবচেয়ে ব্যস্ত ও সবচেয়ে বড়।

কলকাতার গোড়াপত্তন যেহেতু বহু আগেই হয়ে গিয়েছিল কুঠিসাহেব জব চার্নকের হাত ধরে, সেহেতু কলকাতাকে সড়কপথে সংযুক্ত করার নির্বিবাদ প্রয়োজন ছিল। হুগলির পশ্চিম তীরে হাওড়ার উত্থানের মূলে ছিল সমগ্র উত্তর ও পশ্চিম ভারতবর্ষকে মহানগর কলকাতার সন্নিকটে পৌঁছে দেওয়া। হাওড়া এ চাহিদা আজও মেটাচ্ছে। এই সড়ক-সংযোগের জরুরতের কারণে, বহু বিলম্বে হলেও, কলকাতাকে সড়কপথে ভারতবর্ষের সিংহভাগ ভূমির সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ১৯৪২ সালে ব্রিটিশরা গড়ে তুলেছিল আরেক আশ্চর্য স্থাপনা ‘হাওড়া ব্রিজ’ (রবীন্দ্র সেতু)। 
৪. 
যেকোনো সেতুর এই ভূমি-যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে সেই কাজটি করল। জাতীয়তাবাদী ও রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজির কচকচানির বাইরে পদ্মা সেতুর এই ভূমিকাটিই তার প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতাশক্তিকে বাড়াবে। 
কতটা বদলে দেবে মানুষের জীবনযাপন এ সেতু? নানা ধরনের গবেষণা ও গবেষণা-ফল বাজারে হাজির আছে। সেসব ডেটার সত্যাসত্য নিশ্চয়ই একদিন যাচাই হবে। কিন্তু এ কথা সত্য যে, প্রমত্তা পদ্মার জলে ভেসে যে মানুষ নানা চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে গমনাগমন করেছে, তার কাছে এই পথ-সংযোগ একটা আবেগেরই আস্ফালন। 
দক্ষিণবঙ্গের চেহারা বদলাবে কি না, বদলালে কতটা—সেটা অনুমানসাপেক্ষ। কিন্তু ঢাকা হয়ে প্রকারান্তরে সমগ্র দেশের সঙ্গে এই যোগাযোগ মানুষের যাতায়াতের সময়কে যে কমিয়ে আনবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হবে—তা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট না হলেও চলে। 
৫. 
অন্যদিকে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে নৌপথের যে বিকাশ ও উন্নয়ন প্রয়োজন, সেদিকেও আরও মনোযোগ দেওয়ার যে দাবি এই মুহূর্তে উঠেছে, সেটাও অযৌক্তিক নয়। বরং বাস্তবসম্মত। খোদ ঢাকার চারপাশেই যে পরিমাণ জলপথ আছে, সেগুলোকে কার্যকর করা প্রয়োজন। কলকাতা-হাওড়ার বুকে চিরে চলা স্বচ্ছতোয়া হুগলি নদীর ওপর যে পরিমাণ লঞ্চ ও জাহাজ দেখেছি শুধু বাণিজ্যের খাতিরেই, মনে পড়ে না, অধিকতর প্রমত্তা হওয়ার পরও পদ্মা কিংবা ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপর তা দেখেছি। বরং, ঢাকার চারপাশের নদীনালা দেখি দখলদারদের হাতে খাবি খাচ্ছে। রাজনীতির প্রশ্রয় না থাকলে এসব করা সম্ভব? অথচ, আজও পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম জলপথ। 
আবার, মেট্রোরেলের আগমন যে ঢাকার যানজট কমাতে পারবে না, সেটাও বিশেষজ্ঞরা বলে দিয়েছেন। সঙ্গে আরেকটি সত্য উপেক্ষা করার জো নেই, পদ্মা সেতুর কারণে এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে যানজটের নগর ঢাকা। পদ্মাযোগ এখন ঢাকার চাপ আরও বাড়াল। বিপুল পরিমাণ মানুষ ও যানবাহন ঢাকা শহরে ঢুকবে। সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সময়ের কাছে সেই দাবি তোলা থাকল।

সৌমিত জয়দ্বীপযদিও নতুন বিভাগ হয়ে যাওয়ায় ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষকে প্রশাসনিক কাজে আগামীতে আর ঢাকায় আসতে হবে না, সেটা একটা বাস্তবতা। আসল কথা হলো, রাজধানী হিসেবে ঢাকার প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় ঢাকার ওপর অনন্ত যে চাপ, তা বেড়েই চলেছে। ঢাকার কোনো বিকল্প যে আমরা এত বছরেও গড়ে তুলতে পারিনি, এ সত্য কে এড়িয়ে যাবে? জনঘনত্বের কারণে বাংলাদেশে প্রাদেশিক শাসন জরুরি ছিল, এ সত্যও কি এড়ানো যাবে?
তাই বলে পদ্মা সেতুর এই আগমন বুমেরাং হয়ে যেতে পারে না। পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে আনন্দের ও উৎসবের বিষয়। এই আনন্দ-উৎসব যে শুধু একটা ২৫ জুনেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, তা নয়। এ এক চির-আনন্দের বিষয়। দক্ষিণবঙ্গের জন্য তো বটেই, সমগ্র বাংলাদেশের জন্যও।
এমনকি দেখতে পাচ্ছি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পদ্মা সেতু নিয়ে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা ব্যাপক। বলেছি, এক সময় ‘হাওড়া ব্রিজ’ নদীবেষ্টিত কলকাতাকে যুক্ত করেছিল সমগ্র ভারতের সঙ্গে। মাঝে পদ্মা থাকায় শুধু বাদ পড়ে গিয়েছিল জলমাতৃক পূর্ববঙ্গের প্রধানতম মধ্যাঞ্চল, ঢাকা যার হৃদয়। এমনকি আগে যমুনা নদীর বিশালত্বের পরেও, রাজশাহী ও দিনাজপুর হয়ে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল উত্তরবঙ্গের। ‘চিকেন নেক’ শিলিগুড়ি হয়েও সে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে কয়েক বছর হলো। এবার পদ্মা সেতু ঢাকার মাধ্যমে সমগ্র বাংলাদেশকে যুক্ত করল, যুক্ত করল পশ্চিমবঙ্গকেও। বাণিজ্যিক লাভালাভ তো আছেই। কিন্তু যে ঢাকা-কলকাতার এক সময়ের দূরত্ব ও যোগাযোগ কল্পনাতীত ছিল, বাংলার দুই প্রধান মহানগরের দূরত্ব মাত্র ৬.১৫ কিলোমিটারের একটি সেতু এক লহমায় ১৫০  কিলোমিটার কমিয়ে দিল। ‘ভিনদেশি’ পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এ আনন্দবোধ ও ভালোবাসাকে সম্মান করতেই হবে। 
ফাইল ছবি৬. 
আজ থেকে ২৪ বছর আগে, যমুনা সেতুর উদ্বোধনের দিন একই রকম আনন্দঘন উৎসবে মাতোয়ারা হয়েছিল উত্তরবঙ্গের মানুষ। স্পষ্ট মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা। আমাদের বাড়িও হয়ে উঠেছিল উৎসবের বাড়ি! পুরো এলাকাও। উত্তরবঙ্গ এমনিতেই পিছিয়ে থাকা জনপদ। যমুনা সেতু অনেকটাই যে এগিয়ে দিয়েছে, তা সন্দেহাতীত। কিন্তু আরও অনেক কিছু হতে পারত, আঞ্চলিক রাজনীতির ফাঁদে পড়ে তা হয়নি। উত্তরবঙ্গের রাস্তাঘাট কিছু অংশ বাদ দিলে চমৎকার। কিন্তু যে পরিমাণ যানবাহন বেড়েছে, তাতে রাস্তা ওয়ান-ওয়ে হওয়া উচিত ছিল। হয়নি। কত লেনের রাস্তা, সে আলাপ তো দূরস্ত! ফলে, রাস্তার ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছেই। ওয়ান-ওয়ের কাজ কবে শেষ হবে, কত দিন ভোগান্তি থাকবে, তা আমরা জানি না।

আবার যমুনা সেতুর কারণে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গের সব জেলায় ব্রডগ্রেজ লাইনে ট্রেন চালু হয়েছে নানা দেনদরবারের পর, এই গত চার-পাঁচ বছরের মধ্যে। যমুনা সেতু হওয়ার ২০ বছর পরে। ভাবা যায়!

ফলে, উন্নয়ন মানেই যে উন্নয়নের ফল ভোগ করা—ব্যাপারটা এমন সোজাসাপ্টা না-ও হতে পারে। সময় বদলেছে। উন্নয়নের গতিও অন্যরকম। জটিল নির্মাণপ্রকল্পের সংকল্প হিসেবে পদ্মা সেতু আমাদের উন্নয়নের স্মারক, এ সত্যকে আমরা কখনোই শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার খাতিরে এড়িয়ে যেতে পারি না। যে মানুষটি বিরোধী মত দিচ্ছেন, দিতেই পারেন। কিন্তু তিনিও এ পথে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই এ সেতুর সুফল ভোগ করবেন। জন-আনন্দ ও জন-আকাঙ্ক্ষার বাইরে গিয়ে তো রাজনীতি নয়। গণমানুষের আনন্দবোধকে স্বীকার ও শ্রদ্ধা করাই এই মুহূর্তের কর্তব্য। একটি সেতু একটি জনপদের মনোভূমিকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছে, খোদ নিজেই হয়ে উঠেছে মানুষের মনোভূমির অংশ—এই দুঃখবেদনাহত দেশে, এমন উৎসবকে স্বাগত জানানোই স্বাভাবিক। 
৭. 
একটি রাষ্ট্র যেভাবেই চলুক, তার জন্য সরকার প্রয়োজন। সরকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিপালন ও নানা প্রকল্পের বাস্তবায়ন। পদ্মা সেতু কোনো ভিন্ন গল্প নয়। ফলে, যে সরকারই এ অসাধ্য সাধন করুক না কেন, তাদের ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন। ঘটনাচক্রে ২৪ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সেতু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উদ্বোধন করলেন শেখ হাসিনা। তাঁকে ও তাঁর সরকারকে অভিনন্দন জানাই। 
সবই আমাদের টাকায় নির্মিত উন্নয়নের গল্প। তাতে নতুন মহাপালকের নাম—পদ্মা সেতু। 
অভিনন্দন, বাংলাদেশ!

লেখক: গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!

ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।

২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।

৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।

চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।

৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।

তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।

৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!

বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।

৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।

বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।

লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।

নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।

৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।

আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,

দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?

লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নির্বাচনী ব্যয়

সম্পাদকীয়
নির্বাচনী ব্যয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।

সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।

নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।

‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

সম্পাদকীয়
খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।

গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।

এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

অরুণ কর্মকার
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।

দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।

প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!

তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?

কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত