গৌতম ভদ্র

তরবো (অ) পি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।
—যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ
১
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বঙ্গের বাখরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় অবস্থিত) এলাকার সিদ্ধকাঠি গ্রামে গুহ-বকসীদের খাস তালুকদার বংশে রণজিৎ গুহর জন্ম। গ্রামের নামে অনুষঙ্গে জড়িত বৌদ্ধতন্ত্র, গ্রাম সমাজ একেবারে আধা-সামন্ততান্ত্রিক। তবে বংশে ঠাকুরদা পণ্ডিত ও শিক্ষক, বাবা পেশায় আইনজীবী। একশো বছর পরেই অস্ট্রিয়াবাসী, অথচ আদ্যন্ত বাঙালি বলে গর্বিত রণজিৎ গুহর স্মৃতিতে সেই কুলজি-চিহ্ন মুছে যায়নি। তাঁর সাম্প্রতিকতম রচনায় শৈশবের কালকেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘ফর্ম্যাটিভ পিরিয়ড’ বলেছেন। ‘বরিশালনামা’ তো নানা স্মরণীয় বাঙালের কথাকীর্তিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু রণজিৎ গুহর তুলনায় অন্য কারও জীবন, চরিত্র ও রচনা এত বিতর্কিত, এত রঙ্গিবিরঙ্গি নয়, দেশ-বিদেশে, ব্যক্তি ও সমূহের বহুধা সম্পর্কের টানাপড়েনে ছড়িয়ে পড়েনি। শতায়ুজীবীর প্রতি এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি তাঁর জীবনী নয়; তাঁর বিশাল চিন্তনকর্মের পর্যালোচনা দূর অস্ত্। এই নিবেদনটি কেবল এক অনন্য মেধাজীবীর অনুসন্ধিৎসার অভিমুখ, বাঁকবদল ও তাঁর ত্রি-পর্বী লেখালিখির পরিচয়ের রৈখিক খসড়ামাত্র।
সিদ্ধকাঠির এক খাটুলি পরিবারের নগা রণজিৎ গুহর শৈশব সুহৃদ, আবার ওই সব পরিবারের বয়স্করাই বাড়ির প্রজা, হয় দলিত, নয় মুসলমান। এই মনিব-প্রজা দ্বন্দ্বের (উভয়ার্থে) বোধটি যৌবনের ইতিহাসচর্চায় ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যরূপে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়। তারই প্রকাশ দেখি ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম ভূমি আইন চিন্তার উপর তাঁর লেখা বোধি-উজ্জ্বল সন্দর্ভটিতে, যার নাম ‘আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দি আইডিয়া অব পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ (প্যারিস ১৯৬৩ /নিউ দিল্লি ১৯৮২)। নানা কায়েমি স্বার্থের বিরোধের কথা ও ধন লুট করার সরল ইতিবৃত্তের বাইরে তিনি দেখালেন কোম্পানির আমলাদের নানা তর্কের মধ্যে কীভাবে ফিজ়িয়োক্র্যাসি বা প্রাকৃত ধনবাদী ভূমিতত্ত্ব বাংলায় বিনিয়োগনিষ্ঠ, উন্নতিকামী অথচ বশংবদ ভূম্যধিকারী সম্প্রদায় গড়তে চেয়েছিল। অথচ বাস্তবে জন্ম নিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খাজনাগৃধ্নু, নানা স্তরে বিভক্ত, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীর দল। উপনিবেশে প্রবুদ্ধ ইউরোপীয় জ্ঞানের এ-হেন আকারপ্রাপ্তিকে রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যাস’ বা ‘এপিস্টেমোলজিক্যাল ভায়োলেন্স’; তাঁর প্রাকৃত লব্জে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এক ‘ত্রিশঙ্কুর জগৎ’ তৈরি করল—উন্নতির ইচ্ছা ও জ্ঞানফল উল্টোমুখী হতে চলল। দ্বিতীয়ত, তাঁর সন্দর্ভে স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যের যুগে জ্ঞানতত্ত্বের নির্মিতিতে ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার জগৎ ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাওয়া জ্ঞানধারণা একেবারে জড়াপট্টি, ইতরেতর সম্বন্ধে আবদ্ধ। আজ এ কথাটা সবাই জানে ও মানে। কিন্তু সে দিন জ্ঞানতত্ত্বের এই ইতিহাসচিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন রণজিৎ গুহই।
এই সন্দর্ভের অনুষঙ্গে লেখা হয়েছিল এক রাশ প্রবন্ধ, যেমন মেদিনীপুরের লবণ শিল্পে মলঙ্গী তথা লবণ উৎপাদকদের প্রতিরোধ আন্দোলনের বিশ্লেষণী ইতিবৃত্ত থেকে স্থানীয় আর্কাইভস ব্যবহার করে বর্ধমান জেলার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিবরণী। স্বদেশের ইতিবৃত্তে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতের আদি স্পন্দনগুলি রণজিৎ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি দৈশিক ও কালিক অভিজ্ঞতার সতত উপস্থিতিকে কোনও দিন ভোলেননি।
লিখনশৈলীর জন্য প্রশংসিত হলেও আ রুল অব প্রপার্টি প্রথাসম্মত ইতিহাস আলোচক ও দরবারি মার্ক্সবাদীদের কাছে আদৃত হয়নি। ঘটনার প্রবাহে ১৯৫৯-এ ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এ অধ্যাপনার কাজে রত হওয়ার পরও রণজিৎ গুহ থাকবন্দি ঔপনিবেশিক সমাজে শাসকের সর্বেশ্বরতার ক্ষমতাসীমা ও বিন্যাস নিয়ে ভাবনা থামাননি, সেই ভাবনাসূত্রে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের গণতন্ত্রে চিন্তার পরিসরে ঔপনিবেশিকতার দায়ভারের সজীব অস্তিত্বকে দাগাতে শুরু করেছিলেন। ইতিহাস-চিন্তায় বাঁক নেওয়ার সেই প্রস্তুতি-পর্বের স্ফুরণ দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকের ফ্রন্টিয়ার-এর মতো রাজনৈতিক পত্রিকায় লেখা তিনটি প্রবন্ধে। যেমন- উদারনৈতিক সংস্কারচিন্তা ও সদিচ্ছায় আবদ্ধ নীলদর্পণ-এর মতো নাটকে বিদ্রোহী চৈতন্যের ‘ভদ্রস্থ’ উপস্থাপনের সমালোচনা, গণতন্ত্রের সুভদ্র সংস্কৃতিতে নির্মম পুলিশি অত্যাচারের তীক্ষ্ণ ব্যাখ্যা আর জেলে আটক মেরি টাইটলার- এর দেখা ভারতীয় সমাজে জারিত সন্ত্রাসের বিবরণীর এক মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ।
১৯৭০-৭১ সালে গান্ধীর গণ-আন্দোলনের স্বরূপ-সন্ধানে গবেষণা করতে ভারতে এসে নকশালবাড়ির রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর গবেষণার অভিমুখ পাল্টে গেল। সৃজনশীল ইতিহাসচর্চার দ্বিতীয় পর্বে তাঁর ক্রিয়াকর্ম দুটি শাখায় প্রসারিত হল। প্রথমত, কয়েক জন অতি-তরুণ গবেষককে জড়ো করে তিনি ‘নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চা’র ধারা প্রবর্তন করলেন। উদ্দেশ্য—ভারতে চালু আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার আদিকল্পের বিরুদ্ধে নতুন এক আদিকল্পের অনুসন্ধান করা। ১৯৮০ সালে তাঁর বহুচর্চিত ও বিতর্কিত ইংরেজি ম্যানিফেস্টো ও বাংলা প্রবন্ধে বলা হল যে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রে আছে রাষ্ট্রিকতা, সেই ইতিহাসবিদ্যা আসলে ‘বকলমে’ লেখা রাষ্ট্রশক্তির ইতিকথা, ইংরেজ শাসনজাত প্রগতি ও সভ্যতার পক্ষে নানা ধাঁচের বৃত্তান্ত। অন্য পক্ষে, সমালোচনাত্মক জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চাও পর্যবসিত হয়েছে দেশজ উচ্চবর্গের আদর্শবাদের মহিমাগাথায় ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাফল্যের নান্দীপাঠে। এই দ্বিবিধ উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের ক্রিয়াকাণ্ডের বৃত্তান্ত যে গরহাজির, তা কিন্তু একদম নয়। কিন্তু সেই বৃত্তান্ত উচ্চবর্গীয় উদ্যোগ আখ্যানের অনুপর্ব মাত্র, কালু ডোমরা চিরকাল যেন প্রভুর জন্য প্রাণদান করে।
এই ধারণার বিরুদ্ধে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা’র আদিকল্প ভারতীয় রাজনীতির জগৎকে দু’টি বর্গের রাজনীতিক্ষেত্রে বিভক্ত করল। দমনকারী ও দমিতের ক্ষমতার বৈপরীত্যের নানা সূত্র ধরে কর্ম ও মানসজগতে নিম্নবর্গের আনুগত্য, সহকারিতা ও প্রতিবাদের রূপগুলি তুলে ধরল। অবশ্যই উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতি সময় বুঝে প্রতিচ্ছেদিত হতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে স্ব-উদ্যোগ আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি সমাজের বেণিবন্ধন গড়তে পারে। সময় বুঝে ওই বন্ধনের গিঁটগুলি আলগা হয়, এমনকি খুলেও যায়। তবে দুই ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য অবশ্যধার্য। রণজিৎ গুহ প্রণোদিত ও বোধিত ‘নিম্নবর্গের চর্চা’ বলে নামাঙ্কিত নিবন্ধখণ্ডগুলিতে এই সতত সঞ্চারমাণ রাজনীতির কথন ও লেখনই তরুণ গবেষকরা সম্পন্ন করতে শুরু করলেন।
এই যৌথকর্মের সঙ্গে শ্লিষ্ট তাঁর লেখা বহুবিতর্কিত বই এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়াতে (১৯৮৩) এল ভারতের কৃষক বিদ্রোহের মুহূর্তগুলি, আর তার তুলনাসূত্রে, ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহ ও চিনের কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা। বিদ্রোহী চৈতন্যে জাত কর্মকাণ্ডের কাঠামোয় রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাবনার সাধারণ লক্ষণগুলি চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে, এই চৈতন্যের সাধারণ রূপ-লক্ষণগুলি প্রকীর্ণ থাকে জীবনযাপনের নানা ক্রিয়ায়। এই রূপ-লক্ষণগুলির সংহত ও জ্বলন্ত স্ফুরণ ঘটে কৃষক উপপ্লবের নানা ছোটবড় ঢেউয়ে, সরকার-সাহুকার-জমিদারের ক্ষমতাবিন্যাসের মৌহূর্তিক বিপর্যাসে। এই বিশ্লেষণী ছকে রণজিৎ জানালেন যে, কৃষক বিদ্রোহ শুধু কার্যকারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ অর্থনৈতিক বা সামাজিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ‘প্রাক্-রাজনৈতিক ভাবনা’র প্রকাশ নয়। বরং চরিত্রে তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক—সার্বিক ক্ষমতাবিন্যাসকে উল্টে দেওয়ার ঈপ্সা থেকে জাত। দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহী কৃষক সমাবেশের বা স্ব-উদ্যোগের ভিত্তি হল কোনও না কোনও সামূহিকতার বোধ। কৌম সম্বন্ধে, আঞ্চলিক সন্নিহিতি বা জাতপাত বিন্যাসে, গোষ্ঠীগত শ্রম অভ্যাসে, ধার্মিকতার ধারণায়, বা শ্রেণি-সংবিদে এই সামূহিকতার বোধ নিহিত থাকে। একাধিক সূত্রের টানে বোধটি ক্রিয়াশীল হয়, একমাত্রিকতার টানকে ছাপিয়ে যায়, সংহতির বার্তা ও অভিমুখে তার সরণ ঘটে।
রণজিৎ গুহ জানেন যে কোনও ঘটনা-বিশেষের অবয়বে ও ব্যক্তি-সংবেদনার কালিক অভিজ্ঞতায় সাধারণ লক্ষণের ঐতিহাসিকত্ব রক্ষা পায়, বিশেষের প্রেক্ষিতে ও প্রাখর্যে সাধারণ লক্ষণ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই বিদ্রোহী চৈতন্যের সাধারণ লাক্ষণিক কাঠামো গ্রন্থনের ফাঁকফোকরে আখ্যান নির্মাণের আদি রীতিটি তিনি ত্যাগ করেননি। এলিমেন্টারি আসপেক্ট-এ ‘হুল’-এর চরিত্রবিচারে, ভাগনা মাঝি ও ডোমন দারোগার শোধ ও প্রতিশোধের রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণিত হয় অনুপুঙ্খে। রাহুর পৌরাণিক কথার পার্থিব উদ্যাপনের মুহূর্তে, গ্রহণের ক্ষণে, বামুনদের ছুতমার্গী আচার ও শুদ্ধতা রক্ষার বিপরীতে দলিত মুসাহারদের উল্লাস ও আবাহনের বিবৃতি সামাজিক চৈতন্যের নানা স্তরের সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেয়। আবার রাঢ় অঞ্চলে অনুশাসনে দীর্ণ গ্রামসমাজে চাষির মেয়ে মৃত চন্দ্রার গর্ভপাতের মামলায় এজাহারে ধৃত নারীদের সংহতিবার্তা, বাঁচা ও বাঁচানোর আকুতির কথাকাহিনিতে দলিত গোষ্ঠী ও অবদমিত মানবীদের ঐকান্তিক অনুভূতির সহজ স্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতির সূত্রেই নগা, ঢোঁড়াই বা বাঘারুদের জীবনচর্চা ও চৈতন্যের বিশ্লেষণনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ্যা মানবিকতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠল।
কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে। এবং তাঁর সেই ভাবনার সেরা ফসল পাওয়া গেল বাংলা ভাষায় লেখা একাধিক মৌলিক প্রবন্ধের সঙ্কলনে, দুই খণ্ডের রচনাসংগ্রহতে (আনন্দ, ২০১৯)।
রণজিৎ গুহর মতে, মানুষ সত্তাময় জীব। এই সত্তাময়তার প্রকাশই মানুষী চৈতন্য, সেই চৈতন্যের উচ্চারণ ভাষা-ভাবনায় বিধৃত হয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষা-ভাবনার ত্রিভুজে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ্যার রূপানুসন্ধান প্রসারিত হল মানবিক অভিজ্ঞতার ভিন্ন অবয়বে, নিছক কার্যকারণ অন্বিত যুক্তিবোধ থেকে রসগ্রাহী সাহিত্য-আলাপে। এ বারের অন্বেষায় তিনি জানালেন যে, কোনও এক অতীতকালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও এক সমূহের অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া হল ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ইতিহাসবিদের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের আকার নেয়। সদৃশার্থে নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতাও অনুভূতি-সচেতন কবি-সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাসিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয় সংবাদী করে তোলে।
ওয়াকিবহাল পাঠক জানেন যে, তাঁর পূর্বতন রচনায় ইউরোপীয় সমাজবিজ্ঞান থেকে আহৃত ‘ইমপ্রুভমেন্ট’, ‘লয়্যালটি’, ‘হেজেমনি’ ইত্যাদি ধারণার প্রতিপার্শ্বে তিনি দণ্ড, ধর্ম, ভক্তি ও অতিদেশ-এর মতো দেশজ জ্ঞান ও ব্যবহার কাণ্ডের ধারণাগুলিকে সমমর্যাদায় স্থান দিয়েছেন, মোকাবিলায় দুই গোত্রের ধারণার ঠাঁই নড়ে গিয়ে নতুন বিশ্লেষণী পরিসর তৈরি হয়েছে। বাংলা প্রবন্ধাবলিতে তিনি ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শনচিন্তার নানা ভাবনাবীজকে আত্মস্থ করে গবেষণার বিচার-অভিমুখকে বিশ্বমুখী করে তুললেন; যেমন, ভবভূতির ঔপচারিক বৃত্তির সৃজনশীল প্রয়োগ তাঁর মীমাংসাকে অনন্য প্রাখর্য দিল। দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের ঈপ্সিত ভারতীয় মননে স্বরাজসাধনার সিদ্ধপুরুষ রণজিৎ গুহ।
বাংলায় লেখা এই মৌলিক প্রবন্ধগুলির বিষয়গত ঝোঁক দ্বিমুখী। এক পক্ষে, পর্ব থেকে পর্বান্তরে সময়বোধ ও প্রকৃতিবোধের চলাচলের পথে সৃষ্টিশীল অহং-এর প্রসার ও পুষ্টির বিচার চলতে থাকে। খোঁজের সূত্র ছড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রি-গীত’-এর পাঠে, কখনও বা জীবনানন্দের সময়লগ্নতা থেকে বিভূতিভূষণের ঋতবোধের আলোচনায়, কখনও বা রবীন্দ্র-উত্তর কাব্যের তিন আধুনিক কবির কবিরূপের বিশ্লেষণে। অন্য পক্ষে, আমাদের আধুনিকতার কুলজি বিচারে তিনি সমত্ববোধ ও সামাজিক সমানুভূতির ছাপ-ছোপকে ঠাহর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্লেষণী নজরে ধরা পড়ে, কী ভাবে রামমোহনের শাস্ত্রবিচার ও হিতবাদী দর্শনে পুষ্ট যুক্তিবোধটি দেশজ সমাজের গহনে ক্রিয়াময় দয়া-ধর্মের ছোঁয়া পায়, আর তৈরি হয় সংবেদনশীলতার নবানুভূতি।
‘আদি কবি আর প্রথম পাঠক: একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকারের কাহিনি’ নামে এতাবৎকাল সম্পূর্ণ অনালোচিত প্রবন্ধ বলে, রাষ্ট্রসর্বস্বতার বাইরে কাব্যকথার টানে কী ভাবে সামূহিকতার ইতিহাসবোধ জ্ঞানচেতনার ঐতিহ্যে শিকড়ের কথা। প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই তো সভ্যতার ভিত্তি।
যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে। ‘শেষ তর্পণ’ বলে মহাভারতীয় আখ্যানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় রণজিৎ দেখান যে, কুরুক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে সব মানবজাতির ইতিহাসে। কেবল আনৃশংস্য হওয়ার সাধ নয়, অনুকম্পা ও শোচনায় মানুষের মানবিক হওয়ার শেষ ভরসাটুকু জিয়ানো থাকে।
রাজনীতি থেকে মানবনীতির এ-হেন অন্বেষার অক্ষে ‘গ্লোবাল’ ও ‘লোকাল’-এর ভেদ তুচ্ছ হয়ে পড়ে। চৈতন্যের ইতিবৃত্ত রচনার কাছে নিবেদিত এক বাঙালি মেধাজীবীর মমত্ববোধ বহুজনীন হয়ে ওঠে। নানা কাল ও নানা দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বেদনাবোধ সংলগ্ন হতে চায়। সংবেদনশীলতার চর্চা ও লগ্নতার আকাঙ্ক্ষার আধারেই মেধাজীবীর দায়কে রণজিৎ গুহ অনুক্ষণ স্বীকার করেন।
ভাল থাকবেন, রণজিৎদা।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ও সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গতবছর রণজিৎ গুহর ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। উপযোগিতা বিবেচনায় শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।)

তরবো (অ) পি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।
—যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ
১
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বঙ্গের বাখরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় অবস্থিত) এলাকার সিদ্ধকাঠি গ্রামে গুহ-বকসীদের খাস তালুকদার বংশে রণজিৎ গুহর জন্ম। গ্রামের নামে অনুষঙ্গে জড়িত বৌদ্ধতন্ত্র, গ্রাম সমাজ একেবারে আধা-সামন্ততান্ত্রিক। তবে বংশে ঠাকুরদা পণ্ডিত ও শিক্ষক, বাবা পেশায় আইনজীবী। একশো বছর পরেই অস্ট্রিয়াবাসী, অথচ আদ্যন্ত বাঙালি বলে গর্বিত রণজিৎ গুহর স্মৃতিতে সেই কুলজি-চিহ্ন মুছে যায়নি। তাঁর সাম্প্রতিকতম রচনায় শৈশবের কালকেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘ফর্ম্যাটিভ পিরিয়ড’ বলেছেন। ‘বরিশালনামা’ তো নানা স্মরণীয় বাঙালের কথাকীর্তিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু রণজিৎ গুহর তুলনায় অন্য কারও জীবন, চরিত্র ও রচনা এত বিতর্কিত, এত রঙ্গিবিরঙ্গি নয়, দেশ-বিদেশে, ব্যক্তি ও সমূহের বহুধা সম্পর্কের টানাপড়েনে ছড়িয়ে পড়েনি। শতায়ুজীবীর প্রতি এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি তাঁর জীবনী নয়; তাঁর বিশাল চিন্তনকর্মের পর্যালোচনা দূর অস্ত্। এই নিবেদনটি কেবল এক অনন্য মেধাজীবীর অনুসন্ধিৎসার অভিমুখ, বাঁকবদল ও তাঁর ত্রি-পর্বী লেখালিখির পরিচয়ের রৈখিক খসড়ামাত্র।
সিদ্ধকাঠির এক খাটুলি পরিবারের নগা রণজিৎ গুহর শৈশব সুহৃদ, আবার ওই সব পরিবারের বয়স্করাই বাড়ির প্রজা, হয় দলিত, নয় মুসলমান। এই মনিব-প্রজা দ্বন্দ্বের (উভয়ার্থে) বোধটি যৌবনের ইতিহাসচর্চায় ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যরূপে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়। তারই প্রকাশ দেখি ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম ভূমি আইন চিন্তার উপর তাঁর লেখা বোধি-উজ্জ্বল সন্দর্ভটিতে, যার নাম ‘আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দি আইডিয়া অব পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ (প্যারিস ১৯৬৩ /নিউ দিল্লি ১৯৮২)। নানা কায়েমি স্বার্থের বিরোধের কথা ও ধন লুট করার সরল ইতিবৃত্তের বাইরে তিনি দেখালেন কোম্পানির আমলাদের নানা তর্কের মধ্যে কীভাবে ফিজ়িয়োক্র্যাসি বা প্রাকৃত ধনবাদী ভূমিতত্ত্ব বাংলায় বিনিয়োগনিষ্ঠ, উন্নতিকামী অথচ বশংবদ ভূম্যধিকারী সম্প্রদায় গড়তে চেয়েছিল। অথচ বাস্তবে জন্ম নিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খাজনাগৃধ্নু, নানা স্তরে বিভক্ত, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীর দল। উপনিবেশে প্রবুদ্ধ ইউরোপীয় জ্ঞানের এ-হেন আকারপ্রাপ্তিকে রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যাস’ বা ‘এপিস্টেমোলজিক্যাল ভায়োলেন্স’; তাঁর প্রাকৃত লব্জে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এক ‘ত্রিশঙ্কুর জগৎ’ তৈরি করল—উন্নতির ইচ্ছা ও জ্ঞানফল উল্টোমুখী হতে চলল। দ্বিতীয়ত, তাঁর সন্দর্ভে স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যের যুগে জ্ঞানতত্ত্বের নির্মিতিতে ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার জগৎ ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাওয়া জ্ঞানধারণা একেবারে জড়াপট্টি, ইতরেতর সম্বন্ধে আবদ্ধ। আজ এ কথাটা সবাই জানে ও মানে। কিন্তু সে দিন জ্ঞানতত্ত্বের এই ইতিহাসচিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন রণজিৎ গুহই।
এই সন্দর্ভের অনুষঙ্গে লেখা হয়েছিল এক রাশ প্রবন্ধ, যেমন মেদিনীপুরের লবণ শিল্পে মলঙ্গী তথা লবণ উৎপাদকদের প্রতিরোধ আন্দোলনের বিশ্লেষণী ইতিবৃত্ত থেকে স্থানীয় আর্কাইভস ব্যবহার করে বর্ধমান জেলার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিবরণী। স্বদেশের ইতিবৃত্তে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতের আদি স্পন্দনগুলি রণজিৎ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি দৈশিক ও কালিক অভিজ্ঞতার সতত উপস্থিতিকে কোনও দিন ভোলেননি।
লিখনশৈলীর জন্য প্রশংসিত হলেও আ রুল অব প্রপার্টি প্রথাসম্মত ইতিহাস আলোচক ও দরবারি মার্ক্সবাদীদের কাছে আদৃত হয়নি। ঘটনার প্রবাহে ১৯৫৯-এ ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এ অধ্যাপনার কাজে রত হওয়ার পরও রণজিৎ গুহ থাকবন্দি ঔপনিবেশিক সমাজে শাসকের সর্বেশ্বরতার ক্ষমতাসীমা ও বিন্যাস নিয়ে ভাবনা থামাননি, সেই ভাবনাসূত্রে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের গণতন্ত্রে চিন্তার পরিসরে ঔপনিবেশিকতার দায়ভারের সজীব অস্তিত্বকে দাগাতে শুরু করেছিলেন। ইতিহাস-চিন্তায় বাঁক নেওয়ার সেই প্রস্তুতি-পর্বের স্ফুরণ দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকের ফ্রন্টিয়ার-এর মতো রাজনৈতিক পত্রিকায় লেখা তিনটি প্রবন্ধে। যেমন- উদারনৈতিক সংস্কারচিন্তা ও সদিচ্ছায় আবদ্ধ নীলদর্পণ-এর মতো নাটকে বিদ্রোহী চৈতন্যের ‘ভদ্রস্থ’ উপস্থাপনের সমালোচনা, গণতন্ত্রের সুভদ্র সংস্কৃতিতে নির্মম পুলিশি অত্যাচারের তীক্ষ্ণ ব্যাখ্যা আর জেলে আটক মেরি টাইটলার- এর দেখা ভারতীয় সমাজে জারিত সন্ত্রাসের বিবরণীর এক মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ।
১৯৭০-৭১ সালে গান্ধীর গণ-আন্দোলনের স্বরূপ-সন্ধানে গবেষণা করতে ভারতে এসে নকশালবাড়ির রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর গবেষণার অভিমুখ পাল্টে গেল। সৃজনশীল ইতিহাসচর্চার দ্বিতীয় পর্বে তাঁর ক্রিয়াকর্ম দুটি শাখায় প্রসারিত হল। প্রথমত, কয়েক জন অতি-তরুণ গবেষককে জড়ো করে তিনি ‘নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চা’র ধারা প্রবর্তন করলেন। উদ্দেশ্য—ভারতে চালু আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার আদিকল্পের বিরুদ্ধে নতুন এক আদিকল্পের অনুসন্ধান করা। ১৯৮০ সালে তাঁর বহুচর্চিত ও বিতর্কিত ইংরেজি ম্যানিফেস্টো ও বাংলা প্রবন্ধে বলা হল যে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রে আছে রাষ্ট্রিকতা, সেই ইতিহাসবিদ্যা আসলে ‘বকলমে’ লেখা রাষ্ট্রশক্তির ইতিকথা, ইংরেজ শাসনজাত প্রগতি ও সভ্যতার পক্ষে নানা ধাঁচের বৃত্তান্ত। অন্য পক্ষে, সমালোচনাত্মক জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চাও পর্যবসিত হয়েছে দেশজ উচ্চবর্গের আদর্শবাদের মহিমাগাথায় ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাফল্যের নান্দীপাঠে। এই দ্বিবিধ উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের ক্রিয়াকাণ্ডের বৃত্তান্ত যে গরহাজির, তা কিন্তু একদম নয়। কিন্তু সেই বৃত্তান্ত উচ্চবর্গীয় উদ্যোগ আখ্যানের অনুপর্ব মাত্র, কালু ডোমরা চিরকাল যেন প্রভুর জন্য প্রাণদান করে।
এই ধারণার বিরুদ্ধে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা’র আদিকল্প ভারতীয় রাজনীতির জগৎকে দু’টি বর্গের রাজনীতিক্ষেত্রে বিভক্ত করল। দমনকারী ও দমিতের ক্ষমতার বৈপরীত্যের নানা সূত্র ধরে কর্ম ও মানসজগতে নিম্নবর্গের আনুগত্য, সহকারিতা ও প্রতিবাদের রূপগুলি তুলে ধরল। অবশ্যই উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতি সময় বুঝে প্রতিচ্ছেদিত হতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে স্ব-উদ্যোগ আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি সমাজের বেণিবন্ধন গড়তে পারে। সময় বুঝে ওই বন্ধনের গিঁটগুলি আলগা হয়, এমনকি খুলেও যায়। তবে দুই ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য অবশ্যধার্য। রণজিৎ গুহ প্রণোদিত ও বোধিত ‘নিম্নবর্গের চর্চা’ বলে নামাঙ্কিত নিবন্ধখণ্ডগুলিতে এই সতত সঞ্চারমাণ রাজনীতির কথন ও লেখনই তরুণ গবেষকরা সম্পন্ন করতে শুরু করলেন।
এই যৌথকর্মের সঙ্গে শ্লিষ্ট তাঁর লেখা বহুবিতর্কিত বই এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়াতে (১৯৮৩) এল ভারতের কৃষক বিদ্রোহের মুহূর্তগুলি, আর তার তুলনাসূত্রে, ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহ ও চিনের কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা। বিদ্রোহী চৈতন্যে জাত কর্মকাণ্ডের কাঠামোয় রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাবনার সাধারণ লক্ষণগুলি চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে, এই চৈতন্যের সাধারণ রূপ-লক্ষণগুলি প্রকীর্ণ থাকে জীবনযাপনের নানা ক্রিয়ায়। এই রূপ-লক্ষণগুলির সংহত ও জ্বলন্ত স্ফুরণ ঘটে কৃষক উপপ্লবের নানা ছোটবড় ঢেউয়ে, সরকার-সাহুকার-জমিদারের ক্ষমতাবিন্যাসের মৌহূর্তিক বিপর্যাসে। এই বিশ্লেষণী ছকে রণজিৎ জানালেন যে, কৃষক বিদ্রোহ শুধু কার্যকারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ অর্থনৈতিক বা সামাজিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ‘প্রাক্-রাজনৈতিক ভাবনা’র প্রকাশ নয়। বরং চরিত্রে তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক—সার্বিক ক্ষমতাবিন্যাসকে উল্টে দেওয়ার ঈপ্সা থেকে জাত। দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহী কৃষক সমাবেশের বা স্ব-উদ্যোগের ভিত্তি হল কোনও না কোনও সামূহিকতার বোধ। কৌম সম্বন্ধে, আঞ্চলিক সন্নিহিতি বা জাতপাত বিন্যাসে, গোষ্ঠীগত শ্রম অভ্যাসে, ধার্মিকতার ধারণায়, বা শ্রেণি-সংবিদে এই সামূহিকতার বোধ নিহিত থাকে। একাধিক সূত্রের টানে বোধটি ক্রিয়াশীল হয়, একমাত্রিকতার টানকে ছাপিয়ে যায়, সংহতির বার্তা ও অভিমুখে তার সরণ ঘটে।
রণজিৎ গুহ জানেন যে কোনও ঘটনা-বিশেষের অবয়বে ও ব্যক্তি-সংবেদনার কালিক অভিজ্ঞতায় সাধারণ লক্ষণের ঐতিহাসিকত্ব রক্ষা পায়, বিশেষের প্রেক্ষিতে ও প্রাখর্যে সাধারণ লক্ষণ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই বিদ্রোহী চৈতন্যের সাধারণ লাক্ষণিক কাঠামো গ্রন্থনের ফাঁকফোকরে আখ্যান নির্মাণের আদি রীতিটি তিনি ত্যাগ করেননি। এলিমেন্টারি আসপেক্ট-এ ‘হুল’-এর চরিত্রবিচারে, ভাগনা মাঝি ও ডোমন দারোগার শোধ ও প্রতিশোধের রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণিত হয় অনুপুঙ্খে। রাহুর পৌরাণিক কথার পার্থিব উদ্যাপনের মুহূর্তে, গ্রহণের ক্ষণে, বামুনদের ছুতমার্গী আচার ও শুদ্ধতা রক্ষার বিপরীতে দলিত মুসাহারদের উল্লাস ও আবাহনের বিবৃতি সামাজিক চৈতন্যের নানা স্তরের সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেয়। আবার রাঢ় অঞ্চলে অনুশাসনে দীর্ণ গ্রামসমাজে চাষির মেয়ে মৃত চন্দ্রার গর্ভপাতের মামলায় এজাহারে ধৃত নারীদের সংহতিবার্তা, বাঁচা ও বাঁচানোর আকুতির কথাকাহিনিতে দলিত গোষ্ঠী ও অবদমিত মানবীদের ঐকান্তিক অনুভূতির সহজ স্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতির সূত্রেই নগা, ঢোঁড়াই বা বাঘারুদের জীবনচর্চা ও চৈতন্যের বিশ্লেষণনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ্যা মানবিকতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠল।
কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে। এবং তাঁর সেই ভাবনার সেরা ফসল পাওয়া গেল বাংলা ভাষায় লেখা একাধিক মৌলিক প্রবন্ধের সঙ্কলনে, দুই খণ্ডের রচনাসংগ্রহতে (আনন্দ, ২০১৯)।
রণজিৎ গুহর মতে, মানুষ সত্তাময় জীব। এই সত্তাময়তার প্রকাশই মানুষী চৈতন্য, সেই চৈতন্যের উচ্চারণ ভাষা-ভাবনায় বিধৃত হয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষা-ভাবনার ত্রিভুজে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ্যার রূপানুসন্ধান প্রসারিত হল মানবিক অভিজ্ঞতার ভিন্ন অবয়বে, নিছক কার্যকারণ অন্বিত যুক্তিবোধ থেকে রসগ্রাহী সাহিত্য-আলাপে। এ বারের অন্বেষায় তিনি জানালেন যে, কোনও এক অতীতকালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও এক সমূহের অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া হল ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ইতিহাসবিদের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের আকার নেয়। সদৃশার্থে নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতাও অনুভূতি-সচেতন কবি-সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাসিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয় সংবাদী করে তোলে।
ওয়াকিবহাল পাঠক জানেন যে, তাঁর পূর্বতন রচনায় ইউরোপীয় সমাজবিজ্ঞান থেকে আহৃত ‘ইমপ্রুভমেন্ট’, ‘লয়্যালটি’, ‘হেজেমনি’ ইত্যাদি ধারণার প্রতিপার্শ্বে তিনি দণ্ড, ধর্ম, ভক্তি ও অতিদেশ-এর মতো দেশজ জ্ঞান ও ব্যবহার কাণ্ডের ধারণাগুলিকে সমমর্যাদায় স্থান দিয়েছেন, মোকাবিলায় দুই গোত্রের ধারণার ঠাঁই নড়ে গিয়ে নতুন বিশ্লেষণী পরিসর তৈরি হয়েছে। বাংলা প্রবন্ধাবলিতে তিনি ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শনচিন্তার নানা ভাবনাবীজকে আত্মস্থ করে গবেষণার বিচার-অভিমুখকে বিশ্বমুখী করে তুললেন; যেমন, ভবভূতির ঔপচারিক বৃত্তির সৃজনশীল প্রয়োগ তাঁর মীমাংসাকে অনন্য প্রাখর্য দিল। দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের ঈপ্সিত ভারতীয় মননে স্বরাজসাধনার সিদ্ধপুরুষ রণজিৎ গুহ।
বাংলায় লেখা এই মৌলিক প্রবন্ধগুলির বিষয়গত ঝোঁক দ্বিমুখী। এক পক্ষে, পর্ব থেকে পর্বান্তরে সময়বোধ ও প্রকৃতিবোধের চলাচলের পথে সৃষ্টিশীল অহং-এর প্রসার ও পুষ্টির বিচার চলতে থাকে। খোঁজের সূত্র ছড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রি-গীত’-এর পাঠে, কখনও বা জীবনানন্দের সময়লগ্নতা থেকে বিভূতিভূষণের ঋতবোধের আলোচনায়, কখনও বা রবীন্দ্র-উত্তর কাব্যের তিন আধুনিক কবির কবিরূপের বিশ্লেষণে। অন্য পক্ষে, আমাদের আধুনিকতার কুলজি বিচারে তিনি সমত্ববোধ ও সামাজিক সমানুভূতির ছাপ-ছোপকে ঠাহর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্লেষণী নজরে ধরা পড়ে, কী ভাবে রামমোহনের শাস্ত্রবিচার ও হিতবাদী দর্শনে পুষ্ট যুক্তিবোধটি দেশজ সমাজের গহনে ক্রিয়াময় দয়া-ধর্মের ছোঁয়া পায়, আর তৈরি হয় সংবেদনশীলতার নবানুভূতি।
‘আদি কবি আর প্রথম পাঠক: একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকারের কাহিনি’ নামে এতাবৎকাল সম্পূর্ণ অনালোচিত প্রবন্ধ বলে, রাষ্ট্রসর্বস্বতার বাইরে কাব্যকথার টানে কী ভাবে সামূহিকতার ইতিহাসবোধ জ্ঞানচেতনার ঐতিহ্যে শিকড়ের কথা। প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই তো সভ্যতার ভিত্তি।
যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে। ‘শেষ তর্পণ’ বলে মহাভারতীয় আখ্যানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় রণজিৎ দেখান যে, কুরুক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে সব মানবজাতির ইতিহাসে। কেবল আনৃশংস্য হওয়ার সাধ নয়, অনুকম্পা ও শোচনায় মানুষের মানবিক হওয়ার শেষ ভরসাটুকু জিয়ানো থাকে।
রাজনীতি থেকে মানবনীতির এ-হেন অন্বেষার অক্ষে ‘গ্লোবাল’ ও ‘লোকাল’-এর ভেদ তুচ্ছ হয়ে পড়ে। চৈতন্যের ইতিবৃত্ত রচনার কাছে নিবেদিত এক বাঙালি মেধাজীবীর মমত্ববোধ বহুজনীন হয়ে ওঠে। নানা কাল ও নানা দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বেদনাবোধ সংলগ্ন হতে চায়। সংবেদনশীলতার চর্চা ও লগ্নতার আকাঙ্ক্ষার আধারেই মেধাজীবীর দায়কে রণজিৎ গুহ অনুক্ষণ স্বীকার করেন।
ভাল থাকবেন, রণজিৎদা।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ও সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গতবছর রণজিৎ গুহর ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। উপযোগিতা বিবেচনায় শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।)

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৯ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান, ছাত্র সংসদ, ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা
মাসুদ রানা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৯ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসৈয়দা সাদিয়া শাহরীন

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন—নির্বাচন হবে। কবে হবে? সে উত্তরটাও সুনির্ধারিতভাবে পাওয়া গেছে বছরের শেষ দিকে এসে। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আকাঙ্ক্ষিত তফসিল। সারা বছর যাঁরা ‘নির্বাচন কবে হবে’—এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করেছেন, তাঁরা নির্বাচনের তারিখটা জেনে নিশ্চয়ই স্বস্তি পেয়েছেন। এবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনটা আসছে বছর ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেলেই ব্যাপারটা সোনায় সোহাগা হবে!
ভবিষ্যতের কথা থাক। লেখাটা আসলে এ বছরের আলোচিত ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দিতে ছাপা হয়েছে, যেন অতীতের ভুল শুধরে নতুন বছরে আমরা ভালো কিছু করে এর সুফল ভোগ করতে পারি। ২০২৫ সালে এত ঘটনা ঘটে গেছে যে একে ‘ঘটনার ঘনঘটার বছর’ বললে নিশ্চয়ই দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ হবে না! দেখুন তো পাঠক, নিচের ঘটনাগুলো আপনার মনে পড়ছে কি না।
২. ২০২৫। সালটা ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে কেটেছে অনেকের। শিশু ধর্ষণ থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি—কী হয়নি এ বছর? অপরাধ যে কয়েক গুণ বেড়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা মাগুরার আট বছর বয়সী শিশুর ধর্ষণের বিচার চেয়েছিলাম। বছরের শুরুতে সেই শিশুর ওপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল পুরো দেশ। তবু ঢাকার কেরানীগঞ্জে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। রাঙামাটিতে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে ষাট বছরের বৃদ্ধ। ঝিনাইদহে চকলেটের প্রলোভনে ধর্ষণের শিকার হয় চার বছর বয়সী শিশু।
৩. ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ নামের এক ব্যক্তির মাথা থেঁতলে মেরে ফেলা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছিল নেট দুনিয়ায়। ফুটেজটা কোনো দুঃস্বপ্ন হলেই ভালো হতো। কিন্তু না, বাস্তব ঘটনার সাক্ষী এটি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় একই রকমভাবে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। এলাকাবাসী সেদিন সাহসের পরিচয় দিয়ে রুখে দিয়েছেন হামলাকারীকে। চাঁদাবাজি নিয়ে মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল বলে দেশের মানুষ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিল তখন।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বছরের শুরুর দিকেই এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহেদুল হাসান দীপু এবং ইপিএস কম্পিউটার সিটির (মাল্টিপ্ল্যান) যুগ্ম সদস্যসচিব এহতেশামুল হক হামলার শিকার হন। পরে বেরিয়ে আসে এই হামলার পেছনে হাত রয়েছে চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে জামিনে ছাড়া পাওয়া দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর। কারাগারে থাকতেই যেখানে তাঁরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়, সেখানে তাঁদের জামিন দেওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, তা ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই জনগণ নির্ধারণ করে ফেলেছে।
৪. সোনার দাম যেভাবে এ বছর বেড়েছে, তা এক ব্যাপার বটে! এর চেয়েও বড় ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল যখন এক ব্যবসায়ী নিজের সোনার দোকানে নিজেই ডাকাতি করিয়ে ‘কট’ খেয়ে যান। মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টি এলাকায় শুভ দাস লোক ভাড়া করে নিজের দোকানে ডাকাতির নাটক সাজিয়ে গ্রাহকদের স্বর্ণালংকার আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলেন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি তাঁর এই চালাকি।
তবে রাজধানীর বনশ্রীর ঘটনাটি দুঃখজনক ছিল। আনোয়ার হোসেন নামে এক সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত।
৫. আপনারা হয়তো কোনো কমেডি সিনেমায় দেখে থাকবেন, ছিনতাইকারী শুধু টাকাপয়সা বা ফোন ছিনতাই করে না, গায়ের জামা-পায়ের জুতা সবই নিয়ে চলে যায়। রাজধানীর শ্যামলীতে সত্যিই যখন এ রকম একটি ঘটনা ঘটল, তখন এর সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি জব্দ করা হয় ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও চাপাতি। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে মেলে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইকারী চক্রটি চাপাতি ও মোটরসাইকেল ভাড়া দেয় মাঠপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের। প্রতিদিন ঢাকার একাধিক এলাকায় চাপাতি আর মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ছিনতাই কার্যক্রম চালায় চক্রটি। চাপাতি-মোটরসাইকেলের ভাড়া অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় না তাদের, ছিনতাই শেষে মালপত্র বিক্রির পর ভাড়া দিতে হয়। এমনকি ছিনতাইয়ের মালপত্র বিক্রিও করতে হয় ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতাদের কাছে। ছিনতাই করার এক আধুনিক প্যাকেজ বটে!
বছরজুড়ে মোহাম্মদপুর এলাকাটিও কিন্তু ছিনতাইয়ের ঘটনার জন্য এক আতঙ্কের জায়গা হয়ে রয়েছে। যখন-তখন চাপাতি নিয়ে তেড়ে আসা তরুণেরা এলাকাটির ত্রাস। পুলিশ তৎপরতা না বাড়ালে সেখানকার অপরাধ চলতেই থাকবে।
৬. বছরের আলোচিত একটি হত্যাকাণ্ড ছিল প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারভেজ হত্যাকাণ্ড। শুধু হাসির ‘অপরাধে’ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাঁকে।
বাড্ডায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপির নেতা কামরুল আহসান সাধনকে। পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর এলাকায় ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পল্লবীতে একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে প্রবেশ করে মুখোশ ও হেলমেট পরা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়াকে। চট্টগ্রামে চলন্ত প্রাইভেট কার থামিয়ে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে বিএনপি-সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কারণ নাকি ব্যবসায়িক বা ব্যক্তিগত শত্রুতা রয়েছে—সবই জটিল রহস্যে মুড়ে আছে।
লক্ষ্মীপুরে বিএনপির নেতা বেলাল হোসেনের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে তাঁর দুই সন্তানের মৃত্যু পুরো দেশকেই মর্মাহত করেছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে হত্যা করে ও লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা বর্বরতার সব মাত্রা যেন ছাড়িয়ে গেছে। কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার লাশ পুড়িয়ে তথাকথিত মব কী অর্জন করতে পেরেছে, তা এক রহস্য। মবের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সংবাদমাধ্যমও। একটুর জন্য রক্ষা পেয়েছে সংবাদকর্মীরা।
নাটকীয় কায়দায় যেভাবে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে দিনদুপুরে গুলি করা হলো, তা এই বছরটির জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাদির মৃত্যুর পর সারা দেশ এখনো জনরোষে ফুঁসছে, বিচার চাইছে সবাই। কিন্তু বিচার কার হবে? পলাতক হত্যাকারীকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা হোক। তবেই না হবে বিচার।
৭. ২০২৫ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা কোনটি? এর উত্তরে বলতে হয়—বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ৬ হাজার ৩১৪ দিন পর দেশে ফিরেছেন। ফিরেই মাটির স্পর্শ নিয়েছেন। জানিয়েছেন দেশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা। তাঁকে সংবর্ধনা দিতে মানুষের যে ঢল নেমেছিল ঢাকার পূর্বাচলের পথে, তা প্রত্যাবর্তনের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য বলে মেনে নিতে হয়।
আবার সেই নির্বাচনে ফিরে আসা যাক। তারেক রহমানের আগমনে দেশের রাজনৈতিক পট কতটা আর কীভাবে পরিবর্তন হবে, তা সময় বলে দেবে। নির্বাচনের ওপর কেমন আর কতটা প্রভাব পড়বে, তা-ও সময়ই বলে দেবে। কিন্তু নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন এ বছর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা কিংবা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা নতুন বছরে ঠেকানো যাবে কি না। কারণ,
দেশের হাল যাঁরা ধরবেন, দেশ ও জনগণের নিরাপত্তা তো তাঁদেরই হাতে থাকবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তাঁরা থাকবেন জনগণের হৃদয়ে। হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া কি খুব কঠিন?
লেখক: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে। এই চিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য হলো নির্বাচনের ব্যয়।
সুস্থ গণতন্ত্রের প্রধান অন্তরায় হলো টাকার রাজনীতি। নির্বাচনী ব্যয় যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দুর্নীতি রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কারণ, নির্বাচনের পেছনে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, বিজয়ীরা ক্ষমতায় গিয়ে সুদে-আসলে সেই অর্থ জনগণের পকেট থেকেই আদায় করার চেষ্টা করেন।
নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশন অনেকগুলো যুগোপযোগী সুপারিশ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) এই সুপারিশগুলোর একটি বড় অংশই উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করে নিবিড় নজরদারি করার প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়া একটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি করতে পারে ভবিষ্যতে।
‘মনোনয়ন-বাণিজ্যের’ মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যয় বৃদ্ধির সংস্কৃতি আগে থেকেই শিকড় গেড়ে আছে। যখন একজন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন এবং নির্বাচনে লড়েন, তখন জনসেবা নয় বরং ‘বিনিয়োগের মুনাফা’ তোলাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এসব বিষয় উপেক্ষার কারণে ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হওয়া নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় ঐক্যেরও কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন কমিশন এবং সরকারকে বুঝতে হবে যে, লোকদেখানো সংস্কার দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশগুলো দিয়েছে, তা কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রায়ণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা না গেলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
দেশের সচেতন মানুষের প্রত্যাশা ছিল, এবার হয়তো নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা আমূল সংস্কার করা সম্ভব হবে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের বৈঠকে বিভিন্ন দলের নেতাদের মতামত নেওয়ার জন্য চা-নাশতা বাবদ রাষ্ট্রের টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যে আসেনি, তা পরবর্তী সময়ে কমিশনের রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হওয়া গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে নির্বাচনের পরে সেগুলো নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার কোনো বিলাসিতার বিষয় নয়। এটি রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার অপরিহার্য শর্ত। সরকারকে নির্বাচনী ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে এবং সংস্কার কমিশনের বাকি সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে একটি প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করতে হবে। অন্যথায় ভোটের নামে অর্থের খেলা চলবেই এবং দুর্নীতি নামক দানবটি আমাদের শাসনব্যবস্থাকে কুরে কুরে খেতে থাকবে।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৯ ঘণ্টা আগে
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৯ ঘণ্টা আগে
অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশের হাল ধরার পর থেকেই নির্বাচন নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলেছে। বাড়ির খাবার টেবিল থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে মুরব্বিদের আড্ডায় এ নিয়ে নানা জটিল প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না গেলেও ২০২৫ সালের শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা মোটামুটি জোর কণ্ঠেই বলে গেছেন...
১৯ ঘণ্টা আগে
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার: অগ্রগতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বাস্তবতার এক করুণ চিত্র উঠে এসেছে।
১৯ ঘণ্টা আগে