গৌতম ভদ্র

তরবো (অ) পি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।
—যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ
১
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বঙ্গের বাখরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় অবস্থিত) এলাকার সিদ্ধকাঠি গ্রামে গুহ-বকসীদের খাস তালুকদার বংশে রণজিৎ গুহর জন্ম। গ্রামের নামে অনুষঙ্গে জড়িত বৌদ্ধতন্ত্র, গ্রাম সমাজ একেবারে আধা-সামন্ততান্ত্রিক। তবে বংশে ঠাকুরদা পণ্ডিত ও শিক্ষক, বাবা পেশায় আইনজীবী। একশো বছর পরেই অস্ট্রিয়াবাসী, অথচ আদ্যন্ত বাঙালি বলে গর্বিত রণজিৎ গুহর স্মৃতিতে সেই কুলজি-চিহ্ন মুছে যায়নি। তাঁর সাম্প্রতিকতম রচনায় শৈশবের কালকেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘ফর্ম্যাটিভ পিরিয়ড’ বলেছেন। ‘বরিশালনামা’ তো নানা স্মরণীয় বাঙালের কথাকীর্তিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু রণজিৎ গুহর তুলনায় অন্য কারও জীবন, চরিত্র ও রচনা এত বিতর্কিত, এত রঙ্গিবিরঙ্গি নয়, দেশ-বিদেশে, ব্যক্তি ও সমূহের বহুধা সম্পর্কের টানাপড়েনে ছড়িয়ে পড়েনি। শতায়ুজীবীর প্রতি এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি তাঁর জীবনী নয়; তাঁর বিশাল চিন্তনকর্মের পর্যালোচনা দূর অস্ত্। এই নিবেদনটি কেবল এক অনন্য মেধাজীবীর অনুসন্ধিৎসার অভিমুখ, বাঁকবদল ও তাঁর ত্রি-পর্বী লেখালিখির পরিচয়ের রৈখিক খসড়ামাত্র।
সিদ্ধকাঠির এক খাটুলি পরিবারের নগা রণজিৎ গুহর শৈশব সুহৃদ, আবার ওই সব পরিবারের বয়স্করাই বাড়ির প্রজা, হয় দলিত, নয় মুসলমান। এই মনিব-প্রজা দ্বন্দ্বের (উভয়ার্থে) বোধটি যৌবনের ইতিহাসচর্চায় ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যরূপে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়। তারই প্রকাশ দেখি ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম ভূমি আইন চিন্তার উপর তাঁর লেখা বোধি-উজ্জ্বল সন্দর্ভটিতে, যার নাম ‘আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দি আইডিয়া অব পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ (প্যারিস ১৯৬৩ /নিউ দিল্লি ১৯৮২)। নানা কায়েমি স্বার্থের বিরোধের কথা ও ধন লুট করার সরল ইতিবৃত্তের বাইরে তিনি দেখালেন কোম্পানির আমলাদের নানা তর্কের মধ্যে কীভাবে ফিজ়িয়োক্র্যাসি বা প্রাকৃত ধনবাদী ভূমিতত্ত্ব বাংলায় বিনিয়োগনিষ্ঠ, উন্নতিকামী অথচ বশংবদ ভূম্যধিকারী সম্প্রদায় গড়তে চেয়েছিল। অথচ বাস্তবে জন্ম নিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খাজনাগৃধ্নু, নানা স্তরে বিভক্ত, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীর দল। উপনিবেশে প্রবুদ্ধ ইউরোপীয় জ্ঞানের এ-হেন আকারপ্রাপ্তিকে রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যাস’ বা ‘এপিস্টেমোলজিক্যাল ভায়োলেন্স’; তাঁর প্রাকৃত লব্জে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এক ‘ত্রিশঙ্কুর জগৎ’ তৈরি করল—উন্নতির ইচ্ছা ও জ্ঞানফল উল্টোমুখী হতে চলল। দ্বিতীয়ত, তাঁর সন্দর্ভে স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যের যুগে জ্ঞানতত্ত্বের নির্মিতিতে ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার জগৎ ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাওয়া জ্ঞানধারণা একেবারে জড়াপট্টি, ইতরেতর সম্বন্ধে আবদ্ধ। আজ এ কথাটা সবাই জানে ও মানে। কিন্তু সে দিন জ্ঞানতত্ত্বের এই ইতিহাসচিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন রণজিৎ গুহই।
এই সন্দর্ভের অনুষঙ্গে লেখা হয়েছিল এক রাশ প্রবন্ধ, যেমন মেদিনীপুরের লবণ শিল্পে মলঙ্গী তথা লবণ উৎপাদকদের প্রতিরোধ আন্দোলনের বিশ্লেষণী ইতিবৃত্ত থেকে স্থানীয় আর্কাইভস ব্যবহার করে বর্ধমান জেলার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিবরণী। স্বদেশের ইতিবৃত্তে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতের আদি স্পন্দনগুলি রণজিৎ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি দৈশিক ও কালিক অভিজ্ঞতার সতত উপস্থিতিকে কোনও দিন ভোলেননি।
লিখনশৈলীর জন্য প্রশংসিত হলেও আ রুল অব প্রপার্টি প্রথাসম্মত ইতিহাস আলোচক ও দরবারি মার্ক্সবাদীদের কাছে আদৃত হয়নি। ঘটনার প্রবাহে ১৯৫৯-এ ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এ অধ্যাপনার কাজে রত হওয়ার পরও রণজিৎ গুহ থাকবন্দি ঔপনিবেশিক সমাজে শাসকের সর্বেশ্বরতার ক্ষমতাসীমা ও বিন্যাস নিয়ে ভাবনা থামাননি, সেই ভাবনাসূত্রে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের গণতন্ত্রে চিন্তার পরিসরে ঔপনিবেশিকতার দায়ভারের সজীব অস্তিত্বকে দাগাতে শুরু করেছিলেন। ইতিহাস-চিন্তায় বাঁক নেওয়ার সেই প্রস্তুতি-পর্বের স্ফুরণ দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকের ফ্রন্টিয়ার-এর মতো রাজনৈতিক পত্রিকায় লেখা তিনটি প্রবন্ধে। যেমন- উদারনৈতিক সংস্কারচিন্তা ও সদিচ্ছায় আবদ্ধ নীলদর্পণ-এর মতো নাটকে বিদ্রোহী চৈতন্যের ‘ভদ্রস্থ’ উপস্থাপনের সমালোচনা, গণতন্ত্রের সুভদ্র সংস্কৃতিতে নির্মম পুলিশি অত্যাচারের তীক্ষ্ণ ব্যাখ্যা আর জেলে আটক মেরি টাইটলার- এর দেখা ভারতীয় সমাজে জারিত সন্ত্রাসের বিবরণীর এক মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ।
১৯৭০-৭১ সালে গান্ধীর গণ-আন্দোলনের স্বরূপ-সন্ধানে গবেষণা করতে ভারতে এসে নকশালবাড়ির রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর গবেষণার অভিমুখ পাল্টে গেল। সৃজনশীল ইতিহাসচর্চার দ্বিতীয় পর্বে তাঁর ক্রিয়াকর্ম দুটি শাখায় প্রসারিত হল। প্রথমত, কয়েক জন অতি-তরুণ গবেষককে জড়ো করে তিনি ‘নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চা’র ধারা প্রবর্তন করলেন। উদ্দেশ্য—ভারতে চালু আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার আদিকল্পের বিরুদ্ধে নতুন এক আদিকল্পের অনুসন্ধান করা। ১৯৮০ সালে তাঁর বহুচর্চিত ও বিতর্কিত ইংরেজি ম্যানিফেস্টো ও বাংলা প্রবন্ধে বলা হল যে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রে আছে রাষ্ট্রিকতা, সেই ইতিহাসবিদ্যা আসলে ‘বকলমে’ লেখা রাষ্ট্রশক্তির ইতিকথা, ইংরেজ শাসনজাত প্রগতি ও সভ্যতার পক্ষে নানা ধাঁচের বৃত্তান্ত। অন্য পক্ষে, সমালোচনাত্মক জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চাও পর্যবসিত হয়েছে দেশজ উচ্চবর্গের আদর্শবাদের মহিমাগাথায় ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাফল্যের নান্দীপাঠে। এই দ্বিবিধ উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের ক্রিয়াকাণ্ডের বৃত্তান্ত যে গরহাজির, তা কিন্তু একদম নয়। কিন্তু সেই বৃত্তান্ত উচ্চবর্গীয় উদ্যোগ আখ্যানের অনুপর্ব মাত্র, কালু ডোমরা চিরকাল যেন প্রভুর জন্য প্রাণদান করে।
এই ধারণার বিরুদ্ধে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা’র আদিকল্প ভারতীয় রাজনীতির জগৎকে দু’টি বর্গের রাজনীতিক্ষেত্রে বিভক্ত করল। দমনকারী ও দমিতের ক্ষমতার বৈপরীত্যের নানা সূত্র ধরে কর্ম ও মানসজগতে নিম্নবর্গের আনুগত্য, সহকারিতা ও প্রতিবাদের রূপগুলি তুলে ধরল। অবশ্যই উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতি সময় বুঝে প্রতিচ্ছেদিত হতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে স্ব-উদ্যোগ আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি সমাজের বেণিবন্ধন গড়তে পারে। সময় বুঝে ওই বন্ধনের গিঁটগুলি আলগা হয়, এমনকি খুলেও যায়। তবে দুই ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য অবশ্যধার্য। রণজিৎ গুহ প্রণোদিত ও বোধিত ‘নিম্নবর্গের চর্চা’ বলে নামাঙ্কিত নিবন্ধখণ্ডগুলিতে এই সতত সঞ্চারমাণ রাজনীতির কথন ও লেখনই তরুণ গবেষকরা সম্পন্ন করতে শুরু করলেন।
এই যৌথকর্মের সঙ্গে শ্লিষ্ট তাঁর লেখা বহুবিতর্কিত বই এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়াতে (১৯৮৩) এল ভারতের কৃষক বিদ্রোহের মুহূর্তগুলি, আর তার তুলনাসূত্রে, ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহ ও চিনের কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা। বিদ্রোহী চৈতন্যে জাত কর্মকাণ্ডের কাঠামোয় রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাবনার সাধারণ লক্ষণগুলি চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে, এই চৈতন্যের সাধারণ রূপ-লক্ষণগুলি প্রকীর্ণ থাকে জীবনযাপনের নানা ক্রিয়ায়। এই রূপ-লক্ষণগুলির সংহত ও জ্বলন্ত স্ফুরণ ঘটে কৃষক উপপ্লবের নানা ছোটবড় ঢেউয়ে, সরকার-সাহুকার-জমিদারের ক্ষমতাবিন্যাসের মৌহূর্তিক বিপর্যাসে। এই বিশ্লেষণী ছকে রণজিৎ জানালেন যে, কৃষক বিদ্রোহ শুধু কার্যকারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ অর্থনৈতিক বা সামাজিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ‘প্রাক্-রাজনৈতিক ভাবনা’র প্রকাশ নয়। বরং চরিত্রে তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক—সার্বিক ক্ষমতাবিন্যাসকে উল্টে দেওয়ার ঈপ্সা থেকে জাত। দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহী কৃষক সমাবেশের বা স্ব-উদ্যোগের ভিত্তি হল কোনও না কোনও সামূহিকতার বোধ। কৌম সম্বন্ধে, আঞ্চলিক সন্নিহিতি বা জাতপাত বিন্যাসে, গোষ্ঠীগত শ্রম অভ্যাসে, ধার্মিকতার ধারণায়, বা শ্রেণি-সংবিদে এই সামূহিকতার বোধ নিহিত থাকে। একাধিক সূত্রের টানে বোধটি ক্রিয়াশীল হয়, একমাত্রিকতার টানকে ছাপিয়ে যায়, সংহতির বার্তা ও অভিমুখে তার সরণ ঘটে।
রণজিৎ গুহ জানেন যে কোনও ঘটনা-বিশেষের অবয়বে ও ব্যক্তি-সংবেদনার কালিক অভিজ্ঞতায় সাধারণ লক্ষণের ঐতিহাসিকত্ব রক্ষা পায়, বিশেষের প্রেক্ষিতে ও প্রাখর্যে সাধারণ লক্ষণ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই বিদ্রোহী চৈতন্যের সাধারণ লাক্ষণিক কাঠামো গ্রন্থনের ফাঁকফোকরে আখ্যান নির্মাণের আদি রীতিটি তিনি ত্যাগ করেননি। এলিমেন্টারি আসপেক্ট-এ ‘হুল’-এর চরিত্রবিচারে, ভাগনা মাঝি ও ডোমন দারোগার শোধ ও প্রতিশোধের রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণিত হয় অনুপুঙ্খে। রাহুর পৌরাণিক কথার পার্থিব উদ্যাপনের মুহূর্তে, গ্রহণের ক্ষণে, বামুনদের ছুতমার্গী আচার ও শুদ্ধতা রক্ষার বিপরীতে দলিত মুসাহারদের উল্লাস ও আবাহনের বিবৃতি সামাজিক চৈতন্যের নানা স্তরের সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেয়। আবার রাঢ় অঞ্চলে অনুশাসনে দীর্ণ গ্রামসমাজে চাষির মেয়ে মৃত চন্দ্রার গর্ভপাতের মামলায় এজাহারে ধৃত নারীদের সংহতিবার্তা, বাঁচা ও বাঁচানোর আকুতির কথাকাহিনিতে দলিত গোষ্ঠী ও অবদমিত মানবীদের ঐকান্তিক অনুভূতির সহজ স্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতির সূত্রেই নগা, ঢোঁড়াই বা বাঘারুদের জীবনচর্চা ও চৈতন্যের বিশ্লেষণনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ্যা মানবিকতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠল।
কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে। এবং তাঁর সেই ভাবনার সেরা ফসল পাওয়া গেল বাংলা ভাষায় লেখা একাধিক মৌলিক প্রবন্ধের সঙ্কলনে, দুই খণ্ডের রচনাসংগ্রহতে (আনন্দ, ২০১৯)।
রণজিৎ গুহর মতে, মানুষ সত্তাময় জীব। এই সত্তাময়তার প্রকাশই মানুষী চৈতন্য, সেই চৈতন্যের উচ্চারণ ভাষা-ভাবনায় বিধৃত হয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষা-ভাবনার ত্রিভুজে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ্যার রূপানুসন্ধান প্রসারিত হল মানবিক অভিজ্ঞতার ভিন্ন অবয়বে, নিছক কার্যকারণ অন্বিত যুক্তিবোধ থেকে রসগ্রাহী সাহিত্য-আলাপে। এ বারের অন্বেষায় তিনি জানালেন যে, কোনও এক অতীতকালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও এক সমূহের অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া হল ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ইতিহাসবিদের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের আকার নেয়। সদৃশার্থে নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতাও অনুভূতি-সচেতন কবি-সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাসিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয় সংবাদী করে তোলে।
ওয়াকিবহাল পাঠক জানেন যে, তাঁর পূর্বতন রচনায় ইউরোপীয় সমাজবিজ্ঞান থেকে আহৃত ‘ইমপ্রুভমেন্ট’, ‘লয়্যালটি’, ‘হেজেমনি’ ইত্যাদি ধারণার প্রতিপার্শ্বে তিনি দণ্ড, ধর্ম, ভক্তি ও অতিদেশ-এর মতো দেশজ জ্ঞান ও ব্যবহার কাণ্ডের ধারণাগুলিকে সমমর্যাদায় স্থান দিয়েছেন, মোকাবিলায় দুই গোত্রের ধারণার ঠাঁই নড়ে গিয়ে নতুন বিশ্লেষণী পরিসর তৈরি হয়েছে। বাংলা প্রবন্ধাবলিতে তিনি ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শনচিন্তার নানা ভাবনাবীজকে আত্মস্থ করে গবেষণার বিচার-অভিমুখকে বিশ্বমুখী করে তুললেন; যেমন, ভবভূতির ঔপচারিক বৃত্তির সৃজনশীল প্রয়োগ তাঁর মীমাংসাকে অনন্য প্রাখর্য দিল। দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের ঈপ্সিত ভারতীয় মননে স্বরাজসাধনার সিদ্ধপুরুষ রণজিৎ গুহ।
বাংলায় লেখা এই মৌলিক প্রবন্ধগুলির বিষয়গত ঝোঁক দ্বিমুখী। এক পক্ষে, পর্ব থেকে পর্বান্তরে সময়বোধ ও প্রকৃতিবোধের চলাচলের পথে সৃষ্টিশীল অহং-এর প্রসার ও পুষ্টির বিচার চলতে থাকে। খোঁজের সূত্র ছড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রি-গীত’-এর পাঠে, কখনও বা জীবনানন্দের সময়লগ্নতা থেকে বিভূতিভূষণের ঋতবোধের আলোচনায়, কখনও বা রবীন্দ্র-উত্তর কাব্যের তিন আধুনিক কবির কবিরূপের বিশ্লেষণে। অন্য পক্ষে, আমাদের আধুনিকতার কুলজি বিচারে তিনি সমত্ববোধ ও সামাজিক সমানুভূতির ছাপ-ছোপকে ঠাহর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্লেষণী নজরে ধরা পড়ে, কী ভাবে রামমোহনের শাস্ত্রবিচার ও হিতবাদী দর্শনে পুষ্ট যুক্তিবোধটি দেশজ সমাজের গহনে ক্রিয়াময় দয়া-ধর্মের ছোঁয়া পায়, আর তৈরি হয় সংবেদনশীলতার নবানুভূতি।
‘আদি কবি আর প্রথম পাঠক: একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকারের কাহিনি’ নামে এতাবৎকাল সম্পূর্ণ অনালোচিত প্রবন্ধ বলে, রাষ্ট্রসর্বস্বতার বাইরে কাব্যকথার টানে কী ভাবে সামূহিকতার ইতিহাসবোধ জ্ঞানচেতনার ঐতিহ্যে শিকড়ের কথা। প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই তো সভ্যতার ভিত্তি।
যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে। ‘শেষ তর্পণ’ বলে মহাভারতীয় আখ্যানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় রণজিৎ দেখান যে, কুরুক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে সব মানবজাতির ইতিহাসে। কেবল আনৃশংস্য হওয়ার সাধ নয়, অনুকম্পা ও শোচনায় মানুষের মানবিক হওয়ার শেষ ভরসাটুকু জিয়ানো থাকে।
রাজনীতি থেকে মানবনীতির এ-হেন অন্বেষার অক্ষে ‘গ্লোবাল’ ও ‘লোকাল’-এর ভেদ তুচ্ছ হয়ে পড়ে। চৈতন্যের ইতিবৃত্ত রচনার কাছে নিবেদিত এক বাঙালি মেধাজীবীর মমত্ববোধ বহুজনীন হয়ে ওঠে। নানা কাল ও নানা দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বেদনাবোধ সংলগ্ন হতে চায়। সংবেদনশীলতার চর্চা ও লগ্নতার আকাঙ্ক্ষার আধারেই মেধাজীবীর দায়কে রণজিৎ গুহ অনুক্ষণ স্বীকার করেন।
ভাল থাকবেন, রণজিৎদা।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ও সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গতবছর রণজিৎ গুহর ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। উপযোগিতা বিবেচনায় শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।)

তরবো (অ) পি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ।
স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি।।
—যোগবাশিষ্ঠ রামায়ণ
১
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বঙ্গের বাখরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় অবস্থিত) এলাকার সিদ্ধকাঠি গ্রামে গুহ-বকসীদের খাস তালুকদার বংশে রণজিৎ গুহর জন্ম। গ্রামের নামে অনুষঙ্গে জড়িত বৌদ্ধতন্ত্র, গ্রাম সমাজ একেবারে আধা-সামন্ততান্ত্রিক। তবে বংশে ঠাকুরদা পণ্ডিত ও শিক্ষক, বাবা পেশায় আইনজীবী। একশো বছর পরেই অস্ট্রিয়াবাসী, অথচ আদ্যন্ত বাঙালি বলে গর্বিত রণজিৎ গুহর স্মৃতিতে সেই কুলজি-চিহ্ন মুছে যায়নি। তাঁর সাম্প্রতিকতম রচনায় শৈশবের কালকেই তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘ফর্ম্যাটিভ পিরিয়ড’ বলেছেন। ‘বরিশালনামা’ তো নানা স্মরণীয় বাঙালের কথাকীর্তিতে সমুজ্জ্বল। কিন্তু রণজিৎ গুহর তুলনায় অন্য কারও জীবন, চরিত্র ও রচনা এত বিতর্কিত, এত রঙ্গিবিরঙ্গি নয়, দেশ-বিদেশে, ব্যক্তি ও সমূহের বহুধা সম্পর্কের টানাপড়েনে ছড়িয়ে পড়েনি। শতায়ুজীবীর প্রতি এই শ্রদ্ধার্ঘ্যটি তাঁর জীবনী নয়; তাঁর বিশাল চিন্তনকর্মের পর্যালোচনা দূর অস্ত্। এই নিবেদনটি কেবল এক অনন্য মেধাজীবীর অনুসন্ধিৎসার অভিমুখ, বাঁকবদল ও তাঁর ত্রি-পর্বী লেখালিখির পরিচয়ের রৈখিক খসড়ামাত্র।
সিদ্ধকাঠির এক খাটুলি পরিবারের নগা রণজিৎ গুহর শৈশব সুহৃদ, আবার ওই সব পরিবারের বয়স্করাই বাড়ির প্রজা, হয় দলিত, নয় মুসলমান। এই মনিব-প্রজা দ্বন্দ্বের (উভয়ার্থে) বোধটি যৌবনের ইতিহাসচর্চায় ও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্যরূপে দেশ-বিদেশে কাজ করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়। তারই প্রকাশ দেখি ঔপনিবেশিক বাংলার প্রথম ভূমি আইন চিন্তার উপর তাঁর লেখা বোধি-উজ্জ্বল সন্দর্ভটিতে, যার নাম ‘আ রুল অব প্রপার্টি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দি আইডিয়া অব পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট’ (প্যারিস ১৯৬৩ /নিউ দিল্লি ১৯৮২)। নানা কায়েমি স্বার্থের বিরোধের কথা ও ধন লুট করার সরল ইতিবৃত্তের বাইরে তিনি দেখালেন কোম্পানির আমলাদের নানা তর্কের মধ্যে কীভাবে ফিজ়িয়োক্র্যাসি বা প্রাকৃত ধনবাদী ভূমিতত্ত্ব বাংলায় বিনিয়োগনিষ্ঠ, উন্নতিকামী অথচ বশংবদ ভূম্যধিকারী সম্প্রদায় গড়তে চেয়েছিল। অথচ বাস্তবে জন্ম নিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের খাজনাগৃধ্নু, নানা স্তরে বিভক্ত, জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীর দল। উপনিবেশে প্রবুদ্ধ ইউরোপীয় জ্ঞানের এ-হেন আকারপ্রাপ্তিকে রণজিৎ গুহ বলেছেন ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক বিপর্যাস’ বা ‘এপিস্টেমোলজিক্যাল ভায়োলেন্স’; তাঁর প্রাকৃত লব্জে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এক ‘ত্রিশঙ্কুর জগৎ’ তৈরি করল—উন্নতির ইচ্ছা ও জ্ঞানফল উল্টোমুখী হতে চলল। দ্বিতীয়ত, তাঁর সন্দর্ভে স্পষ্ট যে সাম্রাজ্যের যুগে জ্ঞানতত্ত্বের নির্মিতিতে ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার জগৎ ও ঔপনিবেশিক শাসন থেকে পাওয়া জ্ঞানধারণা একেবারে জড়াপট্টি, ইতরেতর সম্বন্ধে আবদ্ধ। আজ এ কথাটা সবাই জানে ও মানে। কিন্তু সে দিন জ্ঞানতত্ত্বের এই ইতিহাসচিন্তার পথিকৃৎ ছিলেন রণজিৎ গুহই।
এই সন্দর্ভের অনুষঙ্গে লেখা হয়েছিল এক রাশ প্রবন্ধ, যেমন মেদিনীপুরের লবণ শিল্পে মলঙ্গী তথা লবণ উৎপাদকদের প্রতিরোধ আন্দোলনের বিশ্লেষণী ইতিবৃত্ত থেকে স্থানীয় আর্কাইভস ব্যবহার করে বর্ধমান জেলার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিবরণী। স্বদেশের ইতিবৃত্তে ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতের আদি স্পন্দনগুলি রণজিৎ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনায় তিনি দৈশিক ও কালিক অভিজ্ঞতার সতত উপস্থিতিকে কোনও দিন ভোলেননি।
লিখনশৈলীর জন্য প্রশংসিত হলেও আ রুল অব প্রপার্টি প্রথাসম্মত ইতিহাস আলোচক ও দরবারি মার্ক্সবাদীদের কাছে আদৃত হয়নি। ঘটনার প্রবাহে ১৯৫৯-এ ইংল্যান্ডে ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এ অধ্যাপনার কাজে রত হওয়ার পরও রণজিৎ গুহ থাকবন্দি ঔপনিবেশিক সমাজে শাসকের সর্বেশ্বরতার ক্ষমতাসীমা ও বিন্যাস নিয়ে ভাবনা থামাননি, সেই ভাবনাসূত্রে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের গণতন্ত্রে চিন্তার পরিসরে ঔপনিবেশিকতার দায়ভারের সজীব অস্তিত্বকে দাগাতে শুরু করেছিলেন। ইতিহাস-চিন্তায় বাঁক নেওয়ার সেই প্রস্তুতি-পর্বের স্ফুরণ দেখা যায় ১৯৭০-এর দশকের ফ্রন্টিয়ার-এর মতো রাজনৈতিক পত্রিকায় লেখা তিনটি প্রবন্ধে। যেমন- উদারনৈতিক সংস্কারচিন্তা ও সদিচ্ছায় আবদ্ধ নীলদর্পণ-এর মতো নাটকে বিদ্রোহী চৈতন্যের ‘ভদ্রস্থ’ উপস্থাপনের সমালোচনা, গণতন্ত্রের সুভদ্র সংস্কৃতিতে নির্মম পুলিশি অত্যাচারের তীক্ষ্ণ ব্যাখ্যা আর জেলে আটক মেরি টাইটলার- এর দেখা ভারতীয় সমাজে জারিত সন্ত্রাসের বিবরণীর এক মর্মস্পর্শী বিশ্লেষণ।
১৯৭০-৭১ সালে গান্ধীর গণ-আন্দোলনের স্বরূপ-সন্ধানে গবেষণা করতে ভারতে এসে নকশালবাড়ির রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তাঁর গবেষণার অভিমুখ পাল্টে গেল। সৃজনশীল ইতিহাসচর্চার দ্বিতীয় পর্বে তাঁর ক্রিয়াকর্ম দুটি শাখায় প্রসারিত হল। প্রথমত, কয়েক জন অতি-তরুণ গবেষককে জড়ো করে তিনি ‘নিম্নবর্গ ইতিহাসচর্চা’র ধারা প্রবর্তন করলেন। উদ্দেশ্য—ভারতে চালু আধুনিক ইতিহাসবিদ্যার আদিকল্পের বিরুদ্ধে নতুন এক আদিকল্পের অনুসন্ধান করা। ১৯৮০ সালে তাঁর বহুচর্চিত ও বিতর্কিত ইংরেজি ম্যানিফেস্টো ও বাংলা প্রবন্ধে বলা হল যে, আধুনিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রে আছে রাষ্ট্রিকতা, সেই ইতিহাসবিদ্যা আসলে ‘বকলমে’ লেখা রাষ্ট্রশক্তির ইতিকথা, ইংরেজ শাসনজাত প্রগতি ও সভ্যতার পক্ষে নানা ধাঁচের বৃত্তান্ত। অন্য পক্ষে, সমালোচনাত্মক জাতীয়তাবাদী, এমনকি মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চাও পর্যবসিত হয়েছে দেশজ উচ্চবর্গের আদর্শবাদের মহিমাগাথায় ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাফল্যের নান্দীপাঠে। এই দ্বিবিধ উচ্চবর্ণকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় নিম্নবর্গের ক্রিয়াকাণ্ডের বৃত্তান্ত যে গরহাজির, তা কিন্তু একদম নয়। কিন্তু সেই বৃত্তান্ত উচ্চবর্গীয় উদ্যোগ আখ্যানের অনুপর্ব মাত্র, কালু ডোমরা চিরকাল যেন প্রভুর জন্য প্রাণদান করে।
এই ধারণার বিরুদ্ধে ‘নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা’র আদিকল্প ভারতীয় রাজনীতির জগৎকে দু’টি বর্গের রাজনীতিক্ষেত্রে বিভক্ত করল। দমনকারী ও দমিতের ক্ষমতার বৈপরীত্যের নানা সূত্র ধরে কর্ম ও মানসজগতে নিম্নবর্গের আনুগত্য, সহকারিতা ও প্রতিবাদের রূপগুলি তুলে ধরল। অবশ্যই উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতি সময় বুঝে প্রতিচ্ছেদিত হতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে স্ব-উদ্যোগ আড়াআড়ি ও খাড়াখাড়ি সমাজের বেণিবন্ধন গড়তে পারে। সময় বুঝে ওই বন্ধনের গিঁটগুলি আলগা হয়, এমনকি খুলেও যায়। তবে দুই ক্ষেত্রের স্বাতন্ত্র্য অবশ্যধার্য। রণজিৎ গুহ প্রণোদিত ও বোধিত ‘নিম্নবর্গের চর্চা’ বলে নামাঙ্কিত নিবন্ধখণ্ডগুলিতে এই সতত সঞ্চারমাণ রাজনীতির কথন ও লেখনই তরুণ গবেষকরা সম্পন্ন করতে শুরু করলেন।
এই যৌথকর্মের সঙ্গে শ্লিষ্ট তাঁর লেখা বহুবিতর্কিত বই এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজ়্যান্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়াতে (১৯৮৩) এল ভারতের কৃষক বিদ্রোহের মুহূর্তগুলি, আর তার তুলনাসূত্রে, ইউরোপের কৃষক বিদ্রোহ ও চিনের কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা। বিদ্রোহী চৈতন্যে জাত কর্মকাণ্ডের কাঠামোয় রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাবনার সাধারণ লক্ষণগুলি চিহ্নিত করলেন। তাঁর মতে, এই চৈতন্যের সাধারণ রূপ-লক্ষণগুলি প্রকীর্ণ থাকে জীবনযাপনের নানা ক্রিয়ায়। এই রূপ-লক্ষণগুলির সংহত ও জ্বলন্ত স্ফুরণ ঘটে কৃষক উপপ্লবের নানা ছোটবড় ঢেউয়ে, সরকার-সাহুকার-জমিদারের ক্ষমতাবিন্যাসের মৌহূর্তিক বিপর্যাসে। এই বিশ্লেষণী ছকে রণজিৎ জানালেন যে, কৃষক বিদ্রোহ শুধু কার্যকারণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ অর্থনৈতিক বা সামাজিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ‘প্রাক্-রাজনৈতিক ভাবনা’র প্রকাশ নয়। বরং চরিত্রে তা আদ্যন্ত রাজনৈতিক—সার্বিক ক্ষমতাবিন্যাসকে উল্টে দেওয়ার ঈপ্সা থেকে জাত। দ্বিতীয়ত, বিদ্রোহী কৃষক সমাবেশের বা স্ব-উদ্যোগের ভিত্তি হল কোনও না কোনও সামূহিকতার বোধ। কৌম সম্বন্ধে, আঞ্চলিক সন্নিহিতি বা জাতপাত বিন্যাসে, গোষ্ঠীগত শ্রম অভ্যাসে, ধার্মিকতার ধারণায়, বা শ্রেণি-সংবিদে এই সামূহিকতার বোধ নিহিত থাকে। একাধিক সূত্রের টানে বোধটি ক্রিয়াশীল হয়, একমাত্রিকতার টানকে ছাপিয়ে যায়, সংহতির বার্তা ও অভিমুখে তার সরণ ঘটে।
রণজিৎ গুহ জানেন যে কোনও ঘটনা-বিশেষের অবয়বে ও ব্যক্তি-সংবেদনার কালিক অভিজ্ঞতায় সাধারণ লক্ষণের ঐতিহাসিকত্ব রক্ষা পায়, বিশেষের প্রেক্ষিতে ও প্রাখর্যে সাধারণ লক্ষণ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই বিদ্রোহী চৈতন্যের সাধারণ লাক্ষণিক কাঠামো গ্রন্থনের ফাঁকফোকরে আখ্যান নির্মাণের আদি রীতিটি তিনি ত্যাগ করেননি। এলিমেন্টারি আসপেক্ট-এ ‘হুল’-এর চরিত্রবিচারে, ভাগনা মাঝি ও ডোমন দারোগার শোধ ও প্রতিশোধের রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণিত হয় অনুপুঙ্খে। রাহুর পৌরাণিক কথার পার্থিব উদ্যাপনের মুহূর্তে, গ্রহণের ক্ষণে, বামুনদের ছুতমার্গী আচার ও শুদ্ধতা রক্ষার বিপরীতে দলিত মুসাহারদের উল্লাস ও আবাহনের বিবৃতি সামাজিক চৈতন্যের নানা স্তরের সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেয়। আবার রাঢ় অঞ্চলে অনুশাসনে দীর্ণ গ্রামসমাজে চাষির মেয়ে মৃত চন্দ্রার গর্ভপাতের মামলায় এজাহারে ধৃত নারীদের সংহতিবার্তা, বাঁচা ও বাঁচানোর আকুতির কথাকাহিনিতে দলিত গোষ্ঠী ও অবদমিত মানবীদের ঐকান্তিক অনুভূতির সহজ স্বীকৃতি আছে। এই স্বীকৃতির সূত্রেই নগা, ঢোঁড়াই বা বাঘারুদের জীবনচর্চা ও চৈতন্যের বিশ্লেষণনিষ্ঠ ইতিহাসবিদ্যা মানবিকতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠল।
কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে। এবং তাঁর সেই ভাবনার সেরা ফসল পাওয়া গেল বাংলা ভাষায় লেখা একাধিক মৌলিক প্রবন্ধের সঙ্কলনে, দুই খণ্ডের রচনাসংগ্রহতে (আনন্দ, ২০১৯)।
রণজিৎ গুহর মতে, মানুষ সত্তাময় জীব। এই সত্তাময়তার প্রকাশই মানুষী চৈতন্য, সেই চৈতন্যের উচ্চারণ ভাষা-ভাবনায় বিধৃত হয়। সত্তা, চৈতন্য ও ভাষা-ভাবনার ত্রিভুজে প্রকাশিত ইতিহাসবিদ্যার রূপানুসন্ধান প্রসারিত হল মানবিক অভিজ্ঞতার ভিন্ন অবয়বে, নিছক কার্যকারণ অন্বিত যুক্তিবোধ থেকে রসগ্রাহী সাহিত্য-আলাপে। এ বারের অন্বেষায় তিনি জানালেন যে, কোনও এক অতীতকালের অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের বোধিতে ধরা, কোনও এক গোষ্ঠীর প্রাত্যহিক খণ্ড অভ্যাসের বৈশিষ্ট্য থেকে বৃহত্তর কোনও এক সমূহের অভিজ্ঞানে উত্তরিত হওয়া হল ইতিহাসবিদ্যার ঈপ্সা। ইতিহাসবিদের চিন্তনে জাত যুক্তির বিন্যাসে ও লেখনী নিঃসৃত ভাষাসজ্জায় যাচাই করা তথ্যাবলি আকাঙ্ক্ষিত আখ্যানের আকার নেয়। সদৃশার্থে নিজস্ব ঐকান্তিক অভিজ্ঞতাও অনুভূতি-সচেতন কবি-সাহিত্যিক শব্দের ব্যঞ্জনায় ভাসিত ও প্রসারিত করে নানা দেশে ও কালে নিজের রচনাকে ভিন্ন ভিন্ন সহৃদয়ের হৃদয় সংবাদী করে তোলে।
ওয়াকিবহাল পাঠক জানেন যে, তাঁর পূর্বতন রচনায় ইউরোপীয় সমাজবিজ্ঞান থেকে আহৃত ‘ইমপ্রুভমেন্ট’, ‘লয়্যালটি’, ‘হেজেমনি’ ইত্যাদি ধারণার প্রতিপার্শ্বে তিনি দণ্ড, ধর্ম, ভক্তি ও অতিদেশ-এর মতো দেশজ জ্ঞান ও ব্যবহার কাণ্ডের ধারণাগুলিকে সমমর্যাদায় স্থান দিয়েছেন, মোকাবিলায় দুই গোত্রের ধারণার ঠাঁই নড়ে গিয়ে নতুন বিশ্লেষণী পরিসর তৈরি হয়েছে। বাংলা প্রবন্ধাবলিতে তিনি ধ্রুপদী ভারতীয় দর্শনচিন্তার নানা ভাবনাবীজকে আত্মস্থ করে গবেষণার বিচার-অভিমুখকে বিশ্বমুখী করে তুললেন; যেমন, ভবভূতির ঔপচারিক বৃত্তির সৃজনশীল প্রয়োগ তাঁর মীমাংসাকে অনন্য প্রাখর্য দিল। দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের ঈপ্সিত ভারতীয় মননে স্বরাজসাধনার সিদ্ধপুরুষ রণজিৎ গুহ।
বাংলায় লেখা এই মৌলিক প্রবন্ধগুলির বিষয়গত ঝোঁক দ্বিমুখী। এক পক্ষে, পর্ব থেকে পর্বান্তরে সময়বোধ ও প্রকৃতিবোধের চলাচলের পথে সৃষ্টিশীল অহং-এর প্রসার ও পুষ্টির বিচার চলতে থাকে। খোঁজের সূত্র ছড়িয়ে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘ত্রি-গীত’-এর পাঠে, কখনও বা জীবনানন্দের সময়লগ্নতা থেকে বিভূতিভূষণের ঋতবোধের আলোচনায়, কখনও বা রবীন্দ্র-উত্তর কাব্যের তিন আধুনিক কবির কবিরূপের বিশ্লেষণে। অন্য পক্ষে, আমাদের আধুনিকতার কুলজি বিচারে তিনি সমত্ববোধ ও সামাজিক সমানুভূতির ছাপ-ছোপকে ঠাহর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্লেষণী নজরে ধরা পড়ে, কী ভাবে রামমোহনের শাস্ত্রবিচার ও হিতবাদী দর্শনে পুষ্ট যুক্তিবোধটি দেশজ সমাজের গহনে ক্রিয়াময় দয়া-ধর্মের ছোঁয়া পায়, আর তৈরি হয় সংবেদনশীলতার নবানুভূতি।
‘আদি কবি আর প্রথম পাঠক: একটি পৌরাণিক সাক্ষাৎকারের কাহিনি’ নামে এতাবৎকাল সম্পূর্ণ অনালোচিত প্রবন্ধ বলে, রাষ্ট্রসর্বস্বতার বাইরে কাব্যকথার টানে কী ভাবে সামূহিকতার ইতিহাসবোধ জ্ঞানচেতনার ঐতিহ্যে শিকড়ের কথা। প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই তো সভ্যতার ভিত্তি।
যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে। ‘শেষ তর্পণ’ বলে মহাভারতীয় আখ্যানের নিজস্ব ব্যাখ্যায় রণজিৎ দেখান যে, কুরুক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে সব মানবজাতির ইতিহাসে। কেবল আনৃশংস্য হওয়ার সাধ নয়, অনুকম্পা ও শোচনায় মানুষের মানবিক হওয়ার শেষ ভরসাটুকু জিয়ানো থাকে।
রাজনীতি থেকে মানবনীতির এ-হেন অন্বেষার অক্ষে ‘গ্লোবাল’ ও ‘লোকাল’-এর ভেদ তুচ্ছ হয়ে পড়ে। চৈতন্যের ইতিবৃত্ত রচনার কাছে নিবেদিত এক বাঙালি মেধাজীবীর মমত্ববোধ বহুজনীন হয়ে ওঠে। নানা কাল ও নানা দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তাঁর বেদনাবোধ সংলগ্ন হতে চায়। সংবেদনশীলতার চর্চা ও লগ্নতার আকাঙ্ক্ষার আধারেই মেধাজীবীর দায়কে রণজিৎ গুহ অনুক্ষণ স্বীকার করেন।
ভাল থাকবেন, রণজিৎদা।
লেখক: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিদ ও সাবঅল্টার্ন স্টাডিজের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: গতবছর রণজিৎ গুহর ৯৯তম জন্মবার্ষিকীতে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। উপযোগিতা বিবেচনায় শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করে লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।)

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৭ ঘণ্টা আগে
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৭ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।
সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।
অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।
সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।
সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।
অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।
সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৭ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেজাহীদ রেজা নূর

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’
ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।
রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।
রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’
আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:
— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?
— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।
পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:
— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?
— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।
স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:
নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু
ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।
রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’
কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’
একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’
এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।
কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে
চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।
দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’
প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’
চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।
বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।
২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।
ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।
নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’
ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।
রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।
রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’
আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:
— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?
— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।
পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:
— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?
— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।
স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:
নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু
ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।
রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’
কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’
একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’
এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।
এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।
কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে
চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।
দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’
প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’
চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।
বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।
২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।
ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।
নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।
নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৭ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেশোয়েব সাম্য সিদ্দিক

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।
এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।
আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।
দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।
তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।
চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।
অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।
আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।
সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।
এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।
আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।
দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।
তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।
চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।
অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।
আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।
সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৭ ঘণ্টা আগে
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৭ ঘণ্টা আগে
বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।
আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।
বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।
আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

কোনও খোপে বেশি দিন আটকে থাকা চিন্তক রণজিৎ গুহের স্বভাব নয়। ১৯৯০-এর দশক থেকে আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ্যার সর্বেশ্বরতার প্রতিকামী চিন্তার চর্চার ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে গিয়ে তিনি হাজির হলেন সৃজনশীল ভাবনার অভিনব পরিসরে।
২৯ এপ্রিল ২০২৩
সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার...
১৭ ঘণ্টা আগে
নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি।
১৭ ঘণ্টা আগে
২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে।
১৭ ঘণ্টা আগে