Ajker Patrika

বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন

বাসস, ঢাকা  
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিশন। দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের কার্যক্রম এবং আটক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে কমিশন তাদের প্রতিবেদনে জানায়, ‘বাংলাদেশে গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা জনসমক্ষে একটি আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

সাবেক বিচারপতি মাইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের কমিশন সম্প্রতি ‘সত্য উদঘাটন’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে।

কমিশন জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এ বিষয়ে একটি জোরালো ইঙ্গিত রয়েছে যে কিছু বন্দি এখনো ভারতের জেলে থাকতে পারে।

কমিশন জানায়, ‘আমরা পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করছি যেন তারা ভারতে এখনো বন্দি অবস্থায় থাকাতে পরে এমন যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিককে খুঁজে বের করতে সাধ্যমত চেষ্টা করে। বাংলাদেশের সীমানার বাইরে এই বিষয়টি তদন্ত করা কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ।

প্রতিবেদনে উল্লেখিত দুটি বহুল আলোচিত ঘটনা গুমের এই কার্যক্রম কীভাবে পরিচালিত হয়েছিল তা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ সরবরাহ করে।

ঘটনা দুটির একটি হলো- বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে অপহৃত হয়ে ভারতীয় কারাগারে উপস্থিত হওয়া সুখরঞ্জন বালির ঘটনা এবং অপরটি হলো বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের ঘটনা।

এসব ঘটনার পাশাপাশি হুম্মাম কাদের চৌধুরী জানান, তার কারাগারের বাইরে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শোনা যেত, যেখানে বলা হচ্ছিল- ‘ওকে কখন ধরা হয়েছে? কোনো তথ্য দিয়েছে কি? এখনো কী জিজ্ঞাসাবাদ হয়েছে?’ ইত্যাদি।

কমিশন জানায়, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত বন্দি বিনিময় ব্যবস্থার কিছু কার্যপ্রণালীকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে।

২০১৫ সালে উত্তরায় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আটক হওয়ার পর তিনি জানান, তাকে একটি পরিত্যাক্ত সেলে আটক রাখা হয়েছিল, যেখানে মেঝেতে একটি গর্ত ছিল যা টয়লেট হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

তাকে দেওয়া কম্বলটিতে ‘টিএফআই’ অক্ষরগুলো লেখা ছিল, যা ‘টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টারোগেশন’-এর ইঙ্গিত বহন করে।

তারা জানায়, ওই সময় একমাত্র সক্রিয় টিএফআই কেন্দ্রটি ছিল র‌্যাব গোয়েন্দা শাখার তত্ত্বাবধানে, যা র‌্যাব সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত হলেও, এটি ঢাকার উত্তরায় র‌্যাব-১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের একটি প্রাচীর ঘেরা স্থাপনার ভেতরে ছিল।

কমিশন স্থাপনাটি পরিদর্শন করে নিশ্চিত করেছে যে র‌্যাব গোয়েন্দা শাখা এখনো এর প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করে এবং এর চাবি নিজেদের হাতে রাখে।

তবে স্থাপনাটির অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো কিছুদিন আগে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সাক্ষীদের সাক্ষ্য ওই প্রাঙ্গণের বিভিন্ন অংশ চিহ্নিত করতে আমাদের সাহায্য করেছে, যার মধ্যে রয়েছে, কুখ্যাত নির্যাতন কক্ষ ও সেলের অবস্থান।’

তারা জানায়, ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে ও মাঝামাঝি সময়ে টিএফআই কেন্দ্র পরিদর্শনকারী সেনা সদস্যদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, এক সময় এই স্থাপনায় বেশ কিছু সেলসহ অতিরিক্ত একটি তলা ছিল, বর্তমানে এটিতে আর প্রবেশ করা যায় না।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা এখনো আরও প্রমাণের অপেক্ষায় আছি। তবে প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করা হচ্ছে যে সালাহউদ্দিন আহমেদ বর্তমানে নষ্ট করে ফেলা সেলগুলোর একটিতে আটক ছিলেন। সালাহ উদ্দিন জানান যে তাকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাকে ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতীয় ভূখণ্ডের বেশ ভেতরে এই হস্তান্তর প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক প্রকৃতি এবং এ সময় পরিচয় গোপন রাখতে ‘জম টুপি’ পরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহভাজন সদস্যদের উপস্থিতি থেকে এটি স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে দুই দেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র‌্যাব গোয়েন্দা শাখায় নিয়োজিত সেনা সদস্যদের সাক্ষাৎকার থেকে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময়ের কার্যক্রম এবং আটক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘একজন সেনা সদস্য বর্ণনা করেছেন যে তিনি ২০১১ সালের দিকে দুটি পৃথক ঘটনায় র‌্যাব গোয়েন্দা শাখা তামাবিল সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে ভারত থেকে তিনজন বন্দী গ্রহণের সময় উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সেখানে ইউনিফর্মধারী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘একটি ঘটনায় দুইজন বন্দীকে গ্রহণ করার পর রাস্তার পাশে হত্যা করা হয়। অন্য একটি ঘটনায়, একজন বন্দীকে জীবিত অবস্থায় গ্রহণ করে বাংলাদেশে আরেকটি দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এর বিনিময়ে, র‌্যাব গোয়েন্দা শাখা বাংলাদেশের দুই বন্দীকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে।’

কমিশন জানায়, সেনা সদস্য বন্দীদের নাম জানাতে না পারলেও এই ধরনের আনুষ্ঠানিক নিরাপত্তা পরিষেবা সমন্বয় গুমের ঘটনাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও আন্তঃসীমান্ত প্রকৃতি নির্দেশ করে।’

কমিশন মনে করে ‘তবে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কতটা সম্পৃক্ত ছিল এবং দুই দেশের জন্য এর তাৎপর্য কী তা সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সচিবালয়ের ১৪ কর্মচারী বরখাস্ত

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

‘সচিবালয় ভাতা’র দাবিতে আন্দোলনে অর্থ উপদেষ্টাকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করার ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৪ কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগপত্র আদালত গ্রহণ করায় তাঁদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

এই ১৪ জন সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁরা হলেন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি বাদিউল কবির, সহসভাপতি শাহীন গোলাম রাব্বানী ও নজরুল ইসলাম; স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মো. তায়েফুল ইসলাম, বিকাশ চন্দ্র রায়, ইসলামুল হক, মো. মহসিন আলী, রোমান গাজী, আবু বেলাল; তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মিজানুর রহমান সুমন; জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কামাল হোসেন ও মোহাম্মদ আলিমুজ্জামান; অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিপুল রানা বিপ্লব এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নাসিরুল হক।

সচিবালয় ভাতার দাবিতে ১০ ডিসেম্বর অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদকে তাঁর দপ্তরে ছয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন বাদিউল কবিরের নেতৃত্বে আন্দোলনরত কর্মচারীরা। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন কর্মচারীকে ১১ ডিসেম্বর আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে তাঁদের ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১২ ডিসেম্বর আদালত তাঁদের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হলে আদালত তা গ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে ফের উত্তাপ

  • ভারতীয় কূটনীতিককে তলবের পর গতকাল বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব নয়াদিল্লির।
  • হাইকমিশন অভিমুখী মিছিল আটকে দিয়েছে পুলিশ। ভারতের ভিসা কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা।
  • নির্বাচন নিয়ে ভারতের উপদেশ সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য মনে করি: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একাধিক সংগঠনের মোর্চা জুলাই ঐক্য। গতকাল এই মোর্চার নেতা-কর্মীরা রামপুরা ব্রিজ থেকে মিছিল নিয়ে উত্তর বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায় পৌঁছালে তাঁদের আটকে দেয় পুলিশ।	ছবি: আজকের পত্রিকা
‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একাধিক সংগঠনের মোর্চা জুলাই ঐক্য। গতকাল এই মোর্চার নেতা-কর্মীরা রামপুরা ব্রিজ থেকে মিছিল নিয়ে উত্তর বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায় পৌঁছালে তাঁদের আটকে দেয় পুলিশ। ছবি: আজকের পত্রিকা

দুই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান বিন হাদিকে হত্যাচেষ্টার পর দুই দেশের সম্পর্কে আবার তিক্ততা তৈরি হয়েছে।

দুই দেশের রাজনীতিকসহ বিভিন্নজনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক তলবের পর গতকাল বুধবার ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে জুলাই ঐক্যের মিছিল কর্মসূচি এবং ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র বন্ধ সম্পর্কের তিক্ততায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। ভারতীয় ভিসার আবেদন কেন্দ্রের (আইভ্যাক) ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলার বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনও বলেছেন। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যকে গতকাল তিনি নসিহত আখ্যা দিয়ে তা অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।

বিগত আওয়ামী লীগের আমলে ‘বন্ধুত্বের শিখরে’ পৌঁছানো দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক নতুন মোড় নেয় গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর। সেদিন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাসহ আরও অনেকে সেখানে গেছেন বলে জানা গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানকে ফেরত চেয়ে ঢাকা অনুরোধ জানালেও নয়াদিল্লি সাড়া দিচ্ছে না। এর মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সীমিত করেছে ভারত। ভিসা কড়াকড়ির কারণে পর্যটনও প্রায় বন্ধ।

এ অবস্থায় ১২ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদির ওপর হামলার পর সম্পর্কে নতুন করে তিক্ততা শুরু হয়েছে। গতকাল ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে মিছিল কর্মসূচির আয়োজন করে ‘জুলাই ঐক্য’। তবে পুলিশি বাধায় হাইকমিশন যাওয়ার আগেই কর্মসূচি শেষ হয়। অবশ্য এর আগে বেলা ২টা থেকে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গত রোববার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলবের পর গতকাল নয়াদিল্লিতে স্থানীয় সময় দুপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহাম্মদ রিয়াজ হামিদউল্লাহকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেখানে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বিএম) বি শ্যাম।

পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে হাইকমিশনারকে তলব করা হয়েছে। এ সময় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষভাবে হাইকমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছে, কিছু ‘চরমপন্থী উপাদান’ প্রকাশ্যে ঢাকায় ভারতীয় মিশনের আশপাশে একটি নিরাপত্তা সংকট তৈরির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে, এই ধরনের হুমকি কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিক, এমনটাই প্রত্যাশিত।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিয়ে ‘চরমপন্থী উপাদানগুলো’র মাধ্যমে যে ‘বয়ান’ তৈরির চেষ্টা চলছে, ভারত তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে। অন্তর্বর্তী সরকার এই উদ্বেগজনক ঘটনাগুলোর কোনো পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করেনি বা ভারত সরকারের কাছে কোনো অর্থবহ প্রমাণ দেয়নি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়, যা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক এবং মানুষে-মানুষে উদ্যোগের মাধ্যমে আরও জোরদার হয়েছে। এই সম্পর্কের ভিত্তিতেই নয়াদিল্লি বারবার বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে মত দিয়েছে। ভারত সরকার ধারাবাহিক আহ্বান জানিয়েছে, বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশে যেন অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

রোববার বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলবের কথা জানায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে জানানো হয়েছে, তারা যেন অবিলম্বে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতে পলাতক তাঁর সহযোগীদের ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া ভারতীয় হাইকমিশনারকে ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টাকারীদের বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা রোধে ভারত সরকারের সহযোগিতা এবং তারা ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলে তাদের অবিলম্বে পাকড়াও করার উদ্যোগ নেওয়ার ও বাংলাদেশের কাছে তাদের প্রত্যর্পণ করার অনুরোধ জানানো হয়।

তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিজ্ঞপ্তির বক্তব্যসমূহ স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছে ভারত। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে ভারতের অবস্থান আমরা ধারাবাহিকভাবে পুনর্ব্যক্ত করে আসছি। বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কার্যকলাপে ভারতের ভূখণ্ড কখনোই ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি।’

এদিকে গতকাল বিকেলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা তাদের (ভারত) হাইকমিশনারকে ডেকেছি। এটার ব্যাপারে আমরা যা কিছু বলেছি, সেটা তারা গ্রহণ করেনি, তাদের কিছু দ্বিমত আছে এ বিষয়ে। একইভাবে আমাদের হাইকমিশনারকেও তারা ডেকেছে। এটা খুব অপ্রত্যাশিত নয়। সাধারণত এটা ঘটে। একজনকে ডাকলে আরেকজনকে ডাকা হয়।’

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সর্বশেষ যে বক্তব্য তাদের, তাতে কিছু নসিহত করা হয়েছে আমাদের। আমি মনে করি না, কোনো প্রয়োজন আছে আমাদের এভাবে নসিহত করার। বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, এটা নিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না।’ তিনি বলেন, ‘ভারত আমাদের এটা (নির্বাচন) নিয়ে উপদেশ দিচ্ছে। এটাকে আমি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য মনে করি। তারা (ভারত) জানে, এর আগে গত ১৫ বছর যে সরকার ছিল, তাদের সঙ্গে (ভারতের) অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। ওই সময় নির্বাচনগুলো যে প্রহসনমূলক হয়েছিল, সে সময় তারা (ভারত) একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এখন সামনে আমরা একটা ভালো নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে আমাদের নসিহত করার তো কোনো প্রয়োজন নেই।’

‘সম্পর্কের এই টানাপোড়েন’ মেনে নিয়েই বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে বলে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘তবে আমরা চাইলেই যে হবে, এমন কোনো কথা নেই। দুই পক্ষ থেকেই সম্পর্ককে এগোনোর চেষ্টা করতে হবে।’

রাজনীতিকদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য

ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদে সোমবার রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বদলীয় সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ অভিযোগ করেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রকারীদের ভারত আশ্রয় দিচ্ছে। এ সময় তিনি ভারত সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, ভোটাধিকার ও মানবাধিকারকে বিশ্বাস করে না, তাদের আশ্রয় দিলে আমরাও বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিয়ে সেভেন সিস্টার্স (উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য) আলাদা করে দেব।’

হাসনাতের ওই বক্তব্যের পর ভারতের আসাম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গত মঙ্গলবার বলেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ভারত থেকে আলাদা করার এবং বাংলাদেশের অংশ করার ব্যাপারে গত বছর থেকে বাংলাদেশে বারবার আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু ভারত খুব বড় একটি দেশ, পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশ এবং বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি। বাংলাদেশ কীভাবে এমনটা ভাবতে পারে? তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষজনের মন-মানসিকতা ভালো না। তাদের খুব বেশি সহযোগিতা করা উচিত নয় আমাদের। আমাদের উচিত তাদের একটা শিক্ষা দেওয়া যে তারা যদি ভারতের সঙ্গে এমন ব্যবহার করে, তাহলে আমরা চুপ থাকব না।’

এর আগেও আসামের মুখ্যমন্ত্রী আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। এ ছাড়া গত নভেম্বরের শুরুতে ভারতের ‘নেটওয়ার্ক-১৮’ গ্রুপের প্রধান সম্পাদক রাহুল যোশীকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ‘কথা বলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছিলেন। জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনাথের ওই মন্তব্যকে ‘শিষ্টাচার ও কূটনৈতিক সৌজন্যের প্রতি সম্মানজনক নয়’ বলে মন্তব্য করেছিল।

হাইকমিশন অভিমুখী মিছিল আটকে দিল পুলিশ

ভারতে পালিয়ে থাকা জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে দেওয়া, সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে গতকাল বিকেলে ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ কর্মসূচি দেয় জুলাই অভ্যুত্থানের একাধিক সংগঠনের মোর্চা ‘জুলাই ঐক্য’। তবে বেলা সোয়া ৩টার দিকে শুরু হওয়া গুলশানে হাইকমিশন অভিমুখী কয়েক শ বিক্ষোভকারীর ওই মিছিল বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকায় ব্যরিকেড দিয়ে আটকে দেয় পুলিশ। এ সময় বিক্ষোভকারীদের একাংশ সড়কে বসে পড়ে। আরেকটি অংশ ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে। এ সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিকেল পৌনে ৫টার দিকে কর্মসূচি শেষ করে জুলাই ঐক্য।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার রওনক আলম সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, বাড্ডায় মিছিলকারীদের আটকে দেওয়া হয়। তারা বিকেলেই সেখান থেকে চলে যায়।

সীমান্তে ‘বাড়াবাড়ি’ করছে বিএসএফ

গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সীমান্তে বিএসএফের পুশ ইন ও তৎপরতা বেড়েছে। সীমান্ত হত্যাও বেড়েছে। এ নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই গত সপ্তাহে কোচবিহার জেলায় এক প্রশাসনিক বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ বাড়াবাড়ি করছে। তারা ভারতীয় নাগরিকদের ধরে ধরে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সাংবাদিক আনিস আলমগীরের মুক্তি চায় অ্যামনেস্টি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আনিস আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত
আনিস আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে (এটিএ) গ্রেপ্তার হওয়া সাংবাদিক আনিস আলমগীরের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

আজ বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক বিবৃতিতে অ্যামনেস্টি জানায়, গত সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) আনিস আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি ও আরও চারজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। এই অভিযোগের পর ঢাকার একটি মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠান।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক রিহ্যাব মাহামুর বলেন, আনিস আলমগীরের গ্রেপ্তার একটি উদ্বেগজনক ধারাবাহিকতার অংশ, যেখানে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে সমর্থন রয়েছে—এমন ধারণার ভিত্তিতে ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অপব্যবহার না করে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত এসব অধিকার নিশ্চিত করা, বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের (আইসিসিপিআর) অধীনে নিজেদের দায়বদ্ধতার সম্মান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে আনিস আলমগীরকে মুক্তি দিতে হবে।

আদালতে শুনানির সময় আনিস আলমগীর বলেন, ‘আমি একজন সাংবাদিক। আমি ক্ষমতাসীনদের প্রশ্ন করি। গত দুই দশক ধরে আমি এই কাজই করছি। কারও কাছে মাথা নত করা আমার কাজ নয়।’

উল্লেখ্য, চলতি বছরের মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। সংশোধনের পর থেকে দলটির প্রতি সমর্থনের অভিযোগে একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাও রয়েছেন।

অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক মতাদর্শ-নির্বিশেষে সবার মানবাধিকার সুরক্ষিত ও বিকশিত হয়। একটি মানবাধিকারসম্মত সমাজের জন্য অপরিহার্য স্বাধীনতাগুলো খর্ব করতে দমনমূলক আইনপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জিয়াউলের বিরুদ্ধে শতাধিক ব্যক্তিকে গুম-খুনের অভিযোগ আমলে নিলেন ট্রাইব্যুনাল

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
জিয়াউল আহসান। ফাইল ছবি
জিয়াউল আহসান। ফাইল ছবি

গুমের পর শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আজ বুধবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এই অভিযোগ আমলে নিয়ে ২১ ডিসেম্বর জিয়াউল আহসানকে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছেন।

এর আগে সকালে এই মামলায় ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। মামলায় জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।

অভিযোগের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, গুম-খুনের কালচার শেখ হাসিনার আমলে শুরু হয়েছিল। সেটা সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে হতো। পরে নির্দেশ আসত তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের মাধ্যমে। এসব কিছুর বাস্তবায়নের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন জিয়াউল আহসান। বাংলাদেশে এ রকম বীভৎস, নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালানোর ব্যাপারে তাঁর যে স্পর্ধা, সে জন্য তাঁকে একক আসামি হিসেবে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।

অভিযোগ-১: ২০১১ সালের ১১ জুলাই রাতে গাজীপুরের পুবাইলের ঢাকা বাইপাস সড়কের পাশে জিয়াউল আহসানের পরিকল্পনায় ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সজল ও অজ্ঞাতনামা তিনজনকে গুলি করে হত্যা।

অভিযোগ-২: ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বরগুনার পাথরঘাটা থানার চরদুয়ানীর নিকটবর্তী বলেশ্বর নদের মোহনায় নজরুল ইসলাম মল্লিক, আলকাছ মল্লিকসহ কমপক্ষে ৫০ জনকে গুলি করে হত্যা ও লাশ গুম।

অভিযোগ-৩: ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বরগুনার বলেশ্বর নদ ও বাগেরহাটের শরণখোলার সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত বনদস্যু দমনের নামে মাসুদসহ ৫০ জনকে গুলি করে হত্যা।

ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে মেজর থাকাকালে র‍্যাবে পোস্টিং হওয়ার পর থেকে জিয়াউল আহসান বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ফলে ২০২৪ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আগপর্যন্ত কখনোই তাঁকে সেনাবাহিনীতে ফেরত যেতে হয়নি। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জিয়াউল আহসান র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক ও এডিজি (অপস) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে অসংখ্য গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। অগণিত হত্যাকাণ্ড, গুমসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ তাঁর সরাসরি নির্দেশে বিশ্বস্ত র‍্যাব সদস্যরা ঘটাতেন।

হত্যাকাণ্ডের অন্যতম হটস্পট ছিল বরগুনার পাথরঘাটার চরদুয়ানী ইউনিয়নের চরদুয়ানী খাল বেয়ে অগ্রসর হয়ে বলেশ্বর নদের বিভিন্ন পয়েন্ট ও মোহনা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, সড়কপথে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া হয়ে বরগুনার চরদুয়ানীতে রাত ১১টা কিংবা তারও পরে কালো কাচের মাইক্রোবাস, জিপ, ডাবল কেবিন পিকআপসহ বিভিন্ন গাড়িবহরে র‍্যাব সদস্যরা সাদা পোশাকে আসতেন। তাঁদের সঙ্গে দু-একজন করে বন্দী থাকতেন, কখনো বন্দীর সংখ্যা অনেক বেশিও হতো। বন্দীদের ট্রলারে উঠিয়ে মাঝ নদীতে নিয়ে শরীরের সঙ্গে (মাথা বা বুকে) বালিশ ঠেকিয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। এরপর পেট ছুরি দিয়ে ফেড়ে শরীরে (মাথা ও পায়ে) সিমেন্টের ব্লক বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ঢাকার বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মোহনা ও পতেঙ্গা উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরেও এ ধরনের অপারেশন পরিচালিত হয়েছে। এ ধরনের অপারেশনের অনেকগুলোয় জিয়াউল আহসান সশরীরে অংশ নেন এবং অনেকগুলোয় তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশনার আলোকে র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা অথবা তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্যান্য ব্যাটালিয়নের বাছাই করা সদস্যরা হত্যাকাণ্ড ঘটান।

অভিযোগে বলা হয়, গুম থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে গভীর রাতে পাথরঘাটার চরদুয়ানী থেকে ট্রলারে করে বলেশ্বর নদ হয়ে সুন্দরবনের পূর্বনির্ধারিত নিজেদের সাজানো কথিত বনদস্যুদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হতো। ভুক্তভোগীদের চোখ, হাত-পা বেঁধে নিয়ে গুলি করে হত্যার পর উপর্যুপরি গুলিবর্ষণের মাধ্যমে বন্দুকযুদ্ধের আবহ তৈরি করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযানের সাক্ষী হিসেবে নিয়ে যাওয়া হতো কিছু অনুগত সাংবাদিককে। তবে তাঁদের ঘটনাস্থলে না নিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে ক্রসফায়ারের নামে ভুক্তভোগীদের হত্যা করা হতো। পরে তাঁদের ঘটনাস্থলে নিয়ে নিজেদের মনমতো ঘটনার বর্ণনা দিত। দস্যুনিধনের নামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগে থেকে আটক রাখা নিরপরাধ বন্দীদের হত্যা করা হতো।

অধিকাংশ অভিযানে জিয়াউল আহসান নিজেই অংশ নিতেন। এ ছাড়া তদন্তে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে ২০১০-১৩ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ২০০ জনকে হত্যা, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার নামে কমপক্ষে ৬১ জনকে হত্যাসহ আরও অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়াউল আহসানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে পৃথক তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত