Ajker Patrika

মৃত্যুর বিন্দুতে শেষ অপেক্ষার প্রহর

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০৭
মৃত্যুর বিন্দুতে শেষ অপেক্ষার প্রহর

ভিক্টর গোমেজের সঙ্গে আমার জানাশোনা অনেক দিনের। তিনি কাজ করতেন ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ বা সিসিডিবি নামের একটি এনজিওতে। ভিক্টর একদিন অফিসে এসে আমাকে গ্রিন রোডের একটি বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। যাব যাব করে বিচ্ছিরি ফরমায়েশি কাজে আটকে গেলাম সেদিন। গেলাম পরের দিন। বাড়ির নিচতলার এক ফ্ল্যাটে গিয়ে কলবেল বাজাতেই মাঝবয়সী এক নারী এসে দরজা খুলে দিলেন। ভিক্টরের সঙ্গে আমাকে দেখে ড্রয়িংরুমে বসতে বললেন। মনে হলো, আমার আসার কথা বাড়ির লোকেরা আগে থেকেই জানতেন।

একটু পর ড্রয়িংরুমে এলেন এক বয়স্ক নারী। ভিক্টর পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘উনি থ্যালমা গোমেজ’। তাঁর বাম হাতে ধরা নীল রঙের একটি চিঠির খাম। খামটি আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘এই চিঠি আমার জীবনটাকে ওলটপালট করে দিয়েছে। সাত দিন ধরে খেতে ও ঘুমাতে পারছি না। আমার ছেলেমেয়েরা বিদেশে, তারাও অস্থির।’

চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখি বিদেশ থেকে আসা। খামের ওপরে প্রেরকের ঠিকানা বলতে লেখা, হিলি গোমেজ, লন্ডন। প্রাপকের নামের জায়গায় ‘থ্যালমা গোমেজ, হাসনাবাদ, নবাবগঞ্জ, খালপাড়, ঢাকা’ লেখা। খামের ওপরে ডান দিকে বাহরাইনের ডাকটিকিট লাগানো। ভেতরে হ্যাট পরা এক বৃদ্ধের পোস্টকার্ড সাইজের রঙিন ছবি, ছবির উল্টো দিকে ‘হিলি গোমেজ’ নাম সই করা। তার পাশে থ্যালমা গোমেজের নাম। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা, ‘আমি তোমাকে ভুলিনি, আমি ফিরে এসেছি, আজ জীবিত থাকলেও নেই।’ আরেক পাশে ছোট করে চারটি নাম লেখা—শান্তি, দিলীপ, বাদল ও করুণা।

ছবিটা হাতে নিয়ে বৃদ্ধার কাছে জানতে চাইলাম, উনি কে। আমার মুখের কথা শেষ না হতেই বৃদ্ধা বললেন, আমার স্বামী। ৪৩ বছর আগে এক ব্রিটিশ জাহাজসমেত নিখোঁজ হন জাপানের কোনো এক বন্দর থেকে। এত বছরেও তাঁর কোনো খোঁজ ছিল না। কয়েক দিন আগে এই চিঠি এসেছে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এই ছবি দেখে চিনতে পারলেন? জবাব তৈরিই ছিল। বললেন, ঠোঁট ও কানের লতি দেখে চিনেছি। পাশে অন্য চারটি নাম কার? ‘এগুলো আমার ছেলেমেয়ের নাম।’ আমার সামনে সোফায় বসা ভিক্টর এসব শুনতে শুনতে বললেন, চিঠিটা আসার পর পুরো পরিবার আনন্দ-বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তারা এখন কী করবে বুঝতে পারছে না।

থ্যালমা বললেন, চিঠিটা ২২ জানুয়ারি (২০০০ সাল) নবাবগঞ্জের ঠিকানায় এসেছে। এরপর তিনি চিঠিটি নিয়ে গ্রিন রোডে মেয়ের বাসায় আসেন। এটা তাঁর ছোট মেয়ে করুণার বাসা। থ্যালমা বললেন, চিঠি পাওয়ার পর তাঁর মনে হয়েছে, এত দিন নিখোঁজ লোকটি বেঁচে আছেন, হয়তো তাঁর কোনো বন্ধু বাহরাইন থেকে চিঠিটা ডাকে ছেড়ে দিয়েছেন। এটুকু বলতেই তাঁর গলা ধরে আসে।

আমি থ্যালমার মুখের দিকে তাকাই। তাঁর চোখে দুকূল ভাসানো ভালোবাসা। বয়সের ভারে চামড়া ভেতরে আশ্রয় নেওয়া চোখের নিচে বিন্দু বিন্দু পানি। এই অবস্থায় কাউকে প্রশ্ন করা সহজ নয়। তবু কীভাবে শুরু করব, ভাবতে ভাবতে বললাম, গোমেজ সাহেব কীভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন? প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েই মনে হলো, মাটিতে ঠিক কোপটি পড়েছে। রোদ পেয়ে অমনি দলে দলে বেরিয়ে আসছে পুরোনো সব স্মৃতি।

থ্যালমা বলতে শুরু করলেন। নবাবগঞ্জের হাসনাবাদ খালপাড়ের যে গ্রামে তাঁরা থাকতেন, ৪৪ বছর আগে সে গ্রাম থেকে বেরিয়েছিলেন দুরন্ত যুবক হিলি গোমেজ। পেশায় জাহাজের নাবিক। ঘুরে বেড়াতেন বন্দর থেকে বন্দরে। সাগরে বেড়ানোর নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল কৈশোর থেকেই। সে কারণে শখ করে জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন।

স্বামী-স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার। বড় মেয়ে শান্তির বয়স তখন ১০। দ্বিতীয় ছেলে দিলীপ ৬, আর বাদল ৪ বছর। ছোট মেয়ে করুণার জন্ম ১৯৫৬ সালের মে মাসে।
হিলি গোমেজ তখন ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বুলার্ড কিং অ্যান্ড কোম্পানির একটি জাহাজে চাকরি করতেন। আমটাটা, আমটালি, আমব্রেলা ও আমবার্ড নামে চারটি জাহাজ ছিল এই কোম্পানির। হিলি গোমেজ জাহাজে থাকা অবস্থায় জানতে পারেন করুণার জন্মের খবর। খবর শুনে তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন বাবা। কোম্পানির জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এলে ক্যাপ্টেনকে না বলেই সোজা হাসনাবাদের বাড়িতে চলে আসেন তিনি।

১৯৫৬ সালের ১৬ জুন রাতে স্টিমারযোগে মইনট ঘাট (বর্তমানে বিলুপ্ত) হয়ে বাড়িতে আসেন হিলি গোমেজ। বাড়িতে এসে মেয়েকে একনজর দেখে সে রাতেই আবার চলে যান। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে তাঁদের জাহাজ যায় করাচি বন্দরে, সেখান থেকে জাপানে। জাপানের কোনো এক বন্দর থেকে জাহাজটি ছাড়ার ৮ দিন পর সেটি নিখোঁজ হয়।

থ্যালমা সেই ঘটনা জানতে পারেন দেড় মাস পর। জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাঁর বাসায় চিঠি দিয়ে জানায়, বন্দর থেকে ছাড়ার পর জাহাজটি নিখোঁজ হয়। ক্রুসহ জাহাজে লোক ছিলেন ২৮৪ জন। দুর্ঘটনায় পড়ার আগে জাহাজ থেকে ‘এসওএস’ বার্তা পাওয়ার পর কাছের বন্দর থেকে উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু জাহাজের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

চিঠিতে কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছিল, বিশাল আয়তনের এই জাহাজ ডুবতে কমপক্ষে ১২ দিন লাগার কথা। কিন্তু তারা জাহাজটির কাউকেই খুঁজে পায়নি। এই জাহাজে কাজ করতেন তাঁদের গ্রামের আরেক যুবক সনাতন। শেষ মুহূর্তে ডাক্তারি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তাঁকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি ফিরে এসে জানান, জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে ক্যাপ্টেন জাহাজ পরিদর্শনে এসে অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল দেখে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, এ জাহাজের মালামাল না কমালে গভীর সাগরে ডুবে যেতে পারে। কিন্তু জাহাজ কর্তৃপক্ষ তাঁর কথা না শুনে নতুন ক্যাপ্টেন নিয়োগ করেন। জাহাজের প্রথম ক্যাপ্টেন সে সময় হিলিকে এ জাহাজে যেতে নিষেধ করেন, কিন্তু হিলি তাঁর কথা শোনেননি।

থ্যালমা বললেন, এ ঘটনা ১৯৫৬ সালের। এরপর দীর্ঘ সময় জাহাজ ও নাবিকদের আর কোনো খোঁজ তিনি পাননি। সর্বশেষ করাচি বন্দর থেকে হিলি তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। জাহাজে চাকরি করার সময় কোম্পানি প্রতি মাসে ৭০ টাকা করে তাঁদের বাড়ির ঠিকানায় পাঠাত। হিলি নিখোঁজ হওয়ার তিন মাস পর তা-ও বন্ধ হয়ে যায়।

থ্যালমা বলেন, হিলি নিখোঁজ হওয়ার পর চার সন্তান নিয়ে পানিতে পড়েন তিনি। অভাব-অনটন তখন নিত্যসঙ্গী। খরচ চালাতে না পেরে দুই সন্তান শান্তি ও দিলীপকে অনাথ আশ্রমে পাঠান। একজন মিশনারি ফাদার তাঁদের দেখাশোনা করেন। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর ক্ষতিপূরণ চেয়ে তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন, কিন্তু কোম্পানি তাঁকে জানিয়ে দেয়, যুদ্ধে জাহাজ বিধ্বস্ত না হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান নেই। এভাবে দিন চলে যায়।

থ্যালমার অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হতে হতে চার সন্তান বড় হয়। বড় ছেলে দিলীপ আমেরিকায় ভালো চাকরি করেন। বাদল চাকরি করেন ওমানের মাসকট বিমানবন্দরে। বড় মেয়ে শান্তি স্বামীর সঙ্গে মুম্বাইবাসী। সেদিনের এক মাসের কন্যা করুণাও মাঝবয়সী নারী। থ্যালমার বয়সও কম হয়নি, তিনি তখন ৭২-এ। চোখে ভালো দেখতে না পেলেও ছবিতে একপলক দেখেই স্বামীকে চিনতে পারেন।

থ্যালমার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি, মঙ্গলবার। সেদিন করুণা আমাকে বলেছিলেন, বাবাকে নিজের চোখে না দেখলেও তাঁর সব গল্প মুখস্থ। শুনেছেন, বাবা তাঁর বড় মেয়ে শান্তির জন্য বিভিন্ন বন্দর থেকে ডাকে কেক পাঠাতেন। সেই কেকের মধ্যে লুকানো থাকত কানের দুল বা নাকফুলের মতো উপহার। কেকটা মুখে দিলেই বেরিয়ে আসত উপহার। সেই উপহার পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলতেন শান্তিদি। করুণা বারবার বললেন, আমি যেন ভালো করে একটা রিপোর্ট করি, যাতে বাবা ফিরে আসেন।

হিলি গোমেজের সেই রিপোর্ট জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল ২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি, বুধবার। এরপর অনেক দিন আর থ্যালমা বা করুণার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। ভিক্টরও অন্য চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে যান। বছর তিনেক পরে করুণাদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে ধানমন্ডির প্রোব ম্যাগাজিনে যাচ্ছিলাম। কী মনে হলো, করুণাদের ফ্ল্যাটে কলবেল বাজালাম। দরজা খুললেন অন্য এক নারী। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, করুণারা নেই, তাঁরা এ বাসার নতুন ভাড়াটে। করুণার মায়ের কথা শুনে বললেন, পাশের ভাড়াটেরা তাঁকে বলেছেন, নিখোঁজ স্বামীর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় করুণার মা সারাক্ষণ বারান্দায় বসে থাকতেন, রাতেও। সহজে বিছানায় যেতেন না। একদিন ভোরবেলা তাঁকে বারান্দায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

এই নারীর কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অফিসে এসে পুরোনো রিপোর্টটা আবার বের করলাম। রিপোর্টে আছে, হিলির জাহাজটা দুর্ঘটনায় পড়েছিল ১৯৫৬ সালে, থ্যালমা আমাকে সেটাই বলেছিলেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, বুলার্ড কিং অ্যান্ড কোম্পানি নামে ব্রিটিশ একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেই কোম্পানির একটি জাহাজের নামও ছিল আমটাটা (Umtata)। টর্পেডোর আঘাতে সেটা ডুবে যায় ১৯৪২ সালে, ১৯৫৬ সালে নয়। ৪২ থেকে ৫৬-তে তো অনেক ফারাক। মনে একটু খটকা লাগল।  

লেখাটা শেষ করার আগে মার্কিন গল্পকার মারজরি কিনান রাউলিংসের ‘আ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পটা মনে পড়ে গেল। অনাথ আশ্রমের বেড়ে ওঠা বালক জেরি সারাক্ষণ তার মায়ের কথা বলত। পাহাড়ের ওপারে মা থাকে, জন্মদিনে মা তাকে উপহার পাঠাত। কিন্তু এতিমখানায় বড় হওয়া জেরির আসলে কেউই ছিল না। মায়ের সঙ্গে তার বসবাস ছিল শুধু কল্পনাতে। 
আমার মনেও ধন্দ। থ্যালমার চিঠির গল্প জেরির মতো নয় তো? সত্যিই কি এত বছর পরে হিলি সেই চিঠি লিখেছিলেন? নাকি অন্য কিছু?

আসলে মানুষের জীবনের গল্প বড় অদ্ভুত, সে গল্প হয়তো কখনো মেলে, কখনো মেলে না।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ: জেএমবির সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে পরিচালক গ্রেপ্তার হন দুবার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৪
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় গত শুক্রবার সকালে একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। মাদ্রাসাটি শেখ আল আমিন নামের এক ব্যক্তি পরিচালনা করতেন। যিনি এর আগে নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাতটি মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, ভবনটি বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, হাসনাবাদ বাজারের ফলপট্টি গলিতে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিশুদের পাঠদান করা হয়। বিস্ফোরণে চার কক্ষের একতলা ভবনটির পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে, সিঁড়ির পাশের ছাদের একাংশ উড়ে গেছে এবং সব কটি কক্ষের পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের ক্রাইম সিন ইউনিটের কর্মীরা আলামত সংগ্রহ করছেন। তাঁরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। ভবনের পাশের একটি ভবনের দোতলার দেয়ালে বিস্ফোরণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরণে পাশের একটি অটোরিকশার গ্যারেজের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিনের নিচে চাপা পড়েছিলেন গ্যারেজের ম্যানেজার আবুল কালাম।

আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত বিকট শব্দ হয়েছে যে আমার কানে তব্দা লেগে যায়। আমি টিনের নিচে চাপা পড়ি। পরে হামাগুড়ি দিয়ে বের হই। এরপর দেখি মাদ্রাসার মধ্যে আগুন জ্বলছে। যারা ভেতরে ছিল, তারা দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়ে চলে যায়।’

গ্যারেজের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আমিও বাসা থেকে দৌড়ে আসি। আমার গ্যারেজের দুজন অটোচালক দুই শিশুকে ওই ভবন থেকে বের করেন। এক নারী আর এক শিশুকে নিয়ে চলে যায়। এ সময় আল আমিনও দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন এসে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।’

মাদ্রাসার পাশের ৫ তলা বাড়ির বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হয়েছিল ভূমিকম্প। কারণ, বিস্ফোরণে সব ভবনে কাঁপুনি লাগে। সবাই চিৎকার করেছিল।’

ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘মাদ্রাসাটিতে ৩০-৩৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তবে শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’

ভবনটির পশ্চিম পাশের এক পাশে তিনটি কক্ষে মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অপর পাশের একটি কক্ষে পরিচালক শেখ আল আমিন (৩২), তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৮) এবং তাঁদের তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকতেন। বিস্ফোরণে দুই ছেলে উমায়েত (১০) ও আবদুল্লাহ (৭) আহত হয়। এর মধ্যে আছিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

পাশের ভবনের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমাদের ভবনের কিছু অংশ ফেটে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবও ভেঙে পড়েছে।’

ঘটনাস্থলেই পুলিশ হেফাজতে বসে ছিলেন ভবনমালিক পারভীন বেগম। ভবনের জমি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে লিবিয়ায় থাকা তাঁর দুই ছেলে এই ভবন ২০২২ সালে তৈরি করেন। এরপর হারুন অর রশীদ নামের এক ব্যক্তি এটি মাদ্রাসা করবেন বলে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুফতি হারুন অর রশীদ মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। হারুন তাঁর শ্যালক আল আমিন ও শ্যালকের স্ত্রী আছিয়াকে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় আসতেন। আমি নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ এসে দেখি, ভবনের চারপাশ উড়ে গেছে।’

পারভীন বেগমের পাশেই ছিলেন তাঁর ছোট মেয়ে সোহানা। তিনি বলেন, ‘ভাড়া নেওয়ার সময় শুধু হারুন অর রশীদ একাই এসেছিলেন। এরপর তাঁরা মাদ্রাসা পরিচালনা শুরু করেন। তবে তাঁরা আশপাশের কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না।’

পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে কেমিক্যাল, ককটেল, ভেস্ট ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, কোনো বিস্ফোরক তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে গতকাল বিকেলে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শেখ আল আমিন পলাতক রয়েছেন। তবে কেরানীগঞ্জ থেকে তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম, আছিয়ার ভাই হারুনের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার এবং ঢাকার বাসাবো থেকে আসমানী খাতুন নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, আল আমিনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগে ২০১৭ ও ২০২০ সালে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আসমানী খাতুনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত