Ajker Patrika

মুসলিম বিশ্বে গ্রন্থাগারের সমৃদ্ধ অতীত

আসআদ শাহীন
মুসলিম বিশ্বে  গ্রন্থাগারের  সমৃদ্ধ অতীত

লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার জ্ঞানের বাতিঘর। ইসলামের সোনালি যুগে মুসলমানরা কোরআন-হাদিস, ভাষা ও অন্যান্য জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেদের জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেন। এরপর গ্রিক, সংস্কৃত ও ফারসি জ্ঞানভান্ডার আরবিতে রূপান্তর করে বিশ্বজ্ঞানের আলোয় আলোকিত হন। সুতরাং জ্ঞানচর্চার প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবেই অসংখ্য সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে ওঠে মুসলিম বিশ্বে। এখানে অতীতের বিখ্যাত কয়েকটি লাইব্রেরির কথা তুলে ধরা হলো—

বায়তুল হিকমাহ
বায়তুল হিকমাহ আনুমানিক ৭৮০-এর দশকে আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশিদ ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খলিফা হারুন আল-রশিদের পর তাঁর পুত্র খলিফা মামুন আল-রশিদ বায়তুল হিকমাহকে সমৃদ্ধির নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন এবং বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগারে পরিণত করেন। এতে পর্যবেক্ষণাগার, বিজ্ঞান গবেষণাগার, অনুবাদ কেন্দ্র, মাদ্রাসা ও বড় হলরুম ছিল। খলিফা মামুন আল-রশিদ ভারত, মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আরব, উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের খ্রিষ্টান, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের বাগদাদে আসার এবং বায়তুল হিকমাহ থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বায়তুল হিকমাহ ৪৫০ বছর ধরে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগারের গৌরব অর্জন করেছিল এবং বর্তমান ব্রিটিশ লাইব্রেরির চেয়েও বড় ছিল।

শাহি লাইব্রেরি কর্ডোবা
কর্ডোবার শাহি লাইব্রেরি ছিল সেই সময়ের অন্যতম বড় লাইব্রেরি। এখানে ৪৪টি ক্যাটালগে বিভক্ত ৪ লাখ বই ছিল। লুবনা নামক একজন মুসলিম নারী এই লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন এবং তিনি বিশ্বের প্রথম মহিলা গ্রন্থাগারিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৮ শতকের খ্রিষ্টান বুদ্ধিজীবী রেইনহার্ট ডজি লিখেছেন, মুসলিম আন্দালুসিয়ায় প্রত্যেক নাগরিক পড়তে ও লিখতে পারত। এটি সেই সময় ছিল, যখন ইউরোপের বাকি অংশে পুরোহিত ছাড়া কেউ পড়তে ও লিখতে পারত না। এখানেই ইবনে রুশদের মতো প্রতিভাধর দার্শনিকের জ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়েছে। তিনি গ্রিক দার্শনিকদের ল্যাটিন পাণ্ডুলিপিগুলো আরবিতে অনুবাদ করেন।

আল-কারাউইয়ান লাইব্রেরি
বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গৌরব অর্জন করেন ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ আল-ফিহরিয়া। তিনি কুরাইশ বংশোদ্ভূত ছিলেন; তবে তাঁর জন্ম তিউনিসিয়ায়। তিনি একজন ধনী বাবার মেয়ে ছিলেন। তিনি মরক্কো ভ্রমণে এসে এখানে বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাবা ও স্বামী দুজনেই ইন্তেকাল করেন। ফাতিমা এবং তাঁর বোন মরিয়ম বাবার উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত সম্পদ শিক্ষা ও দাতব্য কাজে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। মরিয়ম শহরে একটি বিশাল মসজিদ তৈরি করেন এবং ফাতিমা একটি বড় মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসা সংযুক্ত লাইব্রেরি নির্মাণ শুরু করেন, যা ১৮ বছরে সম্পন্ন হয়।

কায়রো লাইব্রেরি
ফাতেমীয় খলিফা আবু মনসুর ১ হাজার খ্রিষ্টাব্দে কায়রোতে একটি বিশাল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। লাইব্রেরিতে ৪০টি কক্ষ ছিল এবং ২ লাখ পাণ্ডুলিপি ও দুর্লভ নথিপত্র রাখা হয়েছিল। এই লাইব্রেরিতে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক ৬ হাজার বই ছিল। তারিখে তাবারির ১ হাজার ২০০ কপি এবং পবিত্র কোরআনের ২ হাজার ৪০০ কপি এখানে মজুত ছিল। গ্রিক দার্শনিক টলেমি পৃথিবীর একটি গ্লোব তৈরি করেছিলেন, যা এই লাইব্রেরির বাইরে স্থাপন করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, গ্লোবটি এই লাইব্রেরির ১ হাজার ৪০০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল।

সিরাজি লাইব্রেরি 
পান্নাহ খসরু (ওয়াদুদ আল-দৌলা) ছিলেন বুইদ রাজবংশের আমির (৯৩৪-১০৬২ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি দশম শতাব্দীতে পারস্যের একজন শাসক ছিলেন। যিনি বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের অধীন হলেও স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি ইস্পাহানে একটি হাসপাতাল এবং সিরাজে ইসলামের শুরু থেকে তাঁর সময় পর্যন্ত লেখা বইসহ একটি বিশাল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, এই গ্রন্থাগারের কেবিনেটগুলো সোনার কারুকাজ দিয়ে সজ্জিত ছিল এবং শুধু নির্দিষ্ট কিছু স্কলারকে এখানে অধ্যয়নের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

সমরকন্দ ও বুখারার লাইব্রেরি 
৭৫১ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য এশিয়ায় প্রথম কাগজকল প্রতিষ্ঠিত হয়। বুখারা ও সমরকান্দেও মধ্যযুগে হাজার হাজার মাদ্রাসা ছিল এবং প্রতিটি মাদ্রাসায় একটি লাইব্রেরি সংযুক্ত ছিল। সামানির মুসলিম শাসক বুখারার সুলতান আমির নুহ ইবনে মনসুর (৯৭৬-৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) বুখারা, সমরকন্দ ও মাওয়ারাউন নাহারে (উজবেকিস্তান) ৪০০টির বেশি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি সেই যুগ ছিল, যখন বই হাতে লেখা, কাগজ ও কালি ছিল দুর্লভ এবং ব্যয়বহুল। বিখ্যাত আলকেমিস্ট, চিকিৎসক ইবনে সিনা, সহি বুখারির রচয়িতা ইমাম বুখারি, আল-বিরুনিসহ হাজার হাজার আলেম ও বিজ্ঞানী এই গ্রন্থাগার দ্বারা ধন্য হয়েছেন। চেঙ্গিস খান এবং মঙ্গোলরা এই লাইব্রেরি ধ্বংস করেছিল।

লাইব্রেরি অব গজনি
সুলতান মাহমুদ গজনভী (৯৯৮-১০৩০ খ্রিষ্টাব্দ), যিনি ভারতে ১৭ বার আক্রমণ করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও সাহিত্যের একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নিজ হাতে শাহি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই শাহি গ্রন্থাগারে লক্ষাধিক বই ছিল। বিখ্যাত কাব্যসংকলন ‘শাহনামা-ই ফিরদৌসী’ তাঁরই আদেশে কবি ফিরদৌসী (১০২০ খ্রিষ্টাব্দ) লিখেছিলেন। যদিও ফিরদৌসী আর্থিক কারণে রাগান্বিত হয়ে তাঁকে ব্যঙ্গও করেন। আল-বিরুনি এবং আল-ফারাবির মতো পণ্ডিতেরাও তাঁর দরবারে আসা-যাওয়া করতেন।

মুঘল রাজবংশের গ্রন্থাগার
ভারতে প্রথম মুঘল গ্রন্থাগারটি সম্রাট বাবর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। যখন তিনি লুধি সাম্রাজ্যের লাহোর প্রদেশের গভর্নর গাজী খানকে পরাজিত করেন, তখন তাঁর গ্রন্থাগারটি দখল করেন। হুমায়ুনও তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ‘শেরমন্ডল’ স্থাপন করেছিলেন, যেখান থেকে তিনি হোঁচট খেয়ে নিচে পড়ে মারা যান। বাদশা জালালুদ্দিন আকবর (১৫৪৩-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ) নিজে নিরক্ষর ছিলেন, কিন্তু তিনি ৬৪ লাখ টাকা খরচ করে ফতেপুর সিক্রিতে একটি শাহি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। লাইব্রেরিটি আগ্রা দুর্গের বড় হলঘরে অবস্থিত ছিল। একইভাবে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও আওরঙ্গজেব আলমগীরের গ্রন্থাগারগুলো ছিল দুর্লভ সংগ্রহে ঠাসা।

অটোমান গ্রেট লাইব্রেরি
ওসমানী আমলে একটি শিক্ষা বিভাগ ছিল, যা গ্রন্থাগারগুলোর বিষয়াবলি পর্যবেক্ষণ করত। বাগদাদ, দামেস্ক, ইস্তাম্বুল, কায়রো, মক্কা, জেরুজালেমসহ প্রতিটি শহরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বিদ্যমান ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তোপকাপি লাইব্রেরি, যাতে ১৪ হাজার অত্যন্ত দুর্লভ পাণ্ডুলিপি ছিল, যার মধ্যে পবিত্র কোরআনের কপি ছিল, যা হজরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলে লেখা হয়েছিল। কনস্টান্টিনোপলের রাজপ্রাসাদের লাইব্রেরিতে লক্ষাধিক বই সংরক্ষিত ছিল।

লেখক: শিক্ষার্থী, উচ্চতর ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগ, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নূরানী বোর্ডের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৯০.৩৬

ইসলাম ডেস্ক 
নূরানী বোর্ডের ফল প্রকাশ, পাসের হার ৯০.৩৬

নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ (এনটিকিউবি) পরিচালিত তৃতীয় শ্রেণির ১৯তম সমাপনী পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে।

শনিবার (২০ ডিসেম্বর) বোর্ডের মোহাম্মদপুরের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের শায়খুল কোরআন মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই ফল প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে অনুষ্ঠানে জুলাই যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন বোর্ডের পরিচালক মাওলানা কালিমুল্লাহ জামিল হুসাইন।

দেশের মোট ১ হাজার ১২টি কেন্দ্রে গত ২৯ নভেম্বর দেশব্যাপী একযোগে এই সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়ে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। এতে মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৬৩ হাজার ৫৩২ এবং পাসের হার ৯০ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা কালিমুল্লাহ জামিল হুসাইন বলেন, ‘দেশব্যাপী তরুণ আলেমদের কাছে অনুরোধ করছি, একটি নীরব সাধনায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে হবে। তা হচ্ছে প্রতিটি গ্রামে-পাড়া-মহল্লায় নূরানি মাদ্রাসা, নূরানি স্কুল, নূরানি মক্তব ও ইসলামিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের প্রতিটি সন্তানের কাছে দ্বীন শেখাকে সহজ থেকে সহজতর করতে হবে।’

পরীক্ষা বাস্তবায়ন কমিটির মহাসচিব ইসমাইল বেলায়েত হুসাইন বলেন, ‘শিশুরা কাঁচা মাটির মতো। তাদের যেভাবে গড়ে তুলবেন, তারা সেভাবেই গড়ে উঠবে। আমরা দ্বীন ধর্ম ও মাতৃভূমির ভালোবাসায় সন্তানদের গড়ে তুলি। সুনাগরিক ও দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তুলতে কাজ করে নূরানী বোর্ড।’

এদিকে অনুষ্ঠানে তরুণদের জন্য ‘শায়খুল কোরআন আল্লামা কারি বেলায়েত হুসাইন (রহ.) স্কলারশিপ’-এরও ঘোষণা দেওয়া হয়। ১০ লাখ টাকা সমমূল্যের এই স্কলারশিপ পাবেন ১০০ তরুণ। মনোনীত ১০০ তরুণ ১০ হাজার টাকা সমমূল্যের নূরানি মুয়াল্লিম প্রশিক্ষণ কোর্সটি বিনা মূল্যে করতে পারবেন।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা আবু বকর, মাওলানা তারেক হুসাইনসহ নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ডের কর্মকর্তা ও দায়িত্বশীলেরা।

প্রসঙ্গত, শায়খুল কোরআন আল্লামা কারি বেলায়েত হুসাইন (রহ.) প্রতিষ্ঠিত এই বোর্ডটি দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলেও শিশু শিক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে এই ধারার হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সারা দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যে মাদ্রাসায় বেড়ে উঠেছিলেন ওসমান হাদি

কাউসার লাবীব
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ২৯
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

একটি সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারের সন্তান থেকে শুরু করে রাজপথের আপসহীন বক্তা—শরিফ ওসমান হাদির শিকড় প্রোথিত ছিল ধর্মীয় শিক্ষার গভীরে। ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার খাসমহল এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা প্রয়াত মাওলানা আব্দুল হাদি ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ মাদ্রাসাশিক্ষক। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ওসমান হাদি ছিলেন সবার ছোট। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য আলেম বা দ্বীনি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত, যা ওসমান হাদির চিন্তা ও চরিত্রে এনেছিল দৃঢ় নৈতিক ভিত্তি।

তাঁর বড় ভাই মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক বরিশালের ঐতিহ্যবাহী শরফুদ্দীন আহমেদ সেন্টু জামে মসজিদের খতিব; মেজো ভাই মাওলানা ওমর ফারুক একজন ব্যবসায়ী। তাঁর তিন ভগ্নিপতিও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও ইমামতির সঙ্গে যুক্ত, যাঁরা স্থানীয় পর্যায়ে অত্যন্ত সম্মানিত।

ওসমান হাদির শিক্ষাজীবনের শুরু ঝালকাঠির বিখ্যাত এন এস কামিল মাদ্রাসায়। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন তুখোড় মেধাবী এবং অসাধারণ বক্তা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্পৃহা তাঁর মধ্যে কাজ করত শৈশব থেকেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তাঁর প্রিয় মাদ্রাসার স্মৃতিচারণা করেছিলেন।

ওসমান হাদি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাকে এটা যদি কেউ জিজ্ঞেস করে—আল্লাহ যদি আমাকে আবারও দুনিয়ায় পাঠায়, আমি কয়টা জিনিস চাইব। আমি প্রথমেই বলব—ইন্টার পর্যন্ত যে মাদ্রাসাটায় পড়েছি, সেই মাদ্রাসায় আবার আমি পড়তে চাইব। বাংলাদেশে এটা কেউ চিন্তাও করতে পারবে না যে মাদ্রাসায় রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চস্থ হয়। আমি যখন চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি; তখন ঝালকাঠি থেকে ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে অনেকবার বিতর্ক, আবৃত্তি, বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে এসেছি এবং স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা মিলিয়ে আমি অনেকবার ফার্স্ট হয়েছি।’

ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা শুধু আমি না, ওই প্রতিষ্ঠানের আমার অনেক ছোট ভাই, বন্ধু জাতীয় পর্যায়ের এমন প্রচুর পুরস্কার পেত। আমাদের এমনভাবে কালচারাল নার্সিং হতো—রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, জারি, ভাটিয়ালি আমরা গাইতাম। যেহেতু মাদ্রাসা, তাই একমাত্র নৃত্যটা হতো না।’

মাদ্রাসার গণ্ডি পেরিয়ে ওসমান হাদি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে (২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষ)। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে তিনি প্রাইভেট পড়িয়েছেন, সাইফুর’সসহ বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ তিনি ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা তাঁকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাহসী ভূমিকা এবং পরে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে টক শো ও সভা-সমাবেশে তাঁর যুক্তিপূর্ণ ও ঝাঁজালো বক্তব্য তাঁকে অনেক তরুণের আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকায় রিকশায় যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে আসা দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলেও মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। ১৮ ডিসেম্বর রাত পৌনে ১০টায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার মাত্র এক মাস আগে নভেম্বর মাসে ওসমান হাদি নিজের জীবনের ঝুঁকির কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন। দেশি-বিদেশি অসংখ্য নম্বর থেকে আসা প্রাণনাশের হুমকির কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছিলেন—‘জীবননাশের আশঙ্কা সত্ত্বেও ইনসাফের লড়াই থেকে আমি পিছিয়ে যাব না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জানাজা ও দাফনে অংশ নিলে যে সওয়াব

আবরার নাঈম 
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ৫৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

দুনিয়ার সফরের শেষ গন্তব্য মৃত্যু। মৃত্যু এক অপ্রিয় সত্য, যা সুনিশ্চিত অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)

জানাজার নামাজ ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ কোনো মুসলমান মারা গেলে মহল্লার অল্পসংখ্যক লোক জানাজার নামাজ আদায় করলে বাকিরা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। এ ছাড়া একজন মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের পাঁচটি হক আছে। এর মধ্যে মৃত ব্যক্তির জানাজায় অংশ নেওয়াও একটি হক।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এক মুসলমানের অধিকার অন্য মুসলমানের ওপর পাঁচটি: সালামের জবাব দেওয়া, রোগীকে দেখতে যাওয়া, জানাজার সঙ্গে যাওয়া, দাওয়াত কবুল করা এবং হাঁচি দিলে তার জবাব দেওয়া।’ (রিয়াদুস সলেহিন: ৯০০)

কোনো মুসলমানের জানাজায় অংশগ্রহণ ও তাকে কবরস্থ করা সমাজের মুসলমানদের ইমানি দায়িত্ব। পাশাপাশি এতে রয়েছে অধিক পরিমাণে সওয়াব। যদিও সবার অংশগ্রহণ জরুরি নয়। তাই বলে এমন সওয়াবের কাজ থেকে পিছিয়ে থাকা কখনোই সমীচীন নয়।

জানাজা ও দাফনকার্যে অংশগ্রহণের লাভ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি (আল্লাহর প্রতি) বিশ্বাস রেখে এবং নেকির আশা রেখে কোনো মুসলমানের জানাজার সঙ্গে যাবে এবং তার জানাজার নামাজ আদায় করবে এবং দাফন করা পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকবে, সে দুই কিরাত (পরিমাপের একক) সওয়াব নিয়ে (বাড়ি) ফিরবে। এক কিরাত উহুদ পাহাড়ের সমান। আর যে ব্যক্তি জানাজার নামাজ আদায় করে মৃতকে সমাধিস্থ করার আগেই ফিরে আসবে, সে এক কিরাত সওয়াব নিয়ে (বাড়ি) ফিরবে।’ (রিয়াদুস সলেহিন: ৯৩৫)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জান্নাতে যেমন হবে শহীদের জীবন

ইসলাম ডেস্ক 
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ১৯
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

মৃত্যু এক অনিবার্য ও চিরন্তন সত্য। এই ধরণির ক্ষণস্থায়ী সফর শেষ করে প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর অমীয় স্বাদ গ্রহণ করতে হয় এবং প্রবেশ করতে হয় অনন্তকালের আবাসে। এই চিরসত্য মৃত্যুকে ঘিরে মানুষের জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই, তবে ইসলামের দৃষ্টিতে মৃত্যুপরবর্তী জীবনই হলো প্রকৃত জীবনের সূচনা।

পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এবং কিয়ামতের দিন তাদের পূর্ণমাত্রায় বিনিময় দেওয়া হবে। অতঃপর যাকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা হলো এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো, অবশ্যই সে ব্যক্তি সফলকাম হলো। কেননা, পার্থিব জীবন ছলনার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)

মৃত্যুর বিভিন্ন প্রকারভেদের মধ্যে সবচেয়ে সার্থক ও উত্তম মৃত্যু হলো শহীদি মৃত্যু। তাই প্রত্যেক মুমিনের একান্ত তামান্না থাকে শহীদ হওয়ার। শহীদদের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে, তাদের তুমি মৃত মনে করো না; বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত এবং তাদের রিজিক দেওয়া হয়।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬৯)

হজরত আবদুল্লাহ (রা.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলে নবীজি বলেন, ‘শহীদদের রুহসমূহ সবুজ পাখির উদরে রক্ষিত থাকে, যা আরশের সঙ্গে ঝুলন্ত দীপাধারে বাস করে। জান্নাতের সর্বত্র তারা যেখানে চায় বিচরণ করে এবং পুনরায় সেই দীপাধারগুলোতে ফিরে আসে। একবার তাদের প্রতিপালক তাদের দিকে পরিপূর্ণভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমাদের কি কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে?’’ তারা বিনয়ের সঙ্গে জানাল, ‘‘আমাদের আর কী আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে! আমরা তো জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াচ্ছি।’’ আল্লাহ তাআলা তিনবার এই প্রশ্ন করার পর তারা বুঝতে পারল, আকাঙ্ক্ষার কথা না বললে তারা রেহাই পাচ্ছে না; তখন তারা বলল, ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের আকাঙ্ক্ষা হয়, যদি আপনি আমাদের রুহগুলোকে আমাদের দেহে ফিরিয়ে দিতেন, তবে আমরা পুনরায় আপনার পথে গিয়ে নিহত (শহীদ) হতে পারতাম।’ আল্লাহ যখন দেখলেন, তাদের আর কোনো অপূর্ণতা নেই, তখন তাদের সেই অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হলো।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৭৭৯)

মৃত্যু আসবেই, তবে সেই মৃত্যু যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং ইমানের ওপর অবিচল থেকে, তবেই তা হবে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত