Ajker Patrika

ট্রাম্প–মোদির আলোচনায় শুধুই বাণিজ্য, উপেক্ষিত সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২: ০৮
হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি
হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি

দুই দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে দুই নেতা বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে তাঁরা সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিং করেছেন।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল বাণিজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয় দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্কে ন্যায্যতা ও পারস্পরিক সহযোগিতায় জোর দিয়েছেন। বৈঠকে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস, শুল্কনীতি, প্রতিরক্ষা চুক্তি ও অভিবাসননীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ট্রাম্প ও মোদির বৈঠকে আলোচনার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:

বাণিজ্য সম্পর্ক

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের উচ্চ শুল্কনীতির সমালোচনা করেছে। ট্রাম্প বলেছেন, ভারত যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করবে, আমরাও সেই পরিমাণই আরোপ করব। ট্রাম্পের মতে, উভয় দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে।

ভারত অবশ্য ইতিমধ্যে কিছু মার্কিন পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে মার্কিন রপ্তানিকারক উপকার হতে পারে। বিশেষত, উচ্চমূল্যের মোটরসাইকেল ও গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাসের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। এই উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে এবং বাণিজ্য উত্তেজনা হ্রাসের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও গভীর হচ্ছে। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ভারতের কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করা হবে, যার মধ্যে সম্ভাব্য এফ–৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমানও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বাজারে নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে চায়। ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য হলো, ভারতকে আমেরিকান প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীল করে তোলা এবং প্রতিরক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা গড়ে তোলা।

আন্তর্জাতিক কৌশলগত সম্পর্ক

এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায়। ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, ভারত–যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব কেবল বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা নিরাপত্তা এবং কৌশলগত বিষয়ে আরও গভীর হবে। এই লক্ষ্যে তারা কোয়াডকে (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের জোট) আরও শক্তিশালী করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২০ সালের গালোয়ান উপত্যকায় ভারত–চীন সীমান্তরক্ষীদের সংঘর্ষের পর ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরও গভীর করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ভারত চায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও স্থিতিশীল হোক এবং এর মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারুক।

বাংলাদেশ ইস্যু

চীনের প্রভাব ঠেকাতে ভারতকে আরও সহযোগিতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের ইঙ্গিত মিলেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যে। সম্প্রতি বাংলাদেশে গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ভারত ঘনিষ্ঠ শেখ হাসিনাকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’–এর কোনো হাত ছিল না—এ প্রশ্ন করেছিলেন এক সাংবাদিক।

জবাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটে মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’-এর কোনো ভূমিকা নেই। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিষয়টি আমি মোদির কাছেই ছেড়ে দিতে চাই!’

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের ডিপ স্টেটের এখানে (বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে) কোনো ভূমিকা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। এটা নিয়ে (ভারত) শত শত বছর ধরে কাজ করছে। বস্তুত, আমি এ রকমই পড়েছি।’ ‘কাজেই বাংলাদেশের বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীর ওপরই ছেড়ে দেব।’ এই বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাশে বসা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে ইঙ্গিত করেন।

অভিবাসন নীতি

অভিবাসন ইস্যুতেও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এই ইস্যুটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। ফলে তিনি এতে ছাড় দিতে চান না। এরই মধ্যে শতাধিক অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীকে ফেরত পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি কোনো দর-কষাকষিতে যাচ্ছেন না নরেন্দ্র মোদি।

মোদি ঘোষণা করেছেন, অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীদের দেশে ফেরত নিতে ভারত প্রস্তুত রয়েছে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, মানবপাচার চক্রের কারণে অনেকেই অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে।

যেখানে ভারতের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ২৪ শতাংশই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। টাকার অঙ্কের সেটি প্রায় ৯০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।

সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার ইস্যু উপেক্ষিত

ওয়াশিংটন ডিসিতে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করলেও ব্রিফিংয়ে এবং অনলাইন বিবৃতিতে মানবাধিকার ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

ওয়াশিংটনের বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের মানবাধিকার সংক্রান্ত ইস্যুগুলো ওয়াশিংটনের কূটনীতিতে কম গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ, যেমন চীনের প্রভাব মোকাবিলা এবং ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত করা, মানবাধিকার আলোচনার চেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কঠোর অবস্থান নেবে বলে আশা করা যায় না। তাঁর পররাষ্ট্রনীতি মূলত স্বার্থভিত্তিক, যেখানে মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধভিত্তিক বিষয়গুলোর জন্য বিশেষ স্থান নেই।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মানবাধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন, বাক্‌স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর আঘাতের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, ভারত এই প্রতিবেদনগুলোকে ‘গভীরভাবে পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন মানবাধিকার ইস্যুতে ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নেওয়ার ফলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও মজবুত হবে। কিন্তু একই সঙ্গে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

মুম্বাই হামলার অভিযুক্তকে ফেরতের প্রতিশ্রুতি

মুম্বইয়ে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর সন্ত্রাসী হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযুক্ত তাহাউর হুসেন রানাকে প্রত্যর্পণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে ইসলামিক সন্ত্রাস রুখতে যৌথভাবে কাজ করবে ভারত–আমেরিকা।’

কানাডার নাগরিক রানা এখন যুক্তরাষ্ট্রের জেলে রয়েছে। মুম্বাইয়ে ওই হামলায় নিহতদের মধ্যে ছয় মার্কিন নাগরিকও ছিলেন। ২০১৩ সালে তাঁকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা দেয় আমেরিকার আদালত। ২০২০ সালে স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় তাঁকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। কিন্তু ভারতের প্রত্যর্পণের আবেদনে হত্যা মামলায় ফের তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছর আগস্টে মার্কিন কোর্ট অব আপিল ফর নাইনথ সার্কিট তাহাউরের প্রত্যর্পণে সায় দেয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে খাওয়ার খরচ চায় পুলিশ

রেমিট্যান্সের নামে ৭৩০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছেন একজন, কার কথা বললেন এনবিআর চেয়ারম্যান

ভারতে বসেছে বিশ্বের গোয়েন্দাপ্রধানদের আসর, কী হচ্ছে সেখানে

মামলা করতে যাওয়া নারীর কাছ থেকে টাকা ‘কেড়ে নিলেন’ এসআই

বিয়ে করলেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ নেতা রাফি, কনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত