Ajker Patrika

শ্যামদেশে এক সাপের আস্তানা

পরাগ মাঝি, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ জুন ২০২৪, ০৯: ২৬
শ্যামদেশে এক সাপের আস্তানা

রাষ্ট্রশক্তির গহিনে চলে অন্তর্ঘাতের খেলা। সেই খেলায় ভর দিয়ে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠে ভয়ংকর সন্ত্রাসের নেটওয়ার্ক। এই চক্রের পাঁকে পড়ে কেউ খুনি, কেউ ডাকাত, কেউ ধর্ষক ও লুটেরা হয়। মানবতার সেখানে কোনো ঠাঁই নেই, পাগলামিই হয়ে ওঠে মুখ্য। দুনিয়াজুড়ে বেড়ে ওঠা এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আজকের পত্রিকার এই সিরিজ প্রতিবেদন। তবে বলে রাখা ভালো, এটা কোনো মৌলিক রচনা নয়, সংকলনমাত্র। প্রকাশিত হয় প্রতি শুক্রবার দুপুরে, আজ তার তৃতীয় কিস্তি।

দুটি লাশই বিকৃত হয়ে গেছে। পাশাপাশি রাখা হয়েছে মর্গে। লাশের গন্ধ ঢাকতে যে ওষুধ ছিটানো হয়েছে, তার গন্ধেও গা গুলিয়ে আসে। এর মাঝেই লাশ দুটির মুখের ওপর ঝুঁকে আছেন এক দন্তচিকিৎসক। মাথা উঁচিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তাঁরা দুজনই। ময়নাতদন্ত করা প্যাথলজিস্ট জানালেন, মেয়েটির মাথায় ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল, আর ছেলেটিকে শ্বাসরোধ। আর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময়ও তাঁরা জীবিতই ছিলেন। 

১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের ওই মর্গের স্মৃতি এখনো স্পষ্ট মনে আছে ডাচ কূটনীতিক হারম্যান নিপেনবার্গের। ৩০ বছরের চাকরি জীবনে এমন বিভীষিকাময় দৃশ্য তিনি আর কখনোই দেখেননি। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বিচারের মুখোমুখি করতে পরবর্তী এক দশকেরও বেশি সময় কেটে যায় তাঁর। কারণ, ছেলে-মেয়ে দুটি তাঁর দেশ নেদারল্যান্ড থেকেই থাইল্যান্ডে ঘুরতে এসেছিলেন। মাসখানেক আগেই নেদারল্যান্ডস থেকে চিঠি লিখে তাঁদের খোঁজ জানতে চেয়েছিলেন এক ব্যক্তি। 

চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, এশিয়ায় ভ্রমণরত শ্যালিকা ও তাঁর প্রেমিক প্রতি সপ্তাহেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে নিজেদের পরিবারের কাছে অন্তত দুটি করে চিঠি লিখতেন। কিন্তু হঠাৎ তাঁরা দুজনই চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি ছয় সপ্তাহ কেটে গেলেও তাঁদের লেখা কোনো চিঠি পাওয়া যায়নি। 

ব্যাংকক থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে আয়ুথায়ার কাছাকাছি একটি রাস্তায় ডাচ ব্যাকপেকার হেনরিকাস ও কর্নেলিয়ার পুড়ে যাওয়া লাশ দুটি পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমে তাঁদের নিখোঁজ হয়ে থাকা এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি ভেবেছিল সবাই। যদিও অস্ট্রেলিয়ান ওই দম্পতিকে পরে জীবিতই পাওয়া গিয়েছিল। এক দন্তচিকিৎসকের সহযোগিতায় দাঁতের চিহ্ন মিলিয়ে লাশ দুটি শেষ পর্যন্ত নিজ দেশের নিখোঁজ দুই ব্যাকপেকারের বলেই নিশ্চিত হয়েছিলেন ডাচ কূটনীতিক নিপেনবার্গ। দীর্ঘদিনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিনি এটাও নিশ্চিত হয়েছিলেন, নৃশংস এই খুনের পেছনে যিনি ছিলেন তাঁর নাম চার্লস শোভরাজ! 

  ডাচ ব্যাকপেকার কর্নেলিয়ার ও হেনরিকাস।১৯৭০-এর দশকে আজকের দিনের মতো গগনচুম্বী অট্টালিকার নগরী ছিল না ব্যাংকক। ছিল না পাতাল রেল, স্কাই-ট্রেনের মতো আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থাও। তবু প্রাচ্যে অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বেড়ানো পশ্চিমা তারুণ্যের কাছে থাইল্যান্ড ছিল এক স্বপ্নের জগৎ। ব্যাংককের উষ্ণ, আর্দ্র রাস্তাগুলোতে তখনো উপচে পড়ছিল পর্যটক আর ভ্রমণকারীরা। সেই আমলের মন্থর যোগাযোগব্যবস্থায় শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পৌঁছাতে লেগে যেত কয়েক ঘণ্টা। 

কোনো স্মার্টফোন বা সোশ্যাল মিডিয়াও না থাকায় সেই সময়টিতে ভ্রমণকারীদের কেউ নিখোঁজ হয়ে গেলে তা অজানা থেকে যেত সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিংবা মাস। এমন একটি শহরের কোলাহলপূর্ণ বাজার আর শান্ত মন্দিরগুলো লুকিয়ে রেখেছিল শোভরাজের মতো এক ধুরন্ধর শিকারিকেও। রঙিন চকমকে জীবনের খোলসে অনায়াসে তিনি মিশে গিয়েছিলেন শহরের প্রাণবন্ত আড্ডা, হাসি, তামাশায়। সুযোগ পেলেই ছোবল মারা ছিল তাঁর স্বভাব। সর্প স্বভাবের এই মানুষটিই পরবর্তীকালে হতে যাচ্ছিলেন বিংশ শতকের সবচেয়ে কুখ্যাত এবং অধরা সিরিয়াল কিলারদের একজন। 

থাইল্যান্ডে শোভরাজ নিজেও ছিলেন বিদেশি। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের সূত্রে ফরাসি নাগরিক হলেও তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয়, আর মা ছিলেন ভিয়েতনামি। শোভরাজের জন্মও ভিয়েতনামে, ১৯৪৪ সালে। ভিয়েতনাম ও ভারতের সংমিশ্রণ তাঁর চেহারাকে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল। এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজের মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ করে দেয়। বিশেষ করে, নারীদের সঙ্গে ভাব জমাতে পটু ছিলেন তিনি।

 শোভরাজকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে ’দ্য সার্পেন্ট’ সিনেমা।১৯৭০-এর দশকের শুরুর দিকে একজন সুচতুর ঠগবাজ হিসেবে আবির্ভূত হন শোভরাজ। চুরি করা অসংখ্য পাসপোর্ট আর ছদ্মনাম ব্যবহার করে তিনি তখন ঘুরে বেড়াতেন আজ এই দেশ তো কাল ওই দেশ। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে তাঁর আনাগোনা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই সময়টিতে পশ্চিম থেকে প্রাচ্য আবিষ্কার করতে আসা ব্যাকপেকার তরুণ-তরুণীরাই ছিলেন তাঁর প্রধান শিকার। ভ্রমণরত মানুষের বিশ্বাস এবং সরলতার সুযোগ নিয়ে সর্বস্ব লুট করে নেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। ব্যাকপেকারদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ গাইড কিংবা সহযাত্রী হয়ে সহজেই মিশে যেতেন তিনি। একবার তাঁর পাল্লায় পড়ে গেলে পর্যটকদের তিনি মাদকে ডুবিয়ে দিতেন। পরে সুযোগ বুঝে টাকাপয়সা এবং মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে চম্পট দিতেন। এটা করতে গিয়ে প্রয়োজন হলে তিনি খুনের পথও বেছে নিতেন। 

শোভরাজের সবচেয়ে কুখ্যাত ছদ্মনামটি ছিল অ্যালাইন গোতিয়ার। এই নামের আড়ালেই তিনি তাঁর প্রেমিকা মেরি আন্দ্রে ল্যাক্লার্ক ওরফে মনিককে নিয়ে থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে একের পর এক অপারেশন চালাতেন। থাইল্যান্ডে থাকা অবস্থায় প্রায় সময়ই ব্যাংককের ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে তাঁরা শিকারকে প্রলুব্ধ করে নিয়ে যেতেন, কিংবা কোনো আড্ডায় আমন্ত্রণ জানাতেন। পরে শিকারের পানীয়তে মিশিয়ে দিতেন মাদকের ওভারডোজ। লুণ্ঠনের প্রমাণ মুছে দিতে শিকারকে প্রায়ই তাঁরা খুন করে গুম করে ফেলতেন। এই কাজে সহযোগিতার জন্য অজয় চৌধুরী নামে এক ভারতীয়কেও দলভুক্ত করেছিলেন শোভরাজ। 

জীবনীকারদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে অন্তত ১২টি খুনের কথা শোভরাজ নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন। তাঁর এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন তেরেসা নোল্টন ও কনি জো ব্রোঞ্জিচ নামে দুই মার্কিন নারী ব্যাকপেকারও। বিকিনি পরা অবস্থায় তেরেসার মরদেহটি ভাসছিল থাইল্যান্ডের পাতায়া সমুদ্র উপকূলে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল, হয়তো সাঁতার কাটতে গিয়েই প্রাণ হারিয়েছেন তেরেসা। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে শোভরাজই তাঁকে নেশাগ্রস্ত করে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আরেক আমেরিকান ব্যাকপেকার কনি জো ব্রোঞ্জিচের পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছিল নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর উপকণ্ঠে। এই দুটি ছাড়াও শারমাইন ক্যারো নামে আরও এক ফরাসি নারীর হত্যাকাণ্ড ‘বিকিনি কিলার’ হিসেবে পরিচিতি দেয় শোভরাজকে। তিনি শারামাইনের আগে তাঁর তুর্কি প্রেমিককেও খুন করেছিলেন। প্রেমিকের খোঁজে থাইল্যান্ডে এসে শারমাইন নিজেও শোভরাজের শিকারে পরিণত হন। তেরেসার মতো বিকিনি পরা অবস্থায় শারমাইনের লাশটিও সমুদ্রের পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। 

শুধু থাইল্যান্ড আর নেপাল নয়, ভারতেও দুই পর্যটককে খুনের দায়ে অভিযুক্ত ছিলেন শোভরাজ। তাঁর প্রতারণার জাল বিস্তৃত ছিল মালয়েশিয়া, তুরস্ক, গ্রিস ও আফগানিস্তানেও। তবে তাঁর অহংকার এবং কুখ্যাতির আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত তাঁকে পতনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে শুরু করা ডাচ কূটনীতিক হারম্যান নিপেনবার্গের তদন্তই ঠান্ডা মাথার ওই খুনিকে শনাক্ত করে। তবে অকাট্য প্রমাণ হাতে আসার পরও কর্তৃপক্ষের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন শোভরাজ। থাইল্যান্ডে ধরা পড়ার আগেই প্রেমিকা মনিককে নিয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং যথারীতি সেখানেও নিজের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ে নয়াদিল্লিতে ফরাসি শিক্ষার্থীদের একটি দলকে মাদকে অচেতন করে সর্বস্ব লুট করতে চেয়েছিলেন তিনি। পরিকল্পনাটি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলে বিষপান ও ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ভারতের পুলিশ। পরে তিহার জেলে তাঁর ১২ বছরের সাজা হয়। 

পৃথিবীর আলোচিত এই সিরিয়াল কিলার এখনো জীবিত আছেন। বিমানে তাঁর পরিচয় জেনে কিছুটা সরে গেলেন পাশের যাত্রী।কারাগারের ভেতরেও নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন কুখ্যাত এই বিকিনি কিলার। তিহার জেলে সেই সময় সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন সুনীল গুপ্ত। কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি বইয়ে সুনীল জানিয়েছেন, কারাগারের ভেতর শোভরাজ এমন সব বিশেষ সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতেন, সাধারণ কর্মীদের কাছে যা ছিল অকল্পনীয়। পছন্দ অনুযায়ী খাবার তো বটেই, আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিতেন তিনি। কয়েদি হিসেবে ওয়ার্ডে থাকার কথা থাকলেও জেলের ভেতর তিনি অবাধে ঘুরে বেড়াতেন। 

গুপ্তের মতে, কারাগারে থাকা ধনী কয়েদিদের সঙ্গে সখ্য এবং আইনি পরামর্শ দিয়ে অনেক অর্থ হাতিয়ে নিতেন শোভরাজ। আর এসব অর্থ রক্ষীদের ঘুষ হিসেবে দিয়ে কারাগারকে নিজের বাড়িতে পরিণত করেছিলেন তিনি। সুনীল লিখেছেন সবাই তাঁকে ভয় পেত, সমীহ করত। 

১৯৮৬ সালে একবার তিনি জেল থেকেও পালাতে সক্ষম হন। তবে তা কিছু সময়ের জন্য। নিজের ইচ্ছায়ই পরে আবার ধরা পড়েছিলেন। ধুরন্ধর শোভরাজ এভাবে মূলত নিজের সাজার মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে চাইছিলেন। কারণ, ভারতের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গেলে থাইল্যান্ডে প্রত্যর্পণ হওয়ার আশঙ্কা ছিল তাঁর। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল মৃত্যুদণ্ড। পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত সফলও হয়। জেল পালানোর অপরাধে ভারতে তাঁর সাজার মেয়াদ আরও ১০ বছর বেড়ে যায়। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ভারতের জেলেই ছিলেন। তত দিনে সংবিধান অনুযায়ী থাইল্যান্ডে তাঁর মৃত্যুদণ্ড তামাদি হয়ে গিয়েছিল। 

ভারতে মুক্তির পর তাই নিজের দেশ ফ্রান্সে ফিরে যান শোভরাজ। অবাক করা বিষয় হলো, ফ্রান্সে তিনি খোলাখুলিভাবেই থাকতেন এবং অর্থের বিনিময়ে নিজের অপরাধের বর্ণনা দিয়ে নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিয়ে বেড়াতেন। তবে তাঁর সেই স্বাধীনতা খুব বেশি দিন টেকেনি। কারণ, ২০০৩ সালে তিনি ভুল করে আবারও নেপালে পা রেখেছিলেন, যেখানে তিনি অন্তত দুজন পর্যটককে খুনের দায়ে ওয়ান্টেড ছিলেন। তাঁর উপস্থিতি নজর এড়ায়নি নেপাল কর্তৃপক্ষের। ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে দেশটির পুলিশ এবং বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 

নেপালের কারাগারে থাকা অবস্থায় নিজের চেয়ে ৪৪ বছরের ছোট নিহিতা বিশ্বাসকে বিয়ে করেন শোভরাজ২০২২ সালে নেপালের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে আরও এক নজির গড়েন তিনি। ২০০৮ সালে নেপালের কারাগারে থাকা অবস্থায়ই ৬৪ বছর বয়সে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজের আইনজীবীর ২০ বছর বয়সী কন্যা নিহিতা বিশ্বাসকে বিয়ে করেন তিনি। নেপালের কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শোভরাজের অপরাধের দুনিয়ায় বিমোহিত হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। তাঁর প্রতারণা ও খুনের গল্প নিয়ে রচিত হতে থাকে বই, তথ্যচিত্র, এমনকি পরবর্তী সময়ে ‘দ্য সার্পেন্ট’ নামে একটি হিট টিভি সিরিয়ালও নির্মিত হয় তাঁর জীবনের অনুপ্রেরণায়। 

ইতিহাসের কুখ্যাত এই খুনি এখনো ফ্রান্সের মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অর্থের বিনিময়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। এমনকি তাঁর জীবনী লিখতে চাওয়া এক লেখককে অনুমতি দিতে সম্প্রতি দেড় মিলিয়ন ডলারও দাবি করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিনের দিল্লি সফর: ভারসাম্য রক্ষার কৌশলে ভারত, অস্ত্র–তেল বিক্রি বাড়াতে চায় রাশিয়া

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে শীর্ষ সম্মেলন শুরু করেছেন। যেখানে বাণিজ্য এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চাপানো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর এই শুক্রবারের এই সম্মেলন পুতিনের ভারতে প্রথম সফর। এই সম্মেলন এক সময় হচ্ছে যখন ভারত রুশ তেল কেনার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের মুখোমুখি।

আলোচনা শুরুর সময় মোদি পুতিনকে বলেন, ‘ভারত নিরপেক্ষ নয়—ভারতের একটি অবস্থান আছে, আর সেই অবস্থানটি হলো শান্তির পক্ষে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তির জন্য নেওয়া সমস্ত প্রচেষ্টাকে সমর্থন করি এবং শান্তির জন্য গ্রহণ করা প্রতিটি উদ্যোগের পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াই।’

জবাবে পুতিন সংঘাত মেটানোর লক্ষ্যে মোদির মনোযোগ এবং প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান। পুতিন বলেন, ‘ইউক্রেনে কী ঘটছে এবং এই সংকটের সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে আমরা অন্যান্য কয়েকটি শরিক, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যৌথভাবে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি—তা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার সুযোগ আমরা পেয়েছি এবং আপনি আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।’

পুতিনের এই সফর এমন এক সময়ে এল—যখন মস্কো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চাইছে। ভারত রাশিয়ার অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের সর্বোচ্চ ৬৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে তাঁরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে বাড়াতে চান।

শুক্রবার পুতিনের সফরসূচি শুরু হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার মাধ্যমে, যেখানে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। পুতিনকে স্বাগত জানাতে মুর্মুর সঙ্গে মোদিও উপস্থিত ছিলেন এবং সেখানে পুতিনকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এরপর পুতিন রাজঘাটে গিয়ে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধে মাল্যদান করেন।

বৃহস্পতিবার মোদি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিমানবন্দরে হাজির হয়ে পুতিনকে আলিঙ্গন ও হাত মিলিয়ে স্বাগত জানান। পরে তিনি রুশ নেতাকে তাঁর বাসভবনে এক নৈশভোজে আপ্যায়ন করেন। দিল্লি থেকে আল–জাজিরার সাংবাদিক নেহা পুনিয়া মন্তব্য করেন, ‘অনেক আলিঙ্গন ও হাত মেলানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন নজর শুক্রবারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের দিকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুই নেতা এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করবেন যে—রুশ নেতা একঘরে নন এবং পশ্চিমা দেশগুলির চাপ সত্ত্বেও ভারতের মতো দেশ তাঁকে স্বাগত জানায়।’

২০২৩ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ইউক্রেনীয় শিশুদের বেআইনিভাবে নির্বাসনের অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। ভারত আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র নয় এবং তার চুক্তি বা নিয়মের দ্বারা আবদ্ধও নয়। সেই কারণে পুতিন গ্রেপ্তারের ভয় ছাড়াই ভারতে সফর করতে পেরেছেন।

রুশ নেতা স্থানীয় সময় আজ শুক্রবার রাত ৯টায় ভারত ছাড়বেন। রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে ২৫ বছর ধরে কৌশলগত শরিকানা রয়েছে, যা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পুতিনের প্রথম বছর থেকেই শুরু। তবে, রাশিয়ার ২০২২ সালের আগ্রাসনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখার এই ভারসাম্যের কাজটি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। রুশ কার্যক্রমের কারণে নেতাদের বার্ষিক সফরের বহুদিনের প্রথা ব্যাহত হয়। তবে গত বছর মোদির রাশিয়া সফরের মাধ্যমে তা কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

যুদ্ধের মধ্যে পশ্চিমা দেশগুলো যখন রুশ অপরিশোধিত তেলের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে শুরু করে, ভারত তখন তার ক্রয় বাড়ায়। কিন্তু আগস্টে ট্রাম্প পুতিনকে যুদ্ধবিরতি মানতে চাপ দেওয়ার জন্য, ভারতের রুশ তেল কেনার শাস্তিস্বরূপ ভারতীয় পণ্যের ওপর পূর্বে আরোপিত ২৫ শতাংশ শুল্ক দ্বিগুণ করে ৫০ শতাংশ করে দেন। তা সত্ত্বেও ভারত রুশ তেল কেনা চালিয়ে যায়।

তবে এখন পরিস্থিতি বদলাচ্ছে—নভেম্বরে রুশ তেল কোম্পানি রোজনেফ্ট এবং ল্যুকওয়েলের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়, সঙ্গে এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যকারী অন্য দেশের সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞার হুমকি আসে। ভারতের মোট তেল আমদানির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই দুটি কোম্পানি থেকে।

নয়াদিল্লি জানিয়েছে, তাদের অন্যায়ভাবে নিশানা করা হচ্ছে। তারা উল্লেখ করে যে—পশ্চিমা দেশগুলোও যখন তাদের স্বার্থে প্রয়োজন হয়, তখন মস্কোর সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যায়। নয়াদিল্লি আসার আগে এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে পুতিনও একইরকম যুক্তি দেন। তিনি বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেরাই তাদের নিজস্ব পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এখনো আমাদের কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানি কেনে।’ তিনি আরও যোগ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যদি রুশ জ্বালানি কেনার অধিকার থাকে, তবে ভারতেরও ‘একই সুবিধা’ পাওয়া উচিত।

পুতিন ভারতকে আরও রুশ অস্ত্র কেনার জন্য চাপ দেবেন বলেও আশা করা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রেও নয়াদিল্লিকে ওয়াশিংটনের চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। মস্কো ভারতকে আরও এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং এসইউ-৫৭ স্টেল্থ যুদ্ধবিমান বিক্রি করার আশা করছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের জন্য চাপ দিতে এই শুক্রবারের বৈঠকের মাত্র কয়েক দিন আগেই পুতিন মস্কোয় মার্কিন এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করেন। সেই বৈঠকের পর উভয় পক্ষই অগ্রগতির প্রশংসা করে, যদিও কোনো যুগান্তকারী সমাধান হয়নি। বৃহস্পতিবার মার্কিন কর্মকর্তারা ইউক্রেনের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন। ভারত যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার নিন্দা করা থেকে বিরত থেকেছে এবং আলাপ-আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে শান্তির আহ্বান জানিয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দক্ষিণ কোরিয়ার পারমাণবিক সাবমেরিন প্রকল্প: এশিয়ায় উসকে দেবে সমুদ্রতলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
দক্ষিণ কোরিয়ার এ উদ্যোগ পানির নিচে অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ কোরিয়ার এ উদ্যোগ পানির নিচে অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনের পর দক্ষিণ কোরিয়ার পরমাণুচালিত সাবমেরিন প্রকল্প নতুন গতি পেয়েছে। দীর্ঘদিনের মার্কিন আপত্তি দূর হওয়ায় এই উদ্যোগ এখন এশিয়ার নিরাপত্তাকাঠামো পাল্টে দিতে পারে এবং পানির নিচে নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে।

উত্তর কোরিয়াকে মোকাবিলায় বহুদিন ধরে পরমাণুচালিত সাবমেরিনের অভিজাত ক্লাবে যোগ দিতে চেয়েছে সিউল। ট্রাম্পের সম্মতি পাওয়ায় দুই দেশের পারমাণবিক চুক্তির আওতায় জ্বালানির প্রবেশাধিকার মিলেছে, যা এত দিন ছিল বড় বাধা।

তবে বিশ্লেষক ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার দ্রুত অগ্রসরমাণ এই কর্মসূচি চীনকে বিরক্ত করতে পারে এবং জাপানকেও একই ধরনের সক্ষমতা অর্জনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সাবমেরিন ক্যাপ্টেন চোই ইল বলেন, সাবমেরিন অত্যন্ত কার্যকর আক্রমণাত্মক অস্ত্র। তাই এই অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা অনিবার্য।

সিউলের যুক্তি, উত্তর কোরিয়ার পানির নিচে থাকা হুমকি, বিশেষ করে সাবমেরিন থেকে নিক্ষেপযোগ্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় পরমাণুচালিত সাবমেরিন অপরিহার্য।

দক্ষিণ কোরিয়া অবশ্য বারবার বলছে, পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করবে না তারা।

গত বুধবার ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক থেকে পাওয়া এই চুক্তিকে ‘বড় ধরনের সাফল্য’ হিসেবে অভিহিত করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিউং।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, এটি দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নমনীয়তা বাড়াবে।

এদিকে উত্তর কোরিয়া দাবি করেছে, তারাও একই ধরনের সক্ষমতা বিকাশে মনোনিবেশ করেছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গত মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখায়, কিম জং-উন একটি তথাকথিত পরমাণুচালিত সাবমেরিন পরিদর্শন করেছেন।

উত্তর কোরিয়ার কর্মসূচি কতটা এগিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে কিছু বিশ্লেষকের সন্দেহ, পিয়ংইয়ং হয়তো রাশিয়ার সহায়তা পাচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া জানিয়েছে, তারা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করছে, তবে প্রযুক্তিগত সহযোগিতার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানায়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

২০ বছর অন্ধকারে বন্দী, মৃত্যুর হুমকিতে থেমে যাওয়া শৈশব-কৈশোর

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: এনডিটিভি
ছবি: এনডিটিভি

পৃথিবী যখন খেলায় মত্ত, তখন তিনি বন্দী ছিলেন অন্ধকারে। ছয় বছর বয়সে ঘরবন্দী হওয়া লিসা ২০ বছর পর সেই দরজা পেরিয়ে বাইরে এলেও আলো দেখার ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন।

কিছু গল্প ক্ষতের মতো করে উন্মোচিত হয়। কিছু শৈশব যেন কোনোদিনই শুরু হয় না। লিসার জীবন তেমনই এক গল্প। নিঃশব্দে হারিয়ে যাওয়া এক শৈশবের, পরিস্থিতিতে মুছে যাওয়া এক শিশুর এবং এক নারীর।

যে বয়সে শিশুরা বর্ণমালা শেখে, ছত্তিশগড়ের বাস্তার জেলার বাকাওয়ান্দ গ্রামের বাসিন্দা লিসা তখন ভয়কে জানছিলেন। ছয় বছর বয়সেই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয় বাইরের জগতের সব শব্দ। বাড়ির দরজা শুধু খাবারের জন্য খুলত, জীবনের জন্য নয়। ২০ বছর পর কর্তৃপক্ষ যখন তাঁকে খুঁজে পায়, তখন তাঁর চোখে নয়, স্মৃতিতেও ছিল শুধু অন্ধকার।

ছায়াই ছিল তাঁর পরিচয়। কথোপকথন বলতে ছিল শুধু দরজার নিচ দিয়ে ঠেলে দেওয়া থালাবাটির শব্দ। দুই দশক ধরে বন্দিদশার পর এখন তিনি নিজের নামে সাড়া দিতেও হিমশিম খান।

লিসার বন্দিত্ব শুরু হয়েছিল না লোহার শিক দিয়ে, না শিকল দিয়ে—শুরু হয়েছিল আতঙ্ক দিয়ে।

২০০০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় গ্রামের এক ব্যক্তি তাঁকে হত্যার হুমকি দেন। সেই কথায় আতঙ্ক এত গভীর হয়, তিনি নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন নীরবতায়। এরই মধ্যে মারা যান তাঁর মা। কৃষক বাবা হয়ে পড়েন দুর্বল ও আতঙ্কিত। কোনো সহায়তা নেই, নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই, কারও কাছে ভরসা চাওয়ার নেই। তাই তিনি এমন এক সিদ্ধান্ত নেন, যা মেয়ের জীবনের পরবর্তী ২০ বছর নির্ধারণ করে দেয়।

তিনি মেয়েকে মাটির ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখেন। বলেন, অন্ধকারই তাঁকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে। জানালাবিহীন একটি ঘরই হয়ে ওঠে তাঁর পৃথিবী। না সূর্যের আলো। না কোনো কথা। না কোনো মানুষের স্পর্শ।

শুধু দরজায় রেখে যাওয়া এক প্লেট খাবার আর প্রতিদিন একটু একটু করে সংকুচিত হয়ে যাওয়া জীবনের প্রতিধ্বনি।

যে ব্যবস্থা তাঁকে রক্ষা করবে ভাবা হয়েছিল, তা-ই শেষমেশ তাঁকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে নেয়।

সমাজকল্যাণ দপ্তরের দল যখন কুঁড়েঘরে প্রবেশ করে, তারা দেখতে পায় এক নারীকে, যাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।

চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘদিন প্রাকৃতিক আলো থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে লিসার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। তাঁর মানসিক বিকাশও গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়েছে। আচরণ বয়সের তুলনায় অনেক কম বয়সী শিশুর মতো। প্রতিটি শব্দে ভয় পান। যেকোনো স্পর্শে চমকে ওঠেন।

উদ্ধারের পর লিসাকে নিয়ে যাওয়া হয় জগদলপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, যেখানে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার বিস্তারিত পরীক্ষা শুরু হয়। প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, লিসার শৈশব থেমে যায় প্রবল ট্রমায় আর প্রাপ্তবয়স্ক জীবন গঠিত হয়েছে ইন্দ্রিয়ের বঞ্চনায়।

সমাজকল্যাণ দপ্তর পুরো ঘটনায় এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে।

কর্তৃপক্ষ লিসার পরিবার ও প্রতিবেশীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে—কেন তিনি ২০ বছর ধরে বন্দী ছিলেন এবং এই বন্দিত্ব আইনবহির্ভূত আটক হিসেবে বিবেচিত হবে কি না।

জেলার প্রশাসন কর্মকর্তারা বলেন, ‘তদন্ত রিপোর্ট জমা পড়লে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

এ ছাড়া কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখছে, লিসার বাবা কি ভয়ে ও অজ্ঞতার কারণে স্কুল, পঞ্চায়েত বা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে কোনো সাহায্য চাননি?

লিসা বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের এক আশ্রমে আছেন, যেখানে সেবাকর্মী ও কাউন্সেলররা তাঁকে নতুন করে জীবন খুঁজে পেতে সহায়তা করছেন।

তথ্যসূত্র: এনডিটিভি

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইন্ডিগোর ফ্লাইট বিপর্যয়: পানি-খাবারহীন অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা হাজারো যাত্রী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ০৩
ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারণে ভোগান্তির শিকার হন হাজারো যাত্রী। ছবি: সংগৃহীত
ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিপর্যয়ের কারণে ভোগান্তির শিকার হন হাজারো যাত্রী। ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে যাত্রীরা নিজেদের মালপত্র হাতে পেতে রীতিমতো সংগ্রাম করছেন। খাবার–পানির কোনো ব্যবস্থা নেই আর ইন্ডিগোর কাউন্টারগুলো ফাঁকা। ভারতের অন্যতম বৃহত্তম বিমান সংস্থা ইন্ডিগোর পরিচালনগত ত্রুটির কারণে পাঁচ শতাধিক ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় ভারতের বিমানবন্দরগুলোতে এমন বিশৃঙ্খল দৃশ্য দেখা গেছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি সরেজমিনে দেখেছে, দিল্লি বিমানবন্দরের টার্মিনালে হাজার হাজার স্যুটকেস পড়ে রয়েছে। বহু যাত্রী মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েছেন আর কেউ কেউ ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

এক যাত্রী ইন্ডিগোর এই ব্যর্থতাকে ‘মানসিক অত্যাচার’ বলে অভিহিত করে এনডিটিভিকে জানান, ১২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তিনি বিমান সংস্থাটির কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট জবাব পাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘আমি ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এখানে। প্রতিবার তাঁরা বলছেন—এক ঘণ্টা দেরি, দুই ঘণ্টা দেরি। আমরা একটা বিয়েতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমাদের মালপত্র পর্যন্ত হাতে নেই। ইন্ডিগোর কর্মীরা আমাদের কিছু বলছেন না। এই মুহূর্তে এটি সবচেয়ে খারাপ বিমান সংস্থা। আমি বুঝি না কেন তাঁরা নতুন যাত্রী নিচ্ছেন আর মালপত্র জমিয়ে রাখছেন।’

আরও এক যাত্রী জানালেন, তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ‘তারা বারবার ফ্লাইট পিছিয়ে দিচ্ছে। ইন্ডিগোর তরফ থেকে আমরা কোনো স্পষ্ট খবর পাচ্ছি না।’ আরও এক যাত্রী বলেন, ‘খুবই মানসিক চাপের বিষয় এটা। ১৪ ঘণ্টা ধরে আমি বিমানবন্দরে বসে আছি। খাবার বা অন্য কিছুর জন্য কোনো কুপন নেই। আমার কানেকটিং ফ্লাইটটি বাতিল হয়েছে। যাত্রীরা চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন, কিন্তু কর্মীরা কোনো স্পষ্ট জবাব দিচ্ছেন না। এমন জরুরি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কর্মীদের বিন্দুমাত্র প্রশিক্ষণ নেই।’

হায়দরাবাদ বিমানবন্দরসহ অন্যান্য বিমানবন্দরেও একই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে। আটকা পড়া যাত্রীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ছিলেন। কারণ, তাঁদের কোনো খাবার বা থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়নি। একদল যাত্রী প্রতিবাদস্বরূপ একটি এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট পর্যন্ত আটকে দিয়েছিলেন।

হায়দরাবাদ বিমানবন্দরের এক যাত্রী বলেন, ‘আমার ফ্লাইট গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ছাড়ার কথা ছিল। আমি আমার সহকর্মীকে নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছাই। আমাদের বলা হয়েছিল, ফ্লাইট সময়মতো চলবে। এখন আমরা এখানে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আছি। ইন্ডিগো আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা দেয়নি। তারা শুধু বলে চলেছে, অনির্দিষ্টকালের জন্য দেরি হচ্ছে। আমাদের কোনো স্পষ্ট খবর, খাবার বা পানি দেওয়া হয়নি। ইন্ডিগোর সাড়া একেবারেই যাচ্ছেতাই। এখানে বয়স্ক মানুষ আছেন, যাঁদের বিশেষ দায়বদ্ধতা আছে, তাঁদের জন্য কোনো সমাধান নেই। এটা খুবই হাস্যকর।’

গোয়া বিমানবন্দরে একদল যাত্রী হতাশায় ভেঙে পড়েন। এক ভিডিওতে দেখা যায়, তাঁরা ইন্ডিগোর কর্মীদের লক্ষ্য করে চিৎকার করছেন। পরিস্থিতি সামলাতে বহু পুলিশ সদস্যকেও সেখানে দেখা যায়। চেন্নাই বিমানবন্দরে শত শত যাত্রী আটকা পড়েছেন। সেখানে সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (সিআইএসএফ) ইন্ডিগোর যাত্রীদের প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে। বিশাখাপত্তম বিমানবন্দরে কমপক্ষে ৪৯টি বহির্গমন ও ৪৩টি ইনকামিং ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।

ইন্ডিগোর এই পরিচালনগত ত্রুটি আজ চতুর্থ দিনের মতো চলছে। কুড়ি বছরের পুরোনো এই বিমান সংস্থাটি ক্রুসংকট, প্রযুক্তিগত সমস্যাসহ একাধিক কারণে ৫৫০টির বেশি ফ্লাইট বাতিল করার রেকর্ড তৈরি করেছে। এর মধ্যে মুম্বাই বিমানবন্দরে ১০৪টি, দিল্লি বিমানবন্দরে ২২৫টি, বেঙ্গালুরুতে ১০২টি এবং হায়দরাবাদে ৯২টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। ভূপাল বিমানবন্দরেও কমপক্ষে পাঁচটি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।

ইন্ডিগো স্বীকার করেছে যে, তারা নতুন নিয়ম অনুযায়ী ক্রুয়ের প্রয়োজনীয়তা ভুলভাবে আন্দাজ করেছিল এবং পরিকল্পনায় ঘাটতি ছিল, যার ফলস্বরূপ শীতকালীন আবহাওয়া ও যানজটের সময়ে পর্যাপ্ত ক্রুর অভাব দেখা দিয়েছে। বিমান সংস্থাটি সতর্ক করেছে, সময়সূচি স্বাভাবিক করার চেষ্টার অংশ হিসেবে আগামী দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত ফ্লাইট বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা জানিয়েছে, ৮ ডিসেম্বর থেকে তারা আরও বিঘ্ন এড়াতে ফ্লাইট পরিচালন কমিয়ে দেবে।

অন্যদিকে, ইন্ডিগোর সিইও পিটার এলবার্স কর্মীদের বলেছেন—পরিচালন স্বাভাবিক করা ও সময়ানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনা ‘সহজ লক্ষ্য হবে না’। বিমান সংস্থাটি গতকাল রাতে তাদের গ্রাহক ও স্টেকহোল্ডারদের কাছে নতুন করে দুঃখ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘গত দুই দিন ধরে ইন্ডিগোর নেটওয়ার্ক ও পরিচালনব্যবস্থায় ব্যাপক বিঘ্ন দেখা দিয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের সব গ্রাহক ও শিল্প স্টেকহোল্ডারদের কাছে আমরা আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ তারা আরও যোগ করেছে, ‘ইন্ডিগো এই বিলম্বের প্রভাব কমাতে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে নিরলসভাবে ও সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত