Ajker Patrika

ফিরে দেখা ২০২৪ /স্বাস্থ্য খাতের অসুস্থতা বেড়েছে

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫: ৫৯
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশের স্বাস্থ্য খাতে অস্থিরতা বিরাজ করেছে বছরজুড়ে। গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের সাত মাসের মাথায় অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। অন্তবর্তীকালীন সরকারের পাঁচ মাসে তা আরো বেড়েছে। বিশেষ করে পদায়ন, বদলি, চিকিৎসকদের আন্দোলন, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও কর্মকৌশলের অভাব ছিল প্রকট। এর সঙ্গে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিয়ে অসন্তুষ্টিও দেখা গেছে। ফলে, স্বাস্থ্যখাতের অসুস্থতা যেন বছরজুড়েই ছিল।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতের এই অসুস্থতা দীর্ঘদিনের, স্বল্প সময়ে তা সারানো যাবে না। এর জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। বছরের প্রথম সাত মাস দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক সরকার। এরপর গত পাঁচ মাসে অন্তবর্তীকালীন সরকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনি; ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি ও পদায়ন পরিকল্পনামাফিক হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।

গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা এখনো তৈরি করতে পারেনি বর্তমান সরকার। এবিষয়ে নানা মহল থেকে কয়েক দফায় চাপ সৃষ্টি হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। একইভাবে আহতদের তালিকা অপূর্ণাঙ্গ এবং আহতরা প্রতিশ্রুত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশের আহবায়ক ডা. কাজী সাইফউদ্দীন বেন্নূর আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে ব্যর্থতা অনেক বেশি। বিগত কয়েক মাস ধরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতা এবং সিদ্ধান্তহীনতা দেখা গেছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এর জন্য দায়ী। যেসব পদায়ন ও বদলি হয়েছে তা সঠিকভাবে হয়নি। অদূরদর্শিতার কারণে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্যের মূল চালিকা শক্তি অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি)। এখন ওপি কার্যকর নেই। এতে কিছুই ঠিকভাবে চলছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের কাজ এখনো বুঝতে পারছি না। কমিশন যথাযথভাবে ডিজাইন করে গঠন করা হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো— অন্তবর্তীকালীন সময়ে আমরা বড় কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির খবর পাইনি। আমরা আশাবাদী উদ্যোগ শুরু হয়েছে, কাজ হবে।’

অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা

গত জুলাই ও আগস্টের অভ্যুত্থানে হাসপাতালগুলোতে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। মূলত জুলাইয়ে আন্দোলনের মাঝামাঝিতে এই চাপ দেখা যায়। আগস্টের প্রথম পাঁচ দিন তা আরো বেড়ে যায়। হাসপাতালগুলো সক্ষমতার পাঁচ থেকে দশ গুণ জরুরি চিকিৎসা দেয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে সেসময় প্রায় ২০ হাজার রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৩২২ জন। আর মারা গেছেন ৮২৬ জন আন্দোলনকারী। গত সোমবার পর্যন্ত এই তথ্য হালনাগাদ চলছে। বেশিরভাগ রোগীই গুলিবিদ্ধ ছিল। এর মধ্যে জীবন বাঁচাতে অন্তত ৩০ জন রোগীর হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। আর চোখ হারিয়েছেন বহু রোগী। শুধু চোখের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন অর্ধসহস্রাধিক রোগী।

আন্দোলনের দিনগুলোতে সারা দেশে হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের জানিয়েছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে এত জরুরি ও সংকটাপন্ন রোগী তারা আগে কখনো দেখেনি। এখন রোগীরা চিকিৎসা পরবর্তী পর্যবেক্ষণের (ফলোআপ) জন্য হাসপাতালে আসছেন। রাজধানীতে এখনো দুই শতাধিক রোগী বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

এদিকে আহতদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। যথাযথ চিকিৎসা পাওয়ার জন্য তাদের বিভিন্ন সময় আন্দোলন করতেও দেখা গিয়েছে। রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) আহতদের দেখতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আহতদের চিকিৎসার জন্য কোনো কার্পণ্য করা হয়নি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আর বিদেশ থেকেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দফায় দফায় আনা হয়েছে।

রোগ নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসূচি নিয়ে কার্যক্রম হয়নি

দেশে রোগ নিয়ন্ত্রণে বছরজুড়েই কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সরকারের উদাসীনতা ছিল। একই পথে হেঁটেছে বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার। ফলে খুবই নিরবে বেড়েছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ। বছরের শুরুতে ৩১ জানুয়ারি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে এক হাজার ৫৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর সে সময় পর্যন্ত মারা যায় ১৪ জন চিকিৎসাধীন রোগী। গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বছর জুড়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৩০ জনে। আর এর মধ্যে মারা গেছে ৫৭৩ জন।

ডেঙ্গুর বিষয়ে বছরে বর্ষার আগে, বর্ষা মৌসুমে এবং বর্ষা পরবর্তী সময়ে তিনটি জরিপ করে সরকার। তবে চলতি বছরে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ পেয়েছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগের এবং চিকিৎসার দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের। এই দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালজুড়ে এই অভিযোগ থেকে বের হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এবং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

দেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় পাঁচ বছরমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। বর্তমানে ওপি চলমান না থাকায় পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় এক রকম স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গত জুলাইয়ে ‘পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি (৫ম এইচপিএনএসপি) ’ শিরোনামের ওপির কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা অনুমোদন পায়নি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি বড় কর্মসূচি।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পঞ্চম এইচপিএনএসপির বাস্তবায়ন চলতি বছরের জুলাইতে শুরু হয়ে ২০২৯ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর ব্যয়ের আকার ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চতুর্থ এইচপিএনএসপি চলতি বছরের জুনে শেষ হয়ে গেছে। ফলে দেশে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, নিয়মিত ব্যবস্থাপনা ও সেবা কার্যক্রমের জন্য কোনো কর্মসূচি দাপ্তরিকভাবে চালু নেই।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কার্যক্রম ওপিতে হওয়ায় এতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে ওপি বাস্তবায়ন শুরু না হওয়া পর্যন্ত রাজস্ব খাত থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। সারা দেশে তৃণমূলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সাড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিচি) নামে কর্মীদের বেতন বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে।

বদলি ও পদায়ন নিয়ে অসন্তুষ্টি

গত জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন হয়। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন ডা. সামন্ত লাল সেন ও প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ডা. রোকেয়া সুলতানা। রাজনৈতিক সরকারের প্রথম সাত মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থিরতা দেখা গিয়েছে। তৎকালীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সমন্বয় করতেন না। নিজ ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত বাস্তাবয়ন করতেন বলে অভিযোগ ছিল। সরকার পতনের আগে পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন ডা. সামন্ত লাল সেনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

অন্তবর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম দায়িত্ব নেন ৮ আগস্ট। সরকার গঠনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ইনস্টিটউট ও বিশ্বিবদ্যালয়ের শীর্ষ পদে পরিবর্তন আসেন। সরকার অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে এবং অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়। তবে সবচেয়ে বড় বিতর্ক হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পদ নিয়ে। প্রায় পুরো আগস্টজুড়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মধ্যম পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কাজ করেননি। কেউ নিজ ইচ্ছায় অফিসে আসেননি; আবার কেউ বা অফিসে এসেও নিজকক্ষে প্রবেশ করতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে, তাঁদের সকলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। কারো কারো বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।

তিন দফায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদে নিয়োগ পাওয়া ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই। অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তার বিরোধিতা করে বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। কিছু দিনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামও (এনডিএফ) রোবেদ আমিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এতে রোবেদ আমিন নিজ বাসায় থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দায়িত্ব সামলান প্রায় এক মাস। এই পুরো সময়ে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অফিস করতে পারেননি। এরপর তাকে সরিয়ে রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেনকে। এর কিছুদিন পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তেরর মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান অধ্যাপক ডা. আবু জাফর।

এছাড়াও সারাদেশের বিশেষায়িত হাসপাতাল, ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদের পরিবর্তন নিয়েও বির্তক দেখা যায়। বর্তমান সরকার নতুন করে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ (বিএমআরসি) ও চিকিৎসা শিক্ষা অ্যাক্রিডিটিশন কাউন্সিল পুনর্গঠন করে সরকার।

এদিকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব পদে বছরজুড়ে বেশ কয়েকবার পরিবর্তন এসেছে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের সময়েও দুই বিভাগের সচিব পদে পরিবর্তন এসেছে।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন

অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর খাতভিত্তিক সংস্কারে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে গত ১৭ নভেম্বর ১২ সদস্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। এতে প্রধান করা হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানকে। তবে কমিশনের কাজ নিয়ে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো— কমিশন এক প্রকাশ অন্ধকারেই কাজ করছে। আদতে কমিশন কি ধরনের সংষ্কারের জন্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে, কি পর্যায়ে সংস্কার প্রয়োজন তার রূপরেখা নেই। এই কমিশনের সদস্যদের বাছাই করার ক্ষেত্রেও যথাযথ পরিকল্পনা করা হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।

এদিকে গত ৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মান উন্নয়ন, কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. এম এ ফয়েজকে প্রধান করা হয়। তবে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা ওঠে। বিশেষত ড্যাব সমালোচনামুখর বেশি ছিল। এর প্রেক্ষিতে ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন ফায়েজ।

স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা সংস্কার নিয়ে কাজ করছি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে এক বাক্যে বলার মতো কিছুই নেই। সরকারকে ফেব্রুয়ারি নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেব। আমরা আপনাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব।’

আন্দোলনমুখর সময়

বছরজুড়েই দেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন পর্যায়ের আন্দোলন অব্যাহত ছিল। অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক দেয়া চিকিৎসকদের কর্মবিরতি বড় পরিসরে আলোচনায় আসে। গত ১ সপ্টেম্বর দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রথমে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সে সময় হট্টগোল হয়। ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধরের ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরেসময়ে বিষয়টি মেডিকেলে ছড়িয়ে পড়লে রোগীর স্বজনদের ডাক্তার ও মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং জরুরি গেট বন্ধ করে দেন। এই ঘটনার মধ্যেই রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকা থেকে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহতরা ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে এলে পরবর্তী সময়ে অন্য গ্রুপের লোকজন জরুরি বিভাগে ভেতরে ঢুকে চাপাতিসহ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের ভেতরে ঢুকে যায়। এ সময় হাতেনাতে চারজনকে আটক করে সেনাবাহিনীকে দেয় কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে নিরাপত্তার অভাবের কথা জানিয়ে জরুরি বিভাগের সকল ধরনের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। টানা একদিন এমন পরিস্থিত থাকার পর সরকারের আশ্বাসের প্রতিক্ষিতে কাজে ফেরেন চিকিৎসকরা।

এদিকে ডিসেম্বরজুড়ে আন্দোলনে নামে স্নাতকোত্তর শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা (বেসরকারি)। মাসিক ভাতা বাড়ানোর দাবিতে তাঁরা রাজপথে আন্দোলন করেন। কর্মবিরতি ও সড়ক অবরোধও করেন তাঁরা। পরে সরকার দুই দফায় ভাতা বাড়ালে আন্দোলনের ইতি টানেন তাঁরা।

এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা কর্মসূচি পালন করেন। এর মধ্যে ছিল, পদায়ন, দীর্ঘদিনের পদবঞ্চিত হওয়া ও আপগ্রেশনের মতো বিষয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কিডনি রোগীর বন্ধু কামরুল

  • নিজের হাতে ২০০০তম কিডনি প্রতিস্থাপন।
  • নিজে কোনো পারিশ্রমিক নেন না ডা. কামরুল।
  • কিডনি প্রতিস্থাপন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকায়।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ২৫
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম।
অধ্যাপক কামরুল ইসলাম।

বাংলাদেশে যেখানে কিডনি প্রতিস্থাপন এখনো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, সেখানে অসহায় ও দরিদ্র রোগীদের শেষ ভরসা হয়ে উঠেছেন কিডনির শল্যচিকিৎসক অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। দেশে যত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়, সেগুলোর একটি বড় অংশই করেন তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (সিকেডি) হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার তিনি ২০০০তম কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেছেন। ব্যয়বহুল এই শল্য-চিকিৎসায় নিজে কোনো পারিশ্রমিক নেন না ২০২২ সালে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক।

কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে কিডনি রোগের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনির কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছেন। দেশে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় পাঁচজন রোগীর মৃত্যু হচ্ছে কিডনি অকেজো হয়ে। কিডনি প্রতিস্থাপন সীমিত এবং ডায়ালাইসিস ব্যয়বহুল। ফলে অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত ও চিকিৎসা নিলে ৬০ শতাংশ রোগীর জীবন রক্ষা সম্ভব।

কামরুল ইসলামের জন্ম ১৯৬৫ সালে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে বোর্ডের মেধাতালিকায় যথাক্রমে ১৫তম ও ১০তম স্থান লাভ করেছিলেন তিনি। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৪০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজের মধ্যে সম্মিলিত এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক পান। এরপর ১৯৯৫ সালে এফসিপিএস, ২০০০ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউরোলজিতে এমএস এবং ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল কলেজ থেকে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

ডা. কামরুলের কর্মজীবন শুরু ১৯৯৩ সালে, বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিয়ে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি এবং ২০০৭ সালে প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেন। ২০১১ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদে দায়িত্ব নেন। পরে ২০১৪ সালে নিজ উদ্যোগে রাজধানীর শ্যামলীতে সিকেডি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।

সিকেডি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ডা. কামরুলের নেতৃত্বে সপ্তাহে ছয়টি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার জন্য একই সঙ্গে দুটি কক্ষে অস্ত্রোপচার চলে। প্রতিটি অস্ত্রোপচারে সাধারণত ১০-১২ জন চিকিৎসক অংশ নেন। যাঁদের মধ্যে থাকেন অবেদনবিদ, কিডনি বিশেষজ্ঞ, ইউরোলজির শল্যচিকিৎসকসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ, পাশাপাশি নার্স ও টেকনোলজিস্ট।

ডা. কামরুল বলেন, সিকেডিতে প্রতিদিন গড়ে একটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়। প্রতিটি অস্ত্রোপচারে ১০-১২ জন চিকিৎসক কাজ করেন। তিনি নিজে পারিশ্রমিক নেন না, তবে অস্ত্রোপচারে আনুষঙ্গিক খরচ থাকে। তাঁর হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্যাকেজ এখন ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা। যার মধ্যে অস্ত্রোপচার, ওষুধ, আইসিইউ এবং অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত। কিডনি দাতা সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিন এবং কিডনি গ্রহীতা ৭ থেকে ১০ দিন হাসপাতালে থাকেন।

হাসপাতালের অন্যান্য সার্জারি ও চিকিৎসাসেবার আয়ের অর্থে কিডনি প্রতিস্থাপনের খরচের পুরো প্রক্রিয়া চালানো হয়। সেখানে প্রতিদিন ৭-১২টি কিডনি স্টোন সার্জারি, কিডনি ক্যানসার, প্রস্টেট ক্যানসারসহ অন্যান্য সার্জারি করা হয়। হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা চার শতাধিক। আউটডোরে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ রোগী, ইনডোরে প্রায় ১০০ রোগী সেবা নেন। ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে আরও ৫০ শয্যা বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে সিকেডি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাসিন্দা মাইনুল রহমান। ৪৪ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ীর কিডনি অকেজো হয়ে গেলে স্ত্রীর দেওয়া কিডনি নিয়ে তাঁর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। ডা. কামরুল ইসলাম এই অস্ত্রোপচার করেন।

কিডনি প্রতিস্থাপনে সিকেডি হাসপাতাল সোয়া দুই লাখ টাকা নিয়েছে জানিয়ে মাইনুল রহমান গতকাল সন্ধ্যায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সিকেডি হাসপাতাল যদি অন্য হাসপাতালের মতো খরচ নিত, তাহলে আমরা তা বহন করতে পারতাম না। এখন প্রতি মাসে ফলোআপ চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। সেখানে গেলে সবকিছু বিনা মূল্যে পাওয়া যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসকের ফি দিতে হয় না।’

এর আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরে স্ত্রীর দেওয়া কিডনি নিজের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন নারায়ণগঞ্জের ৩৭ বছর বয়সী আবু বকর। তিনি বলেন, ‘ডা. কামরুল স্যার খুবই মানবিক। আমরা খরচের ভয়ে চিকিৎসায় যেতে চাইনি। তিনি কয়েকবার ফোন করে আমাদের খোঁজ নিয়েছেন, তিনি কিডনি বসিয়ে দিয়েছেন।’

ডা. কামরুল জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীরা বাসায় গেলে প্রথম এক থেকে দুই বছর অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়; বিশেষ করে ওষুধ ঠিকমতো না খাওয়া, সময়মতো ডোজ না নেওয়া এবং অনিয়মিত জীবনধারা ঝুঁকি বাড়ায়। আবার রোগীরা খরচের ভয়ে ফলোআপ চিকিৎসায় আসতে চান না। ফলে তাঁদের এসব চিকিৎসা আজীবন বিনা মূল্যে করেন তিনি।

ডা. কামরুলের স্ত্রীও একজন চিকিৎসক। তিনি বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত। তাঁদের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক, মেজ মেয়ে এমবিবিএস অধ্যয়ন করছেন।

নিজের প্রতিষ্ঠিত সিকেডি হাসপাতালকে ‘বড় গাছের মতো’ দেখেন ডা. কামরুল ইসলাম। যেখানে আয়ের একটি অংশ দরিদ্র রোগী ও কিডনি প্রতিস্থাপনে ব্যয় করা হয়। তিনি বলেন, ‘মানুষকে নিখুঁত চিকিৎসা দেওয়া আমার কর্তব্য। আমি কিডনি রোগীদের খরচ হাসপাতালের অন্যান্য আয়ের মাধ্যমে বহন করি। এটি যেকোনো হাসপাতালই করতে পারে এবং এর জন্য লোকসান হয়; তা কিন্তু নয়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কবিরাজিসহ প্রথাগত চিকিৎসার কার্যকারিতা খতিয়ে দেখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৪৭
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

আফ্রিকায় ভেষজ চিকিৎসকেরা ক্ষত বা ব্যথা উপশমে গাছগাছড়া সংগ্রহ করছেন; চীনে আকুপাংচার বিশেষজ্ঞরা সুচ ব্যবহার করে মাইগ্রেন সারাচ্ছেন; আবার ভারতে যোগীরা ধ্যানচর্চা করছেন—এ ধরনের প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো ক্রমেই কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে এবং এগুলো আরও বেশি মনোযোগ ও গবেষণার দাবি রাখে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক কর্মকর্তা।

ডব্লিউএইচওর গ্লোবাল ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন সেন্টারের প্রধান ডা. শ্যামা কুরুবিল্লার মতে, ঐতিহাসিকভাবে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অভাবের কারণে যেসব প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতিকে অনেক সময় অবহেলা করা হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ বাড়লে সেই ধারণা বদলাতে পারে।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের শুরুতে বিভিন্ন দেশ সম্মত হয়েছে যে আগামী এক দশকের জন্য ডব্লিউএইচও একটি নতুন বৈশ্বিক প্রথাগত চিকিৎসা কৌশল গ্রহণ করবে।

এই কৌশলের লক্ষ্য—প্রমাণভিত্তিকভাবে স্বাস্থ্য ও কল্যাণে প্রথাগত, পরিপূরক ও সমন্বিত চিকিৎসার সম্ভাবনাময় অবদানকে কাজে লাগানো।

এই কৌশলের আওতায় প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য শক্তিশালী প্রমাণভিত্তি তৈরি, চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এসব পদ্ধতিকে আধুনিক জৈব-চিকিৎসাভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

কুরুবিল্লা বলেন, ‘এটা ভীষণ রোমাঞ্চকর। আমি বলছি না, আমরা এখনই জানি—কোনটা কাজ করে আর কোনটা করে না। তবে এ মুহূর্তে বিষয়টি জানার বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

প্রথাগত চিকিৎসা বলতে এমন স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ব্যবস্থাকে বোঝায়, যেগুলোর উদ্ভব আধুনিক বায়োমেডিসিনের আগেই হয়েছে। এসব চিকিৎসা পদ্ধতির ধরন নানাবিধ—ভেষজ চা থেকে শুরু করে ভারতের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যন্ত।

কুরুবিল্লা বলেন, শত শত বছর ধরে চলে আসা এসব পদ্ধতির মধ্যে অনেকগুলোরই বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিনোমিক্স ও মস্তিষ্ক স্ক্যানসহ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন সেগুলো নতুনভাবে অনুসন্ধান করা সম্ভব।

তাঁর মতে, প্রথাগত চিকিৎসা গ্রহণের ক্ষেত্রে থাইল্যান্ড ভালো উদাহরণ। দেশটিতে গবেষকেরা প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ ও নথিবদ্ধ করছেন এবং ভেষজ চিকিৎসাকে প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। গত মে মাসে থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পেশির ব্যথা ও কোষ্ঠকাঠিন্যসহ কিছু রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আধুনিক ওষুধের বদলে প্রথাগত চিকিৎসা ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শীতে খিচুড়ি কেন খাবেন

ফিচার ডেস্ক
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ১৮
শীতে খিচুড়ি কেন খাবেন

শীতের সকাল কিংবা সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা এক বাটি খিচুড়ির চেয়ে আরামদায়ক আর কী হতে পারে। খিচুড়ি শুধু একটি খাবার নয়। শীতকাল মানে আরাম করে হরেক রকমের সবজি দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি খাওয়া। এতে যেমন মন ভরে, তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর এ খাবার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এ ছাড়া এটি শরীরে বিভিন্ন উপাদানের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়ক। শীতকালীন ক্লান্তি দূর করতে এবং ঋতু পরিবর্তনের অসুস্থতা থেকে বাঁচতে খিচুড়ি একটি আদর্শ খাবার। এটি সহজে হজম হয়।

কেন খাবেন খিচুড়ি

পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুযায়ী, খিচুড়ির প্রতিটি উপাদান আমাদের শরীরের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এতে থাকা চাল থেকে পাওয়া যায় পর্যাপ্ত শর্করা ও শক্তি। ডাল জোগায় প্রোটিন ও আঁশ, যা হজমে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ঘি শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে এবং পুষ্টি শোষণে সহায়ক। হলুদে থাকা কারকিউমিন ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে এবং আদা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে শরীর উষ্ণ রাখে। খিচুড়িতে সবজি যোগ করলে আঁশের মাত্রা বাড়ে। গোলমরিচ ও জিরার মতো মসলা বিপাক প্রক্রিয়া উন্নত করে। এ ছাড়া সাবুদানার খিচুড়ি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ ছাড়া এটি তাৎক্ষণিক শক্তি জোগাতে কার্যকর।

mog-dal

মুগ ডালের খিচুড়ি

চাল ও মুগ ডালের মিশেলে তৈরি এই খিচুড়ি যেমন সহজপাচ্য, তেমনি পুষ্টিগুণে ভরপুর। এর বিশেষত্বের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে মসলায়। একেবারে হলুদ, লবণ, জিরা অথবা ধনেগুঁড়ার মতো সাধারণ কিছু মসলা দিয়ে এটি রান্না করা হয়। এটা রান্নার সময় মুগ ডালের সঙ্গে চালও ভেজে নিতে পারেন। এতে মুগ ডালের একটা ভিন্ন গন্ধ পাওয়া যাবে। হলুদের পরিবর্তে এতে ব্যবহার করতে পারেন সবুজ মুগডাল।

উপকারিতা: শরীর উষ্ণ রাখে এবং দীর্ঘক্ষণ শক্তি জোগায়।

khichuri

সবজি খিচুড়ি

গাজর, মটরশুঁটি, ফুলকপি, আলু, টমেটো ইত্যাদি শীতের সবজি দিয়ে তৈরি রান্না করা সবজি খিচুড়ি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। এর সঙ্গে শীতে পাওয়া যায় এমন প্রায় সব শাক ও সবজি যোগ করতে হবে। সবজিগুলো ছোট টুকরা করে কেটে নিতে হবে।

যে সবজিগুলো সেদ্ধ হতে বেশি সময় নেয়, সেগুলো আগে ভেজে নিন অথবা প্রেশার কুকারে দিন। এরপর তেল বা ঘিতে জিরা, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলা দিয়ে পেঁয়াজ, আদা, রসুন ভাজার পর সবজিগুলো হালকা ভেজে নিন। ভেজে রাখা সবজি, চাল, ডাল ও পানি দিয়ে প্রেশার কুকারে বা হাঁড়িতে রান্না করুন। নরম খিচুড়ি চাইলে পানি বেশি দিতে পারেন। শেষ মুহূর্তে পালংসহ অন্য নরম শাক এতে যোগ করতে পারেন।

উপকারিতা: এটি অন্যান্য উপকারের সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় এবং দ্রুত শক্তি পুনরুদ্ধার করে।

তিল-খিচুড়ি

তিল খিচুড়ি

ঠান্ডা পাহাড়ি অঞ্চলে শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে এই খিচুড়ি অত্যন্ত জনপ্রিয়। চাল, মাষকলাইয়ের ডাল এবং তিল এর প্রধান উপকরণ। রান্নার আগে চাল ও ডাল ভিজিয়ে রাখা হয়। তিল হালকা ভেজে গুঁড়া করে নেওয়া হয়। তিল থেকে পাওয়া স্বাস্থ্যকর চর্বি ও খনিজ উপাদান শীতের দিনে শরীরের জন্য খুবই উপকারী। জিরা, হিং, হলুদ এবং লাল মরিচ গুঁড়ার সুগন্ধি মিশ্রণ এতে অনন্য স্বাদ যোগ করে। খাঁটি ঘি অথবা তেল-মসলার ফোড়ন দিয়ে এটি রান্না করা হয়। প্রোটিন, চর্বি এবং মিনারেলসমৃদ্ধ এই খাবার শীত জয়ের এক অমোঘ হাতিয়ার হতে পারে।

উপকারিতা: এটি শরীরে তাৎক্ষণিক শক্তি জোগানোর পাশাপাশি দীর্ঘক্ষণ শরীর গরম রাখতে সাহায্য করে।

আমলকীর-খিচুড়ি

আমলকী খিচুড়ি

সচরাচর খাওয়া হয় এমন কোনো খিচুড়ি খেতে না চাইলে রান্না করতে পারেন আমলকী খিচুড়ি। এটি কোনো সাধারণ খাবার নয়। এ খিচুড়ি রান্না করা হয় চাল, খোসা ছাড়ানো কালো মাষকলাইয়ের ডাল এবং তাজা আমলকী দিয়ে। নরম ধরনের এ খিচুড়ির স্বাদ ও সুগন্ধ বাড়াতে রান্নায় জিরা, হিং, হলুদ ও লাল মরিচের গুঁড়া ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো এতে রাজকীয় স্বাদ যোগ করবে। সবশেষে ঘি বা তেলের সুগন্ধি ফোড়ন এই খিচুড়িকে করে তোলে আরও সুস্বাদু। কেউ চাইলে এই খিচুড়ির পুষ্টিমান আরও বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের ঋতুভিত্তিক সবজি যোগ করতে পারেন। শীতের এই উৎসবের দিনগুলোতে শরীর সতেজ রাখতে এবং রসনা তৃপ্তিতে আমলকী খিচুড়ি হতে পারে আপনার সেরা পছন্দ।

উপকারিতা: এটি শরীরে শক্তি জোগানোর পাশাপাশি হজমশক্তি এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া শরীর ডিটক্সে সহায়তা করে, হজম প্রক্রিয়া উন্নত হয়, গ্যাস্ট্রিক কমায়, কোলাজেন উৎপাদন বাড়ায় এবং ওজন কমাতে সহায়ক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এই শীতে কেন খাবেন তেজপাতা ও লবঙ্গ চা

আলমগীর আলম
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ০৪
এই শীতে কেন খাবেন তেজপাতা ও লবঙ্গ চা

তেজপাতা ও লবঙ্গ—উভয়ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। এতে রয়েছে শক্তিশালী প্রদাহবিরোধী ও ব্যাকটেরিয়ারোধী গুণাবলি, যা শরীরের ভেতরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। তবে এই চা সাধারণত সবার জন্য নিরাপদ হলেও গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের এটি পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

১. হজমশক্তি বৃদ্ধিতে: বদহজমের সমস্যায় ভুগলে তেজপাতা দারুণ মুক্তি দিতে পারে। অন্যদিকে, লবঙ্গ এনজাইম নিঃসরণ বাড়িয়ে হজমপ্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত এবং পেটের অস্বস্তি দূর করে।

২. ব্যথা ও প্রদাহ উপশমে: আর্থ্রাইটিসের মতো রোগে যাঁরা ভোগেন, তাঁদের জন্য এই চা অত্যন্ত উপকারী। ইউরিক অ্যাসিডের ব্যথা কমাতে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশের প্রদাহ বা ফোলা ভাব রোধে তেজপাতা ও লবঙ্গ লড়তে সাহায্য করে।

৩. রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে: লবঙ্গে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া

ও ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। এর সঙ্গে তেজপাতা যুক্ত হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যায়, যা বিশেষ করে ঠান্ডা ও ফ্লু মৌসুমে সুরক্ষা দেয়।

৪. দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কমাতে: এই চা শরীরে ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়। ফলে হৃদ্‌রোগ এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি কমে পায়।

৫. দাঁত ও মাড়ির সুরক্ষায়: লবঙ্গ তেল দাঁতের জন্য উপকারী হিসেবে স্বীকৃত। নিয়মিত লবঙ্গ চা পান করলে মাড়ি ও দাঁত সুস্থ রাখা সম্ভব।

তেজপাতা ও লবঙ্গ চা তৈরি করবেন যেভাবে

উপকরণ সংগ্রহ করা এবং এই চা তৈরি করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ—

উপকরণ: ৩-৪টি শুকনো তেজপাতা, ৫-৬টি আস্ত লবঙ্গ এবং ৪ কাপ পানি। স্বাদ বাড়াতে মধু বা লেবু ব্যবহার করতে পারেন।

প্রণালি: প্রথমে একটি পাত্রে পানি ফুটিয়ে নিতে হবে। তাতে তেজপাতা ও লবঙ্গ দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে দিন। ১৫ মিনিট মিশ্রণটি সেদ্ধ করার পর চুলা নিভিয়ে আরও ৫ মিনিট পাত্রটি ঢেকে রেখে দিন। এরপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে তেজপাতা ও লবঙ্গ ফেলে দিয়ে পানি আলাদা করে নিন। স্বাদ অনুযায়ী মধু কিংবা লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন।

সেবনবিধি ও সতর্কতা

ভালো ফল পেতে প্রতিদিন এক কাপ এই চা-পান করা ভালো; বিশেষ করে খাবারের পর এটি পান করলে হজমশক্তি বাড়াতে সবচেয়ে ভালো কাজ করে।

লেখক: খাদ্য পথ্য ও আকুপ্রেশার বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত