Ajker Patrika

বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির রুদ্ধশ্বাস কাহিনি

আপডেট : ২২ জুন ২০২১, ১২: ৩৪
বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির রুদ্ধশ্বাস কাহিনি

ঢাকা: ২০১৬ সালে বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির ঘটনা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। কীভাবে হয়েছিল এই চুরি? গতকাল বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতিহাসে নজিরবিহীন এই রিজার্ভ চুরির নেপথ্যে ছিল উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা।

চুরির বিষয়টি টের পাওয়া যায় একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রিন্টার থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীদের কাছে প্রিন্টারের এই ত্রুটি ছিল একটি নিত্যদিনের সমস্যা। সাধারণ যান্ত্রিক ত্রুটি ভেবে এটি নিয়ে মাথা ঘামানোর বিশেষ প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। এটা যে একসময় অনেক বড় মাথা ব্যথার কারণ হবে, তা কারও ভাবনাতেই ছিল না।

এটা কারও মাথায় আসেনি যে অন্য দশটা সাধারণ প্রিন্টার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রিন্টারের এমন প্রিন্ট বের না হওয়ার ঘটনা এক নয়। রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবনের দশম তলায় একটি সুরক্ষিত কক্ষে ছিল এই প্রিন্টারের অবস্থান। ত্রুটিপূর্ণ হলেও গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হতো এটিকে। ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লেনদেনের নথি প্রিন্ট করা হতো এই প্রিন্টার দিয়ে।

রিজার্ভ চুরির পর এই প্রিন্টার সম্পর্কে কর্তব্যরত ডিউটি ম্যানেজার জুবায়ের বিন হুদা পুলিশকে জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যখন দেখা গেল প্রিন্টারটি কাজ করছে না, তখন এটিকে অন্যান্য দিনের মতো একটি সাধারণ ঘটনা হিসেবেই মনে করা হয়েছিল। জুবায়ের বলেছিলেন, ‘এ ধরনের সমস্যা আগেও দেখা গিয়েছিল।’

বাংলাদেশ ব্যাংক যে অনেক বড় একটি সমস্যার মুখে পড়েছে এ ঘটনাই ছিল তার প্রথম ইঙ্গিত। হ্যাকাররা ততক্ষণে ব্যাংকের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমে ঢুকে পড়েছিল। আর এ সময়ই তারা এ যাবৎকালের দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনাটি ঘটাতে শুরু করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ১০০ কোটি ডলার চুরি করা, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা হাতিয়ে নিতে হ্যাকার দলটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রস্তুত রেখেছিল অসংখ্য ভুয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, দাতব্য সংস্থা এবং ক্যাসিনো। কিন্তু কারা ছিল এই হ্যাকার, কোথা থেকেই বা এসেছিল?

ঘটনাটি যাঁরা অনুসন্ধান করেছিলেন তাঁদের মতে–ঘটনার সব ডিজিটাল ফিঙ্গার প্রিন্ট একটি দিকে যাচ্ছিল। আর তা হলো–উত্তর কোরিয়া!

ঘটনা পরম্পরায় উত্তর কোরিয়াই হতে যাচ্ছিল এই সাইবার অপরাধের প্রধান সন্দেহভাজন। পৃথিবীর অন্যতম গরিব দেশ এটি এবং প্রযুক্তি, অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোতে এই দেশ বাকি দুনিয়া থেকে প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের মতে, দুর্ধর্ষ এই চুরিটি করতে উত্তর কোরিয়া সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা সেই হ্যাকার দল ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তাদের সহযোগীরা কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিল। সাইবার নিরাপত্তার জগতে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা ‘ল্যাজারাস’ গ্রুপ নামে পরিচিত। এই ল্যাজারাস হলো বাইবেলে বর্ণিত একটি চরিত্র, যিনি মৃত্যুর পর ফিরে এসেছিলেন।

কারা এই ল্যাজারাস: ল্যাজারাস হ্যাকারদের সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তবে রিজার্ভ চুরির সঙ্গে জড়িত এই গ্রুপের প্রধান সন্দেহভাজনের একটি ছবি প্রকাশ করতে সক্ষম হয় এফবিআই। তাঁর নাম পার্ক জিন–হিয়োক। এ ছাড়া পার্ক জিন–হেক, পার্ক কোয়াং–জিন নামগুলোও তিনি ব্যবহার করেছেন। কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবেই তিনি পরিচিত। উত্তর কোরিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো একটি থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। পরে চীনের বন্দরনগরী দালিয়ানে চোসান এক্সপো নামে একটি উত্তর কোরিয়ান কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। এই কোম্পানি মূলত অনলাইন গেম ও জুয়া খেলার প্রোগ্রাম তৈরি করে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করে।

দালিয়ানে থাকা অবস্থায় পার্ক জিন–হিয়োক একটি ইমেইল ঠিকানা ও একটি সিভি তৈরি করেছিলেন। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তিনি তাঁর নিজস্ব যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন। সাইবার ফুটপ্রিন্ট এটাই নির্দেশ করছে যে, ২০০২ সালের শুরু থেকে ২০১৩ কিংবা ২০১৪ সাল পর্যন্ত দালিয়ানেই অবস্থান করছিলেন পার্ক।

এফবিআইয়ের তদন্তকারীরা পার্ক জিন–হিয়োকের একটি ছবি প্রকাশ করতে সক্ষম হন। এই ছবি ২০১১ সালে চোসান এক্সপোর ম্যানেজার বাইরের এক ক্লায়েন্টের সাথে পার্কের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় ব্যবহার করেছিলেন। ছবিতে পার্কের চেহারায় সাদামাটা এক উত্তর কোরিয়ান যুবকের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, যার বয়স ৩০ বছরের কম কিংবা বেশিও হতে পারে। তাঁর গায়ে একটি কালো শার্ট, তার ওপর একটি চকলেট–বাদমি রঙের স্যুট। প্রথম দেখায় যার চেহারায় কোনো বিশেষত্ব ধরা পড়বে না। এফবিআই বলছে, ছবিটি সেই সময়ের, যখন দিনের বেলায় প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করতেন পার্ক, আর রাতের বেলায় হ্যাকার।

২০১৮ সালের জুনে মার্কিন কর্তৃপক্ষ পার্কের বিরুদ্ধে কম্পিউটার জালিয়াতির মাধ্যমে ষড়যন্ত্র ও যোগাযোগ বিচ্যুতি ঘটানোর অভিযোগ আনে। এই কাজগুলো ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত করেছিলেন তিনি। বিচারের আওতায় আনা গেলে এর জন্য পার্কের সর্বোচ্চ ২০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারত।

বিবিসি বলছে, রাতারাতি হ্যাকারে পরিণত হয়নি পার্ক। তিনি হলেন উত্তর কোরিয়ার এমন হাজারো যুবকের একজন, যাদেরকে শৈশব থেকেই সাইবার যোদ্ধা হওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গণিতে মেধাবী এ ধরনের শিশুদের ১২ বছর বয়সেই তাদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে উত্তর কোরিয়ার রাজধানীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে তাদের প্রশিক্ষণ।

ঘটনার এ পর্যায়ে আসা যাক বাংলাদেশ ব্যাংকের সেই প্রিন্টারে যেখান থেকে রিজার্ভ চুরির প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। প্রিন্টারটি সমস্যা দূর করার পরই ব্যাংক কর্মীদের জন্য এমন কিছু অপেক্ষা করছিল, যা কি–না খুবই দুশ্চিন্তাজনক। প্রিন্টারের ভেতর থেকে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের একটি বার্তা বেরিয়ে এসেছিল। এই ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেখানে মার্কিন ডলারে বাংলাদেশের রিজার্ভ জমা হয়।

হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে অর্থ ছাড়ের নির্দেশ দেয়, যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১০০ কোটি ডলার। এই বিষয়ে পরে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ থেকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে জানতে চায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে হ্যাকাররা যে সময়টি বেছে নিয়েছিল তার জন্য বেকায়দায় পড়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

খুব সতর্কতার সঙ্গে হ্যাকিংয়ের সময়টি বেছে নিয়েছিল ল্যাজারাস গ্রুপ। তারা হ্যাকিং শুরু করেছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায়। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। নিউ ইয়র্কের সময় অনুযায়ী সেই সময়টি ছিল বৃহস্পতিবার সকাল, পুরোদমে ব্যাংকের কাজ চলছিল সেখানে। পরদিন শুক্রবার এবং শনিবারও বন্ধ থাকায় টানা দুই দিনের ছুটিতে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ছুটি শেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন বিষয়টি অনুধাবন করতে শুরু করে ততক্ষণে নিউ ইয়র্কে শুরু হয়ে যায় সাপ্তাহিক ছুটি। এই সময়টিই বেছে নিয়েছিল হ্যাকাররা। পুরো ব্যাপারটি সামনে আসার আগেই অন্তত তিন দিনের সময় পেয়ে গিয়েছিল হ্যাকাররা। তারা আরও একটি কৌশল অবলম্বন করেছিল। এ ক্ষেত্রে নিউ ইয়র্ক থেকে ডলার ছাড় হয়ে গেলে সেগুলো কোথাও না কোথাও নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল তাদের। তাই তারা এই অর্থ ফিলিপাইনের ম্যানিলায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চন্দ্র বর্ষের প্রথম দিন হওয়ায় ফিলিপাইনসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে ছুটি চলছিল তখন। ফলে সব মিলিয়ে পাঁচ দিনের সময় পেয়েছিল হ্যাকার দল। এ থেকেই বোঝা যায়, দিন ক্ষণ মিলিয়ে চুরির ঘটনাটি ঘটাতে বেশ সময় নিয়ে পরিকল্পনা করেছিল হ্যাকাররা।

বিবিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে জানুয়ারিতে একটি সিভি ডাউনলোড করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকে পড়েছিল হ্যাকাররা। সিভিটি ছিল রাসেল আহলাম নামে এক ব্যক্তির, যিনি একজন চাকরি প্রত্যাশী ছিলেন। আসলে এই নামে কেউ ছিল না। হ্যাকাররাই এই সিভিটি তৈরি করেছিল ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে তাদের ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য। ব্যাংকের কোন একটি কম্পিউটার থেকে সিভিটি ডাউনলোড করার পরই সেই কম্পিউটার হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরে এই কম্পিউটার থেকে তারা অন্যান্য কম্পিউটারে প্রবেশ করতে শুরু করে।

হ্যাকাররা অর্থ স্থানান্তরের জন্য ম্যানিলার জুপিটার স্ট্রিটে থাকা ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের একটি শাখাকে বেছে নিয়েছিল। ২০১৫ সালের মে মাসে এই শাখায় তারা চারটি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। এই অ্যাকাউন্টগুলোকে সন্দেহের বাইরে রাখতে তারা আরও কিছু কৌশল অবলম্বন করেছিল। প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টেই ৫০০ ডলার করে জমা রেখেছিল হ্যাকাররা।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিন্টারে যখন ত্রুটি চিহ্নিত হয় ততক্ষণে অন্তত ৩৫টি গন্তব্যে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড়ের নির্দেশ দিয়ে দেয় হ্যাকাররা। প্রিন্টারটি তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারত। তাই এটিরও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল তারা।

বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, হলিউড সিনেমায় যেমনটি ঘটে–ঠিক তেমনিভাবে ছোট্ট একটি ভুল করে বসেছিল হ্যাকাররা। ফিলিপাইনে আরও অসংখ্য ব্যাংক রেখে জুপিটার ব্যাংক বাছাই করাই ছিল তাদের সেই ভুল। কারণ জুপিটার নামে ইরানের একটি জাহাজ রয়েছে। ফলে মার্কিন স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার সিস্টেম জুপিটার শব্দটি শনাক্ত করে সন্দেহজনক বিবেচনায় আটকে দেয় হ্যাকারদের বেশির ভাগ অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশ। তবে, আটকে দেওয়ার আগেই পাঁচটি লেনদেনে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ছাড় দিয়ে দেয় নিউ ইয়র্কের ফেডারেল ব্যাংক। এর মধ্যে ২ কোটি ডলারের একটি লেনদেন ছিল শ্রীলঙ্কার দাতব্য প্রতিষ্ঠান শালিকা ফাউন্ডেশনের নামে। কিন্তু ফাউন্ডেশন বানানে ভুল করায় সেই অর্থছাড়ও আটকে যায়।

শেষ পর্যন্ত ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তর করতে সক্ষম হয় হ্যাকাররা। যে পরিমাণ অর্থ চুরি হতে যাচ্ছিল, তার তুলনায় এই অর্থ কিছুই নয়। তবু বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটি অনেক বড় অঙ্ক। বাংলাদেশ এখনো সেই অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপি-জামায়াত জোটে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি দল, আসন বণ্টন ঘোষণা রাতেই

নির্বাচন না করার ঘোষণা দিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

নাহিদকে শুভকামনা জানিয়ে সরে গেলেন জামায়াতের আতিক

কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের লাঠিমিছিল, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা এনসিপি নেত্রী মনজিলা ঝুমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কেরানীগঞ্জে মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ: জেএমবির সঙ্গে জড়িতের অভিযোগে পরিচালক গ্রেপ্তার হন দুবার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৪
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় মাদ্রাসা ভবনে বিস্ফোরণ। ছবি: আজকের পত্রিকা

ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় গত শুক্রবার সকালে একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। মাদ্রাসাটি শেখ আল আমিন নামের এক ব্যক্তি পরিচালনা করতেন। যিনি এর আগে নিষিদ্ধ উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাতটি মামলা রয়েছে। পুলিশ বলছে, ভবনটি বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

আজ শনিবার দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, হাসনাবাদ বাজারের ফলপট্টি গলিতে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসা। মাদ্রাসায় শিশুদের পাঠদান করা হয়। বিস্ফোরণে চার কক্ষের একতলা ভবনটির পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষ সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে, সিঁড়ির পাশের ছাদের একাংশ উড়ে গেছে এবং সব কটি কক্ষের পিলার ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ঘটনাস্থলে ককটেল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগের ক্রাইম সিন ইউনিটের কর্মীরা আলামত সংগ্রহ করছেন। তাঁরা পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছেন। ভবনের পাশের একটি ভবনের দোতলার দেয়ালে বিস্ফোরণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরণে পাশের একটি অটোরিকশার গ্যারেজের টিনের ছাউনি উড়ে গেছে। টিনের নিচে চাপা পড়েছিলেন গ্যারেজের ম্যানেজার আবুল কালাম।

আবুল কালাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এত বিকট শব্দ হয়েছে যে আমার কানে তব্দা লেগে যায়। আমি টিনের নিচে চাপা পড়ি। পরে হামাগুড়ি দিয়ে বের হই। এরপর দেখি মাদ্রাসার মধ্যে আগুন জ্বলছে। যারা ভেতরে ছিল, তারা দ্রুত বাচ্চাদের নিয়ে বের হয়ে চলে যায়।’

গ্যারেজের মালিক মোশাররফ হোসেন ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘বিস্ফোরণের পর পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। আমিও বাসা থেকে দৌড়ে আসি। আমার গ্যারেজের দুজন অটোচালক দুই শিশুকে ওই ভবন থেকে বের করেন। এক নারী আর এক শিশুকে নিয়ে চলে যায়। এ সময় আল আমিনও দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে চলে যায়। আধা ঘণ্টার মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের লোকজন এসে পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।’

মাদ্রাসার পাশের ৫ তলা বাড়ির বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পাই। মনে হয়েছিল ভূমিকম্প। কারণ, বিস্ফোরণে সব ভবনে কাঁপুনি লাগে। সবাই চিৎকার করেছিল।’

ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘মাদ্রাসাটিতে ৩০-৩৫ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তবে শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় মাদ্রাসা বন্ধ ছিল। এ কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।’

ভবনটির পশ্চিম পাশের এক পাশে তিনটি কক্ষে মাদ্রাসার কার্যক্রম পরিচালিত হতো। অপর পাশের একটি কক্ষে পরিচালক শেখ আল আমিন (৩২), তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম (২৮) এবং তাঁদের তিন সন্তান নিয়ে সেখানেই থাকতেন। বিস্ফোরণে দুই ছেলে উমায়েত (১০) ও আবদুল্লাহ (৭) আহত হয়। এর মধ্যে আছিয়া ও তাঁর দুই সন্তানকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

পাশের ভবনের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বিস্ফোরণে আমাদের ভবনের কিছু অংশ ফেটে গেছে। ঘরের ভেতরের আসবাবও ভেঙে পড়েছে।’

ঘটনাস্থলেই পুলিশ হেফাজতে বসে ছিলেন ভবনমালিক পারভীন বেগম। ভবনের জমি তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে লিবিয়ায় থাকা তাঁর দুই ছেলে এই ভবন ২০২২ সালে তৈরি করেন। এরপর হারুন অর রশীদ নামের এক ব্যক্তি এটি মাদ্রাসা করবেন বলে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পারভীন বেগম বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমার বাড়ি ভাড়া নিয়ে মুফতি হারুন অর রশীদ মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। হারুন তাঁর শ্যালক আল আমিন ও শ্যালকের স্ত্রী আছিয়াকে মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। তিনি মাঝেমধ্যে মাদ্রাসায় আসতেন। আমি নিয়মিত খোঁজখবর নিতাম। কিন্তু মাদ্রাসার আড়ালে কী কার্যক্রম চলছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ এসে দেখি, ভবনের চারপাশ উড়ে গেছে।’

পারভীন বেগমের পাশেই ছিলেন তাঁর ছোট মেয়ে সোহানা। তিনি বলেন, ‘ভাড়া নেওয়ার সময় শুধু হারুন অর রশীদ একাই এসেছিলেন। এরপর তাঁরা মাদ্রাসা পরিচালনা শুরু করেন। তবে তাঁরা আশপাশের কারও সঙ্গে তেমন মিশতেন না।’

পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে কেমিক্যাল, ককটেল, ভেস্ট ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের ধারণা, কোনো বিস্ফোরক তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে।

ঘটনার বিষয়ে গতকাল বিকেলে জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শেখ আল আমিন পলাতক রয়েছেন। তবে কেরানীগঞ্জ থেকে তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগম, আছিয়ার ভাই হারুনের স্ত্রী ইয়াছমিন আক্তার এবং ঢাকার বাসাবো থেকে আসমানী খাতুন নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

পুলিশ জানিয়েছে, আল আমিনের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটে। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগে ২০১৭ ও ২০২০ সালে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন জেএমবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন থানায় অন্তত সাতটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার আসমানী খাতুনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপি-জামায়াত জোটে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি দল, আসন বণ্টন ঘোষণা রাতেই

নির্বাচন না করার ঘোষণা দিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

নাহিদকে শুভকামনা জানিয়ে সরে গেলেন জামায়াতের আতিক

কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের লাঠিমিছিল, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা এনসিপি নেত্রী মনজিলা ঝুমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার ৮ হাজার ৫৯৭

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে। গত ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এ সারা দেশে ৮ হাজার ৫৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ৮৫টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২ লাখ ৫৮ হাজার ১৬৮টি মোটরসাইকেল ও ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪১১টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ৩ হাজার ৩৯৪টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

বিষয়:

অপরাধ
Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপি-জামায়াত জোটে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি দল, আসন বণ্টন ঘোষণা রাতেই

নির্বাচন না করার ঘোষণা দিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

নাহিদকে শুভকামনা জানিয়ে সরে গেলেন জামায়াতের আতিক

কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের লাঠিমিছিল, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা এনসিপি নেত্রী মনজিলা ঝুমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ডেভিল হান্ট-২: এক দিনে আরও ৬৯৮ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২-এর বিশেষ অভিযানে গত রোববার বিকেল থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল রোববার রাতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ৬৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় ১৪টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২৮ হাজার ৭৬৬টি মোটরসাইকেল ও ৪৩ হাজার ৩৫২টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিকালে ২৯১টি অবৈধ মোটরসাইকেল আটক করা হয়।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও ‘ফ্যাসিস্টদের’ দমনে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে দেশজুড়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপি-জামায়াত জোটে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি দল, আসন বণ্টন ঘোষণা রাতেই

নির্বাচন না করার ঘোষণা দিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

নাহিদকে শুভকামনা জানিয়ে সরে গেলেন জামায়াতের আতিক

কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের লাঠিমিছিল, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা এনসিপি নেত্রী মনজিলা ঝুমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন ফয়সাল ওরফে দাউদ কে, মাস্ক পরা ব্যক্তিটিই কি তিনি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৫
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত
হাদি হত্যা মামলায় প্রধান আসামি ফয়সাল করিম মাসুদ। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আলোচিত মুখ ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমে বহুল আলোচিত নাম ফয়সাল করিম মাসুদ কিংবা দাউদ খান। গতকাল শুক্রবার হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই দুই নামে এক ব্যক্তির ছবি ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

হাদিকে গুলির ঘটনায় মাস্ক পরা দুই তরুণ জড়িত বলে তাঁর সহযোদ্ধাদের সন্দেহ। তাঁদের দাবি, কয়েকদিন ধরে দুই তরুণ মাস্ক পরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হাদির সঙ্গে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছেন। বার বার তাঁদের মাস্ক খুলতে বলা হলেও তাঁরা রাজি হননি। হাদিঘনিষ্ঠদের সন্দেহ, এই তরুণরা হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে তাঁর গতিবিধি বোঝার জন্য তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন।

দুজনের মধ্যে মাস্ক পরা একজন হাদির পাশে বসে আছে— এমন একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই তাকে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে মাস্ক করা এই তরুণই যে হাদিকে গুলি করেছেন, কিংবা এই তরুণই যে ফয়সাল, তা নিশ্চিত করে বলছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে ‘সন্দেহভাজন’ হিসেবে শনাক্ত একজনের ছবি প্রকাশ করে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ডিএমপির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তদের হামলায় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেফতারে রাজধানীতে জোর অভিযান পরিচালনা করছে। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ছবির ব্যক্তিকে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য থাকলে বা তার সন্ধান পেলে দ্রুত নিম্নলিখিত মোবাইল নম্বর অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর জন্য বিনীত অনুরোধ করা হলো।’

পুলিশের বিবৃতিতে এই তরুণের নাম উল্লেখ করা না হলেও ছবি দেখে ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ বলে আন্দাজ করা যায়। এই তরুণকেও আগে হাদীর সঙ্গে দেখা গেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে হাদির সঙ্গে গণসংযোগে থাকা মাস্ক পরা তরুণটিই ‘ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান’ এমন কোনো তথ্য পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম। সেই আলোচনার ছবিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।

ফয়সাল করিম নামের তরুণ কার্যক্রমনিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধঘোষিত সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৯ সালের ১১ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে তিনি সদস্য হন। তাঁর পুরো নাম ফয়সাল করিম দাউদ খান।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। হাদিকে বহনকারী রিকশাকে অনুসরণ করে পেছন দিকে থেকে মোটরসাইকেলে এসে তাঁকে গুলি করে চলে যায় আততায়ীরা। হাদি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার নামে ওসমান হাদির প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সঙ্গে ফয়সাল করিমের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ছবিগুলোতে থাকা ফয়সাল করিমের সঙ্গে মাস্ক পরা ব্যক্তির চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। সেকারণে গুলি ছোড়ার ঘটনায় তাঁকে সন্দেহ করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই দুপুরে ডিএমপি সন্দেহভাজনকে শনাক্তের কথা জানায় এবং ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলামোটর এলাকায় হাদির ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারে গিয়ে হাদির পাশে বসে আলোচনা শুনেছিলেন ফয়সাল করিম।

আলোচিত ফয়সাল করিম কে?

পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনে ফয়সাল করিমের নামে প্রোফাইল আছে। সেখানে তিনি নিজেকে অ্যাপল সফট আইটি, ওয়াইসিইউ টেকনোলজি ও এনলিস্ট ওয়ার্ক নামে তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লিংকডইন প্রোফাইলের তথ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম ২০১৩ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। পরে আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমবিএ করেছেন বলে সেখানে উল্লেখ রয়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনকারীদের দমনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের সঙ্গে মাঠে ছিলেন বলে ছাত্রলীগের সূত্র জানিয়েছে।

ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় নাম আসার পর ফয়সাল করিমের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের দুইবারের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতার ছবি ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হাদির সঙ্গে ঢাকা–৮ আসনে গণসংযোগ এবং বাংলামোটরে হাদির প্রতিষ্ঠিত ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের আড্ডায় ফয়সালের অংশ নেওয়ার ছবিও ভাইরাল হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, ফয়সাল করিম ওসমান হাদিকে বেশ কিছুদিন ধরে অনুসরণ করছিলেন।

২০১৬ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সহযোগিতা ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘ব্যাটল অব ৭১’ নামে একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেছিল ফয়সাল করিমের মালিকানাধীন ওয়াইসিইউ টেকনোলজি লিমিটেড। সে বছরের নভেম্বরে ওই গেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেসিসের তৎকালীন সভাপতি এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘আসনভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা ও সমন্বয়ক কমিটি’ করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ঢাকা–১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এই আসনের সমন্বয়ক কমিটির সদস্য ছিলেন ফয়সাল করিম।

অভ্যুত্থানের অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার ফয়সালের দ্রুত জামিন নিয়ে প্রশ্ন সবার

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকার আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটি এলাকায় ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের চতুর্থ তলায় অফিসে অস্ত্রের মুখে ১৭ লাখ টাকা লুটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় আদাবর থানার মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ফয়সাল করিম।

মামলা হওয়ার কিছুদিন পর ৭ নভেম্বর আদাবর এলাকা থেকে ফয়সাল করিমকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর কাছ থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন ও পাঁচটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। ওই মামলায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান ফয়সাল করিম। জামিনের সময়সীমা বাড়াতে গত ১২ আগস্ট আবারও আবেদন করলে হাইকোর্ট নতুন করে তাঁর এক বছরের জামিন মঞ্জুর করেন।

জামিনে থাকা অবস্থায় এবার তাঁর বিরুদ্ধে ওসমান হাদিকে গুলি করার অভিযোগ এল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে জামিন পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, কোনো অপরাধমূলক কাজের প্রমাণ না থাকলেও অভ্যুত্থানের পর শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা সভা করায় গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকের জামিন বারবার নাকচ করা হয়েছিল। আর এ রকম লুটের ঘটনায় দুটি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে এতো দ্রুত জামিন দেওয়া হলো কীভাবে, সেই প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন আলোচনা–সমালোচনায় সরব।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপি-জামায়াত জোটে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি দল, আসন বণ্টন ঘোষণা রাতেই

নির্বাচন না করার ঘোষণা দিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

নাহিদকে শুভকামনা জানিয়ে সরে গেলেন জামায়াতের আতিক

কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের লাঠিমিছিল, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা এনসিপি নেত্রী মনজিলা ঝুমার

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত