Ajker Patrika

আইএমএফ কী, কেন এটা এত আলোচিত

আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২: ২৯
আইএমএফ কী, কেন এটা এত আলোচিত

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এখন বহুল চর্চিত নাম। দুই বছরেরও বেশি সময় আগে আসা মহামারি করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে অভূতপূর্ব প্রাণহানি ঘটিয়েছে। তার সঙ্গে রেখে গেছে অর্থনৈতিক সংকট। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আইএমএফের নাম যতবার উচ্চারিত হয়েছে, তা আর কখনো হয়নি। 

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর সৃষ্ট যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে টালমাটাল করে দিয়েছে। খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহে বিপর্যয় সব দেশকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে অনেক দেশ। এমন পরিস্থিতিতে শেষ আশ্রয় আইএমএফ। বাংলাদেশও এর আশ্রয় নিয়েছে, সম্প্রতি ঋণও পেয়েছে। 

কিন্তু এই ঋণ যেসব শর্ত দিয়ে নেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক সমালোচনা চলছে। এই সমালোচনা শুধু এখনকার নয়, আগেও ছিল বিশ্বজুড়ে। আইএমএফ তৈরির সময় থেকেই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ সমালোচনা চলছে।          

অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আইএমএফের ঋণ অর্থনীতিকে চাঙা করতে সাহায্য করে না কি, বিকল্প উপায়গুলোর চেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে ফেলে তা জানা কঠিন। এ ক্ষেত্রে একেক দেশের অভিজ্ঞতা একেক রকম। তা ছাড়া আইএমএফ কঠোর শর্ত দেয় বলেও সমালোচনা আছে। এসব প্রেক্ষাপট বিবিসি এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।  

আইএমএফ কী?
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ১৯০টি দেশের আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ১৯৪৪ সালে এ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। যেকোনো দেশ এর সদস্য হতে পারে। তার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো দেশের অর্থনীতির নানা তথ্য এবং একটা মোটা অঙ্কের অর্থ (কোটা চাঁদা) সংস্থাটিকে দিতে হয়। যে দেশের অর্থনীতি যত বড়, সে দেশকে তত বেশি অর্থ দিতে হয়।

অর্থনীতিতে নজরদারি ও সহায়তার জন্য আইএমএফ প্রধান তিনটি কাজ করে—

১. অর্থনৈতিক ও আর্থিক ঘটনাগুলোতে চোখ রাখা; অর্থনীতির পাশাপাশি বাণিজ্য বিষয়ে বিবাদের মতো সম্ভাব্য ঝুঁকির ওপরও নজর রাখে।
২. অর্থনীতি মজবুত করতে উপদেশ দেয়।
৩. সংকটে পড়া দেশগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ঋণসহ নানা ধরনের সহায়তা দেয়।

আইএমএফকে দেওয়া দেশগুলোর চাঁদা থেকেই এই ঋণ দেওয়া হয়। আইএমএফের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ ৫৭ বিলিয়ন ডলার ২০১৮ সালে পেয়েছিল আর্জেন্টিনা। তবে আইএমএফ সব সদস্য দেশ মিলে মোট ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লাখ কোটি ডলার ঋণ দিতে পারে।

আইএমএফের প্রধান অর্জন
ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফকে অনেক সময় ‘নিরুপায়ের শেষ আশ্রয়’ হিসেবে ধরা হয়। সংকটের সময় দেশগুলো আর্থিক সহায়তার জন্য আবেদন করতে পারে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যক্ষ বেঞ্জামিন ফ্রিডম্যান মনে করেন, আইএমএফের এসব ঋণ আদৌ কোনো দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করতে সাহায্য করে না কি, বিকল্প উপায়গুলোর চেয়ে বাজে পরিস্থিতিতে ফেলে—তা আসলেই জানা কঠিন।

তবে আশির দশকের শুরুতে মেক্সিকো ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা প্রকাশের পরও সহায়তা করে যাওয়ায় অনেকে আইএমএফের প্রশংসা করে থাকেন।  

এরপর ব্রাজিলও ২০০২ সালে আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে দেশের অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে এনেছিল। নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই দেশটির সব ঋণ শোধ করেছিল।

আইএমএফের সমালোচনা
অর্থনৈতিক মন্দায় পড়া দেশগুলোকে ঋণ দেওয়ার সময় আইএমএফ যেসব শর্ত দেয়, তা কঠোর বলে আইএমএফের সমালোচনা আছে। এসব শর্তের মধ্যে আছে—সরকারি ঋণ কমানো, করপোরেট কর কমানো এবং বিদেশি বিনিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত করা।

২০০৯ সালে গ্রিসে অর্থনৈতিক মন্দা এত তীব্র হয় যে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়ে। আইএমএফ কঠোর সব নীতি মানার পর গ্রিসকে ঋণ দেয়। নীতিগুলো এতই কঠোর ছিল যে গ্রিসকে অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হয়েছিল।

সরকারি ঋণ নেওয়া কমানোর মতো আইএমএফের সব কঠোর নীতি বাস্তবায়নের ফলে গ্রিসের অর্থনীতি ও সমাজ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিল বলে সমালোচকেরা বলে থাকেন।

আইএমএফ চালায় কারা?
২০১৯ সাল থেকে আইএমএফের প্রধানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। এর আগে এই অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ বুলগেরিয়া থেকে প্রথম আইএমএফের প্রধান হন জর্জিয়েভা। 

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রীতি মেনে একজন ইউরোপীয় আইএমএফের প্রধান ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হন। 

কেন আইএমএফ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আইএমএফের যাত্রা শুরু। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছিলেন।

যুদ্ধপরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা, স্থিতিশীল বিনিয়োগ ব্যবস্থা ও ভেঙে পড়া ইউরোপীয় অর্থনীতি পুনর্গঠনে করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে তখন আলোচনা করা হয়।
পরবর্তী সময় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক এসব লক্ষ্য পূরণে কাজ শুরু করে। এ লক্ষ্যে আইএমএফ অর্থ বিনিময়ের নির্দিষ্ট হার নির্ধারণ করে, যা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

আইএমএফ-বাংলাদেশ সম্পর্ক
১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশে আইএমএফে যোগদান করে এবং ১৯৯৪ সালের ১১ এপ্রিল আর্টিকেল ৮-এর ধারা ২, ৩ ও ৪-এর অধীনে বাধ্যবাধকতায় সম্মত হয়। আইএমএফ ঋণ দেয় তার নিজস্ব সম্পদের বিশেষ হিসাব থেকে, যাকে স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআর বলা হয় (১ এসডিআর সমান প্রায় ১ দশমিক ৩৫৩৫৫০)। 

আইএমএফে বাংলাদেশের কোটা আছে ১ হাজার ৬৬ মিলিয়ন এসডিআর। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ নিট ঋণ ছিল ৬৩০ দশমিক ৮২ মিলিয়ন।

অনুবাদ: আব্দুল বাসেদ, সূত্র: বিবিসি, আইএমএফ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত