Ajker Patrika

আনি এরনোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লজ্জা’

জাহীদ রেজা নূর
আনি এরনোর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লজ্জা’

আমার সামনেই ছিল অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপনের তালিকা, আমি সেগুলো দ্রুতগতিতে ‘প্যারিস নরম্যান্ডি’ পত্রিকা থেকে লিখে নিচ্ছিলাম। এই তালিকা থেকে আমার কোনো নির্দিষ্ট চাওয়া-পাওয়া নেই। বলে রাখি, সে সময় গাড়ি আর রেফ্রিজারেটরের সংখ্যা ছিল খুব কম। সে সময় বিজ্ঞাপন-তারকা ছিল ‘লাক্স’ সাবান। নব্বই দশকের কম্পিউটার, ওভেন, হিমায়িত খাবার রাখার বাক্সের চেয়ে তা বেশি আকর্ষণীয় ছিল না। পণ্যের বণ্টন পণ্য প্রাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ’৫২ সালে কারও কারও বাড়িতে বেসিনও ছিল না, আবার কারও কারও বাড়িতে অপরিহার্য ছিল বাথটাব। এটাই হচ্ছে তখনকার অবস্থা। এখনো তো কেউ কেউ পোশাকের জন্য বেছে নেয় ফ্রগি, কেউ কেউ বেছে নেয় অ্যাগনেস বি। পত্রিকা একসঙ্গে ধরে রাখে বিভিন্ন যুগের সেরা লক্ষণগুলোকেই।

আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে শব্দগুলো দিয়ে আমি নিজেকে এবং অন্যকে চিনতাম, সে শব্দগুলো খুঁজে বের করা, যে শব্দগুলোকে সে সময় মনে হয়েছিল খুবই সাধারণ এবং অগ্রহণযোগ্য। অথবা মনে হয়েছিল একেবারেই অসম্ভব কিছু। কিন্তু আমি তো এখন ’৯৫-এ বাস করা এক নারী, যে কিনা ’৫২-এর সেই কিশোরী হিসেবে পুনর্জন্ম নিতে পারবে না কখনো, যে কিনা চেনে শুধু নিজের ছোট্ট শহরটিকে, চেনে নিজের পরিবারকে, স্কুলটাকে এবং যার শব্দভান্ডারে শব্দের সংখ্যা নিতান্তই কম। তখন আমি সেই কিশোরীটা—যার সামনে রয়েছে পুরোটা জীবন। নিজের জীবনের সবকিছুই তো আর সত্যি সত্যি মনে রাখা যায় না।

 আনি এরনোআমার শৈশবের দিনগুলোকে নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই সেই সময়ের নিয়মকানুন, আচার-ব্যবহার, বিশ্বাস, সে সময়ের আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলো, আমাদের স্কুলে, পরিবারে, শহরতলিতে মান্য করা রীতিগুলোকে স্মরণে আনতে হবে—সেগুলোই আসলে আমার জীবনকে গড়ে নিয়েছে, প্রশ্নহীনভাবে আমার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমি যে আমার মতো হলাম, তার সবকিছুই আমাকে মনে করে দেখতে হবে: আঞ্চলিক ভাষা, ধর্মীয় ধারণা, বাবা-মার বলা কথায় ব্যবহৃত শব্দাবলি, শরীর ও আশপাশের বস্তু থেকে খাপ খাওয়ানো তাদের অঙ্গভঙ্গি, মেয়েদের ম্যাগাজিনে পড়া উপন্যাস ‘পেটিট ইকো দ্য লা ফ্যাশন’ বা ‘ভিয়েনে দ্য শোমের’। এসব ভিন্ন ভিন্ন শব্দের কোনো কোনোটি এখনো আমার জীবন থেকে অর্থ হারিয়ে ফেলেনি—এবং সে শব্দগুলোই সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি ঘিরে তৈরি করেছিল এর প্রেক্ষাপট, যা বারো বছর বয়সী একটি মেয়ের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং মেয়েটি একদিন মনে করল, আতঙ্কে সে পাগল হয়ে গেছে।

তাহলে বলি। যা দাঁড়াচ্ছে, তা কোনো কারণেই একটি কল্পনার আশ্রয়ে গড়ে ওঠা কোনো ছোটগল্প হবে না। বাস্তবতার ছোঁয়াহীন কোনো গল্প এটা নয়। আমি শুধু কাগজে আমার শৈশবের ছবি আঁকতে চাই না, বরং আমি জীবনের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে সে ছবিটি দেখতে চাই, যে ছবিটি তার আলোকে পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে। সংক্ষেপে, আমি সেভাবেই নিজের জীবনটি দেখতে চাই, যেভাবে দেখে একজন নৃতাত্ত্বিক।

(এটা অবশ্য বলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না, কিন্তু আমি চাই আমার কাজকে একদম স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে, নইলে আমি কাজটা করে উঠতে পারব না।)
আমি হয়তো আমার শৈশবের নিত্য কথামালা ও দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপটে ওই ভয়ংকর দৃশ্যটি তুলে ধরার চেষ্টা করব। অথবা এমনও হতে পারে, আমাকে চালিত করবে উন্মত্ত—প্রতারক কোনো শক্তি, যাকে মনে হতে পারে আমার অচেনা গসপেলের মতোই অভিশপ্ত। এমন এক অভিশাপ, যা আমাকে ভুডু আচারধর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।

মেনে নিন এবং পাঠ করুন: ইহা আমার দেহ, যাহা আপনার নিকট অর্পণ করা হইবে, ইহা আমার রক্তপূর্ণ বাটি, যাহা আপনার এবং আরও অনেকের মধ্য দিয়া প্রবাহিত হইবে।

১৯৫২ সালের জুন মাসের আগে অবধি আমি কোনো দিন আমার শহর ছেড়ে আর কোথাও যাইনি। আমার শহরটাকে সবখানে একটু ধোঁয়াশাঘেরা অদ্ভুত নামে ডাকা হয়, অথচ সেই নামটিই সবার কাছে পরিচিত, ‘কো অঞ্চল’। এটাকে আমরা ‘এখানে’ বলে থাকি। এই শহর দাঁড়িয়ে আছে সেন নদীর ডান পারে, লে হাভরে ও রুয়ান শহর দুটোর মাঝখানে এর অবস্থান। এবং এই দুই শহরের পর আর কী আছে, তা আমার একেবারেই জানা নেই। আসলে এরপর যা আছে, তা হলো ফ্রান্সের বাকি অংশ, আসলে রয়েছে বাদবাকি পুরো পৃথিবীটা। এই অজানা জায়গা সম্পর্কে ‘সেখানে’ শব্দটি ব্যবহার করি আমরা। আর সে শব্দ ব্যবহার করার সময় দিগন্তের দিকে এমনভাবে হাত নাড়া হয়, যা দেখে মনে হবে, এ এক উদাসীনতার প্রকাশ কিংবা ওই বাদবাকি পৃথিবী সম্পর্কে জানার কোনো উপায় নেই বলেই এমনটা করা হচ্ছে। আমাদের শহর থেকে কেউই আমাদের দেশের রাজধানীমুখো হবে না। তখনই তারা রাজধানীমুখো হবে, যখন কোনো ট্যুরিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যাবে অথবা নিশ্চিতভাবেই প্যারিসে তাদের কোনো কাছের মানুষ আছে, যারা সেখানে তার দায়িত্ব নেবে। ট্রামে করে নিজ এলাকার মেলায় যাওয়ার চেয়ে মেট্রোতে করে চলাচল করা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, মেট্রোতে উঠতে হলে দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি প্রয়োজন। সবাই বিশ্বাস করে, যেখানে সবাই অচেনা, সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। আর সেখানে গেলেই আনন্দ লাগবে, যেখানে মানুষ যখন ইচ্ছে যেতে পারে।

আমাদের ‘এখানে’ শব্দটি দিয়ে আমরা আমাদের পাশের সেই দুটো শহর লা হাভরে ও রুয়ানকেও নির্ভয়ে বোঝাই, আমাদের পরিবারগুলোয় প্রায়ই এই শহর দুটি নিয়ে কথা হয়। আমাদের শহরের অনেক শ্রমিক রেলকারে করে কাজে যায়। রুয়ান শহরটি আমাদের শহরের বেশি কাছে, তুলনামূলকভাবে শহরটা বড়। এখানে দোকানপাট রয়েছে, সর্বরোগের চিকিৎসকেরা আছেন, কয়েকটি সিনেমা হল আছে, ইনডোর সুইমিং পুল আছে, সেখানে সাঁতার শেখা যায়, সেঁ রোমেঁ নামে মেলা আছে—পুরো নভেম্বরজুড়েই যে মেলাটি বসে, আছে ট্রাম, চা-খানা, আছে হাসপাতাল, যেখানে মানুষের শরীরে জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। এখানে ইলেকট্রিক শক দেওয়া অথবা বিষনাশক কোর্সেরও ব্যবস্থা আছে।

 জাহীদ রেজা নূরআমাদের শহর থেকে কেউই ভুলেও রুয়ান শহরে যাবে না, যদি সে সেখানে নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ না করে। মা আমাকে বছরে দুবার রুয়ানে নিয়ে যেত। সেখানে গিয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে আমার চোখ পরীক্ষা করাতো আর নতুন চশমা বানিয়ে দিত। আর সেই সুবাদে মা সেখান থেকে কসমেটিকস আর প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনত, যেগুলো আমাদের শহরে পাওয়া যেত না। এই রুয়ান শহরটিকে আমরা ‘নিজের ঘর’ বলে মনে করতাম না, কারণ এই শহরের কেউই আমাদের পরিচিতজন ছিল না। এ শহরে যারা বসবাস করে, তারা আমাদের শহরের লোকেদের চেয়ে ভালো কাপড়চোপড় পরে, তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আমাদের চেয়ে কম।

রুয়ানে এলেই আমরা বুঝতে পারতাম, কোথায় কোথায় আমরা পিছিয়ে আছি। বুদ্ধিতে, যোগাযোগ করার ক্ষমতায়, কথা বলার পারঙ্গমতায়, সামগ্রিক অগ্রসরমানতায় আমাদের দুর্বলতা ছিল।

১৯৫২ সালে আমি আমার শহরের বাইরে নিজেকে কল্পনাও করিনি। আমাকে যারা ‘আনি’ নামে চিনত, শুধু তাদের দোকানে, তাদের বাড়িতে যাওয়ার মধ্যেই আমার চলাচল ছিল সীমাবদ্ধ। অন্য পৃথিবীর কোনো কিশোরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হওয়ার সুযোগই ছিল না। সে সময় আমার সকল ভাবনা ছিল আমার ছোট শহরটিকে ঘিরে। এই শহরের স্কুল, গির্জা, ফ্যাশনেবল কাপড়ের দোকানঘর এবং উৎসব ছিল আমার নিজের। ল হাভরে ও রুয়ানের মাঝখানে সাত হাজার মানুষের এই শহরটি ছিল পৃথিবীতে একমাত্র জায়গা, যার প্রায় সব মানুষ সম্পর্কে আমরা বলতে পারতাম, কোথায় কার বাড়ি, কার কজন ছেলেমেয়ে, কে কোথায় কাজ করে। আমরা মুখস্থ বলতে পারতাম গির্জার সময়সূচি, লেরুয়া সিনেমা হলে কটার সময় কোন সিনেমার শো আছে, কোনটা সেরা পেস্ট্রিশপ কিংবা কোন কসাইয়ের কাছ থেকে মাংস কিনলে সে মাপে কম চুরি করবে। এই শহরেই জন্মেছে আমার বাবা আর মা, কাছের কোনো গ্রামেই জন্মেছিল তাদের বাবা মা, এবং তাদেরও বাবা-মা। পৃথিবীতে কোথাও আর কোনো জায়গা নেই, যে জায়গাটিকে আমি এই শহরটির মতো এ রকম আপন করে চিনে নিতে পারি। আমি জানি, আমাদের পাশের বাড়িতে পঞ্চাশ বছর আগে কারা থাকত এবং স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার কিশোরী মা কাদের কাছ থেকে পাউরুটি কিনে আনতেন। রাস্তাঘাটে চলাচল করতে গিয়ে এমন নারী বা পুরুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়, যাদের কারও কারও সঙ্গে একটুর জন্য বাবা বা মায়ের এনগেজমেন্ট হয়নি। এরপরই কেবল বাবা আর মায়ের দেখা হয়েছে। যাদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, তাদের বলি ‘আগন্তুক’।

আমরা তাদের অতীত সম্পর্কে জানি না, তারাও আমাদের অতীত সম্পর্কে কিছু জানে না। ব্রিটেনবাসী, মার্সেলবাসী, স্প্যানিশ, যেকোনো লোক, যারা আমাদের ভাষায় কথা বলে না, তারা সবাই আমাদের চোখে ‘বিদেশি’।

(অন্যান্য উপন্যাসে আমি যেভাবে এই শহরের নাম করেছি, এখানে তার দরকার নেই। কারণ রুয়ান বা ল হাভরে থেকে রেলগাড়ি চেপে কিংবা ১৫ নম্বর হাইওয়ে দিয়ে যেখানে পৌঁছানো যায়, এখানে মানচিত্রে স্থান পাওয়া সেই ভৌগোলিক স্থান হিসেবে শহরটাকে দেখানো হচ্ছে না, এটা না হয় থাকুক নামহীন আমার জন্মশহর হিসেবে, যার কাছে ফিরলে আমি হতাশা আর বিষণ্নতায় ভুগতে থাকি, আর তা আমার সব ভাবনা আর স্মৃতিকে গ্রাস করে নেয়।)

চল্লিশের দশকে জার্মান বাহিনীর আক্রমণের পর আগুনে পোড়া নগরের কেন্দ্রস্থলে নরম্যান্ডির মতোই পরে বোমা হামলা হয়, সেখানেই পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। সবকিছুই একের পর এক সাজানো আছে: নির্মাণকাজ চলছে, খালি জায়গাও আছে পাশে, ইটের নতুন ত্রিতল ভবন গড়ে উঠেছে, যার প্রথম তলায় জায়গা করে নিয়েছে ফ্যাশনেবল দোকানপাট, আর পাশেই রয়েছে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ব্যারাক আর পুরোনো ভবন: মেয়র ভবন, সিনেমা হল লেরুয়া, পোস্ট অফিস, মার্কেটের প্যাভিলিয়ন। গির্জাটা পুড়ে গিয়েছিল এবং এর নিচে তৈরি হয়েছিল ক্লাব, যা মেয়র ভবনের চত্বরের সঙ্গে জায়গা ভাগ করে নিয়েছিল। ধার্মিক মানুষ সেখানে এসে হাজির হয়, সাধারণ মানুষেরা বসে সেই স্টলগুলোয় অথবা গ্যালারিতে।

কেন্দ্রীয় সড়ক থেকে অ্যাসফাল্টে গড়া রাস্তা বা ফুটপাত ছড়িয়ে গেছে চারদিকে, ইট আর পাথরে গড়া ব্যক্তিগত বাড়িগুলো সুবিন্যস্ত হয়ে লুকিয়ে আছে প্রাচীরের আড়ালে এবং সেখানে গড়ে উঠেছে নোটারি পাবলিক, ডাক্তারখানা, বড় চাকুরেদের বাড়ি। একটু দূরেই রয়েছে সরকারি এবং বেসরকারি স্কুল। এ জায়গাটাকে অবশ্য ঠিক শহরের কেন্দ্র বলা যাবে না, তবে একে শহরতলি বলারও কোনো কারণ নেই।

এরপর রয়েছে শহরতলি, যেখানকার বাসিন্দারা শহরের কেন্দ্রের দিকে যাওয়ার কালে বলে, ‘শহরে যাই’ কিংবা শহরের নাম করে বলে ‘অমুক শহরে যাই।’ তবে সত্যের খাতিরে বলতে হয় শহরের কেন্দ্র আর শহরতলির মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। তবে এখানে এসে শেষ  হয়েছে ফুটপাত, বেশির ভাগ বাড়িই কাদালেপা কুঁড়ে (দু-তিনটা ঘর তাতে, পানির ব্যবস্থা নেই, টয়লেট আছে বাড়ি থেকে কিছু দূরে আর বাড়ির সঙ্গে রয়েছে বাগান)। দোকানপাট অনেক দূরে দূরে, তবে ঐতিহ্যবাহী মুদির দোকান, কফি কর্নার রয়েছে এই শহরতলিতে, যাকে ‘গ্রাম’ বলা যায়। তবে সবাই জানে, এসব দোকানে যেতে হলে ভারী জুতো কিংবা ভালো পোশাক পরার দরকার নেই। কেন্দ্র থেকে যতই দূরে যাওয়া, ততই প্রাসাদোপম বাড়ির সংখ্যা কমতে থাকে, একসময় শুধু মাটির কুঁড়ের দেখা পাওয়া যায়। শহরের প্রান্তে এসে রাস্তাগুলো হয়ে গেছে কাঁচা রাস্তা। বৃষ্টি হলেই সে রাস্তায় কাদা জমে। আর ঠিক এর পেছন থেকেই শুরু হয়েছে খামারবাড়িগুলি—এখান থেকেই আসলে গ্রামের শুরু।

(চলবে)

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

তৌহিদুল হক
তৌহিদুল হকের গুচ্ছ কবিতা

রক্ত লাল

আলসেমি শরীরে এদিক-ওদিক চেয়ে আটকে

গেল চোখ পশ্চিমান্তে। রক্তিম সূর্যের বিদায়

ধীর গতিতে। খুব লাল হয়েছে, সারা দিনের

জ্বলন্ত প্রহরে পেয়েছে এক অপূর্ব রূপ।

যা স্বভাববিদ্ধ, তবে কতটা উপকারী বা বাঁচিয়ে

রাখার নিরলস অভিপ্রায়। মানুষের তরে

প্রাণীর অফুরন্ত প্রাচুর্য বিস্তৃতকরণে, কিংবা

উদ্ভিদের অন্তিম প্রেমে বসন্তের অভিষেকে।

কতটা জ্বলতে হয় পরের জন্য, কতটা ফুটন্ত

শরীর নিয়ে চালিয়ে যায় সেবার পরিধি।

এক চিরন্তন শিক্ষা, আবার উদিত হয়

দিনের শুরুতে, বিদায় প্রান্তিক অপূর্ব

মায়ায়-দিনের শেষ প্রান্তে।

এতটুকু কার্পণ্য রেখে যায়নি, হয়তো মুখ

ফিরিয়ে নিবে না কোনো দিন। তবে ভাবনার

অন্তিমে শেষ দৃশ্যের সংলাপে ভেসে

ওঠে জনদরদি রাজার মুখ। যেখানে রক্ত ঝরে

বন্যার বেগে সেখানেও প্রতিদিন ফুল ফোটে ফুল হয়ে।

যত দেখি

যত দেখি তৃপ্ত হই, শীতল হয়ে

জড়িয়ে পড়ি তোমার সমস্ত শরীরে। এক অজানা

শিহরণ ছুঁয়ে যায় হৃদয়ের সমস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে।

যেন দীর্ঘদিনের শুষ্কতা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দূরে।

হারিয়ে যাওয়া রস ফিরছে মূলে, নিয়ে যাচ্ছে আদিপর্বে।

যেমন নেয় নদীর কূল, জোয়ারের ফেনা।

ভাবনার অতলে অদ্ভুত মায়া, দীর্ঘক্ষণ মোহগ্রস্ত

করে রাখে চোখের পলক, তাকিয়ে থাকি মায়ার মায়ায়। কী অপরূপ মায়া!

সেখানেও দেখি তৃষ্ণার ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষারত কান্না।

জীবনের তল্লাটে হারিয়ে খুঁজি আজ

আমারও জীবন ছিল। মায়ায় ভরা নির্বিঘ্ন আয়োজন, কলমিলতার মতো নিষ্পাপ।

তৃপ্ত হই ঘাসে, বাতাসের বেহায়া আঘাতে

অভিমানের মোড়ক ছুড়ে ফেলে হাতে তুলে নেই

কচু পাতায় টলোমলো জলের লজ্জা। এ জীবনের চাহিদা তোমায় দেখার

প্রয়োজনে তপ্ত, হয় উত্তপ্ত অথবা সহ্যের অতীত শীতল।

এ যেন কেমন

গহিন অরণ্যে সবুজ পাতার মতো, মগজে

চিন্তার রাজ্যে ভাবের উদয়, আকুল বিন্যাসে

একটু একটু করে এগিয়ে নেয়, আবার ভরা কলসির

মতো বসিয়ে রাখে-ভবের রাজ্যে। একদিন সমস্ত ভাবনা থেকে মুক্ত হয়ে

এদিক-ওদিক চলন, জীবন্ত মরণ! মানুষ

কেন বাঁচে, কীভাবে বাঁচে-প্রশ্নের সমাধা

আজ তর্কপ্রিয় সন্ধানে, মূর্ত প্রার্থনা।

সকল প্রিয়জন পরিত্যাগে, নিগূঢ় যত্নে হৃদয়ে প্রবেশ করে

নিজের অপরিচিত চেহারা, সব জিজ্ঞাসার

অন্ত-ক্রিয়ার এক উচ্চতম বিলাস।

জীবনের মানে অর্থশুন্য ভবিতব্য! এ কী হয়?

চোখের পলকে নিষ্পাপ দৃশ্যলোক-পেছন ডাকে বারবার

যেখানে থাকে আবার দেখার ইচ্ছা, নামে যে মুক্তকরণ। মিলনকান্তির আবাস।

চতুর্মুখ সমীকরণে খেলে যায় সময়ের ঝাঁজালো সিদ্ধান্ত। কেউ কী অপ্রিয় হয় কারও?

যেখানে ভেসে ওঠে নীলপদ্ম, অতীতের নিটোল কিতাব। সে-তো মানুষের ছবি!

চলে আসুন সবজি বাজারে

মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি অনেক কিছু

যা মানুষের নয়। অ-মানুষের জন্ম-উত্তর বাঁচার

উপায় হতে পারে। পোশাকে সজ্জিত দেহ কতভাবে

হিংস্র হয়, গোপনে, অন্ধের গহনে।

প্রবেশের আগেই পেয়েছি সংকেত। কত নোংরা, পচা, আবর্জনায় ভরা একটি থালার মতো

পড়ে আছে সম্মুখে। কেউ কি দেখেছে?

হয়তো মেনে নিয়েছে সবাই, সবার আগে সে

যে ভেবেছে, কী বা আছে উপায়!

চারপাশে কত কিছুর ঘ্রাণ, চোখ যা বলে তা কি মেনে নেয় স্বাস্থ্যবার্তা

ফুটে আছে ফুলের মতো দোকানের পসরা। খেতে বা কেনায় বারণ বালাই নেই।

যা পাচ্ছে নিচ্ছে, অনেকে। কেউ গায়ে কেউ পেটে।

আহা! দেখার কেউ নেই!

এক অন্ধকারে হাঁটছে আমাদের পা।

কেউ কি আছে কোথাও, আলো নিয়ে হাতে? ভেবেছে কি কেউ

কেন আমাদের আয়োজনে সবাই নেই?

কেউ এসে শুধু একবার বলুক, এই নিন-আপনাদের জীবন টিকিট যা উত্তরণ।

চলে আসুন সবজির বাজারে, সবুজের খোঁজে।

ইতিহাস

আজ স্পষ্ট ঘোষণা, আমার চোখের সামনে কেউ নেই

নেই কেউ ভাবের অন্তিম ঘরে। এক অস্পৃশ্য অনুভব

ছুঁয়ে চলে, ভাসিয়ে দেয় অগণিত স্রোতের তুমুল আলিঙ্গনে।

আজ কিছু ভেবে বলছি না, সরাসরি জবাব---

আমি নই কারও!

সব বাতাসের সাথে মিশে থাকা চোখের প্রেম

ভাবনার বিলাসে জড়িয়ে পড়ার বাসনা----সকলের অগোচরে

অথবা সকলের মাঝে। জীবনের অর্থে হৃদয়ের গুড়গুড় আলাপ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হৃদয়ে খোলা আকাশ, শুধু

এক মুখচ্ছবি।

আজ কোনো ক্ষমা নেই---নিজের প্রতি! নিজের পাপে

হাঁটি আমি, সবার মাঝে একলা হয়ে। বেদনার

কালো রং নিয়ে। শুধু দেখে যাই, শুধু দেখতে যাই।

কত রং বিরাজ করে ভাবনার গরমিলে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রই।

দাঁড়িয়ে থেকেও হেঁটে যাই!

আজকের না বলা কথা, কোনো দিন বলা হবে না

হবে না দাঁড়িয়ে আবার ভাবা আর একটু বসলে

ভালো হতো। যে বসিয়ে রাখে যে আশায় বসে থাকে

সবকিছুর-ই সময় থাকে---

এরপর---ইতিহাস!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিদায় নেওয়া হুমায়ূন এখনো আছেন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্যানসার আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। হঠাৎ চিকিৎসকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলেন নুহাশপল্লীতে। নাটক বানাবেন। অভিনেতা ফারুক আহমেদকে ডাকলেন। নুহাশপল্লীতে নাটকের শুটিংয়ের ফাঁকে গল্প করছিলেন হুমায়ূন ও ফারুক। হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘কী আশ্চর্য, তাই না ফারুক!’ জবাবে ফারুক বললেন, ‘কী আশ্চর্য ভাই?’ হুমায়ূন আহমেদ বললেন, ‘এই যে প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী— কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা; আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায় রে জীবন!’

‘আমার না বলা কথা’ বইয়ে ফারুক আহমেদ এই স্মৃতিচারণ করেছেন। লিখেছেন, ‘আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। একসময় তাকিয়ে দেখলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের দুচোখের কোনায় পানি।’

হুমায়ূন আহমেদ নেই। তবে তিনি রয়েছেন দেশের তরুণদের মনে। যে বইমেলায় তিনি থাকবেন না বলে আক্ষেপ, সেই বইমেলায় তাঁর বইয়ের স্টলে তরুণদের ঢলের মধ্যে আছেন।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে হুমায়ূন আহমেদের জন্ম এই দিনে (১৩ নভেম্বর); ভারত ভাগের এক বছর পরে ১৯৪৮ সালে। ছোট সময়ে তাঁর নাম ছিল শামসুর রহমান। তাঁর বাবা ছেলেমেয়েদের নাম পাল্টে ফেলতেন। তাঁর নাম পাল্টে রাখেন হুমায়ূন আহমেদ। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের স্রষ্টা তিনি। শুধু কথাসাহিত্যেই নয়; ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’, ‘কোথাও কেউ নেই’,

‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটক বানিয়েছেন, তৈরি করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’র মতো চলচ্চিত্র।

হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি, জোছনা ভালোবাসতেন। তাঁর লেখায় সেসব উঠে এসেছে বারবার। ২০১২ সালের জুলাইয়ে বর্ষাতেই তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন ওপারে।

তিনি নেই। কিন্তু তাঁর লেখায় উঠে আসা চান্নিপসর, বৃষ্টি বিলাস আজও আছে তরুণদের মনে। ফারুক আহমেদ তাঁর ওই বইয়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতিচারণ করেছিলেন এভাবে—‘এক বিকেলে শুটিং শেষে তাঁর প্রিয় লিচুগাছের দিকে তাকিয়ে আছেন হুমায়ূন। সেখানে ঝুলছে পাকা লিচু। তিনি তাঁর কেয়ারটেকার মুশাররফকে ডেকে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এলেন। তাদের বললেন, গাছে উঠে যে যত পারে লিচু খেতে। বাচ্চারা কেউ গাছে উঠে লিচু খাচ্ছে, হইচই করছে। কেউ পকেটে ভরছে। হুমায়ূন আহমেদ অবাক হয়ে সেই লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন।’

ফারুক আহমেদ লিখেছেন, ‘হুমায়ূন ভাই একসময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালো লাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়? আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালো লাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না।’

হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ঘিরে রাজধানীসহ জন্মস্থান নেত্রকোনাতে রয়েছে নানা আয়োজন। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার রোয়াইলবাড়ি ইউনিয়নের কুতুবপুরে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে এসব কর্মসূচি পালন করা হবে। সকালে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোরআন খতম করবেন। এরপর শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ প্রাঙ্গণ থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী এবং হুমায়ূনভক্তদের আনন্দ শোভাযাত্রা বের হবে। পরে লেখকের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, জন্মদিনের কেক কাটা, বৃক্ষরোপণ, কুইজ, হুমায়ূন আহমেদের রচিত নাটক ও সিনেমার অংশবিশেষ নিয়ে অভিনয়, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাজধানীতে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র নিয়ে চলচ্চিত্র সপ্তাহ, হুমায়ূন প্রতিযোগিতা, হুমায়ূন জন্মোৎসব, টেলিভিশন চ্যানেলে নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারসহ নানা আয়োজনে মুখর থাকছে দিনটি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘হীরক রাজার দেশে’ মঞ্চস্থ করল স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করেছে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। গতকাল শুক্রবার স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার নাটক, সংগীত ও নৃত্যকলা ক্লাবের উদ্যোগে দুই দিনব্যাপী বার্ষিক নাট্যানুষ্ঠানে এটি মঞ্চস্থ করা হয়।

মঞ্চনাট্যটি স্কলাস্টিকার প্রতিষ্ঠাতা ইয়াসমিন মুরশেদকে উৎসর্গ করা হয়।

গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গতকাল শুক্রবার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্র মঞ্চস্থ করে স্কলাস্টিকার শিক্ষার্থীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

স্কুলের এসটিএম মিলনায়তন প্রতিষ্ঠার রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনকে সামনে রেখে আয়োজিত এ নাট্যানুষ্ঠানের সমাপনী দিনে বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াত, দিলারা জামান ও আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কলাস্টিকা উত্তরা সিনিয়র শাখার অধ্যক্ষ ফারাহ্ সোফিয়া আহমেদ।

হীরক রাজার দেশে নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন কাজী তৌফিকুল ইসলাম ইমন। প্রোডাকশন ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন শৈলী পারমিতা নীলপদ্ম। সংগীত পরিচালনা করেন গাজী মুন্নোফ, ইলিয়াস খান ও পলাশ নাথ লোচন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও ফরহাদ আহমেদ শামিম।

নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন নাজিফা ওয়াযিহা আহমেদ, আরিয়াদ রহমান, আজিয়াদ রহমান, বাজনীন রহমান, মোহম্মদ সফির চৌধুরী, ফাহিম আহম্মেদ, সৈয়দ কাফশাত তাইয়ুশ হামদ ও তাজরীবা নওফাত প্রমুখ।

শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকেরা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পরিবেশিত অভিনয়, গান ও নাচ উপভোগ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গবেষণায় বেরিয়ে এল আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’র গল্প

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় উপস্থাপিত আরবি সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক এক গবেষণা ইতিহাসের বহুল প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এত দিন মনে করা হতো, আব্বাসীয় আমলের (৭৫০-১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) পর আরবি সাহিত্য প্রায় ৮০০ বছর বছর স্থবির হয়ে ছিল। কিন্তু ভাষাবিদ ও সাহিত্য ইতিহাসবিদদের মতে, এই ধারণা আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে তৈরি এক ‘ঔপনিবেশিক কল্পনা’ মাত্র। বাস্তবে আরবি সাহিত্য কখনোই থেমে যায়নি।

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, অষ্টম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে বিজ্ঞান, দর্শন ও কবিতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বাগদাদ। আবু নুয়াস, আল-মুতানাব্বি, আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো কবি ও দার্শনিকদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এক স্বর্ণযুগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় গবেষকেরা—যেমন ফরাসি চিন্তাবিদ আর্নেস্ট রেনাঁ ও ডাচ ইতিহাসবিদ রেইনহার্ট দোজি সেই আমলটিকেই আরবি বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের শিখর বলে স্বীকার করেছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, একাদশ শতাব্দীর পর এই ধারাবাহিকতার পতন ঘটে। তাঁদের মতে, এরপর প্রায় ৮০০ বছর আরবে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক বা দার্শনিক কাজ হয়নি—যতক্ষণ না ইউরোপে রেনেসাঁ শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা বলছেন, এই ধারণা সরলীকৃত ও পক্ষপাতদুষ্ট। ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলায় শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ডের আয়োজিত এক আলোচনায় ভাষাবিদেরা দাবি করেছেন, আরবি রচনা শৈলী কখনো বিলুপ্ত হয়নি; বরং তা ধারাবাহিকভাবে কপি, অনুবাদ ও পাঠের মাধ্যমে বেঁচে ছিল।

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলার তাঁর ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, আরবি সাহিত্যে ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে যে ধারণাটি প্রচলিত আছে তা আসলে গাল-গল্প। এই বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। গ্রুন্ডলার এতে দেখিয়েছেন, নবম শতাব্দীর বাগদাদে বইয়ের ব্যবসা, কপিকারদের প্রতিযোগিতা, জনসম্মুখে পাঠ ও লেখার প্রচলন—সবই ছিল আধুনিক প্রকাশনা সংস্কৃতির পূর্বসূরি। তিনি মত দিয়েছেন, ‘বাগদাদের রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতেন লোকেরা হস্তলিপি বিক্রি করছে, বিরামচিহ্ন নিয়ে তর্ক করছে—এ যেন এক জীবন্ত প্রকাশনা বাজার।’

গবেষণা বলছে, আরবি সাহিত্য আসলে কখনো এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এর কেন্দ্র এক সময় বাগদাদ থেকে কায়রো, দামেস্ক ও আন্দালুসিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু ধারাটি অব্যাহতই থাকে। নতুন ঘরানা তৈরি হয়, পুরোনো ঘরানা রূপান্তরিত হয়।

ফরাসি অধ্যাপক হাকান ওজকান তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘জাজাল’ নামের কথ্য ছন্দভিত্তিক কবিতার ধারা আব্বাসীয় যুগের পরও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর মতে, ‘এই কবিরা নিয়ম ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছে—তাঁদের ছন্দ ও ব্যঙ্গ আধুনিক র্যাপের মতো প্রাণবন্ত।’

জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল
জার্মান গবেষক বেয়াট্রিস গ্রুন্ডলারের ‘দ্য রাইজ অব দ্য অ্যারাবিক বুক’ বইটি এবারের শেখ জায়েদ পুরস্কারের শর্টলিস্টে রয়েছে। ছবি: দ্য ন্যাশনাল

এদিকে এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সোমবার (২০ অক্টোবর) আমিরাতভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ন্যাশনাল জানিয়েছে, আবুধাবির নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ‘আরবি সাহিত্য লাইব্রেরি’ প্রকল্প ইতিমধ্যেই ‘হারানো শতাব্দী’ বলে বিবেচিত সময়ের ৬০ টিরও বেশি আরবি সাহিত্যকর্ম পুনরুদ্ধার করেছে। প্রকল্পটির সম্পাদক অধ্যাপক মরিস পোমেরান্টজ বলেছেন, ‘এই বইগুলো সম্পাদনা করা মানে এক চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া—যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেখক, অনুবাদক ও সমালোচকেরা একে অপরকে উত্তর দিয়ে গেছেন।’

মরিস মনে করেন, আরবি সাহিত্য স্থবির হয়ে যাওয়ার ধারণাটি মূলত অনুবাদের অভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো লেখা অনুবাদ করা হয় না, তখন সেটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব হারায়।’

মরিসের মতে, এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই সাহিত্যকে আবার জনসাধারণের কল্পনায় ফিরিয়ে আনা—স্কুলে পড়ানো, মঞ্চে উপস্থাপন করা, অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া। তা না হলে আরবি সাহিত্যের ‘হারানো শতাব্দী’ হিসেবে চিহ্নিত সময়টি অধরাই থেকে যাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত