Ajker Patrika

বহু কোম্পানি চীন থেকে সরলেও ভারতে আসছে সামান্যই, এই অনাগ্রহ কেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৫: ২৪
ভারতের চেন্নাইয়ের কাছে অবস্থিত ফক্সকনের একটি কারখানা। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের চেন্নাইয়ের কাছে অবস্থিত ফক্সকনের একটি কারখানা। ছবি: সংগৃহীত

বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো যখন তাদের উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থা চীন থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করে, ভারত তখন নিজেদের ‘বিশ্বের কারখানা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তটি এখনো আসেনি। অর্থাৎ, ভারত ‘বিশ্বের কারখানা’ হয়ে উঠতে পারেনি।

এক দশক আগে যেসব কোম্পানি তাদের উৎপাদন ঘাঁটি অন্যত্র সরাতে চাইছিল তখন ভারত নিজেকে প্রধান গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরেছিল। বিশ্লেষকেরা ভারতের এই কৌশলকে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা এখনো কার্যকর হয়নি এবং ভারত এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। ভিয়েতনামের মতো ছোট দেশগুলো বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি সফল।

দুই ডজনেরও বেশি ব্যবসায়িক নির্বাহী, সরকারি কর্মকর্তা এবং কূটনীতিকদের সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, আমদানি নীতিতে কড়াকড়ি এবং নিয়মকানুনের অনিশ্চয়তা বিশ্বব্যাপী কোম্পানিগুলোকে ভারতে পূর্ণাঙ্গ বিনিয়োগে বাধা দিয়েছে।

ভারতের এক সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে, কিন্তু সত্যিটা হলো, আমরা ভিয়েতনাম নই।’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচারণার জমকালো বার্তার আড়ালে আছে এক জটিল বাস্তবতা। এর মধ্যে রয়েছে হাতছাড়া হওয়া চুক্তি, আটকে থাকা বিনিয়োগ এবং কোম্পানিগুলোর চুপিসারে অন্য দেশে চলে যাওয়ার ঘটনা।

তাইওয়ানের কয়েকটি সেমিকন্ডাক্টর ফার্ম ভারত পরিদর্শন করলেও শেষ পর্যন্ত তারা বিনিয়োগ নিয়ে আসেনি। স্যামসাং ২০১৮ সালে বলেছিল, তাদের সবচেয়ে বড় কারখানা ভারতেই হবে। কিন্তু সেই ঘোষণার পরও কোম্পানিটি ভিয়েতনামে আরও বেশি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি ভারতের সবচেয়ে বড় সাফল্যের গল্প অ্যাপল হলেও কোম্পানিটিও চীন থেকে সরে এসে ভারতে যাওয়ার পথে বাধার সম্মুখীন হয়েছে।

ভারতীয় বাজার বিশ্লেষক ফয়সাল কাওসা বলেন, ‘আমরা মনে করি, আমাদের একটি বড় বাজার আছে এবং আমরা মনে করি, এই ব্র্যান্ডগুলো আমাদের প্রাপ্য। কিন্তু সবাই প্রতিযোগিতা করছে এবং ভিয়েতনাম অতিরিক্ত চেষ্টা করছে।’

উৎপাদনকারীরা যখন চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে, তখন দুই টেক জায়ান্ট দুই ভিন্ন পথে এগিয়ে যায়। দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং ১৯৯০-এর দশকে ভারতে টেলিভিশন তৈরি শুরু করলেও তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ নিয়ে ভারতে আসেনি। কোম্পানিটি তাদের পরবর্তী সম্প্রসারণের জন্য ভিয়েতনামে মনোযোগ দেয়। অন্যদিকে, অ্যাপল ভারতের দিকে মনোযোগ দেয়।

বর্তমানে স্যামসাংয়ের বেশির ভাগ স্মার্টফোন ভিয়েতনামে উৎপাদিত হয়। সেখানে কোম্পানিটির ৬টি কারখানায় প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে তারা চীনে তাদের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে, অ্যাপল এখনো তাদের বেশির ভাগ ডিভাইস চীনে তৈরি করে। অ্যাপলের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ভারতে মাত্র ১৫ শতাংশ উৎপাদন হয়, যা ২০২৪ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশের লক্ষ্যের চেয়ে অনেক কম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘অ্যাপলের জগতে ১৫ শতাংশ পরিবর্তন খুব বেশি নয়। এই গতি তাদের পছন্দ নয়।’ অ্যাপল ও স্যামসাং এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। অ্যাপলের ঘনিষ্ঠ ওই ব্যক্তি জানান, যন্ত্রাংশ আমদানিতে বিধিনিষেধ, বিশেষ করে চীন থেকে এবং উৎপাদনের মানের কারণে কোম্পানির বৈশ্বিক উৎপাদন ব্যবস্থাপনার মধ্যে ‘বিরোধ ও হতাশা’ তৈরি হয়েছে। শ্রমিক ধর্মঘটও একটি বড় ‘বাস্তবতা পরীক্ষা’ হিসেবে কাজ করেছে।

ওই ব্যক্তি ২০২১ সালের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ‘অ্যাপল এ ধরনের মনোযোগ পছন্দ করে না।’ সে সময় ফক্সকন পরিচালিত তামিলনাড়ুতে অবস্থিত একটি আইফোন অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে খাদ্যে বিষক্রিয়ার খবরের পর ২ হাজার নারী শ্রমিক মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন। ফক্সকন এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

স্যামসাংয়ের তামিলনাড়ু কারখানায় গত বছর সেপ্টেম্বরের পর থেকে অন্তত তিনটি শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছে। সেখানে তারা গৃহস্থালি সামগ্রী তৈরি করে। অন্যদিকে, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ভিয়েতনামে শ্রমিক অসন্তোষ তুলনামূলকভাবে বিরল।

একটি আন্তর্জাতিক বাজারের এক পরিচালক বলেন, ‘ভিয়েতনামে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণ এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে, যা ব্যবসার জন্য আরও বেশি নিশ্চয়তা প্রদান করে।’ ওই পরিচালক আরও বলেন, ভারতের বিশাল গণতন্ত্র এবং বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা ‘অসংগতি’ তৈরি করে। তিনি আরও ‘এটা ব্যবসার জন্য যা প্রয়োজন তার ঠিক বিপরীত।’

=বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কোম্পানিগুলোর জন্য এটি একটি স্বাভাবিক পরবর্তী গন্তব্য। এর বিপরীতে, ভারত ২০২০ সালে সীমান্ত সংঘাতের পর চীনা বিনিয়োগে তীব্র কড়াকড়ি আরোপ করেছে। ভিয়েতনামের ইলেকট্রনিকস শিল্পের বাজার এখন ১২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের, যা ভারতের চেয়ে তিনগুণ বেশি। ভারতের জনসংখ্যা এবং আয়তন ভিয়েতনামের চেয়ে যথাক্রমে ১৪ এবং ১০ গুণ বেশি।

বাণিজ্যের পরিসংখ্যানও এই বৈষম্য তুলে ধরে। ভিয়েতনাম এখন আমেরিকার ষষ্ঠ বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, দেশটি ২০১৪ সালে ১৫তম স্থানে ছিল। ভারত এখনো ১০ম স্থানেই আটকে আছে। গোল্ডম্যান স্যাচের চলতি বছরের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের রপ্তানি উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে সর্বনিম্ন।

ভারতের অর্থনৈতিক গতি মন্থর হওয়ায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। দেশটিতে তীব্র কর্মসংস্থান সংকট চলছে। প্রতি বছর কর্মজীবনে প্রবেশ করা ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য পর্যাপ্ত চাকরি তৈরি করতে পারছে না ভারত। শ্রমঘন শিল্প যা ভারতের বিকাশের জন্য জরুরি, সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ পিছিয়ে থাকাটা এই সমস্যার মূল কারণ।

এমনকি ভারতের কিছু সরকারি মূল্যায়নও এই বাস্তবতা স্বীকার করেছে। ডিসেম্বরে প্রকাশিত রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চায়না প্লাস ওয়ান কৌশল বাস্তবায়নে ভারত এখনো সীমিত সাফল্য পেয়েছে।’ এতে বলা হয়েছে, কম শ্রম ব্যয়, সহজ নিয়মকানুন এবং অনুকূল করনীতির কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। ভারতের প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব এস কৃষ্ণান বলেন, ‘সরকার অবগত আছে যে আমরা একমাত্র গন্তব্য নই।’

২০২৩ সালের এক সংসদীয় প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, ভারত ‘চীন থেকে সরে আসা ব্যবসাগুলোর মধ্যে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারেনি।’ ভারতের অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান অরবিন্দ পানাগারিয়া ডিসেম্বরে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমাদের অসুবিধা মূলত নীতিগত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জমিকে অবিশ্বাস্যভাবে ব্যয়বহুল করে তুলেছি এবং শ্রমিক নিয়োগ অত্যন্ত কঠিন করে দিয়েছি।’

ভারত সরকার বারবার তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলোকে গুজরাটে কারখানা স্থাপনের জন্য অনুরোধ করেছে। গুজরাট হলো মোদির নিজের রাজ্য। কিন্তু বেশির ভাগ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানেন এমন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘শুল্কের কারণে ভারত আরও তাইওয়ানের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ অনেক কোম্পানি মহামারির সময় সমীক্ষার জন্য ভারতে এসেছিল এবং লাভজনক নয় বলে আর ফিরে আসেনি।

ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পাওয়ারচিপ সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং করপোরেশন (পিএসএমসি) ঝুঁকি মূল্যায়নের পর ভারতের টাটা গ্রুপের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। এর পরিবর্তে তারা ভারতীয় কোম্পানিটিকে তাদের প্রযুক্তি বিক্রি করতে এবং কারখানা নির্মাণে সহায়তা করতে রাজি হয়েছে। ২০২৩ সালে ফক্সকন এবং ভারতীয় কোম্পানি বেদান্তের মধ্যে ১ হাজার ৯৫০ কোটি ডলারের একটি সেমিকন্ডাক্টর অংশীদারত্ব ভেঙে যায়।

বৈশ্বিক বাজারের এক পরিচালক বলেছেন, কোম্পানিগুলো ভারতের বাজার দেখে ‘আশাবাদী’ হয়, কিন্তু তারপর ভারতে ব্যবসা করার ‘প্রয়োজনীয় খরচ’ হিসাব করতে শুরু করে। এই দ্বিধা শুধু সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নয়। জাপানের চেম্বার অব কমার্স ইন ইন্ডিয়ার সেক্রেটারি জেনারেল কেনজি সুগিনো বলেন, ভারতের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া ১০টি জাপানি কোম্পানির মধ্যে মাত্র একটি শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ করে। তিনি আরও জানান, চীন থেকে ভারতে তাদের কার্যক্রম সরিয়ে নিতে পেরেছে, এমন জাপানি কোম্পানির সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ১০টি।

যারা ভারতে আসেও, তাদের প্রায়ই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। জাপানি গাড়ি কোম্পানিগুলো ফ্রিকশন-ফ্রি টায়ারের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্ক নিয়ে অভিযোগ করেছে। নিয়মকানুন সংক্রান্ত সমস্যার কারণে ভারতীয় কাস্টমস নিপ্পন স্টিলের গুরুত্বপূর্ণ চালান কয়েক মাস আটকে রাখলে কোম্পানিটি বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে।

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পেছনে ইতিহাসের অনেক সতর্কবার্তা রয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ভারতের এক নির্বাহী জানান, ২০১৩ সালে ওষুধ কোম্পানি ডাইচি স্যাঙ্কিও ভারত থেকে ব্যয়বহুলভাবে বেরিয়ে যায়। তারা যে ভারতীয় কোম্পানিটিকে অধিগ্রহণ করেছিল, সেটির বিরুদ্ধে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ ডেটা জালিয়াতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ পণ্য রপ্তানির অভিযোগ এনেছিল।

অন্যদিকে, জেনারেল মোটরস তাদের ভারতীয় কারখানা বিক্রির চেষ্টা করেছে অন্তত চার বছর ধরে। ২০২০ সালে এই কারখানা শুরু হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় বাধা ছিল নতুন ক্রেতাকে তাদের কর্মীদের ধরে রাখার নিয়ম। এই ঘটনা সম্পর্কে পরিচিত এক ব্যক্তি এ কথা জানিয়েছেন।

ভারত সরকার বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য নতুন প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবছে। এর মধ্যে যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য ভর্তুকি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তারা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তিও করতে চাইছে, যা ভারতের শুল্ক কমাতে এবং দেশটিকে উৎপাদনের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।

মোদি চলতি মাসে বলেছেন, ‘বিশ্বের একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার প্রয়োজন, যারা উচ্চমানের পণ্য তৈরি করতে পারে এবং যার সরবরাহব্যবস্থা নির্ভরযোগ্য। আমি চাই আমরা বিশ্বের প্রত্যাশা পূরণ করি।’

ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

ফরিদপুরে জেমসের কনসার্ট পণ্ড, কী ঘটেছিল সেখানে

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে—শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

ফরিদপুরে জেমসের কনসার্ট পণ্ড, কী ঘটেছিল সেখানে

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে—শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

ফরিদপুরে জেমসের কনসার্ট পণ্ড, কী ঘটেছিল সেখানে

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে—শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

ফরিদপুরে জেমসের কনসার্ট পণ্ড, কী ঘটেছিল সেখানে

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে—শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

তারেক রহমানের পঙ্গু হাসপাতালে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল

ফরিদপুরে জেমসের কনসার্ট পণ্ড, কী ঘটেছিল সেখানে

আজকের রাশিফল: ভুঁড়িটা বাড়ছে—শরীরের দিকে নজর দিন, প্রাক্তনের মেসেজে রিপ্লাই দিলে বিপদ

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত